আশিয়ানা #পর্ব_৬ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
68

#আশিয়ানা
#পর্ব_৬
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
চিকেন শপের মালিক একজন মহিলা। নাম সিমলা খাতুন। মেজাজ ভীষণ খিটখিটে। শপ ওপেন করার পর থেকে কাস্টমার শূন্য কারণ, ওনার ব্যবহারে কোনো মাধুর্য নেই। কাস্টমার চায় নম্র-ভদ্র ব্যবহার। টাকা খরচ করে খাবার খেতে এসে যদি দুটোর একটাও না পান সেখানে দ্বিতীয় বার কেনোই বা আসবেন? পুরো দিন শূন্য পড়ে থাকত, এই শপ। দীর্ঘদিন পর জুবিয়া এই শপে পার্ট টাইমারের কাজ নেয়। প্রথমত লোকজন একদমই আসতো না। তবে ধীরে ধীরে লোকজনের টেস্ট বদলেছে। এখন পুরো শপে লোকজন গিজগিজ করে। পা রাখার ও জায়গা থাকে না।

জুবিয়ার নিজ হাতে সবটা করতে হয়। কাস্টমারদের সঙ্গে ভাল আচরণ এবং সঠিক ভাবে খাবার পরিবেশন করায় মুগ্ধ হন তারা, প্রতিটা কাস্টমার-ই রেগুলার আসেন। সন্ধ্যার পর বেশি ভীড় হয়। একা হাতে কাস্টমারের অর্ডার নেওয়া এবং খাবার সার্ভ করায় হিমশিম খাচ্ছে সে। শপের মালিক সিমলা খাতুন কাউন্টারে বসে আছেন। আঁড় দৃষ্টিতে নজর রাখছেন তিনি জুবিয়ার উপর। ওনার শপের জন্য জুবিয়া তার বেস্ট দিয়ে কাজ করে, তবুও তিনি খুশি নন। ওনার ধারণা জুবিয়ার জন্য কাস্টমার হাত ছাড়া হচ্ছে এবং বর্তমানে শপে যে পরিমাণ ভীড় হয় সবকিছুর পিছনে সমস্ত ক্রেডিট তার। দুটো টেবিল থেকে কোল্ড ড্রিংকস এর অর্ডার এলো।

জুবিয়া দ্রুত হিশেলের দিকে এগিয়ে গেল। দুটো ট্রে-তে দুইটা দুইটা চারটা গ্লাস রেখে তাতে ড্রিংকস ঢেলে দু’হাতে নিয়ে বাহিরে এলো। জুবিয়া টেবিলের উপর ট্রে রাখার জন্য খানিক ঝুঁকে এলো তখনি চেয়ার ছেড়ে এক ভদ্রলোক উঠতে নিলেন। লোকটার হঠাৎ উঠে দাঁড়ানোর প্রয়াসে জুবিয়ার হাতের সাথে ধাক্কা লাগল। ওমনি ট্রে উল্টে যায়। লোকটার পোশাক ভিজে চিপচিপে হয়ে গেছে। গ্লাস গুলো ফ্লোরে পরে ভেঙে যায়। অকস্মাৎ গ্লাস ভাঙ্গার শব্দ কানে আসায় কাউন্টার ছেড়ে এগিয়ে আসলেন সিমলা খাতুন।

ভদ্রলোক খানিক নির্বাক চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ জুবিয়াকে অভদ্র ভাষায় গালমন্দ করতে উঠেপড়ে লাগেন। বারংবার ক্ষমা চেয়ে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জুবিয়া। সিমলা খাতুনকে পাশে দাঁড়াতে দেখে সে ভাবে বোধহয় উনি তার পক্ষ নিবে। কিন্তু সিমলা খাতুন উল্টো জুবিয়ার উপর রাগ ঝাড়তে উঠেপড়ে লাগলেন। জুবিয়া বুদ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভদ্রলোক খাবারের বিল পেমেন্ট না করে হনহনিয়ে শপ থেকে বেরিয়ে যান।

সিমলা খাতুন আরও চটে যান। বেশ কয়েকদিন ধরে তিনি জুবিয়াকে অন্যমনস্ক দেখছিলেন, কাজে গাফলতি ও খেয়াল করেন। সিমলা খাতুন মনে মনে চাচ্ছিলেন জুবিয়াকে চাকরি থেকে বের করে দিবেন। এই সুযোগে জুবিয়াকে তিনি ডিসচার্জ করলেন। রাগান্বিত ও শক্ত গলায় বললেন সিমলা,

‘ তোমার আর কাজে আসার প্রয়োজন নেই। আমি নতুন পার্টটাইমার খুঁজে নিব। চলে যাওয়ার সময় হাফ বোনাস নিয়ে যেও।’

জুবিয়া কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না। যেন সে আগে থেকে জানত এমন কিছু ঘটবে। হিশেল থেকে ওড়না ও ব্যাগ নিয়ে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়ায়।

চাঁদনি রাত। আকাশের বুকে ঝলমলে আলাের পসরা নিয়ে উদয় হয়েছে ভরা পূর্ণিমার রাতে নিটোল চাঁদ। আলাে-আঁধারের স্নিগ্ধ মিতালিতে ঝলমল করে ওঠে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত শহর। রাস্তা জুড়ে রিক্সা, অটো, বড়বড় গাড়ির হর্ণের তীব্র আওয়াজ। ফুটপাতে লোকজনের ভীড়। জুবিয়া একপলকে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল। ১০:১১মিনিট। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। পাশেই একটা শপ দেখতে পেয়ে এগোল সে। ঠান্ডা পানির বোতল হাতে নিয়ে বিশাল এই পৃথিবীর মাঝে আনমনে হাঁটতে লাগল। ব্যাগের ভেতর তার বাটন ফোনটি হঠাৎই বেজে উঠল। বাম হাতে চেইন খুলে ফোন বের করে দেখল, ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরে ইংলিশে লেখা ‘ হ্যাপিনেস।’

কল রিসিভ করে ফোন কানে লাগাল সে। ফোনের ওপাশ থেকে চাপা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ এই জুবি, কোথায় তুই? এখনো বাসায় ফিরলি না যে?

জুবিয়া অনেক ভেবে চিন্তে বলল,
‘ আজ তোর আমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে?’

‘ আমার না। বাড়িওয়ালা আন্টির হচ্ছে।’

জুবিয়া বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ মানে?’

‘ উনি আমাদের ড্রয়িংরুমে এসে বসে আছেন।’

‘ কেনো? ওনার রুমে কী পানি উঠছে?’

‘ ঠাট্টা করিস না। উনি তোর ওপর ভীষণ রেগে আছে। কয়টা বাজে ঘড়িতে দেখছিস?’

জুবিয়া ছোট্ট করে বলল,
‘ দেখছি। সাড়ে দশটা কাছাকাছি।’

‘ উনি বলছেন, মেয়ে মানুষের এত রাত অব্ধি বাহিরে কী কাজ? উনার বাড়িতে থেকে এসব অকাজ চলবে না। আমি একা ওনাকে সামলাতে পারছি না। তুই প্লিজ জলদি আয়।’

জুবিয়া অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ অকাজ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন? ভাড়া দিয়ে থাকব। আবার ওনার উলট পালট কথাও শুনব? আসতেছি আমি। আজ একটা অঘটন ঘটিয়েই ছাড়ব।’

_____________

দরজা লাগানোর শব্দ কানে আসামাত্র কেঁপে উঠল তূর্ণ। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেহরিশের মাত্র আগমন ঘটল। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছে তূর্ণ। সে খুব ভালো করে জানে এই মূহুর্তে বড়সড় ঝড় বয়ে যাবে তার ওপর। সোফায় নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল৷ সেহরিশের শান্ত চাহনি দেখে তূর্ণর গলা শুকিয়ে কাঠ প্রায়। হৃদপিণ্ড বেরিয়ে আসার উপক্রম। ড্রয়িংরুম জুড়ে ভয়াবহ নিস্তব্ধতা। এই নীরবতা চিরে সাদাফ বলে উঠল,

‘ ভাই, তোরা নিজেদের মধ্যে হিসেব নিকেশ পুরো করে নে। আমি বাবা ঘুমোতে যাচ্ছি।’

সাদাফের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সেহরিশ। শক্ত ও গম্ভীর গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠল,

‘ ডাফার। ঝামেলা বাঁধিয়ে এখন ঘুমাতে যাওয়া হচ্ছে? এজন্য তোদের দুজনকে আমি আনতে চাইনি। স্পেশালি এই ইডিয়ট টাকে। এক্ষুণি আমার সামনে থেকে ওঁকে নিয়ে যা, না হলে ভীষণ খারাপ হয়ে যাবে।’

সাদাফ ভারী গলায় বলল,
‘ ওঁকে এভাবে বকিস না। ছোটো মানুষ ভুল করে ফেলছে।’

‘ ওঁ ছোটো মানুষ? আটাশ রানিং।’

তূর্ণ মৃদু গলায় বলল,
‘ আ’ম স্যরি। আমি আসলে..’

‘ গেট্ লস্ট।’ ধমকের স্বরে বলল সেহরিশ।

তূর্ণ গুজগুজ করে বলল,
‘ আমি কী করেছি? এত সেফ থাকার পরও যদি মেয়েরা চিনে ফেলে, তাহলে আমার কী দোষ?’

প্রতিটা নিউজ চ্যানেলে খবরটি নিয়ে এখনও তোলপাড় চলছে। অধিকাংশ লোকের কল এসেছে সেহরিশের ফোনে। ফোনটি সাইলেন্ট করে পাশে রাখে সে। তারপর বারান্দার রেলিঙ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে গেল। কড়া করে কফি বানিয়েছে সাদাফ। রেলিঙের ওপর দুটো কাপ রেখে হঠাৎ কেশে উঠল। খানিক সময় মৌন থাকল সেহরিশ। জড়তা কাটিয়ে বলল,

‘ তূর্ণ কোথায়?’

সাদাফ বলল,
‘ ওর রুমে। সম্ভবত এখন ঘুমিয়ে পড়ছে।’

‘ ডিনার করেছে ওঁ?’

সাদাফ স্মিথ হাসলো। বলল,
‘ এত চিন্তা হলে তুই নিজে গিয়ে হালচাল জিজ্ঞেস কর।’

সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল।
‘ ওঁর যখন ষোল বছর তখন প্রথম আমার সাথে দেখা হয়। ওঁর বেবিফেইস দেখে আমার তখন-ই ওর প্রতি অন্য রকম মায়া লাগে। সিদ্ধান্ত নেই, যত কঠিন সময় আসুক তূর্ণ আমার সাথেই থাকবে। ওঁর অবুঝ দৃষ্টিতে তাকানো, চটপটে বলা কথাগুলো আমায় ভীষণ ভাবে আনন্দ দিত। সময় পেরিয়ে গেল। কিন্তু ওর বাচ্চামো, ছেলেমানুষী এখনও স্বভাবের সাথে রয়েই গেছে। মাঝেমধ্যে এমনসব কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে যা সামলানো আমার হাতে থাকে না। এবার এই দেশ থেকে বের হওয়া কী খুব সহজ হবে? দেশের বড় বড় লোকজন, ফ্যানস তারা কী চাইবে না আমাদের সঙ্গে দেখা করার? এসব সামলে আবার কতদিনে ফিরব? এক সপ্তাহ বা তারও বেশি? ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান করে একটা কাজ করে না। কী দরকার ছিল ওভাবে শপিং করতে যাওয়ার?’

সেহরিশের কাঁধে তার ডান হাতটি রাখল সাদাফ। তূর্ণর রুম থেকে হঠাৎ হঠাৎ কান্নার আওয়াজ আসছে সেহরিশের কানে। ব্যালকণি থেকে এসে তূর্ণর রুমের দরজায় নক করল সে। কক্ষের ভেতর থেকে কোনো শব্দ এলো না। কান্নার আওয়াজ বাড়ল। অন্ধকার চারিপাশ। একটু আলোর ঝিলিক নেই। তূর্ণ থেমে থেমে কেঁদে কেঁদে উঠছে। সেহরিশ অসহায় দৃষ্টিতে রুমের ভেতর তাকালো। স্পষ্ট কিছুই দেখতে পেল না। আন্দাজ করে হেঁটে বিছানার ওপর গিয়ে বসলো। অন্ধকারেই হাত হাতড়ে তূর্ণকে খুঁজে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

‘ বাচ্চাদের মতো কান্না করছিস কেন? আমি কী বকেছি তোকে? আর কান্না করতে হবে না। শপিং করবি তো? ঠিক আছে। আগামীকাল আমি তোকে শপিং করাতে নিয়ে যাব। তুই কত শপিং করতে পারিস দেখব।’

তূর্ণ কান্না ভেজা গলায় বলে উঠল,
‘ থ্যাংক ইয়্যু।’

লাইট অন করে সেহরিশের দিকে এগোল সাদাফ। পরপরই তূর্ণর কথাটা তার কানে পৌঁছায়। তূর্ণর দিকে তাকিয়ে মৃদু মিষ্টি হেসে সাদাফ শান্ত গলায় বলল,

‘ তোর চোখের জলে এমন কী আছে? যা সেহরিশকে গলিয়ে পানি করে দেয়?’

তূর্ণ বিগলিত হাসি দিয়ে বলল,
‘ অ্যা বিউটিফুল লাভ অফ ম্যাজিক।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here