আশিয়ানা #পর্ব_১৪ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
212

#আশিয়ানা
#পর্ব_১৪
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে পড়ে আছে। টপটপ করে কয়েক ফোঁটা পানি বারান্দায় পরে ফ্লোর ভিজিয়ে দিচ্ছে। বারান্দার এককোণে বসে থরথর করে কাঁপছে জুবিয়া। রোদেলা দুকাপ চা নিয়ে বারান্দায় আসলো। জুবিয়ার পাশে চেয়ারটায় বসে এক কাপ চা জুবিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। হাতের মুঠোয় রাখা চা কাপটা থেকে গরম গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। এই গরম গরম চা মুখে নিলে জিব পুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। চা কিঞ্চিত ঠান্ডা হওয়ার জন্য রেলিঙের উপর রেখে চোখ নামিয়ে বাড়ির গেইটের দিকে তাকাল। একটা গাড়ি এসে মাত্রই দাঁড়াল। কিছুক্ষণের অন্তরে একজন পুরুষ লোক গাড়ি থেকে নামলেন। পরোক্ষণেই উমাইয়া গাড়ি থেকে নামে। জুবিয়া বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। রোদেলার উদ্দেশ্য বলল, ‘ ওইটা আমাদের উমাইয়া না?’

রোদেলা অবাক স্বরে বলল,
‘ হ্যাঁ। দেখে তো উমাইয়ার মতো লাগছে। কিন্তু সাথে ছেলেটা কে?’

উমাইয়া সাদাফের সঙ্গে বাড়ির কেঁচি গেইটের দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণের অন্তরে তারা তৃতীয় তলায় এসে পৌঁছে যাবে। জুবিয়া রোদেলার হাত ধরে সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়াল। কলিংবেল বাজার সঙ্গে দরজা খুলে দিল। উমাইয়া বিস্মিত গলায় বলল,

‘ এত তারাতাড়ি দরজা খুলে দিলি। তোরা দরজার সামনেই ছিলি নাকি?

উমাইয়া ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসল। জুবিয়া আর রোদেলা তাকে ঘিরে ধরল। উমাইয়া তাদের দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে। জুবিয়া শক্ত গলায় বলল,

‘ কি ছিল ওইটা?’

হুট করে জুবিয়ার কথায় উমাইয়া চকিত তাকাল। উমাইয়া নির্বিকার গলায় বলল, ‘ কোনটা?’

রোদেলা বিচিত্র গলায় বলল, ‘ ছেলেটা কে ছিল?’

জুবিয়া উমাইয়ার সামনে এসে বসল। দু-হাত বাড়িয়ে উমাইয়ার হাত দুটো ধরে উমাইয়ার চোখে চোখ রেখে বলল,
‘ তুই প্রেম করছিস? ছেলেটা কে? নাম কি? কি করে? জানিস কিছু?’
‘ ছেলেটা কে? নাম কি? সে কি করে? এসব খোঁজ নিয়েছিস নাকি ডিরেক্ট প্রেম করছিস?’

উমাইয়া অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ উনার নাম সাদাফ। আমরা প্রেম করছি না। উনি আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের ফ্ল্যাটে থাকেন। উনি চাকরি করেন কি না, আমি জানি না। সেভাবে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। আর…’

রোদেলা শুধাল,
‘ আর কি?’

উমাইয়া বলল,
‘ উনি আমাকে বিয়ে করতে চান। বলেছেন পছন্দ করেন।’

জুবিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলল,
‘ বিয়ে করতে চাই বললেই কি বিয়ে হয়ে যায়? বিয়ে করার জন্য কত নিয়ম কানুন মানতে হয়। সেসব সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে?

উমাইয়া কাচুমাচু করে বলল,
‘ উনি বাবার সঙ্গে কথা বলতে চান।’

রোদেলা চিন্তান্বিত সুরে বলল,
‘ খালেদ মামা যদি এসব কথা শুনেন রেগে যাবেন না?’

উমাইয়া বলল,
‘ আব্বা যদি আমাকে মারে?’

জুবিয়া বলল,
‘ মারবে কেন?’

উমাইয়া বলল,
‘ আমাকে এখানে পড়াশোনা করার জন্য পাঠাইছে। আর আমি বিয়ে করার জন্য পাত্র নিয়ে সামনে দাঁড়ালে? আব্বা কি আমায় ছেড়ে কথা বলবেন?’

উমাইয়া বাড়ি এসে গোসল করার জন্য যায়। ক্ষুধা প্রচণ্ড লাগায় খেতে বসে যায় জুবিয়া আর রোদেলা। ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে সবেমাত্র ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল উমাইয়া। কলিংবেলের শব্দ শুনে কপালের চামড়া খানিক ভাজ ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ফুটোয় বাড়িওয়ালী খালাকে দেখে দরজা খুলে দিল। বাড়িওয়ালা কাসেম উদ্দিনের স্ত্রী হালিমা, একটা কাগজ উমাইয়ার হাতে দিয়ে বললেন,

‘ তোমাদের বাসা ভাড়া ট্রিপল হইছে। মাসের এক তারিখে তিনজনের ভাড়া তৈরি রাখবা।’

উমাইয়া ইতস্তত করে বলল,
‘ খালা, তিনজনের কেন?’

হালিমা রুদ্ধ গলায় বললেন,
‘ আগে তোমরা দুইজন ছিলা৷ এখন তিনজন হইছ তাই ভাড়া বাড়ছে।’
‘ এটা কেমন নিয়ম খালা?’ এই রকম নিয়ম বাসা ভাড়া নেওয়ার আগে তো বলেন নি।’
‘ আমার বাড়িতে থাকতে হলে তিনজনের ভাড়া দিয়ে থাকতে হবে। ভালো না লাগলে নাহলে চলে যেতে পারো।’

বিধস্ত অবস্থায় বিছানার ওপর বসে রইল উমা৷ রাতের খাবার টাও সে খায়নি৷ রোদেলা প্লেটে খাবার নিয়ে রুমে এসে লাইট অন করল।

জুবিয়া শুধাল,
‘ হঠাৎ তোর কি হলো? মুখ ভার করে রাখছিস কেন?’

উমাইয়া বলল,
‘ বাড়িওয়ালা খালা আসছিলেন।’

‘ কি বললেন?’ বলল রোদেলা।

‘ মহিলা আবার উল্টা পাল্টা কিছু বলছে?’

উমা একবার জুবিয়ার দিকে তাকাল৷ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘ উনি বলছেন ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। এই মূহুর্তে ভাড়া বাড়িয়ে কিভাবে দিব? আমার একার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কি ভাড়া মিটবে?’

জুবিয়া উৎসুকভাবে জানতে চাইলো,
‘ আর কি বলেছে?’

‘ ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে বললেন।’

জুবিয়া গর্জে ওঠা কণ্ঠে বলল,
‘ উনি জানেন আমার চাকরি নেই। সেই সুযোগটা নিয়ে এখন বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাচ্ছেন।’

একটু ভাবনা চিন্তা করে রোদেলা বলল,
‘ মামার কাছে টাকা চাইতেও আমার দ্বিধা লাগে। আমরা তিনজন যদি জব করি তাহলে এই সব সমস্যার সমাধান হবে।’

উমাইয়া ত্যক্ত গলায় বলল,
‘ এখানে জব নেওয়া এত সহজ না৷ আর তিনজন একসাথে জব কিভাবে পাবো?’

হুট করে জুবিয়া বলে উঠল,
‘ ভার্সিটিতে আমার এক ফ্রেন্ড আছে। ওর বাবার বিশাল রেস্ট্রন্টের কারবার। আমি ওর সাথে একবার কথা বলব? যদি আমাদের ওখানে ওয়েটারের কাজ দিয়ে দেয়। তাহলে ভালোই হবে।’

জুবিয়া ঘুরে উমাইয়ার দিকে তাকাল। তারপর আবারও বলল, ‘ রেস্ট্রন্টের জব হয়ে গেলে তোর আর নার্সারিতে কাজ করতে হবে না।’

রোদেলা নিরর্থক প্রশ্ন করল,
‘ কোন বন্ধু?’

জুবিয়া বলল,
‘ আয়ান। ওর সাথে ওইদিন তোর পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম।’

রোদেলা বলল,
‘ ওই যে, লম্বা করে ফর্সা ছেলেটা?’

জুবিয়া ছোট্ট করে বলল,
‘ হুম।’

উমা একবার উঠে দাঁড়াল। টেবিলের ওপর থেকে জুবিয়ার বাটন ফোনটা নিয়ে এসে জুবিয়ার হাতে দিয়ে বলল,
‘ রাত বেশি হয়নি। এখনই কল কর।’

জুবিয়া ধাতস্থ হয়ে বসল। বাটনের ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে গিয়ে আয়ানের নাম্বারে কল দিল। দুই বার রিং হতে আয়ান কল রিসিভ করে।

আয়ান কুটিল হাসল। বিছানার ওপর শুয়ে পরে জিজ্ঞেস করল,
‘ এতরাতে হঠাৎ আমাকে মনে করলি কিভাবে?’

জুবিয়া শ্লেষের সুরে বলল,
‘ তোর সাহায্য চাই।’
‘ কি সাহায্যে লাগবে তোর? বল, তোর জন্য তো আকাশের তাঁরা ও মাটিতে নিয়ে আসবো।’

জুবিয়া খানিক বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,
‘ না না ওসব চাঁদতাঁরা তোর মাটিতে নিয়ে আসতে হবে না। তাদের আকাশে থাকতে দে।’ বলে খানিক থামল জুবিয়া। নিশ্চল আওয়াজে বলল, ‘ তোর বাবার খাবারের রেস্ট্রন্ট আছে তাই না?’
‘ হ্যাঁ, আছে। কেন বল তো?’
‘ আমাদের সেখানে জব নিয়ে দিতে পারবি।’

আয়ান উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তারপর বলল,
‘ এটা তো আমার বা হাতের খেল। কিন্তু আমাদের বলতে তুই আর কে?’

জুবিয়া একবার রোদেলা ও আরেকবার উমাইয়ার দিকে তাকাল। অগাধ স্বরে বলল,
‘ আমি উমাইয়া আর রোদেলা। আমাদের তিনজনের জব দরকার।’

আয়ান ডানহাতে ফোন কানে ধরে রেখে বা-হাতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
‘ আগামীকাল সকাল ১০টায় আমার বাবার রেস্ট্রন্টে আসবি। আমি সব ব্যবস্থা করে রাখব। চিন্তা করিস না, আমি একবার বললেই তোদের জব পাকা হয়ে যাবে।’

হিমেল বাতাসে বারান্দার চারাগাছের পাতাগুলো হালকা নড়েচড়ে উঠে। রেলিঙের উপর রাখা ছোট্ট এক চারাগাছের সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়াল সাদাফ। বিস্তীর্ণ গলায় বলল,
‘ মেয়েরা এত কঠিন কেন?’

হঠাৎ পাশ থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠে ভেসে এলো। কণ্ঠের মালিককে চিনতে বিড়ম্বনা হলো না সাদাফের। উমাইয়া বিদ্রুপের স্বরে বলল,

‘ শুধু মেয়েরা কঠিন? পুরুষরা নয়?’

সাদাফ থমথমে মুখে উমাইয়ার দিকে তাকাল। বোঝাই যাচ্ছে, উমাইয়ার হঠাৎ উপস্থিতিতে সাদাফ বিব্রত বোধ করছে। সাদাফ কিয়ৎক্ষণ মৌন থাকল। এরপর বলল,

‘ আমি কথাটা সেভাবে বলতে চাইনি।’

উমাইয়া চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ কিভাবে বলতে চেয়েছেন?’

সাদাফ এই প্রশ্নের জবাব দিল না। ঠোঁট কামড়ে ঘনান্ধকার আকাশের দিকে তাকাল। সাদাফ বলল,

‘ মধ্যরাত। আপনি এখনো জেগে আছেন। কোন কারণে ঘুম আপনার চোখে হানা দিচ্ছে না?’

উমাইয়া মলিন কণ্ঠে জানালো,
‘ আগামীকাল বন্ধুর বাবার রেস্ট্রন্টে যাব। জবের জন্য। চিন্তা হচ্ছে যদি জবটা না পাই। তাহলে এখানে থাকা সম্ভব হবে না। ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে।’

সাদাফ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘ কোন রেস্ট্রন্ট? নাম কী?’

‘ জাপানি ফুড।’

সকাল ৯:৫০মিনিট। দশটা বাজার ৩০মিনিট আগেই আয়ানের বাবার রেস্ট্রন্ট এসে উপস্থিত হয়েছে তারা। আয়ান জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে ওষ্ঠকোণে হাসি ফুটিয়ে তুলে মোহাম্মদ নায়েব চৌধুরীর অফিস রুমে প্রবেশ করল। নায়েব চৌধুরী ছেলের আচরণে রুষ্ট হয়। উচ্চকিত গলায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন,

‘ তোমার সাহস কে দিয়েছে? আমার রেস্ট্রন্টের জন্য স্টাফ হায়ার করার?’

আয়ান তার বাবার প্রতিটা কথায় কেঁপে কেঁপে উঠল। নায়েব চৌধুরীকে প্রচণ্ড ভয় পায় আয়ান। আয়ান চটজলদি ছুটে গেল। নায়েব চৌধুরীর পা জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ বাবা। আমি এমন কাজ দ্বিতীয় বার করব না। এবারের মতো আমার বন্ধুদের তুমি জবটা দিয়ে দাও। ওদের আমি অনেক বড়মুখ করে বলেছি, তুমি আমার একটা কথাও ফেলো না৷ প্লিজ রাজি হয়ে যাও, না হলে বন্ধুদের সামনে আবার ইজ্জত থাকবে না।’

নায়েব চৌধুরী কঠোর গলায় বলল,
‘ পা ছাড়ো আয়ান৷ তুমি তো জানো এভাবেই কাউকে আমি স্টাফের কাজে নিয়োজিত করি না। তোমার বন্ধুদের চলে যেতে বলো।’

আয়ান আরও শক্ত করে নায়েব চৌধুরীর পা জড়িয়ে ধরে। কান্না জড়িত গলায় উঁচু সুরে বলল,
‘ বাবা। যতক্ষণ তুমি ওদের জব না দিবে, ততক্ষণ আমি পা ছাড়বো না।’

আয়ানের চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। নায়েব চৌধুরী টেবিলের উপর দৃষ্টি রেখে ফাইল পত্র দেখতে লাগলেন। আচমকা টেবিলের ওপর টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনের ওপাশ থেকে একটি দৃঢ় স্পষ্ট গলা ভেসে এলো। কথার এক পর্যায়ে নায়েব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বিচলিত কণ্ঠে আয়ানকে বলল,

‘ তোমার বন্ধুদের নিয়ে এসো। ওদের চাকরি কনফার্ম।’

বাবার এমন রূপ দেখে চমকাল আয়ান। অস্ফুট আওয়াজে শুধাল, ‘ এই সময় তোমাকে কল দিচ্ছে কে?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here