তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন পর্ব ১৮ #জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

0
58

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ১৮

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

ত্রিশা যেনো এক অশরীরী বাণী শুনতে পেলো যে, “ওর মা বড় বিপদে আছে।”

নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে অস্ফূট স্বর বেরিয়ে এলো “মা, মা গো!” !
তারপর চোখ দিয়ে গড়িয়ে এলো লোনা পানি।
ত্রিশার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। বাবা মা’রা যাওয়ার পর ভীষণ ই অসুস্থ হয়েছিলো সে। শ্বসুর বাড়ির মানুষজন অসুস্থ মেয়ে সহ কনকচাপাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তখন শত পরিশ্রম করে, কঠোর শ্রম দিয়ে, সেবা দিয়ে সে নিজের বুকের ধন ত্রিশাকে সুস্থ্য করেছিলো। ত্রিশার এসব মনে হতেই মায়ের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগে ভরে গেলো।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই যে মায়ের কন্ঠস্বর শুনতে পাবে তা কোনোদিন ভাবেনি ও। খুশিতে লাফিয়ে উঠলো মনটা। কিন্তু মা এসব কি বলছে?

” এই মেয়ে এক ন’ষ্টা মেয়ে, দু:শ্চরিত্রা মেয়ে, হেন কোনো ছেলে নেই যার সাথে এ কু’কীর্তি করেনি! একে নিজের মেয়ে বলতেও আমার ঘৃণা হয়। ”

ত্রিশা ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠলো। দ্রুত উঠে বসলো। মায়ের চাঁদ মুখে যেনো অমাবশ্যা নেমেছে। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে, তবুও এই দুটো বাক্য শুনেই ঘেমে নেয়ে গেলো। ত্রিশার চোখে ঘুম কেটে এখন রাজ্যের বিস্ময়!

“মা, এসব বলছে? মাথা ঠিক আছে তো?”

ত্রিশার হোস্টেলের ছোটো কক্ষজুড়ে কনকচাপা সহ প্রায় দশ বারোজন মানুষ। হোস্টেল সুপার, হোস্টেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষিকাসমূহ ও উৎসাহী ছাত্রী জনতা! সবার চোখ একযোগে যেনো ত্রিশাকে গি’লে খাচ্ছে!

ত্রিশা চেঁচিয়ে উঠলো,

” মা, তুমি এসব কি বলছো?”

কনকচাপার কন্ঠে উত্তেজনা ও কান্না ঢেকে রাখার প্রয়াস,

” হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি, নিজের মেয়ের নামে কেউ মিথ্যে বলে? আমার মেয়ে এটা দারুন বদ! আমার কোন পাপের শাস্তি যে আমার এই মেয়ে, তা উপরওয়ালাই জানে, হোস্টেল সুপার ম্যাডাম আপনি দয়া করে এই হোস্টেল থেকে বিদায় দিয়ে দিন, এ এই হোস্টেলে থাকলে অন্য মেয়েদেরও নিজের মতোই ফাজিল, বেয়াদব আর দুশ্চরিত্রা বানিয়ে দেবে!”

ত্রিশা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে! চোখ ফেটে অশ্রুধারা ছিটকে পড়ছে।

হোস্টেল সুপার ক্ষাণিকক্ষণ চুপ থেকে বললো,

” ম্যাডাম কনকচাপা, আপনি বললেই তো আর হলো না? আপনার সব কথাই প্রমাণসাপেক্ষ? আপনি যা বলছেন তার পক্ষে কোনো প্রমাণ আছে?”

কনকচাপা দ্রুত তার হ্যান্ডব্যাগ হতে কয়েকটা ফটোগ্রাফ বের করে হোস্টেল সুপার সহ উপস্থিত শিক্ষিকাদের হাতে তুলে দিলো সাথে উপস্থিত ছাত্রীদের হাতেও। সবাই একযোগে সব ফটো দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেলো।

এদিকে কনকচাপা বলতে লাগলো,

” নিজের মেয়ের নামে কেউ মিথ্যে বলে? নিজের মেয়ের নামে কেউ কুৎসা রটায়? আমি যা বলছি, সবই সত্য! একবিন্দুও মিথ্যে নয় এসব! ”

কথাটা বলতেই কনকচাপার গলা ধরে এলো।
ত্রিশা যেনো কি বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে ছুটে এসে ওর মা’কে দু হাতে দুই কাঁধ ধরে জোরে জোরে ঝাঁকিয়ে বললো,
” মা, তুমি কি পা’গল হয়ে গেছো? তুমি জানো তুমি কি বলছো? তুমি আমার নামে মিথ্যে বলছো কেনো? তুমি কি আমাকে গর্ভে ধরোনি? তুমি কি আমার মা না? আমার নামে এত বড় অপবাদ তুমি কেনো দিচ্ছো?”

কনকচাপা চুপ হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। চোখে মুখে বিষন্নতা, ক্লান্তি, অপরগতা আর দু:সহ যন্ত্রণা।

ত্রিশা তারপর আবার হোস্টেল সুপার ও শিক্ষিকাদের উদ্দ্যেশ্যে বলা শুরু করলো,

” বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, এগুলো একটা চক্রান্ত, আমাকে মানুষের সামনে হেয় করার চক্রান্ত, এ সব জহির শেখের কাজ, আমার মা এ সব জহির শেখের কথায় করছে! আমাকে এসব জালে ফেলে নিজেদের উদ্দ্যেশ্যে হাসিলের চক্রান্ত করছে তারা!”

উপস্থিত শিক্ষিকাবৃন্দ ও ছাত্রীরা সব ছবি দেখে ত্রিশার উপর যেনো ঘৃণার বর্ষণ শুরু করলো।
হোস্টেল সুপার বলে উঠলো,

” ত্রিশা, প্রমাণ এখন চাক্ষুষ, একাধিক ছেলের সাথে এরকম নোংরামীর ছবি দেখেও তোমাকে বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ ই নেই! তোমাকে আমরা আর আমাদের হোস্টেলে রাখতে পারছি না, এক ঘন্টার মধ্যে তোমাকে হোস্টেল ত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছি। তুমি তোমার ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ নিয়ে এক ঘন্টার মধ্যেই এখান থেকে চলে যাও প্লিজ”

ত্রিশা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো।

হোস্টেলের ছাত্রীরা যারা যারা ত্রিশার ছবিগুলো দেখেছে আর যেনো তাদের মধ্যে এক ধরনের নোংরা উৎসব শুরু হলো। তাদের মধ্যে দ্রুত কয়েকজন নিজেদের মোবাইল ফোনে এসবের ছবিও তুলে নিলো। যে যার মতো নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবিগুলো ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে গেলো তারা।

এমন সময় কনকচাপার ফোনে কল এলো, সে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

“হ্যালো, কাজ প্রায় শেষ!”

তারপর ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে কি জানি নির্দেশ এলো, আর কনকচাপা সবটা শুনে ফোন রেখে দিয়েই আবার ছবিগুলো নিয়েই ছুটলো কলেজের প্রিন্সিপালের নিকট।

ত্রিশার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। কার কাছে কি সাহায্য চাইবে সে? কাকেই বা এসব বলবে? নিজের মা ই যখন বিপক্ষে বলছে, তখন কার সাধ্যি ওকে এখান থেকে বাঁচানোর? মিথ্যে কলঙ্কের চেয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করাই যেনো শ্রেয়!

কনকচাপা দ্রুত ছুটলো প্রিন্সিপালের উদ্দ্যেশ্যে। তাকে যেনো এক কালো যাদু ভর করেছে। এই কালো যাদুর দ্বারা নিজের গর্ভজাত মেয়েকেই সে ভষ্ম করে ছাড়বে। এখন টার্গেট প্রিন্সিপালকে ছবিগুলো দেখিয়ে ত্রিশাকে কলেজ থেকে বের করে আনা।

প্রিন্সিপাল ছবিগুলো দেখেই চটে গেলো।

” এখন মেয়েটার পরীক্ষার আর আছে মাত্র তিন মাস, আর এখন আপনি আমাকে মেয়েটাকে চরিত্রের সার্টিফিকেট দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দিতে বলছেন? হোয়াট টাইপ অব মাদার ইউ আর?”

কনকচাপা চুপ থাকলো। সত্যিই কেমন ধরনের মা সে? কনকচাপার মাথাটা নিম্নদিকে স্থিত হলো।

প্রিন্সিপাল বলেই চললেন,

“লিসেন মিসেস শেখ, চাক্ষুষ কোনো প্রমাণ ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারবো না, আপনি যা দেখাচ্ছেন সবই সেকেন্ডারি ডেটা, উই নিড প্রাইমারি ডেটা, তাছাড়া মেয়েটা যদি কোনো ভায়োলেন্স করতো, তাহলে আমরা ওকে সাসপেন্ড করতে পারতাম, কিন্তু একটা মেরিটেরিয়াস স্টুডেন্টকে পরীক্ষার আগে এসব করে আমরা নিজেদের সম্মান নিজেরাই নষ্ট করতে পারবো না। ”

প্রিন্সিপালের কথায় কনকচাপা নিজের কান্না লুকানোর চেষ্ঠা করলো। কিন্তু তাকে যেনো শক্ত হওয়ার কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে তাকে যেনো ত্রিশার এক বলিষ্ঠ শত্রুর ভূমিকায় লড়তে হবে। সাথে সাথেই আবার ফোন এলো তার ফোনে। ফোন করে সব শুনাতেই কয়েক মিনিট পর জহির শেখ কলেজে নেমে এলো। সাথে ববিতা শেখ এবং আরো কয়েকজন চ্যালা প্যালা।

সবাই আসার পরে প্রিন্সিপালের রুমে টিচার্স রুম হতে সব টিচারকে একত্রে ডেকে এনে বসানো হলো। যেনো কোনো মুভি দেখানো হবে। প্রসঙ্গত সকল শিক্ষকদের সাথে আহনাফও সেখানে ছিলো।

প্রথমত আহনাফ তার অন্যান্য কলিগদের অনুসরনে প্রিন্সিপাল রুমে ঢুকে গেলো। তারপর যা দেখানো হলো জায়ান্ট স্কিনে তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
জায়ান্ট স্কিনে ত্রিশার সাথে একাধিক পুরুষের মেলামেশার ভিডিও বেরিয়ে এলো।

সবার কি প্রতিক্রিয়া তা জানার আগেই আহনাফ অবজেকশন করলো,

” হোয়াট দ্যা হেল! স্টপ দিস ফানি ভিডিও! এই ভিডিও ফুললি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স জেনারেটেড! মিস্টার জহির আপনি কি নিজে অন্ধ? নাকি অন্ধের দেশে বাস করেন? এটা যে একটা এ আই জেনারেটেন ভিডিও তা যে কেউ দেখে বলে দিতে পারবে”

সাথে সাথে অন্য শিক্ষকরাও আঙ্গুল তুললো,

” আহনাফ ইজ রাইট! আপনারা বাবা মা হয়েও এসেছেন মেয়ের ফিউচার বরবাদ করতে? বাবা না হয় প্রকৃত নয়, তবে মা? এ কেমন মা? ”

“প্রকৃত বাবা নয়! এত বড় অপমান!” জহির রা’গে গরগর করতে লাগলো।

এমন সময় সামনে এগিয়ে এলো এক যুবক। বেশ বলিষ্ঠভাবে সে বলে উঠলো,

” এই মেয়ে আমাকেও ঠকিয়েছে, আমার সাথে মিথ্যে প্রেমের নাটক করেছে, আমার মন ভেঙ্গেছে”

যুবকের বলার ধরণ দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলো।

সাথে সাথে আরো দুজন মানুষ এসে বলা শুরু করলো,

” আমাদের সাথেও ও খা’ রাপ সম্পর্ক করার প্রস্তাব দিয়েছিলো!”

ওই দু জন আর কেউ নয়, বরং ইন্দু ও বিন্দুর স্বামী পাভেল ও নয়ন।

আহনাফ তাদেরকে ভালো করেই চেনে, ঘৃণায় আহনাফের গা গুলিয়ে এলো!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here