#আশিয়ানা
#পর্ব_১৩
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
নির্মল প্রকৃতি আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে পাশাপাশি বসে আছে সাদাফ ও উমাইয়া। সূর্যের কিরণে চারপাশে বিচরণ করছে সোনালী আভা। ফাল্গুনের পাতাঝরা গাছের ডালে ডালে ফুলের অপূর্ব উন্মাদনা। পত্রশূন্য শাখায় থোকা থোকা রক্তপলাশে ভরে ওঠেছে, তেমনি ঝরা ফুলে ভরে আছে গাছের তলা। টকটকে উজ্জ্বল লাল থোকা ধরা ফুলের ডালে বসা বুলবুলি ও শালিক কিচিরমিচির শব্দে অনবরত ডাকতে লাগল। উমাইয়া ইতস্তত করে শুধাল,
‘ আপনি আজও নার্সারিতে কি শুধু চারাগাছ নিতে এসেছেন?’
সাদাফ মৃদু গলায় বলল,
‘ উঁহু না, আপনাকে দেখতে এসেছি।’
উমাইয়া বার দুয়েক চোখের পলক ফেলে আসক্তিহীন ভাবে তাকাল সাদাফের দিকে। সাদাফ কয়েক পলক চেয়ে সৃষ্টি নামিয়ে ফেলল, সরু গলায় বলল,
‘ এভাবে তাকাবেন না, প্লিজ।’
উমাইয়া অস্ফুটে শুধাল,
‘ হুম? কোনভাবে?’
‘ যেভাবে একটু আগে তাকালেন।’
‘ আমি তো স্বাভাবিক ভাবেই তাকালাম।’
সাদাফ কিয়ৎক্ষণ মৌন থাকল। তারপর বলল,
‘ আমার কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে।’
‘ আমার মনে হচ্ছে, আপনি আমাকে ফলো করছেন।’
‘ যদিও ফলো করি তাহলে দোষ কোথায়?’
উমাইয়া নড়েচড়ে উঠল, শুঁকনো ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে খানিক ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
‘ দোষ রয়েছে। একজন অবিবাহিত মেয়ের পিছন পিছন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে ঘুরঘুর করলে অবশ্যই সেটা দোষের।’
সাদাফ ভ্রু উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। মাটি থেকে ঘাস তুলতে তুলতে বলল,
‘ আমি তো বলেছি বিয়ের কথা। আপনার চরিত্রে কলঙ্কের দাগ লাগতে দেওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আমি আপনাকে সরাসরি বিয়ে করতে চাই।’
উমাইয়া উঠে দাঁড়াল, কয়েক কদম পা এগিয়ে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। পিছন দিকে ঘুরে তাকাল সে, অকপটে বলল,
‘ সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এখনও বসে থাকবেন?’
সাদাফ ওঠে উমাইয়ার দিকে পা বাড়াল। সাদাফ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে নিমিষ তাকিয়ে উমাইয়াকে জিজ্ঞেস করল,
‘ মিস উমাইয়া, আপনি কবে আমার প্রেমে পরবেন?’
হতভম্বিত উমাইয়া হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। চোখ ছোটছোট করে তাকিয়ে। কপালে ভাজ, শিথিল কণ্ঠে সে শুধাল,
‘ আপনি আমায় কেন ভালবাসেন? যেখানে আমার চেয়ে অধিকতর সুন্দর নারী এদেশে রয়েছে।’
সাদাফ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল উমাইয়ার ওপর। উমাইয়া এমন কোনো প্রশ্ন করতে পারে যেন তার ধারণার বাইরে ছিল। সাদাফের চোখেমুখে এখন চিন্তার ছাপ, গম্ভীর গলায় বলল,
‘ এমন নয় আমি আপনার চেয়ে সুন্দর বা লাবণ্যময়ী নারী আগে দেখিনি। কিন্তু আপনাকে দেখার পর মনের ভেতর সুপ্ত উন্মাদনা তৈরি হয়। সে উন্মাদনা থেকেই আপনার নার্সারিতে পরপর তিনবার এসেছি। আমি যখনই চেয়েছি আপনার মতোই একজনকে চেয়েছি। সাধারণ কিন্তু অতুলনীয়। যার চোখে আমি অনান্য মানুষের মত হবো। যে আমাকে আগে থেকে চিনবে না হুট করে পরিচয় হবে। আপনিই সেই মানুষ যে আমাকে আর দশটা মানুষের মতোই ভাবেন। তাই হয়তো এমন অনুভব হয়।’
উমাইয়ার কপালে ভাজ পড়ল। নিগূঢ় অস্পষ্ট কণ্ঠে শুধাল,
‘ আমিই কেনো?’
সাদাফের সহজ স্বীকারোক্তি,
‘ ভালোবাসা সম্পূর্ণ মনের ওপর নির্ভর উমা। কার জীবনে কখন আসবে? কিভাবে আসবে? কাকে দেখে ভালোবাসা জেগে উঠবে? এটা শুধু মন নির্ধারণ করে। মানুষ নয়।’
উমাইয়া আশ্বস্ত আওয়াজ বলল,
‘ আপনি কি করেন? চাকবি বা বেকার? স্যরি, বেকার বলেছি বলে কিছু মনে করবেন না। এক সপ্তাহে আপনাকে কাজে জন্য যেতে দেখিনি।’
বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সাদাফ। উমাইয়ার নির্লিপ্ত চাহনি সাদাফের মাথায় গিয়ে লাগল। সাদাফ দু কদম এগিয়ে গেল, উমাইয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। বিস্ময়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল উমাইয়া। সাদাফ তার বৃদ্ধা আঙ্গুলটি উমাইয়ার ঠোঁটে ছোঁয়ালো। উমাইয়ার কপালের সঙ্গে সাদাফ তার কপাল ঠেকিয়ে নিমিষ স্বরে বলল,
‘ চিন্তা করবেন না উমা। আপনার সমস্ত ভরণপোষণের সামর্থ্য এই অধমের রয়েছে।’
উমাইয়ার অস্থিরতা ক্রমশ বাড়তে লাগল। তার চোখজোড়া সাদাফের মুখপানে অপলক ভাবে মেলে ধরল। সাদাফ দু কদম এগিয়ে গেল, উমাইয়া চার কদম পিছিয়ে গিয়ে ফ্যাচফ্যাচ স্বরে বলল,
‘ আমার কাছে আসবেন না মিস্টার সাদাফ কসাই।’
উমাইয়া চক্ষু যুগল ছোট ছোট করে সাদাফকে দেখল। সাদাফ বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল। উমাইয়ার কথা শুনে সাদাফের রাগ উঠল। কপট রাগ দেখিয়ে কোনো কথা না বলে ধপধপ পা একটু এগিয়ে গেল সাদাফ। উমাইয়া ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল সাদাফের দিকে। সহসা সাদাফ এসে উমাইয়ার সামনা-সামনি দাঁড়াল গেল।
আচমকা দাঁড়িয়ে গেল সাদাফ। ঘুরে এসে
আচমকা সাদাফ দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর ঘুরে এসে উমাইয়ার সামনা-সামনি দাঁড়াল। কোনো কিছুর অপেক্ষা না করে উমাইয়ার হাত ধরে রেখে অভিযোগ বিহীন বলল,
‘ আমার নাম, সাদাফ কাসানো। কসাই না।’
উমাইয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। বলল,
‘ একই হলো।’
সাদাফ ঠোঁট জোড়া চেপে রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ যেমন বাপ তেমন বেটি।’
‘ দেখো কি দিনকাল আইছে? মাইয়ারা রাস্তায় দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ছেলেদের সঙ্গে প্রেম পিরীতি করে। পরিবারের শিক্ষা নাই। বাপ মা এমন মেয়েদের রাস্তায় ছাইড়া দিয়া রাখছে।’
রাস্তার সাইডে উমাইয়া ও সাদাফকে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন বয়স্ক লোক তার পাশে দাঁড়ানো এক মহিলাকে বললেন। মহিলাটি একবার তাকালেন।
ছোট্ট করে বললেন,
‘ ওরা জামাই বউও তো হইতে পারে।’
লোকটা খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন। বললেন,
‘ তুমি এই সব বিষয়ে কিছু জানো না। থাকো তো সারাদিন ঘরের ভেতর। আমি রোজই এইসব দেখি। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নাই। বুঝছ?’
লোকটার কথা স্পষ্ট শুনতে পেল উমাইয়া। তাদের কটুবাক্য শুনে উমাইয়া দ্রুত প্রস্থান করে। ধীরেধীরে অন্ধকারে বিলীন হচ্ছে উমাইয়া। নিকষকালো রঙে মিলিয়ে যাচ্ছে সে। চোখ বুজে ফোঁস করে হতাশার দীর্ঘ শ্বাস ফেলল সাদাফ। বিরবির করে বলল,
‘ আপনি কী আমার ছটফটানি কখনোই বুঝবেন না উমা?’
_____________
রাতের নিস্তব্ধতায় হেঁটে যেতে লাগল তূর্ণ। একটু দূরে দেখা যায় ল্যাম্পপোস্টের আলো। অধরকোণে মোহনীয় হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গেল সে। একহাত প্যান্টের পকেটে স্থায়ীভাবে রেখে অন্য হাতের ছোট একটা ব্যাগ জুবিয়ার দিকে এগিয়ে দিল। জুবিয়া একবার ব্যাগের দিকে তাকাল পরোক্ষণে তূর্ণর দিকে আগ্রহী মনে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘ এটা কী?’
তূর্ণ ঝুঁকে এলো। জুবিয়ার হাত ধরে ব্যাগটা জুবিয়ার হাতে গুঁজে দিল। তূর্ণ জুবিয়ার পাশাপাশি দাঁড়াল। দৃষ্টি রাখল জুবিয়ার মুখমণ্ডলে।
উত্তর দিল, ‘ তোমার জন্য ছোট্ট উপহার।’
জুবিয়া সরাসরি তাকাল তূর্ণর দিকে। জানতে চাইলো,
‘ আমার জন্য? কিসের গিফট?’
জুবিয়া একহাতে ব্যাগটা ধরে অন্য হাতে খুলতে নিল। সে মূহুর্তে তূর্ণ একটি হাত জুবিয়ার হাতের উপর রেখে অদ্ভুত চোখমুখ করে ফিচলে কণ্ঠে বলল,
‘ এখন না। ছোট্ট একটা জিনিস। ব্যাগে ভরে রাখ। বাড়ি গিয়ে একা দেখ।’
জুবিয়ার কথা বলা থেমে গেল। সে ত্রস্তভাবে কাঁধের ব্যাগটার চেইন খুলে বক্সটা রেখে দিল। আশেপাশে গাছ গাছালি নেই। মৃদু বাতাস বইছে সেটাও কেমন যেন মিলিয়ে যায়। ঠিক গা পর্যন্ত পৌঁছায় না। জুবিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াল। উদাসীনভাবে চুলে খোঁপা করতে লাগল। তূর্ণ খেয়াল করে, মুখ থেকে মাস্কটা খানিক সরিয়ে নিশ্চল আওয়াজে বলল, ‘ থাক না এভাবেই। খোলা চুলে তোমায় বেশ লাগছে আজ।’
রান্নাঘর থেকে কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল রোদেলা। দরজা খুলে জুবিয়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এক হাতখানা কোমরে রেখে শক্ত গলায় বলল,
‘ এতক্ষণে আসার সময় হলো? ক’টা বাজে দেখছিস? আরেকজন কোই?’
জুবিয়া কাঁধের ব্যাগ সোফায় রেখে ধপ করে বসে পড়ল। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে রোদেলাকে জিজ্ঞেস করল,
‘ উমাইয়া বাসায় আসেনি?’
‘ না।’
জুবিয়া হঠাৎ ওঠে বসল। চমকায়িত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ ও সকালে আমাকে বাজারে রেখে গায়েব হয়ে গেছিল। বলেছিল তোকে সাথে নিয়ে নার্সারি যাবে।’
রোদেলা চুলায় রান্না বসিয়েছে। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,
‘ ওর সাথে আমার একবারও কথা হয়নি।’
জুবিয়া ব্যাগ থেকে বাটন ফোনটি বের করে। উমাইয়ার নাম্বারে কল লাগাল। একটি বাক্য শ্রবণকেন্দ্র এসে পৌঁছাল,
‘ আপনার কাঙ্খিত নাম্বার টিতে এই মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
রোদেলা বিস্মিত গলায় বলল,
‘ ওর কোনো বিপদ হয়নি তো?’
জুবিয়া সোফা থেকে ওঠে দাঁড়াল। রোদেলার কপালে তর্জনী আঙুল ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
‘ হয়তো ওর ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। তুই চিন্তা করিস না। একটু পরেই চলে আসবে।’
চলবে….