#আশিয়ানা
#পর্ব_১১
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
সাদা রঙের ফতুয়া আর ঢিলেঢালা পাজামা পরে এক ভদ্রলোক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বার দুয়েক কলিংবেল চাপে। কলিংবেলের তিব্র শব্দে দরজা খুলল সাদাফ। উমাইয়ার ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে দেখে আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল সাদাফ। ভ্রুযুগল কুঁচকে শুধাল, ‘ আপনি কে?’
ভদ্রলোক সরু চোখে সাদাফের দিকে তাকাল। মৃদু গলায় প্রশ্ন করে বললেন,
‘ তুমি কে বাবা? আগে তো দেখিনি।’
সাদাফ চমৎকার ভাবে হাসল। বলল,
‘ আমার নাম সাদাফ কাসানো। আমি এই ফ্ল্যাটে নতুন। আজই উঠেছি।’
ভদ্রলোক সাদাফের দিকে চেয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
‘ সাদাফ কসাই। তুমি কসাই বংশের?’
ভদ্রলোকের কথা শোনামাত্র স্তম্ভিত হয়ে গেল সাদাফ। হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
‘ কসাই না, কাসানো চাচা।’
উমাইয়া দরজা খুলল। ফারুক হোসেনকে দেখে চমকিত কণ্ঠে বলল,
‘ বাবা। তোমার আজ ফুফুর বাসায় থাকার কথা ছিল। হঠাৎ চলে আসলে কেনো?’
ফারুক হোসেন উমাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কণ্ঠ নামিয়ে কোমল স্বরে বললেন,
‘ কাল সকালে গ্রামে ফিরে যাব। তোর বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ড কাছে তাই চলে আসছি।’
উমাইয়া চোখ সরিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের সামনে ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা সাদাফের দিকে তাকালো। বিষ্ময়ে চমকে উঠল। উমাইয়া থমথমে কণ্ঠে বলল, ‘ আপনি?’
রাত আটটা।
আকাশ ভেঙে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামল। প্রাণ ভরে শ্বাস নিল সাদাফ। বারান্দার ফটকের সাথে হেলান দিয়ে নতজানু হয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। শুকনো কাপড় বারান্দায় রেখে ভুলে গিয়েছিল উমাইয়া। জামা কাপড় নেওয়ার জন্য বারান্দায় ছুটে এলো আচমকা সাদাফকে পাশের বারান্দায় দেখে থিতু হয়ে দাঁড়ায়। চোখে চশমা। ঝাকড়া চুলের লম্বাচওড়া মানুষটাকে নির্বিকার চোখে লক্ষ্য করল সে। উমাইয়ার হাত পা কাঁপতে লাগল। হঠাৎ পাশ থেকে সাদাফ শীতল কণ্ঠে শুধাল,
‘ মিস উমাইয়া! উইল ইউ ম্যারি মি?’
উমাইয়া অবাক হলো, বিষ্ময় নিয়ে শুধাল,
‘ কি?’
সাদাফ সশরীরে ঘুরে তাকাল। কয়েক পা এগিয়ে এলো উমাইয়ার দিকে। সাদাফ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল, তীব্র কণ্ঠে বলল,
‘ আমার পৃথিবীতে কেউ নেই। আমি অনাথ। রোজ রাতে আমার ঘুমানোর জন্য মেডিসিন প্রয়োজন হয়। মেডিসিন না হলে ঘুম হয় না। আপনার সাথে পরপর কয়েক দিন দেখা করি, ইচ্ছে করেই। আপনার সঙ্গ আমার ভাল লাগে। প্রায় রাতে যখন ঘুমানোর জন্য যাই তখন আপনার মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠে। তখনই রাজ্যের ঘুম এসে আমার চোখে ভর করে। আমার প্রেম করার ইচ্ছে বা মন মানসিকতা নেই। সপ্তাহে একদিন বা মাসে একদিন আপনাকে দেখার চেয়ে আমি রোজ আপনাকে দেখতে চাই। আপনি কি এই অনাথ ছেলেটার একমাত্র আশ্রয় হবেন? উমা!’
উমাইয়া বারান্দার দরজাটা ভেরিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর এসে দাঁড়াল। প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসল। মূহুর্তেই সারা গায়ে বয়ে গেল অদ্ভুত এক শিহরণ। ঘরজুড়ে মিহি গুঞ্জনের রব ছড়িয়ে পড়ল। উমাইয়া হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ঘন অন্ধকারে খোলা চুলগুলো দু’হাতে টেনে ধরে পায়চারি করতে লাগল। রাগে চোখ বন্ধ করে বলল,
‘ আমি কি বুঝে হ্যাঁ বলেছি? আমি কেনো স্বীকারোক্তি দিয়েছি তাকে ভালোবাসি? তার ওই মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কেন ওসব কথা বলে ফেলছি? কেনো? কেনো?’
জুবিয়া বলল,
‘ কাকে ভালোবাসিস বলে ফেলছিস?’
উমাইয়া হকচকিয়ে গেল। অস্ফুটে কেবল বলল,
‘ কাউকে না।’
বৃষ্টির ধার কমে এসেছে। গাঢ় সন্ধ্যায় এক কাপ কফি হাতে কিচেন থেকে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল সেহরিশ। সোফায় আয়েসি ভঙ্গিতে শুয়ে থেকে তূর্ণ বলল,
‘ সাদাফের সাথে কথা হয়েছে?’
সেহরিশ ছোট্ট করে বলল,
‘ হুম।’
তূর্ণ বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ সাদাফের যে পরিমাণ টাকা আছে সেগুলো দিয়ে এই সিটি হাজারবার কিনতে পারবে। সেখানে সেই নিম্নমানের সামান্য ফ্ল্যাট কিনলো কেন?’
সেহরিশ সর্বগে বলল,
‘ শিউর! কোনো খিঁচুড়ি পাকাচ্ছে নজর রাখ।’
তূর্ণ সোজা হয়ে উঠে বসল। সন্দেহী কণ্ঠে শুধাল,
‘ প্রেম করছে না তো?’
সেহরিশ গম্ভীর চোখে তাকাল।
‘ অসম্ভব। সাদাফ আর প্রেম?’
তূর্ণ বিগলিত কণ্ঠে বলল,
‘ কেন অসম্ভব? ওর কী ফিলিংস নাই? ওঁ কি রোবট? প্রেম যে কোনো সময় হতে পারে।’
সেহরিশ তূর্ণর দিকে খানিক ঝুঁকে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ তুই কী কারো প্রেমে পরছিস?’
তূর্ণ আকর্ণ হেসে বলল,
‘ হুহ। কিন্তু?’
সেহরিশ তূর্ণর দিকে তীব্র চোখে চেয়ে বলল,
‘ সিরিয়াসলি? কে সে?’
তূর্ণ ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,
‘ জানি না।’
সেহরিশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ ফাজলামো হচ্ছে?’
তূর্ণ কোনোরূপ প্রত্যুত্তর করে, জুবিয়ার কথা সেহরিশকে জানালো। সেহরিশ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। আগের মতোই শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তুই জাস্ট ইম্পসিবল।’
এখন রাত প্রায় তিনটা। হঠাৎ এক স্বপ্নে রক্ত দেখে ঘুম ভাঙল, বিছানায় উঠে বসল সেহরিশ। তারপর বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দেখল, শেষ রাতের থমথমে নিকশ কালো আকাশ। আশেপাশের কয়েকটি বাড়ির ফ্ল্যাটে এখনও আলো জ্বলছে। রাস্তার অলিগলি থেকে এখনও রিক্সার বেলের শব্দ কানে বাজছে। এলাকার পাহারাদার খানিক বাদে বাদে বাঁশি ফুঁকছেন। ফুরফুরে হাওয়ায় খানিক বাদে বাদে চুলগুলো উড়ে উড়ে উঠছে তার। সেহরিশ রেলিঙের উপর উঠে বসল। সহসা রুমের ভেতর থাকা ফোনটি সশব্দে বাজলে লাগল। সেহরিশ রুমে এলো, খানিক ঝুঁকে ফোনটি হাতে নিয়ে নাম্বার দেখে কল কেটে দিল।
____________
সকাল ন’টা বাজে। তূর্ণ সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে হাঁপিয়ে গেল। লিফট ছাড়া বাড়ির ফ্ল্যাট কিনেছে সাদাফ। এতগুলো সিঁড়ি হেঁটে উঠায় পা ব্যথা করছে তূর্ণর। রাগে, ক্ষোভে সাদাফের ফ্ল্যাটের বেল অনবরত বাজাতে লাগল তূর্ণ। পাশের ফ্ল্যাটে বেল বাজার তীব্র শব্দ ঢুকছে অবলীলায়- বিরক্ত হয়ে ড্রয়িংরুম থেকে উঠে এসে দরজা খুললো জুবিয়া। পিছনদিক থেকে দরজা খোলার আওয়াজ শুনে তূর্ণ ঘুরে তাকিয়ে পলকেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। অস্পষ্ট ভাবে কাউকে দেখেছে ভাবনায় তূর্ণ স্তম্ভিত মুখশ্রী নিয়ে পুনরায় ঘুরে মেয়েটার উপর দৃষ্টি স্থির করল। ভারী পল্লব কাঁপিয়ে তূর্ণ বলল,
‘ হায়, আল্লাহ! আপনি? এখানে থাকেন?’
জুবিয়া মলিন কণ্ঠে বলল,
‘ এতবার বেল বাজাচ্ছিলেন কেন? আপনি জানেন এটা কত বিরক্তিকর?’
তূর্ণ ঠোঁট প্রসারিত করে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ ধন্যবাদ কলিংবেল। যাকে আমি এক সপ্তাহ ধরে খুঁজে পাইনি। আজ তোর কয়েকবার বাজার ফলে পেয়ে গেলাম।’
জুবিয়া দুই আঙুলে তুরি বাজিয়ে বলল,
‘ কানে শুনতে পান না?’
ওষ্ঠকোণে দুর্বৃত্ত হাসির দেখা মিলল তূর্ণর। জুবিয়ার দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে এগিয়ে আসলো আরও নিকটে।
তূর্ণ মৃদু গলায় বলল,
‘ আপনি আমায় চিনতে পারেননি? ওই যে সেদিন আমার গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে মিডিয়ার লোক থেকে বাঁচালেন।’
‘ আপনি আমার পুরোনো চিকেন শপের ঠিকানায় ফুল পাঠিয়ে ছিলেন?’
তূর্ণর জিজ্ঞেস করল,
‘ আপনি ফুল রিসিভ করেছিলেন?
জুবিয়া নিরর্থক গলায় বলল,
‘ না।’
জুবিয়া আর কথা বাড়াল না আচমকা দরজা বন্ধ করে দিল। হেঁটে রুমে এসে দেয়ালে দৃষ্টি ছুড়ে ফেলল। দক্ষিণের দেয়ালে একটা পেরেক ঠুকে রশি দিয়ে মর্মরা ফুলগুলো বেঁধে ঝুলিয়ে রাখছে জুবিয়া। চেয়ার টেনে বসে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। সামান্য ফুলের বিষয়ে তূর্ণর কাছে মিথ্যা কেন বলল মাথায় খেললো না তার।
সাদাফ দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। দরজা খোলার আওয়াজ শুনে তূর্ণ সাদাফের দিকে তাকাল। তারপর একসাথে ভেতরে আসলো। মিনিট পাঁচেক হবে তূর্ণ একা একা মিটমিটিয়ে হাসছে। সাদাফ ভ্রু উঁচিয়ে তূর্ণর হাসিহাসি মুখখানা দেখে অবাক হলো। সহজ সরল কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ এভাবে হাসার কারণ? তূর্ণ, ক্ষুধা লাগছে তোর? কিছু বানিয়ে দিব?’
সাদাফকে দ্বিগুণ চমকে দিতে তূর্ণ সোফা থেকে উঠে এসে সাদাফের গলা জড়িয়ে ধরল। সাদাফ প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
‘ কি করছিস? ছাড় আমায়।’
তূর্ণ ওষ্ঠকোণে অমায়িক হাসি ফুটিয়ে তুলে মৃদুস্বরে বলল,
‘ আমার একা একা থাকতে ভাল লাগে না। তাই আজ থেকে আমি তোর সাথে তোর নতুন ফ্ল্যাটেই থাকব।’
সাদাফ হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। তূর্ণর উদ্দেশ্য ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল, ‘ নাহ। তুই এখানে থাকতে পারবি না।’
তূর্ণ বলল,
‘ পারব না। কেন?’
সাদাফ পরোক্ষণেই ছুতো খুঁজে বের করল,
‘ এই ফ্ল্যাটে বেডরুম দুটো। একটায় আমি থাকি অন্যটা এখনো ক্লিন করা হয়নি।’
তূর্ণ সহাস্যে বলল,
‘ সমস্যা নেই৷ ক্লিনারকে বললে আজই ক্লিন করে দিয়ে যাবে।’
সাদাফের ধবধবে ফর্সা ত্বক লাল হয়ে গেল।
সাদাফ ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘ আমি তোকে রাখব না।’
চলবে….