#আশিয়ানা
#পর্ব_৭
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
কলিংবেলের প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল উমাইয়ার। ঘুমুঘুমু চোখটা বার কয়েক পিটপিট করে আবারও কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল। খানিকবাদে আবারও কলিং সেই শব্দে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলো। তারপর ডান হাতখানা দিয়ে চোখ কচলাতে লাগল, বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল সে। অগোছালো চুলগুলোকে হাতখোপা করতে করতে দরজা খুললো উমাইয়া। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রোদেলা ও মাসুম বিল্লাহ। রোদেলাকে দেখেই উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠল সে। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ কতদিন পর তোকে দেখলাম রোদু। কেমন আছিস তুই? এত শুঁকিয়ে গেছিস কেন? ঠিক মতো খাবার খাসনি তাই না?’
একটু পর উমাইয়া রোদেলাকে ছেড়ে সরে দাঁড়াল। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাসুম বিল্লাহ’র উদ্দেশ্য বলল,
‘ আসসালামু আলাইকুম চাচা। আপনি কেমন আছেন?’
মাসুম মৃদু হেসে বললেন,
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি রে মা। তোরা কেমন আছিস? কত মাস পর দেখলাম তোকে। আরেকজন সে কোই? ‘
মাসুমের কাছ থেকে ব্যাগ নিজ হাতে নিল উমাইয়া। তারপর ব্যাগটা সোফায় রাখতে রাখতে বলল,
‘ জুবিয়া? ওঁর কথা আর বলবেন না চাচা। মাসে মাসে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাসায় বসে থাকে। গতকালই ওর চিকেন শপের চাকরিটা চলে গেছে। পুরো রাত ঘুমোয়নি। এখন ঘুমাচ্ছে।’
মাসুম বিল্লাহ সোফায় পা তুলে আরাম করে বসলেন। রোদেলা উমাইয়ার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
‘ তুই বস। আমি জুবি কে চমকে দিয়ে আসি।’
কাঁথা মুড়ি দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে জুবিয়া। রোদেলা ধীরেধীরে হেঁটে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। খানিকবাদে একটানে কাঁথা টেনে ছিনিয়ে নিল সে। বিরক্তিতে কঠিন চোখে তাকাল জুবিয়া। রোদেলার আসার খবর উমাইয়া তাকে দেয়নি। জুবিয়া সন্দেহী চোখে তাকিয়ে হঠাৎই চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে নিল। তারপর চোখে খুলে রোদেলাকে দেখে বিষ্ময়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ রোদু? এটা কী সত্যি তুই? আমি কী স্বপ্ন দেখছি?’
রোদেলা হেসে ফেলল। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল,
‘ জুবি! এটা সত্যি আমি।’
জুবিয়া অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সহসা উচ্চকিত গলায় চেঁচিয়ে উঠে বিছানা থেকে নেমে আসলো। রোদেলাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। তুই সিরাজগঞ্জ থেকে গাজীপুর কিভাবে এলি? তোর মামা আসতে দিল তোকে?’
ভ্রু কুঁচকে ফেলল রোদেলার। শুধাল,
‘ আমি যে আসবো। উমাইয়া তোকে বলেনি?’
‘ না।”
ভাবান্তর ভঙ্গিতে রোদেলা তাড়া দিয়ে বলল,
‘ বসাররুমে মামা বসে আছেন। চল।’
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সকাল ৯টা। আকাশের অবস্থা ভালো না। দমকা বাতাস বইতে শুরু করেছে। তূর্ণ বিছানা ছেড়ে আধোঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়ালো। সেহরিশ ও সাদাফ আগে থেকে বসে ল্যাপটপে কিছু দেখছিল। তূর্ণ সেহরিশের পাশে এসে দাঁড়াল। আদুরে গলায় বলল,
‘ আমার ক্ষুধা লাগছে। আমার জন্য কিছু বানিয়ে দিবে?’
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
‘ তুই নিজের খাবারটাও বানিয়ে নিতে পারিস না। কবে শিখবি এসব?’
তূর্ণ বলল,
‘ তোমাদের মতো দুজন বড় ভাই থাকতে আমি কেন এসব কষ্ট করে শিখতে যাব?’
সেহরিশ বলল,
‘ নাস্তা করে বাইরে যাব। একেবারে রেডি হয়ে আয়।’
শপিংমলে তূর্ণ, সেহরিশ ও সাদাফ একসঙ্গে প্রবেশ করে। ফ্যানসরা এসে যেন উত্যক্ত না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রেখে বডিগার্ড চারপাশ দিয়ে হাঁটছে। তূর্ণ পছন্দ মতো কিছু শপিং করে বের হলো। শপিংমলের সামনে তুমুল ভীড়। উৎসুক দৃষ্টিতে নিজেদের প্রিয় সিঙ্গার বা আইডলদের এক নজর দেখার জন্য ফ্যানস’রা জড়ো হয়েছে। এবং সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান সকলে যেন তাদের মুখ থেকে কিছু শোনার প্রতিক্ষায় রয়েছে।
সেহরিশ আজ পড়েছে, সাদা টি-শার্টের উপর কালো ব্লেজার, ডেনিম ব্লু জিন্স, পায়ে কেটস। সেহরিশের ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা চাপ দাঁড়ি আর কপালে পড়ে থাকা সিল্ক চুলগুলো বাতাসে হালকা নড়ে উঠল৷ তূর্ণ বার বার ঘুরে সেহরিশকে লক্ষ্য করছে। তূর্ণ যেন সেহরিশের উপর থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না, ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে। সেহরিশ কথা বলার সময় হঠাৎ তূর্ণর দিকে তাকাল সহসা তূর্ণ খিলখিল করে হেসে হাসিতে লুটিয়ে পড়ল।
সাংবাদিকদের প্রতিটি প্রশ্নের সহজ ভাবে জবাব দিচ্ছে সেহরিশ৷ এক পর্যায়ে একজন তূর্ণকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ গতকাল একজন আপনার গাড়ি ড্রাইভ করে ভীড় থেকে আপনাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। কে ছিলেন তিনি?’
তূর্ণ বেশ কিছুক্ষণ নিরব থাকল। মেয়েটির নাম ছাড়া আর কিছুই জানা নেই তার। সহসা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠল,
‘ আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী।’
সাদাফ মুখ তুলে সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আপনাদের মনে আমাদের নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আমরা বুঝতে পারছি। আমাদের বাংলাদেশ আসার কোনো প্ল্যান ছিল না। হঠাৎ করে আসতে হয়েছে বলে কোনো আপডেট কাউকেই দেওয়া হয়নি৷ ফ্যামিলির সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যই আমাদের হুট করে দেশে আসা। আমরা চাইনি আমাদের আসার খবর এভাবে পাবলিকে ছড়িয়ে পড়ুক বা আমাদের নিয়ে সবার কৌতূহল জাগুক। আমরা এসেছি দুদিনের জন্য আগামীকাল ফ্লাইটে চলেও যাব। আমাদের জন্য আপনারা প্লিজ উত্তেজিত হবেন না।’
ভীড়ের ভেতর থেকে এক শোরগোল শুনে সেদিকে তাকাল সেহরিশ। একসাথে অনেকজন চিৎকার করে কিছু বলছে। অস্পষ্ট শোনা গেল। মাইক হাতে সেহরিশ তাদের উদ্দেশ্য বলল,
‘ শুনতে পাইনি। আপনারা সবাই চুপ করুন এবং একজন বলুন। যেন আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই।’
ফ্যানসদের দাবি তারা নিজেদের দেশে এআই ব্যান্ডদের লাইভ পারফরম্যান্স দেখতে চায়। সেহরিশ গম্ভীর চোখে তাকাল তূর্ণর দিকে। তূর্ণ শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে গুটিয়ে নিল।
সাদাফ বলল,
‘ আপনারা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এমুহূর্তে আমরা আপনাদের ইচ্ছে পূরণ করতে পারব না। কারণ আগামীকাল রাতেই আমাদের ফ্লাইট।’
_____________
সন্ধ্যা ৭টা। গম্ভীর চিত্তে নির্বিকার ভঙ্গিমায় বসে আছে সেহরিশ। রাগে ও ক্ষোভে কপালের রগ ফুলেফেঁপে উঠেছে তার। তূর্ণ ভয় পেয়ে সাদাফের ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। সেহরিশের রাগ ক্রমশ বাড়তে লাগল। টেবিলের উপর রাখা গ্লাসটা ফ্লোরের উপর ছুড়ে ফেলল সে। তারপর রাশভারী গলায় বলে উঠল,
‘ এগুলো করতে আসছি আমি এখানে?’
সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে দেশের প্রায় সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, এআই ব্যান্ডের তারকারা বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে। দেশের সব বড়বড় শিল্পপতি সবার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা না হলেও কয়েকজন শিল্পপতি এবং গাজীপুর জেলা মন্ত্রীর সঙ্গে বিকেলে আলাপ হয়। ওনারা গাজীপুরে বড় করে কনসার্ট আয়োজন করতে চান। এবং পারফরম্যান্স করবে এআই ব্যান্ড। সেহরিশ তাদের সরাসরি না করেনি। ভাবার জন্য সময় নিয়েছে।
সাদাফ এগোল। সে ইতস্তত করে বলল,
‘ কনসার্ট আয়োজন করা মুখের কথা না। দুই এক দিনেই হয়ে যায় না। অনেকদিন সময় লাগবে। যেহেতু হাতে অনেক সময় রয়েছে, আমি গ্রাম থেকে ঘুরে আসি।’
সেহরিশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদাফের দিকে তাকাল। সোফায় থাকা কুশান তুলে সাদাফের মুখপানে ছুড়ে ফেলল সে। তূর্ণ জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমানতালে ঠোঁট কামড়ে দাঁতের সঙ্গে পিষে ফেলতে চাচ্ছে সে।
সাদাফ সেহরিশের মুখের উপর দৃষ্টি স্থির রেখে আগ্রহী কণ্ঠে বলল, ‘ এতগুলি বছর অনান্য দেশে পারফরম করেছি। এবার নিজের দেশে করা আত্মতুষ্ট হবে। কী বলিস?’
সেহরিশের কথা থেমে যায়। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজ ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তূর্ণ হতবিহ্বল কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ আমি একবার কথা বলব?’
সাদাফ বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থেকে হতাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ হ্যাঁ। ওর সামনে গিয়ে উইয়ার্ড বিহেভ করবি। তারপর ওর উল্টোহাতে চড় খেয়ে উল্টে পরবি। তোর অদ্ভুত সব পাগলামো দেখলে সেহরিশ আরও রেগে যাবে।’
তূর্ণ জবাব দিল না। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে অভিমানী
কণ্ঠে বলল,
‘ আমি এতটাও উইয়ার্ড বিহেভ করি না। আমি ওকে মানিয়ে নিব। সত্যি।’
তূর্ণর কথায় হতভম্ব হয়ে গেল সাদাফ। বিব্রত কণ্ঠে বলল,
‘ একদম না। সেহরিশের আশেপাশেও যাবি না। প্রবলেম তোর জন্যই সৃষ্টি হইছে। চুপচাপ রুমে গিয়ে চিপস খা।’
তূর্ণ অবাক হলো। বিব্রত কণ্ঠে বলল,
‘ আ’ম নট অ্যা বেবি।’
চলবে….