আশিয়ানা শারমিন আক্তার বর্ষা (৪)

0
75

#আশিয়ানা
শারমিন আক্তার বর্ষা
(৪)
ঠিক দুপুরবেলা। রোদেলা উঠোনের বেলী ফুল গাছের গোড়ায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। পুতুল বেগম রান্নাঘরে রান্না করছেন। তরকারি বাকি আছে। কড়াইয়ে কাটা সবজি ঢালতে নিয়ে থেমে গেলেন তিনি। আওয়াজ তুলে বললেন,
‘কি রে এখনো চোখের সামনে থেকে যাসনি?’
কড়াইয়ে খুন্তি নাড়ছেন। রাগান্বিত গলায় আবার বললেন,
‘আজকে তোর মামাকে বাসায় আসতে দে। তোর একদিন আর আমার যে কয়দিন লাগে। চোখে লজ্জা নেই। পুকুরে নেমে পাড়ার ছেলেদের সাথে মাছ ধরতে যাস। আজ আমি তোকে একটা উচিত শিক্ষা দেব, না হলে আমি আমার নাম পরিবর্তন করব।’
পুতুল বেগম রাগে কড়াইয়ে ঠাস ঠাস শব্দ করছেন। শব্দগুলো রোদেলার কানে বাজছে। সে বলল,
‘এভাবে কথা বলছ কেন মামি? তারা এখনও ছোট হাফপ্যান্ট পরে। আর আমি সিঁড়িতে বসে ছিলাম, বিশ্বাস করো।’
পুতুল বেগম ফুঁসে ওঠে বললেন,
‘আমার ঘরে খেয়ে, আমার ঘরে থেকে, আমার সাথে তর্ক অসভ্য মেয়ে কোথাকার।’

হঠাৎ একটা লাঠি রোদেলার দিকে ছুঁড়ে দিল। লাঠিটা চলে গেল উল্টো দিকে। লক্ষ্য ভুল করে আরো রেগে যান তিনি। রান্নাঘর থেকে বের হওয়ার সময় হাতে একটা মোটা লাঠি নিল। বড় বড় চোখে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে রোদেলা। পোষা কুকুরটি পায়ের কাছে লেজ কুঁচকে বসে আছে। রোদেলা চঞ্চল বলল,
‘জোজো। মার খেতে না চাইলে পালা।’

চনমনে রোদ গায়ে মেখে নিয়ে পুকুরের পাশের সরু পথ ধরে হাঁটতে থাকে সেহরিশ। মারিয়া তার ছোট ছোট পাঁচটি আঙুল দিয়ে সেহরিশের শক্ত তর্জনীর ধরে লাফাচ্ছে। মৃদু বাতাসে তার চুল দুলছে, হঠাৎ চোখের পলকে সুঠাম সুদর্শন লোকটি প্রায় লোকেরা ঘিরে ধরল, তার ঠোঁটের কোণে একটি বিরল হাসি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো পোশাক পরা দুই দক্ষ দেহরক্ষী বিশাল বন্দুক নিয়ে সেহরিশের পাশাপাশি হাঁটছে। তারা জনগণকে আটকানোর চেষ্টা করে।

ছবি তুলতে চাইলেও বন্দুক দেখে আর এগিয়ে আসেনি ভক্তরা। গ্রামের প্রবীণরা মুদির দোকানে বসে ভ্রু কুঁচকে। আওয়াজ করে বললেন,
‘কি দিনকাল এসেছে? নিজ এলাকায় বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বুঝলাম না বাপু, মৃত্যুরে এত ভয় পায় ঘর থেকে বের হয় কেন?’

সেহরিশ তাদের কথার জবাব দিল না। দেহরক্ষী দুজনকে কঠোর আদেশে বাড়ি ফিরে যেতে বলে, সেহরিশের আদেশ অমান্য করার সাহস তাদের নেই।

ইতোমধ্যে দেশে এসে গ্রামের বাড়িতে দুদিন কাটিয়েছে সে। আগামীকাল গাজীপুর ফিরবে এবং পরশু ইতালিতে ফিরে যাবে। সেহরিশ বিছানায় বসে পরিকল্পনা করছিল। ঠিক তখনই মারিয়া রুমে ঢুকল। মৃদুস্বরে বলল,
‘চাচু, তুমি আমাকে মজা কিনে দিবা? দাও না, মজা কিনে।’

মারিয়ার কথা ফেলতে পারলো না সেহরিশ। কিন্তু বাইরে যাওয়ার মতো বাড়তি কাপড় নেই তার। বেশিদিন থাকবে না ভেবে দুটো স্যুট নিয়ে এসেছে। দুদিন সেগুলো পরেছে। আজ সকালে ফারিয়া বেগম তার ছেলের স্যুটগুলো ড্রাই ক্লিন করার জন্য দেন। আর একটা ঢিলেঢালা শার্ট ও লুঙ্গি বিছানার পাশে রেখে যান। সেহরিশ তার পোশাকের ব্যাপারে খুবই সচেতন। সে অকারণে তার শরীর দেখাতে পছন্দ করে না। এমনকি মঞ্চে পারফর্ম করার সময়ও কখনো তার অর্ধনগ্ন বক্ষঃ দেখা যায়নি।

মারিয়ার সাথে ঢিলেঢালা শার্ট আর লুঙ্গি পরে আসছে। লুঙ্গির ভাজ দুই হাতে ধরে হাঁটে এতক্ষণ। সেহরিশ ডান হাতে দোকানের জিনিসপত্র দেখিয়ে বলল,
‘তুমি যা নিতে চাও। নাও। চাচ্চু, আজ সব কিনে দেব।’
মারিয়া এগিয়ে যায়। দুই হাতে ও বুকে অনেকগুলো চকলেট আর চিপস নিয়ে দৌড়ে গেল সে। দোকানদার টাকা নিয়ে পেছন ফিরে তাকাল, কিছু ছেলে তখনও দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশের সঙ্গে সেলফি তুলতে চায় তারা। বাংলাদেশে আগমনের খবর গোপন রাখতে চায় সে। এজন্য সেহরিশ তাদেরকে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার ছবি আপলোড করতে নিষেধ করে। তারা ছবি তুলতে পেরেই খুব খুশি হলো। ছবি আপলোড করবে না কথা দিল।

হাঁটতে হাঁটতে সেহরিশ প্রায় পায়ের দিকে লক্ষ্য করছে। তার বারবার মনে হচ্ছে লুঙ্গিটা এই বুঝি খুলে গেলো। সেহরিশ পরিষ্কার চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,
‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আমি এই অদ্ভুত পোশাক পরে রাস্তায় হাঁটছি।’

হঠাৎ এক নারী বাতাসের বেগে দৌড়ে সেহরিশের সাথে ধাক্কা খায় অন্য পথে ছুটে গেল। সেহরিশ মাটিতে পড়ে যেতে নিয়েও সোজা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। দৌড়ে আসা লোকটার দিকে রাগান্বিত তাকালো সে। সেহরিশের ভুরুগুলো শিথিল হয়ে গেল। পোষাক আর খোলা চুল দেখেই বুঝতে পারলো সে মেয়ে। কিন্তু সেহরিশ এভাবে পালানোর কারণ বুঝতে পারছে না। ভদ্রতা বোধ নেই। স্যরি ও বলল না। তখনই পেছন থেকে একটা কুকুর জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠল। সেহরিশ চোখ বড় করে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। কুকুরটি দৌঁড়ে সেহরিশের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং সাথে সাথে তার লুঙ্গির একপাশে কামড় দিয়ে ধরে টানতে লাগল। এই প্রথম কোনো কুকুর তাকে আক্রমণ করেছে। সেহরিশ হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
‘এই কুকুর আমার ইজ্জত ধরে টানছে কেন?’

রাস্তার এই ধারে মানুষ নেই। সেহরিশের আওয়াজ কারো কানে পৌঁছায়নি। সেহরিশের বাম হাতে রুটির প্যাকেট। প্যাকেটটা মাটিতে ফেলে দিল। কুকুরটি হঠাৎ লুঙ্গি ছেড়ে রুটির প্যাকেট মুখে নিয়ে মেয়েটি যেদিকে গেছে সেদিকে দৌড়ে গেল। সেহরিশ তার ডান হাত বুকে রেখে গভীর শ্বাস নিল। একটু পর তার পায়ের দিকে তাকালেই সে চমকে উঠল। কুকুরের টানাটানির কারণে লুঙ্গি ছিঁড়ে গেছে। লুঙ্গির এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যাচ্ছে। সেহরিশ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে রাগ দমানোর চেষ্টা করে।

মারিয়া তার ঘরে ঢুকে দরজা চাপিয়ে দিল। সে চকলেটগুলো বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখল তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এল। কলিংবেলের শব্দ শুনেই দরজা খুলে দিল মায়মুনা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেহরিশকে অবাক দৃষ্টিতে দেখে তার লুঙ্গির দিকে তাকায়। সেহরিশ সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই মায়মুনা লুঙ্গির ছেঁড়া অংশটা বিস্তারিতভাবে লক্ষ্য করার চেষ্টা করল। তারপর শুধল,
‘নতুন লুঙ্গি ছিঁড়লে কেমনে?’
সেহরিশ মুখ ঘুরিয়ে কড়া গলায় বলল,
‘এটা কিভাবে ছিঁড়েছে আর একবার ছিঁড়ে দেখাব?’
মৃদু স্বরে বলল মায়মুনা,
‘থাক, তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। নীলু আপার হাতে আরেকটি লুঙ্গি তোমার জন্য পাঠাচ্ছি।’
সেহরিশ অস্ফুট স্বরে বলল,
‘না। আর লুঙ্গি নয়।’
ফারিয়া বেগম ড্রয়িংরুমে বসে তাসবীহ পাঠ করছেন। সেহরিশের লুঙ্গির দিকে তাকান। দৃঢ় গলায় বললেন,
‘ফাতু, তুই এত বড় হয়েগেছিস, তবু লুঙ্গি ছিঁড়ে ফেলছিস? আমি কত শখ করে এটা তোর জন্য কিনেছিলাম। তুই কি একটু সাবধান থাকতে পারিস না?’

সেহরিশ কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে কড়া গলায় বলল,
‘একটা লুঙ্গি ই তো ছিঁড়েছে। তোমরা এমন রিঅ্যাক্ট করছ কেন? আমি কখনো ইউরোপে লুঙ্গি পরিনি। আজ প্রথম। তোমার খুশির জন্য আমি এটা পরেছি। ছিঁড়ে গেছে বলে এখন এত জেরা করছ। মনে হচ্ছে আমি একজন আসামী আর তোমরা পুলিশ অফিসার।’
সেহরিশ থামল। কিছুক্ষণ পর মায়ের দিকে তাকিয়ে ফের বলল,
‘আমাকে ফাতু বলে ডাকবে না মা। নাম শুনলেই অদ্ভুত লাগে। লোকে শুনে হাসবে।’
ফারিয়া বেগম বিড়বিড় করে বললেন,
‘আমার ছেলে। আমি যা খুশি ডাকব। মানুষের কি?’

.
ভারী চশমার আড়ালে দুটি চোখ তূর্ণ দিকে শান্তভাবে চেয়ে। সাদাফ বলল,
‘তূর্ণ, ভালো হচ্ছে না। দরজা খোল।’

তূর্ণা ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে উচ্ছল ভঙ্গিতে। ড্রয়িং রুমের দক্ষিণ পাশের ঘরটি অন্যান্য কক্ষের চেয়ে বড়, এর সাজসজ্জা ও আসবাবপত্রের বিন্যাসে আকর্ষণীয়। সাদাফ সেই ঘরটা দখল করে নিয়েছে। প্রতিশোধ নিতে সাদাফের ক্রেডিট কার্ড নিয়ে নেয় তূর্ণ এবং সাদাফকে ঘরে তালাবদ্ধ করে।

জানালার ওপাশ থেকে শান্ত গলায় বলল সাদাফ,
‘ভাই, দরজা খোল, আমি তোমার কিছু করব না।’
ঠান্ডা গলায় বলল তূর্ণ,
‘তুই কি আমাকে বোকা ভাবিস? আমি বিশ্বাস করব তোকে, ভুলে ও না।’
সাদাফ রেগে বলল,
‘আমি তোকে ছাড়ব না।’
তুরান হাসে এবং তিরস্কার করে বলল,
‘আগে ধর। আমি এখন শপিং মলে যাব। হাহাহা আমি আজ তোর টাকা দিয়ে শপিং করব।’
সাদাফ রাগী ও উচ্চকিত গলায় বলল,
‘তোর মাথায় গাড়ির ছাদ ভেঙে পরবে।’
তূর্ণ প্রায় চলেই গিয়েছিল। সাদাফের কথাটা শোনা মাত্রই পেছনে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল,
‘শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here