আশিয়ানা শারমিন আক্তার বর্ষা (২)

0
292

#আশিয়ানা
শারমিন আক্তার বর্ষা
(২)
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সাদাফের টি-শার্ট, ঘামে ভেজা, পিঠের সঙ্গে ল্যাপ্টে আছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে সাদাফ নিচতলার ঘরে আসে। সূর্যের আলো আছড়ে ঘরের মেঝেতে পরছে। সাদাফ সামনের দিকে এগিয়ে এসে এক হাতে জানালার পর্দা লাগিয়ে দিল এরপর ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে সোফায় বসল। সে চোখ বন্ধ করে মাথাটা পেছনে ঝুঁকলো। নতুন অ্যালবামের গান প্রকাশের জন্য দুই দিন ধরে প্রাকটিস করছে তারা। এজন্য সাদাফের শরীর দুর্বল হয়ে গেছে, হাঁটার শক্তি নেই। সোফা থেকে উঠে বিছানায় যাওয়ার শক্তিটুকু পাচ্ছে না। মিনিট পাঁচেক পর তূর্ণ এলো। কিছু না বলে অন্ধকার ঘরের সব আলো জ্বালিয়ে দিল। সাদাফ একটু বিরক্তিতে ভ্রুকুটি করল। সাদাফ বিরক্ত গলায় বলল, ‘তূর্ণ এই সময়ে আমাকে বিরক্ত করলে খুব খারাপ হবে।’

তূর্ণ খুব ক্লান্ত। পিপাসায় কাতর। সে হেঁটে সাদাফের পাশে বসল। সে এক হাতে সেন্টার টেবিলের পানির বোতলটা তুলে নিল। শুঁকনো গলা ভিজিয়ে সোফায় হেলান দিল। সাদাফকে অস্থির লাগছে। তার ডান হাত দিয়ে সে তার শার্টের কলার উপরের তিনটি বোতাম খুলে ফেলল। তূর্ণ অবাক হয়ে সাদাফের দিকে তাকাল। সে হঠাৎ সোফা থেকে উঠে দাড়াল এবং উচ্চস্বরে বলল, ‘ছি, তোর কি লজ্জা লাগে না?’
সাদাফের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে তূর্ণর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘কেন লজ্জা পাব?’
হতবাক গলায় তূর্ণ বলল,
‘তোমার শরীর আছে বলে সবাইকে দেখাতে হবে?’
‘সবাইকে কোথায় দেখালাম?’ পাতলা কণ্ঠে শুধল সাদাফ।
তূর্ণা সাদাফের চিবুক বরাবর তার তর্জনী চালিয়ে বলল,
‘দেখানোর জন্য বাটন খুলছিস।’
সাদাফ বিরক্তি প্রকাশ করে কড়া গলায় বলল,
‘আমার অস্বস্তি লাগছিল তাই খুললাম। স্টুপিট।’

সেহরিশ একটা ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে রেস্ট রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তূর্ণ ও সাদাফের নির্লিপ্ত অবস্থা দেখে তার ভ্রুকুটি কুঁচকে গেল। দরজার সামনে থেকে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ আমি তোদের সাথে রাতের খাবারের প্ল্যান করেছি। রাত আটটায় রেডি থাকবি। একসাথে বের হব।’

তূর্ণর মনে হল তার শরীরের শক্তি ফিরে এসেছে। হঠাৎ ছুটে এসে সেহরিশের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। সেহরিশের হাত শক্ত করে ধরে তূর্ণ খুশিতে বলল, ‘আমি ডিনারের জন্য কি স্যুট পরব?’
সেহরিশ সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। তূর্ণ কথার জবাবে সে বলল, ‘ তোর যা ভালো লাগে।’

সকাল থেকেই সাদাফের পিঠে ব্যথা হচ্ছিল। ড্যান্স প্রাকটিস শেষে সাদাফ বিকেলে বাসায় এসে ডাক্তার নাজ-নে কে বাসায় আসতে বলে। ডাক্তার নাজ-নে বাড়িতে এসে সাদাফের কিছু চেক-আপ করেছেন। আর বললেন, শরীরে চাপ কম দিতে। আপাতত কিছু ওষুধ দিলেন এবং বললেন পর্যাপ্ত ঘুমানোর কথা। ওষুধ খাওয়ার পর সাদাফের পিঠের ব্যথা কিছুটা কমেছে। সে এখন স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছে। বাড়িতে একা একা বিরক্ত লাগছে তার। কয়েকটি শব্দের সমন্বয়ে একটি গান লেখার কথা ভাবল সাদাফ। একটা পোর্টেবল টেবিল নিয়ে বিছানায় বসল। মেরুদন্ড টানটান করে একটা চমৎকার গান লিখতে লাগল।

সন্ধ্যা 7:30 মিনিট। দীর্ঘক্ষণ ধরে একই ভাবে বসে থেকে সাদাফের পিঠে ব্যথা করছে। হালকা ব্যায়াম করে শরীরের অসাড়তা দূর করল। এরপর বিছানায় ফোনটা নিয়ে টাইম চেক করল। অল্প সময় আছে মাত্র। তাই তাড়াতাড়ি তৈরি হতে ওয়াশরুমে ঢুকল।

বিশ্বের সেরা রেস্তোরাঁ হল ইতালির অস্টেরিয়া ফ্রান্সসকানা। ছিমছাম পরিবেশ, বেশ মোহনীয়। সেহরিশ, সাদাফ ও তূর্ণ আজকের ভিআইপি অতিথি। তাদের আগমনের বার্তা রেস্টুরেন্ট মালিক ও শেফ ছাড়া কেউ জানে না। টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা স্বাদের খাবার। একজন পুরুষ কর্মী তার পরিবেশনের দক্ষতায় তূর্ণর মন জয় করে নিল। সাদাফ নরম গলায় বলল, ‘পছন্দ হয়েছে? আমি কি কথা বলব?’

তূর্ণ এক হাতে ছুরিটা টেবিলে ধরে সাদাফের মুখের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল। তূর্ণর তীক্ষ্ণ চেহারা বলছে সাদাফের বুকে ছুরিটা সেঁটে দিতে চায় সে। তূর্ণ বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলল,
‘আমি সমকামী নই।’

তূর্ণ আর সাদাফের কথোপকথন শোনার সাথে সাথে সেহরিশ অদ্ভুতভাবে মাথা তুলে তূর্ণর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর গম্ভীর গলায় বলল, ‘ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, আমি তোদের বলতে ভুলে গেছি।”

তূর্ণ কৌতূহল নিয়ে সেহরিশের দিকে তাকাল।
সেহরিশ শান্ত গলায় বলল,
‘ দুই সপ্তাহ পর ২৪শে ফেব্রুয়ারি। দ্য আর্টিস্ট অফ দ্য ইয়ার ২০১৭ অ্যাওয়ার্ড শো ফেয়ারমন্ট সেঞ্চুরি প্লাজা হোটেলে অনুষ্ঠিত হবে। ২২ ফেব্রুয়ারি আমাদের যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে।’
অবাক হয়ে বলল সাদাফ,
‘তালিকায় আমাদের নাম থাকবে?’
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘হুম। গতকাল রাতে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে।’

দুই দিন পর। দুপুরের পর সূর্য পশ্চিমে চলে যায়। আকাশে ছুটেছে মেঘ ও মিষ্টি রোদের ঝলকানি। দিন শেষে পুড়ন্ত বিকেল উপভোগ করতে বারান্দায় এলো আরুশি। সে চায়ের কাপটি রেলিংয়ে রাখল এবং অপলক দৃষ্টিতে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রইল। পরিবার ছাড়া অন্য কিছু যদি তাকে কাছে টানে, তা হলো প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা। ঘড়িতে সময় ৫:৫০মিনিট। ফারিয়া বেগম ফোন হাতে আরুশির ঘরে ছুটে যান। মেয়েকে খুঁজতে বারান্দায় আসেন ফারিয়া। চেয়ার টেনে আরুশির পাশে বসলেন তিনি। এরপর তার স্মার্টফোনটি আরুশির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘ফোন ধর। তোর ভাইকে ফোন দে।’
‘মা, তুমি নিজেও তো কল দিতে পারো। প্রতিবার ফোন নিয়ে আমার কাছে ছুটে আসো কেন?’ রূঢ় গলায় জিজ্ঞেস করল আরুশি। ফারিয়া কোন উত্তর দিল না। ফোনটা আরেকটু একটু এগিয়ে দিল।

ইতালিতে এখন দুপুর। সময় ১২:৫০মিনিট। বাড়ির উত্তর দিকে একটা বিশাল গাছ। গাছের ডালে বসা দু’টি পাখি। বার বার জানালার দিকে উঁকি দিচ্ছে, জানালা বন্ধ।

আরুশি কল দিয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। সেহরিশ বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। বালিশের নিচে ফোন বাজছে। বিরক্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিনে নাম না দেখেই কল রিসিভ করল সে। হঠাৎ মায়ের কন্ঠস্বর কানের পর্দায় এসে পৌছাল। ফারিয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছিস বাবা?’
সেহরিশ অন্য হাত দিয়ে কানের লতি চুলকে বলল, ‘ভালো মা, তুমি কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো, বাবা।’ ফারিয়া কিছুক্ষণ থেমে বিস্মিত গলায় বললেন, ‘তোকে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ফোন করেছি।’
‘ হ্যাঁ, বলো।’

‘আরুশির বিয়ে নিয়ে বাড়িতে আলোচনা চলছে। বর তোর বাবার বন্ধুর ছেলে, নাম অনিক। শুনেছি খুব ভালো ছেলে। অনিকের সঙ্গে আরুশিকে বিয়ে দিতে চায় তোর বাবা। আগামী সপ্তাহে ওঁরা আরুশিকে দেখতে আসবেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে মাসখানেক পর বিয়ে দিবেন। আমরা সবাই চাই তুই বিয়ে উপলক্ষে দেশে আয়। আসবি বাবা?’

অনেকক্ষণ পর সেহরিশের উত্তর এলো। থমথমে সুরে বলল,
‘এটা সম্ভব হবে না, মা। অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে যেতে হবে আমেরিকায়। তোমরা যা ভাল মনে করো তাই করো। আমাকে এর মধ্যে টেনে আনবে না।’

ফারিয়া জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটা কেটে দিল। হুইলচেয়ারের আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই উঠে দাঁড়ান। তিনি পিছন ফিরে দেখলেন শফিকুল চৌধুরী দুই হাতে হুইল চেয়ারের চাকা ঠেলে এদিক আসছেন। সেহরিশ আসবে না, এই কথাটা তার স্বামী শফিকুলের কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে ফারিয়া। স্ত্রীর মুখ দেখে শফিকুল বুঝতে পারল ছেলে আসবে না, সরাসরি না করেছে। তার কষ্ট হবে ভেবে ফারিয়া তার কাছ থেকে লুকানোর চেষ্টা করছে। শফিকুল চৌধুরী প্রায় স্ত্রীকে পাশে বসিয়ে বলতেন, ‘শোন তুমি একজন সৈনিকের স্ত্রী। তোমাকে বুঝতে হবে যে একজন সৈনিকের চোখ এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।’

শফিকুল চৌধুরী সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ১৬ বছর আগে ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলায় তিনি পঙ্গু হয়েন।
শফিকুল চৌধুরী তার জীবনের ষোলটি বছর হুইল চেয়ারকে দিয়েছিলেন। এখন চেয়ারটা তার শরীরের সাথে মিশে গেছে যেন।

২০০২ সাল। মুচিপাড়া এলাকায় সরকারি জমিতে এক মাসের জন্য সেনা ক্যাম্প শুরু হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবক-বৃদ্ধ সবাই সেনাবাহিনী দেখতে আসেন। গ্রামগঞ্জের ছেলেরা মানুষের মুখে আর্মি নাম শুনেছে, নিজের চোখে দেখতে আসছে আর্মি আসলে কেমন। গ্রামপ্রধান আসাদুজ্জামান পলাশ এক কিলোমিটার দূর থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আর্মি ক্যাম্প পরিচালনা করবেন লতিফ রহমান, আসাদুজ্জামানকে আসতে দেখে তিনি শফিকুল চৌধুরীর হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে এগিয়ে যান।

আসাদুজ্জামান মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
‘এখানে ক্যাম্প করতে আপনার কোন সমস্যা হয়নি তো?’
লতিফ রহমান বললেন,
‘আমাদের কোনো সমস্যা হয় নি। আমরা বরং ক্যাম্প করার জন্য এমন একটি খালি জায়গা খুঁজছিলাম। আর একটু খেয়াল রাখবেন ট্রেনিং শুরু হওয়ার পর ছোট বাচ্চারা যেন এদিকে না আসে।’
আসাদুজ্জামান বললেন,
‘চিন্তা করবেন না। এই মাঠের পর বিশাল জঙ্গল, ভূতের ভয়ে এখানে শিশুরা আসে না। আপনি মনের শান্তি সঙ্গে প্রশিক্ষণ করাতে পারেন।’

তখন সকাল ছয়টা। বন্য পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ কানে বাজতে লাগল। দেড়শ সৈন্য হাতে বন্দুক নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল সকাল লতিফ রহমান সব সৈন্য নিয়ে কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শনে বের হন। সৈন্যদের পায়ের থপথপ আওয়াজে লোকজন ঘরে থেকে বেরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে, লতিফ রহমান লাইনে সবার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁটছেন। মুখের কাছে মাইক নিয়ে কথা বলছেন তিনি। সৈন্যদের পেছন পেছন হাঁটতে থাকে বেশ কিছু ছোট বাচ্চা। শফিকুল শিশুদের পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, শিশুরাও তাদের মতো হাঁটতে চেষ্টা করছে। শফিকুল কুটিল হেসে বললেন,
‘এই বাচ্চারা, দুষ্টুমি করো না। বাড়ি যাও। যদি তোমরা আমাদের পিছনে আসো, আমি তোমাদের বেঁধে নিয়ে যাব।’
হঠাৎ বাচ্চাদের পা থেমে গেল। তারা বাড়ির দিকে ছুটে গেল। শফিকুল নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

এক সপ্তাহ পর। গভীর রাত। গ্রামগঞ্জে মানুষ সন্ধ্যার পর ঘুমাতে যায় এবং ফজরের আযান হলে উঠে যায়। রাস্তায় কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে, দূর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। শিবিরের চারপাশে মশাল জ্বলছে। সৈন্যরা খুব ক্লান্ত। বেশিরভাগ সৈন্য মাটিতে চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শফিকুল সহ আরও দুইজন আর্মি ক্যাম্পের মাঝখানে বসে নিজেদের বাড়ির কথা বলছে। শফিকুল বললেন, ‘আমার ছোট ভাই রফিক তার পরিবারের সাথে ইতালির রোমে থাকে। সেখানে একটি কোম্পানিতে চাকরি করে। ওদের কোন সন্তান নাই। আমার ছোট ছেলে পড়ালেখায় খুব ভালো হওয়ায় রফিক তাকে ইতালি নিয়ে যায়। ছেলেকে জোর করে বিদেশে পাঠানোর জন্য আমার উপর খুব রেগে আছে। ইতালি গেছে এক বছর হয়ে গেল, ছেলের অভিমান কমেনি। সে আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।’

তারা শফিকুলের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। একজন বললেন, ‘ছোট ছেলেটার বয়স কত ভাই?’
‘ এখন চৌদ্দ বছর।’ বললেন শফিকুল।

হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠে শফিকুল। মধ্যরাতে কাকন নামের একটি জঙ্গি দল অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে সেনা ক্যাম্পে হামলা চালায়। ফায়ারিং শুরু হলো। শফিকুল প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি পরে হঠাৎ মনে হলো আশেপাশের লোকজন মারা যাচ্ছে। অন্ধকার ভেদ করে কানে এলো মানুষের হাহাকার। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসিখুশি শিবির পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। একটি গুলি শফিকুলের পায়ে বিদ্ধ হয়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। অন্ধকারে বন্দুকটা কোথায় পড়ল সে খেয়ালই করল না। আহত পা মাটিতে টেনে নিয়ে লতিফ রহমান ও অন্যান্য সৈন্যদের ডাকতে থাকে। কারো কোন কথা নেই। শফিকুল কোনোমতে একটি গাছের নিচে এসে আশ্রয় নেয়। বোমার আঘাতে গাছের ডাল ভেঙে একটু বেঁধে ছিল। শফিকুল পা টেনে গাছের নিচে বসতে আহত পায়ের উপর গাছের ডালটা পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে শফিকুল চিৎকার করে ওঠে। সকাল হল। রাতে গুলির শব্দ শুনেও গ্রামবাসীর একজনও ঘর থেকে বের হয়নি। সকাল হতে না হতেই আশেপাশে লোকজন জড়ো হয়।

উদ্ধারকারীরা পৌঁছেছে, ৮০ জন নিহতকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। আর আহত ৬০ জনকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। দেড়দিন হাসপাতালে নিথর হয়ে পড়ে ছিল শফিকুল। দ্বিতীয় দিন জ্ঞান ফিরে চোখ খুলে চারপাশে তাকান। বিছানার পাশে দাঁড়ানো তার স্ত্রী ও মা কাঁদছেন। বড় ছেলের কোলে ছয় মাসের মেয়ে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলেন, চেক-আপ করলেন। তারপর বললেন, ‘শফিকুল সাহেব, সময়মতো চিকিৎসার অভাবে আপনার পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে ছিল। পুরো শরীরে জীবানু ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল, সেজন্য আপনার এক পা কেটে ফেলা হয়েছে।’
কত অযত্নে ডাক্তার এমন বিশ্রী সত্য বললেন। শফিকুল চৌধুরীর স্ত্রী ফারিয়া ও মায়ের কান্নার আওয়াজ আরও জোরালো হয়ে ওঠে। শফিকুল চোখ বন্ধ করল। তার জীবন অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে গেছে যেন।

ড্রয়িংরুমের এক কোণে হুইলচেয়ারটা অযথা থামিয়ে দিল শফিকুল। ফারিয়া শফিকুলের পাশে এসে দাঁড়াল। শফিকুলের গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, তিনি জড়ানো গলায় বললেন, ‘তোমার ছেলে আমাকে বোঝে না ফারিয়া। পনের বছর কেটে গেছে। এখনও সে অভিমান, রাগ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফারিয়া, একটা কঠিন সত্য কি জানো?’
ফারিয়া কিছু বলল না। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বুকের অস্থিরতা লুকিয়ে শফিকুল বললেন, ‘অভিমান জমতে জমতে একসময় ঘৃণাতে পরিণত হয়। তোমার ছেলে কি আমাকে খুব ঘৃণা করে?’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here