#আশিয়ানা শারমিন আক্তার বর্ষা (৩)

0
272

#আশিয়ানা
শারমিন আক্তার বর্ষা
(৩)
একদিন হলো ‘লাভ ইয়োর সেলফ’ গানটি রিলিজ হয়েছে। এরইমধ্যে গানটি টপ সং চার্টের শীর্ষে উঠে আসছে৷ ভক্তদের মধ্যে উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে। শুধু ইতালি নয়, লাভ ইয়োর সেলফ গানটি 8৫টি দেশের শীর্ষে রয়েছে। একজন মানুষের সবসময় নিজেকে ভালোবাসতে হবে, গানটিতে নিজেকে ভালোবাসার কথা বলেছেন সেহরিশ।
অমাবস্যা রাত। চারিদিকে নীরবতা। সেহরিশ ব্যস্ত হাতে কাউকে কল দিল। ফোনের ওপাশ থেকে কেউ স্থির কণ্ঠে শুধল,’এত রাতে ফোন?’
সেহরিশ ছোট্ট করে জবাব দিল,’তোর বাসার উল্টোদিকের রাস্তায় চলে আয়। তূর্ণকে বলার দরকার নেই।’
সাদাফ এলো। সেহরিশ কিছু বলার আগেই সাদাফ জিজ্ঞেস করল, ‘ আপসেট?’
‘উহুহ।’
‘তাহলে হঠাৎ এভাবে ডাকলি যে? আর তূর্ণকে বলতে বারণ করলি কেন?’
সেহরিশ সাদাফের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘ভালো লাগছে না।’
সেহরিশের বলিষ্ঠ শরীরে কালো টি-শার্টটা আষ্টেপৃষ্ঠে ল্যাপ্টে আছে। চুলগুলো এলোমেলো এবং কপালে ছড়িয়ে আছে। সেহরিশ গাড়ির বাম্পারে বসে ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
সাদাফ বলল,
‘আমাকে বল, কি হয়েছে?’
কংক্রিটের রাস্তার দিকে চোখ স্থির রেখে সেহরিশ বলল,
‘গাড়ির সামনের সিটে বিয়ার আছে।’
গাড়ি থেকে বিয়ারের বোতল আনতে সাদাফের বেশি সময় লাগেনি। সেহরিশ চাঁদের দিকে তাকাল। সাদাফ জিজ্ঞেস করল, ‘খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?’
সেহরিশ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ।’
সাদাফ এগিয়ে গিয়ে সেহরিশের কাঁধে হাত রাখল। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘এইসব ভাবা ছাড়! আমাদের নতুন গানটি হিট হয়েছে। এই খুশিতে আরও এক বোতল চলবে?’
‘আগামীকাল আমেরিকা যাব। আজ বেশি খাওয়া শরীরের জন্য ঠিক হবে না।’ বলল সেহরিশ।

২৪ই ফেব্রুয়ারী।
ফেয়ারমন্ট সেঞ্চুরি প্লাজা হোটেলটি ধুমধাম করে অনুষ্ঠান শুরু করে। একজন মহিলা উপস্থাপক নিখুঁতভাবে উপস্থাপনা শুরু করেছিলেন। মহিলা উপস্থাপক খুব সুন্দর। তিনি যে কোনও পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। হাস্যোজ্জ্বল মহিলা মাইক্রোফোন ধরে একের পর এক কথা বলছেন। তূর্ণ তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। সাদাফ খানিকটা নার্ভাস বোধ করছে। ডান হাতে চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলল। সেহরিশ ঠোঁট কামড়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। মহা আনন্দে পুরস্কার গ্রহণকারী দল ঘোষণা করতে যাচ্ছেন উপস্থাপক। সাদাফের পা কাঁপছে উত্তেজনায়। মহিলা উপস্থাপক অষ্টভুজে হাসলেন এবং ইংরেজিতে চিৎকার করলেন, ‘এ বছর, আর্টিস্ট অফ দ্য ইয়ার 2017 পুরস্কার পেয়েছেন বিশ্ব বিখ্যাত সঙ্গীত তারকা এম-বি।’
সাদাফ সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং একটা মোহনীয় হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে তূর্ণকে বুকে জড়িয়ে ধরে। তূর্ণ উন্মাদনায় স্টেজের দিকে আগে আগে চলে গেল। পুরস্কার গ্রহণের সময় সেহরিশ বলল, ‘আমাদের ফ্যানডম এম-বি দীর্ঘ বারো বছর ধরে আমাদের সমর্থন করছে। তোমাদেরকে ছাড়া আমরা কিছুই না। আমরা তোমাদের অনেক ভালোবাসি।’

সেহরিশ মাইকে কথা বলার সময় মহিলা উপস্থাপককে লক্ষ্য করে, তাকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছে তিনি। সেহরিশ কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বক্তব্য শেষ করল। সেহরিশ মহিলাদের দিকে তাকাতে বা তাদের চারপাশে থাকাতেও বিরক্ত হয়। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। সেহরিশ তার বিরক্তিটুকু না দেখিয়ে দ্রুত তার স্থান পরিবর্তন করল। মহিলাকে লক্ষ্য করে সাদাফ সেহরিশের দিকে তাকাল। সেহরিশ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

সকাল সাতটা বাজে। ইতালি ফেরার সকালের ফ্লাইট। আমেরিকার এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে ঢুকে তূর্ণ জড়ানো গলায় বলল, সে এই দেশে আরো কিছুদিন থাকতে চায়। সেহরিশ তার কথায় মন দিল না। হাত ধরে অভিবাসন দিয়ে প্রবেশ করে। সাদাফ তূর্ণর কাঁধে হাত রাখল। তারপর বলল, ‘মন খারাপ করিস না। সেহরিশ তোকে একা রেখে যাবে না। আরেকবার এসে তোর ইচ্ছামত সময় কাটিয়ে নিস। এখন আমাদের সাথে ফিরে চল।’


মার্চ মাসের এক তারিখ। দুদিন ধরে মায়ের জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছে। মায়ের টানে এবার দেশে যেতেই হবে। সেহরিশ তূর্ণকে নিয়ে সাদাফের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিল। চোখে চশমা, বাঁ হাতে ঘড়ি, মাঝের আঙুলে নীল পাথরের আংটি আর দুই আঙুল দিয়ে বই ধরে বারান্দায় বসে আছে সাদাফ। অবসর সময়ে ইংলিশ বই পড়ে সে। সহসা কলিংবেলের আওয়াজ শুনে সে ওদিকে তাকাল। হঠাৎ কে এলো?

সাদাফের বডিগার্ড জসনুর দরজা খুলে দিল। সেহরিশকে দেখে জসনূর ভয় পেয়ে দরজা থেকে সরে গেল, কাঁপতে লাগল। সেহরিশের পেছন থেকে মাথা গলিয়ে একগাল হাসি দিয়ে বলল তূর্ণ, ‘ভয় পেও না। আমিও আছি।’
জসনুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘স্যার বারান্দায় আছেন।’
পায়ের আওয়াজ শুনে সাদাফ সোজা হয়ে বসল। সাদাফ ওঁর চোখ থেকে চশমাটা সরিয়ে টেবিলের উপরে রাখল ততক্ষণে সেহরিশ এগিয়ে গেল। সেহরিশ ওঁর সামনে বসল। সে তার ডান হাত ও বাম হাত নাড়াতে লাগল। তারপর গম্ভীর ও শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি দুই দিনের মধ্যে বাড়ি যেতে চাই।’ কিছুক্ষণ থেমে দম নিল এরপর আবার বলল, ‘দুদিন ধরে আমি শুধু অস্থির বোধ করছি। বারবার মনে হয় মায়ের কাছে ফিরে যাই।’ একথা বলে সাদাফের দিকে তাকাল সেহরিশ। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘বাংলাদেশে যাওয়ার খবর মিডিয়ায় ফাঁস করার দরকার নেই। আমি চুপচাপ যাব এবং ফিরে আসব। মানুষ আমাদের চিনতে পারলে বিমানবন্দরে ভিড় ও উল্লাস হবে। এতে আরও ঝামেলা হবে।’
তূর্ণ সোফায় বসে দুই হাত তুলে বলল,
‘এখন দেশে যাওয়ার পর আর বাড়ি যাব না। আমি আমার ফ্ল্যাটে থাকব। বাড়ির সামনে মানুষের ভিড় থাকে আমি বাইরে যেতে পারি না।’
সাদাফের ভ্রু কুঁচকে শিথিল হলো সেহরিশকে বলল,
‘তুই কি নিশ্চিত? সত্যিই দেশে যাবি?’
সেহরিশ ঠোঁট চেপে বিরক্ত গলায় জবাব দিল,
‘এখন কী লিখে দিবো?’

দুই দিন পর। মাস্ক, ক্যাপ ও চশমা পরা তিন ব্যক্তি বাংলাদেশ বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে। লাগেজ নিয়ে পেছনে দাঁড়াল দেহরক্ষী। কিছুক্ষণ পর চারজন এসে সেহরিশের সামনে দাঁড়াল। খুব বিনীত কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, আসুন। গাড়িটা ওখানে পার্ক করা আছে।’

সেহরিশ গাড়িতে উঠে চলে গেল। সাদাফ একটা করুণ দৃষ্টি ছুড়ে দিল তূর্ণর দিকে। তূর্ণ সশব্দে হেসে উঠল। তারপর বলল, ‘কষ্ট পাসনে ভাই। একা মানুষ গ্রামে গিয়ে কী করবি? আমার সাথেই চল।’

সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। এখুনি রাতের খাবার তৈরি করছেন ফারিয়া বেগম, কাজে সহযোগিতা করছেন বড় ছেলের স্ত্রী মায়মুনা। মায়মুনার নয় বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। যেমন মিষ্টি তেমনি কৌতুকপূর্ণ এবং দুষ্টু। সন্ধ্যার পর আরুশি ভাগ্নী মারিয়াকে বই নিয়ে পড়ায়। মারিয়া আজ পড়াশুনা করতে চায় না সে আরুশির বইয়ের একটি পাতা ছিঁড়ে ফেলল। আরুশি সাথে সাথে মারিয়ার হাত ধরে মায়মুনার কাছে রান্নাঘরে চলে আসলো। রুক্ষ গলায় বলল, ‘ভাবী তার বিচার করো।’
মায়মুনা ব্যস্ত হাতে আরুশি আর মারিয়ার দিকে তাকাল। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘সে আবার কী করল?’
‘ভাবী আমার বই ছিঁড়ে ফেলছেন।’ বলল আরুশি।
ফারিয়া ধমক দিয়ে বললেন,
‘ছোট মানুষ ভুল করে ছিঁড়ে ফেলছে। এত কান্না করার কি আছে? নতুন একটা কিনে নিস।’
আরুশি বলল, ‘মা তোমার কারণে মেয়েটা বানর হয়ে গেছে। কাউকে ভয় পায় না।’

এত বছর পর দেশে এসে এতএত বাড়ির মাঝে নিজের বাড়ি খুঁজে বের করা দুষ্কর। রাস্তার পাশে টং দোকানে বসে চা খেয়ে আড্ডা দিচ্ছে কয়েকজন। তাদের পাশেই গাড়ি থামাল চালক। জিজ্ঞেস করল, ‘ও, ভাই শুনুন। দেওয়ান চৌধুরীর বাড়ি যাব। আপনি আমাকে রাস্তাটি একটু বলতে পারবেন?’
একজন মধ্যবয়সী লোক উঠে এলো। বললেন, ‘সোজা যান তারপর রাস্তার ডান পাশে দেখতে পাবেন বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়ি। ওটা মৃত দেওয়ান চৌধুরীর বাড়ি।’
‘ ধন্যবাদ ভাই।’ বলল চালক।

কলিংবেলের আওয়াজ শোনামাত্র নীলু ওড়নার ধারে হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলে দিল। সেহরিশকে দুই চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীলু জোরে চেঁচিয়ে উঠল। নীলুর চিৎকার শুনে বসার ঘর থেকে দৌঁড়ে এলো আরুশি। শুধল, ‘নীলু আপা, এভাবে চিৎকার করছ কেন?’

আরুশি বড় বড় চোখ করে সেহরিশের মুখের দিকে তাকাল। সে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। মারিয়া আরুশির ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ভিডিও কলে সেহরিশকে অনেকবার দেখেছে। প্রায় চাচার সাথে কথা হয়েছে, প্রথম দেখাতেই তাকে চিনতে দ্বিধা হলো না। মারিয়া রান্নাঘরের দিকে দৌঁড়ে গেল। এবং বলতে লাগল, ‘দাদু চাচ্চু আসছে। মা চাচ্চু আসছে, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।’

ফারিয়ার বুক কেঁপে ওঠে। তিনি দৌঁড়ে বসার ঘরে গেল। সেহরিশ দাঁড়িয়ে আছে। ফারিয়া ভাবলো সে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে। পাশে দাঁড়ানো মায়মুনাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ‘আমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি, বউ। এক চিমটি দাও তো।’
মায়মুনা হাসল চোখে জল নিয়ে। বলল, ‘এটা স্বপ্ন নয়, মা। সত্যি তোমার ছেলে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।’

ফারিয়া পায়ে পায়ে হেঁটে সামনে এলো। মায়ের দিকে নিষ্পাপভাবে চোখ মেলে তাকাল সেহরিশ। কাঁপা হাতে সেহরিশের গাল স্পর্শ করে ফারিয়া। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন, নিচু স্বরে বললেন, ‘এত বছর পর তোমার মায়ের কথা মনে পড়ল বাবা?’
সেহরিশ যে অস্বস্তির কারণে দেশে ছুটে এসেছিল তা মায়ের কোমল স্পর্শ শুষে নিল। সেহরিশের অবচেতন মন বলল, ‘মা, দেখ, আমি আসছি।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here