তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন পর্ব ১৪ #জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

0
57

#তুমি_ছুঁয়ে_দিলে_এ_মন

পর্ব ১৪

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

পরের দিন ভোরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অবস্থায়ই আহনাফের জ্ঞান ফিরলো। দুর্ঘটনাস্থলের পাশের এক প্রাইভেট হসপিটালে এডমিট করানো হয়েছে তাকে। সারা গায়ে জায়গায় জায়গায় ব্যান্ডেজ লাগানো। মুখে অক্সিজেন মাক্স, হাতে ক্যানোলা লাগানো, তাতে স্যালাইন চলছে।
সে বুঝে উঠতে পারছিলো না যে, গতরাতে তার সাথে ঠিক কি ঘটেছিলো! আহনাফের বন্ধু ডাক্তার রাতুল এসেছে, সে অন্য ডাক্তারদের সাথে বন্ধুর ব্যাপারে আলোচনা করছে।
জ্ঞান ফিরেছে শুনে এক বৃদ্ধ তার সাথে এক কমবয়সী ছেলে এগিয়ে এলো আহনাফের কাছে।

রাত দশটায় এ রাস্তা দিয়ে মানুষ তেমন চলাচল করেনা। কিন্তু রাস্তার পাশের খাদে একটা বাইক সি. এন. জি র ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো তা দেখে ফেললো এক বৃদ্ধ জেলে, যে নদীতে আসা বানের পানিতে জাল পাততে এসেছে। বৃদ্ধ সে জেলের একার সাধ্যি নেই ঐ খাদে নামার। তাই সে তার নাতিকে ডেকে আনলো খাদে নামার জন্য।
খাদে নামতেই দেখে যে, বাইক আরোহি অজ্ঞান, বাইক ও তার আরোহী দুজনের গায়েই খাদের কাদার নিচে প্রায় তলিয়ে গিয়েছে। বহু কষ্টে সেই জেলে আর তার নাতি আহনাফকে টেনে বের করেছে। মাথায় হেলমেট ছিলো বলে শুধু শরীরে আঘাত পেয়েছে। তবে কাদায় পড়েছে বলে হাত পা কিছু ভাঙ্গেনি। বেশ কয়েক জায়গায় গভীরভাবে ক্ষত হয়েছে আর ফুসফুসে কাদা আর পানি ঢুকে পড়েছিলো। তবে মোটামুটি এক সপ্তাহের মধ্যেই সুস্থ্য হয়ে যাবে বলে জানালেন ডক্টর, আহনাফের বাবা আশফিককে। আহনাফের কাছে ফোন না থাকায় পকেটের নোটবুক থেকে নাম্বার বের করে সেই বৃদ্ধই কল দিয়েছিলো আশফিক রহমানকে।
.
.

ইতিমধ্যে কলেজের সবার কানেই ছড়িয়ে গিয়েছে যে, “আহনাফ স্যার এক্সিডেন্ট করেছে”। ত্রিশার কানে এ খবর যেতেই হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠলো ওর। হাত পা কাঁপাকাপি শুরু হলো ওর। নিজেও বুঝতে পারলো না কেনো মনটা এত ছটফট শুরু করলো আহনাফের জন্য। রাত্রি, স্নিগ্ধা আর ঊষা ঠিক করলো কলেজ ছুটির পর ওরা স্যারকে দেখতে যাবে, সাথে ত্রিশাকেউ নেবে! কিন্তু বিভা বিপত্তি বাঁধালো।
সে এসে সব মেয়েদেরকে কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেলো, বেশি দর্শনার্থী যাওয়া নিষেধ স্যারের ওখানে। বেশি মানুষ গেলে স্যারের ক্ষতি হতে পারে, বিধায় কেউ যাওয়ার দু:সাহস করলে বিভা তাকে প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করবে। ঊষা এসে ওকে ধমকের সুরে বললো,
” আর তুই?”
” আন্টি আমাকে যেতে বলেছে, আমি তো যাবোই, আফটার অল হি ইজ মাই ফিয়ন্সি!”

এভাবে বিভার ঠাঁটানি খেয়ে মনে মনে সবাই বেশ ভীত হলো। বিভা তাই কলেজের ক্লাশ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইলো।
কলেজ ছুটির পর তাই ই হলো। কলেজের সামনের সুপার শপ হতে বিভা একগাদা শপিং করলো আহনাফের ওখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ত্রিশা তার চার বান্ধবিদের সাথে ক্লাশ এসাইনমেন্ট বিষয়ে আলোচনা করার পর সে পথ ধরে একা একাই যাচ্ছিলো অটোরিকশার খোঁজে। দু হাত ভর্তি জিনিসপত্র থাকায় বিভা ত্রিশাকে ডাকলো ওকে সাহায্য করার জন্য। সামান্য ইতস্তত করেও ত্রিশা এগিয়ে গেলো।
বিভা নিজের হাতের আঙ্গুলগুলোতে ফুঁক দিতে দিতে বললো,
” আমার হাত জ্বলে গেলো রে! আজ আমার ড্রাইভারের শরীর ভালো না, তুই যাবি আমার সাথে? আমি একা এতগুলো ব্যাগ কিভাবে নিবো?”

ত্রিশা যেনো এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলো।
স্বয়ং বিধাতা ওকে এই সুযোগ তৈরি করে দিলো যেনো। হাসিমুখে মাথা নেড়ে দ্রুত উঠে গেলো গাড়িতে।

বিভা ত্রিশাকে পেয়ে ভাবলো, এই বোকাটাকে দিয়ে সাহায্য ভালোমতোই করিয়ে নেওয়া যাবে। তাই হাতে সবগুলো ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বিভা দৌড়ে চারতলা বেয়ে আহনাফের কেবিনে প্রবেশ করলো। এদিকে ত্রিশা একা একা অতগুলো ব্যাগ নিয়ে আস্তে আস্তে চারতলা বেয়ে উপরে উঠে আসতে লাগলো।
কেবিনে ঢুকেই বিভা তার স্বভাবসুলভ চপল স্বভাবে বলা শুরু করলো,

” ইশ রে! স্যার…আপনাকে যে সি এন জি ওয়ালা এভাবে ধাক্কা দিয়েছে, সেটাকে পেলে আমি এক্কেবারে দু হাতে থাপড়াবো”

শুনে আহনাফ চুপচাপ হাসলো। মনে মনে ভাবলো,

” কোত্থেকে এ গুন্ডি এলো? এ তো এখন এই হসপিটালের শব্দ দূষণ করেই ছাড়বে!”

ওদিকে শায়লাকে দেখেই বিভা চিৎকার সমেত ” আন্টি” বলে জড়িয়ে ধরলো। শায়লাও খুশিতে জড়িয়ে ধরলো।

আর ডিউটিরত নার্স বিভাকে আস্তে কথা বলতে নির্দেশ দিয়ে চলে গেলো।

কিন্তু বিভাকে থামায় কে?

সে তার স্বর কিছুটা মাত্র নিচে নামালো বটে, তবে কথা সে চালিয়েই গেলো।

অহনাকে দেখেই সে চিৎকার শুরু করলো, ” অহনা! অহনা! ”

অহনা হেসে ওকে ভলিওম কম করার ঈংগীত দিলো।

শায়লা বিভাকে আদরের স্বরে বললো, ” এত জিনিস আনতে গেছো কেনো মা? ”

ওদিকে ত্রিশা এক্ষণে মাত্র কেবিনে প্রবেশ করলো। ত্রিশার দিকে চোখ পড়তেই শায়লা বলে উঠলো,

” মেয়েটা কে? ইশ এতগুলো জিনিস নিয়ে কষ্ট করে তুমি চারতলায় উঠেছো, ঘেমে কি অবস্থা! এগুলো রাখো তুমি!”

বিভা আবারো চেঁচিয়ে বললো,
” এগুলো আমি এনেছি আন্টি, ও বেচারি আর আনবে কি?”

” তুমি, এত জিনিস কেনো কিনেছো, মা” শায়লা নম্রস্বরে বললো।

ত্রিশা হাতের জিনিসগুলো টেবিলে রাখলো।

ত্রিশা এসেছে! আহনাফ ত্রিশাকে দেখেই যেনো অর্ধেক সুস্থ্য হয়ে গেলো। সে ত্রিশাকে দেখে মুখে বিশাল হাসির রেখা টেনে আনলো, ত্রিশাও মুচকি হেসে সুধালো,

” এখন কেমন আছেন আপনি?”

আহনাফ হাসি আরো বর্ধিত করে বুকে একটা হাত রেখে বললো,

” খুব ভালো, মনে হচ্ছে অর্ধেক সুস্থ্য হয়ে গিয়েছি”

বলেই সে ত্রিশার দিকে অপলক চেয়ে রইলো। ত্রিশা দৃষ্টি নামিয়ে নিল।

পাশে থেকেই ভাইয়ের এমন অপলক হাসিমুখ পর্যবেক্ষণ করছিলো আহনাফের একমাত্র ছোটোবোন অহনা। মনে মনে ভাবলো,

মেয়েটার চুল দেখা যাক। বলেই কাছে এসে স্কার্ফের ফাঁকফোকড় দিয়ে চুল দেখা শুরু করে দিলো।

আহনাফ ধমক দিয়ে বললো,
” ঐ শার্লক হোমসের বউ!”

অহনা হেসে দিলো।

শায়লার দৃষ্টিও বিভার দিক হতে ত্রিশার দিকে পরিবর্তিত হলো। সে ত্রিশাকে সুধালো,

” বড্ড মিষ্টি দেখতে তো এই মেয়ে! কার মেয়ে তুমি? এত লক্ষী?”

ত্রিশা আর কি বলবে তার আগেই বিভা বলে দিলো,

” আন্টি, ওর বাবার নাম তো জহির শেখ, মানে ঐ টু’নটুনি জহির শেখ আছে না?”

বলেই মুখ টিপে উপহাসের হাসি হেসে দিলো সে!

শহরের লোকজন জহির শেখের নারীলিপ্সু চরিত্রকে ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে ” টুনটুনি জহির” বলে সম্বোধন করে!

ত্রিশা বিভার একথা শুনে লজ্জায় যেনো মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলো। ওকে আরো হেয় করার উদ্দ্যেশ্যে বিভা বলে উঠলো,

” আন্টি ও আসলে জহির শেখের স্টেপ ডটার!”

শায়লা মুখ দিয়ে ” চ্যহ” জাতীয় ধবনি করে বললো,

” কাউকে এভাবে ছোটো করা উচিত নয় মা, বিভা!”

বিভা মাথা নাড়লো, কিন্তু মুখে একটা বদমায়েশের হাসি অক্ষুণ্ণ রাখলো।

আহনাফ এবার বলা শুরু করলো,

” মা ত্রিশা, টুয়েলভথ এর স্টুডেন্ট, ভীষণ মেধাবী আর পরিশ্রমী, কোনো রকম প্রাইভেট পড়া ছাড়াই মেয়েটা এস এস সি তে গোল্ডেন পেয়েছিলো। আর যে এস সি তেও স্কলারশিপ সহ গোল্ডেন পেয়েছিলো। ক্লাশেও দ্বীতিয়।”

শায়লা হাসিমুখে বললো,

” আহা! ভীষণ ভালো মেয়ে তো তুমি? আর দেখতেও মাসাল্লাহ! আল্লাহ সবাইকে সবসময় সঠিক জায়গায় পাঠায় না, দুনিয়া একটা পরীক্ষা! তবে জহির শেখের মতো পরিবারে তুমি আর তোমার মা যে আছো, এটা একটা চরম ধৈর্যের বিষয়।”

ত্রিশা বিষন্ন মুখে মাথা নাড়লো।

অহনা আবারো ত্রিশার দিকে গোয়েন্দার মতো তাকাচ্ছিলো। সে চশমার ফাঁক দিয়ে ত্রিশাকে দেখতে লাগলো।

ওদিকে ত্রিশা আর শায়লার এসব আলাপের মধ্যে বিভার আলাপ যেনো ভাটা পড়লো।

তাই দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দ্যেশ্যে সে বললো,

” স্যার, আপনার জন্য আমি চিকেন বিরিয়ানি এনেছি, খাবেন?”

আহনাফ ওকে জিজ্ঞেস করলো,

” তুমি রেঁধেছো বুঝি?”

বিভা জিহবায় কামড় দিয়ে বিকট এক হাসি হেসে বললো,

” স্যার, আমি কিভাবে রাঁধবো, আমি তো কোনোদিন কিচেনেই যাইনি!”

আহনাফ মায়ের দিকে চেয়ে কূট হাসি হাসলো।

শায়লা কিছু বলতেই যাচ্ছিলো, ঠিক তখনি বিভা বলে উঠলো,
” আন্টি, আপনার কাছে আয়না হবে একটা?”

ঠিক তখনি অহনা একটা আয়না বের করে দিয়ে বললো,

” এটা লুকিং গ্লাস বিভা আপু, তবে দর্পনটা উত্তল, তুমি কি জানো উত্তল দর্পন কি?”

বিভা হেসে বললো,
” আমি ক্যামিস্ট্রিতে ভীষণ কাঁচা, এসব প্রশ্নের উত্তর তাই জানি না!”

অহনা হেসে বললো,

” এটা ক্যামিস্ট্রির বিষয় না আপু, এটা ফিজিক্স এর বিষয়”

বলতেই বিভা আবার আবার একটা বোকামির হাসি হেসে বললো,

” আমি জানি আপু, জেনেও ইয়ার্কি করছি”

এদিকে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়া গোয়েন্দাবৎ অহনা এটা ঠিকই বুঝলো যে বিভার মাথায় ঘিলুর জায়গায় গোবর রয়েছে।

আহনাফ অহনাকে ঈশারায় কাছে ডাকলো,

” তুই এত জিনিয়াস রে!”

” জিনিয়াসের কি দেখলা? এই যে তোমার পকেটে যে চুল দুটো ছিলো তা কার ছিলো, তা আমি জেনে গেছি!”

আহনাফ ফিসফিসিয়ে বললো,

” সত্যিই, তুই বলতে পারলে তোর ট্রিট আছে”

” আগে বলো কি ট্রিট?”

” তোকে পিজ্জা হাটের পিজ্জা খাওয়াবো”

” হুম, বেশ! ঐ চুলগুলা তো ত্রিশারই”

আহনাফ নির্দিধায় অকপটে বোনের কাছে নিজের ভালোবাসার কথা বোনের কাছে স্বীকার করে নিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here