আশিয়ানা #পর্ব_২৯ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
200

#আশিয়ানা
#পর্ব_২৯
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
নিস্তব্ধ চারিপাশ। অদ্ভুত এক নিরবতা বিরাজ করছে চারিদিক জুড়ে। অন্ধকারে গা ছমছম করে ওঠে। বার বার মনে হচ্ছে ঘরের ভেতর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি আছে। কাঁথার নিচে পায়ে পা ঘষে দু’হাতে মুখ ঢাকলো জুবিয়া। ওর রুমের সামনেই ড্রয়িংরুম। এতক্ষণ রুমে শুয়ে থেকেই ওদের কথা স্পষ্ট না হলেও শুনতে পাচ্ছিল। হঠাৎ করে চতুর্দিক নিঘুম হয়ে এলো। বাহির থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। জুবিয়া কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। ভয় হচ্ছে, মুখের ওপর থেকে কাঁথা সরালেই বিকৃত আকৃতির কিছু সামনে হাজির হবে। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঁঠ প্রায়। জুবিয়া একপাশ থেকে ঘুরে অন্য পাশ ও হচ্ছে না। পাছে কিছু দেখে ফেলবে সে ভয়। জুবিয়া গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইল। পায় থেকে তখন একজনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। চটজলদি মুখের ওপর থেকে কাঁথা সরিয়ে ভূত দেখার মতন চমকে উঠে বিছানায় বসল জুবিয়া। যা দেখছে ভূল দেখছে ভাবনায় দু’হাতে ইচ্ছে মতো চোখ দুটো দলাইমলাই করে তাকাল। খাট থেকে একহাত দূর ড্রেসিংটেবিলের ছোট্ট টুলে বসা তূর্ণ। হালকা চাপা দাড়ি, ফর্সা বরণ গোলগাল মুখ, হাতে একটা ঘড়ি, পড়েন সাদা হাতা গোটানো এবং অধরকোণে এক চিনতে হাসি। নিজ রুমে তূর্ণ কে দেখে চমকে উঠল জুবিয়া।

তূর্ণ বলল,

‘ চলুন।’

জুবিয়া অবাক হয়ে বলল,

‘ কোথায়?’

‘ বাহিরে সবাই খাচ্ছে। আপনিও খাবেন।’

জুবিয়া বিস্মিত গলায় বলল,

‘ না। আমি খাব না। আপনি আমার রুম থেকে যান।’

‘ কেন? আপনার ক্ষুধা পায়নি?’ প্রশ্ন করল তূর্ণ।

জুবিয়া অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,

‘ এত প্রশ্ন করছেন কেন? যেতে বলেছি। চলে যান।’

তূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়াল। এরপর ভাব নিয়ে বলল,

‘ আপনি নিজ থেকে উঠার কষ্ট করবেন নাকি আমি তুলে নিয়ে যাব?’

কথা বলে থামল তূর্ণ। জুবিয়া এখনো বিছানায় বসে রয়েছে। তার কোনো হেলদোল নেই দেখে একপা এগিয়ে এলো তূর্ণ। সহসা বিছানা থেকে নেমে গেল জুবিয়া। দু-হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তূর্ণকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে বলল,

‘ আমি.. আমি যাচ্ছি।’
.
.
রুম থেকে বের হওয়ার পর ভ্রু কুঁচকে গেল জুবিয়ার। সবাই কেমন চুপচাপ বসে আছে। তূর্ণ এগোল সেহরিশের পাশাপাশি সোফায় বসল। সেহরিশের পিছন দিকে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোদেলা। সাদাফ রান্নাঘরের দিক থেকে বেরিয়ে এদিকটায় এলো। জুবিয়াকে দেখামাত্র বলল,

‘ ঘুম ভাঙলো? আমাদের সাথে এসে বসো।’

জুবিয়া ওর ভারী পল্লব ঝাঁকিয়ে এগিয়ে এলো। সাদাফ সোফায় বসতে বসতে আবারও বলল,

‘ তোমায় তুমি সম্মোধন করেছি। কিছু মনে করোনি তো?’

জুবিয়া আঁড়চোখে একপলক, দু’পলক তূর্ণ কে দেখে নিল। তারপর মাথা ডানে-বামে নাড়াল। সে বলল,

‘ আমি কিছু মনে করিনি।’

তূর্ণ সেহরিশের সঙ্গে কিছু কথা বলছে। এরইমধ্যে উমাইয়া সবার জন্য চা করে নিয়ে এলো। ট্রে টি-টেবিলের ওপর রাখে এরপর এক সাইড হয়ে দাঁড়ায়। তূর্ণ হাতের ফোনটা পাশে রেখে কাপ নিতে এগিয়ে এলো। হুট করেই তার দৃষ্টি জোড়া গিয়ে পরে দরজার পিছনে স্ট্যান্ডে। বেশ কয়েকটি ছাতার পাশেই একটা ছাতা অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে। ছাতাটার ওপর দৃষ্টি পরতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল তূর্ণ। বেশ পরিচিত লাগছে। ঠিক এমন ছাতাই সেহরিশের বাড়িতে সে দেখেছে।

তূর্ণ সন্দেহ ত্যাগ করে জিজ্ঞেস করল,

‘ ওই ছাতাটা কার?’

তূর্ণ’র প্রশ্ন শুনে সেদিকে লক্ষ্য করে জুবিয়া ইতস্তত করে জবাবে বলল,

‘ রোদেলার।’

তূর্ণর দৃষ্টি এবার রোদেলার ওপর। জুবিয়া আঁতকে ওঠা ভঙ্গিতে বলল,

‘ না না। ও কিনেনি। ওকে একজন সাহায্য করে দিয়েছে।’

সেহরিশ একপলক তাকাল রোদেলার দিকে। তারপর দৃষ্টি নামিয়ে ফোনে তাকাল। হোয়াটসঅ্যাপে কিছু জরুরি আলাপ করছে সে।

তূর্ণ জিজ্ঞেস করল,

‘ ঠিক বুঝতে পারলাম না।’

জুবিয়া এবার তূর্ণর চোখে চোখ রাখে। কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চয় করে বলল,

‘ একবার সন্ধ্যায় আমরা বাজারে গিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়। পথেই আমার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়। সে জোর করে আমার সাথে কথা বলার জন্য ওর সাথে নিয়ে যায়। আর রোদেলা পথে একা থাকে। তখন বৃষ্টি আরম্ভ হয়। আমি হোটেলের ভেতর ছিলাম তাই বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে কি না টের পাইনি। তখন ওকে সাহায্য করার জন্য কেউ ওই ছাতাটা পাঠিয়েছিল।’

জুবিয়ার বলা কথাগুলো কান দিয়ে শুনছিল সেহরিশ। শেষ কথাটুকু বেশ পরিচিত লাগল। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল সাদাফের দিকে। এরপর তূর্ণর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল ছাতাটার স্থানে। প্রথম দেখায় ছাতাটি চিনতে পারলো সেহরিশ। বুক ভারী হয়ে আসলো তার।

তূর্ণ ফুঁস করে বলে উঠল,

‘ ওই ছাতাটা তো সেহরিশের। তার মানে সেহরিশ রোদেলাকে সাহায্য করেছিল।’

উমাইয়া বলল,

‘ ছাতাটা ওনার কিভাবে হবে?’

তূর্ণ সোফার সঙ্গে গা হেলিয়ে বলল,

‘ ছাতাটার উপরে SFC ওয়ার্ড শর্টফর্ম সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী লেখা আছে। চেক করুন যদি বিশ্বাস না হয়।’

রোদেলা সেহরিশের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেহরিশের দৃষ্টির আড়ালে থেকে সে এখন সেহরিশ কে দেখার জন্য উঁকি দিচ্ছে। সাদাফের শরীরের জন্য সেহরিশের মুখ অদৃশ্য। রোদেলার এই প্রয়াসটি অতি অবলীলায় ড্রয়িংরুমে থাকা একটি আয়নায় দেখতে পেল সেহরিশ। দেখামাত্র তার ওষ্ঠকোণে মৃদু ও মলিন হাসি ফুটিয়ে তুললো।

জুবিয়া বুদ্ধি করে উমাইয়া আর সাদাফকে বারান্দায় একসাথে কিছুক্ষণ গল্প করার জন্য রেখে গেছে।

সাদাফ তার চোখের ইশারায় জুবিয়াকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। প্রথম প্রথম খেয়াল না করলেও দ্বিতীয় বার ঠিক লক্ষ্য করেছে জুবিয়া। সাদাফ চাইছে উমাইয়ার সাথে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য। উমাইয়া কেন তাকে ইগনোর করছে? এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য সাদাফ ব্যাকুল হয়ে আছে। জুবিয়া চট করে বুদ্ধি বের করে ফেলল।

উচ্চকিত গলায় উমাইয়ার উদ্দেশ্য বলল,

‘ উমা বারান্দায় চল। তোকে দারুণ একটা খবর দেওয়ার আছে।’

উমাইয়া বলল,

‘ এখন না। পরে।’

জুবিয়া এগিয়ে গেল। উমাইয়ার হাত ধরে টানাটানি করে রাজি করিয়েই ছাড়ল। তূর্ণ অবাক দৃষ্টিতে জুবিয়াকে দেখছে। এমন আচরণ সে নিজেও করে সেহরিশের সঙ্গে। এখন জুবিয়া কে করতে দেখে সে মনে মনে আনন্দিত অনুভব করল। উমাইয়া বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে। গলা শুকিয়ে গেছে পানি নিয়ে আসার নাম করে পালিয়েছে জুবিয়া। উমাইয়া ঘুরে দেখল সাদাফ এখানেই এসে দাঁড়িয়েছে। উমাইয়া পাশ কেটে রুমে চলে যেতে নিল। সাদাফ তার একহাত দিয়ে উমাইয়ার হাতখান আলতো ভাবে ধরে বলল,

‘ কিছু কথা ছিল।’

‘ আমার কোনো কথা নেই। হাতটা ছাড়ুন।’

‘ শুধু পাঁচ মিনিট।’

‘ আমার হাতে সময় নেই। আমাকে যেতে দিন।’

‘ আমাকে এভাবে ইগনোর কেন করছেন উমা?’

সাদাফের এমন আচরণে বিরক্ত লাগছে উমাইয়ার। সে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে বলল,

‘ আপনাকে আমার পছন্দ না। দয়া করে আমার সামনে আসা বন্ধ করুন। চলে যান। প্লিজ চলে যান। আর আসবেন না।’

সাদাফের হাতখানা আলগা হয়ে এলো। উমাইয়ার হাতখানা আলগোছে বেরিয়ে গেল। সাদাফ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। তার ভাষা যেন এখানে শূন্য। উমাইয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

উমাইয়ার কান্না থামলো না। চোখের জল উপচে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে। কোনোক্রমে আটকে রাখতে সক্ষম হচ্ছে না সে। নিজের মনের অজান্তে যে মানুষ টিকে সে ভালোবেসে ফেলল পরিবারের কাছে হেরে গিয়ে তাকেই মুখের ওপর অপছন্দ করি বলা কতটা কষ্টের উমাইয়া টের পাচ্ছে। না পাচ্ছে আগলে ধরতে আর না পারছে ছেড়ে দিতে। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে কান্না করতে লাগল।

সাদাফ ভারী গলায় বলল,

‘ আপনার চোখের জলের কাছে
আমার শরীরের সমস্ত রক্তও নগণ্য।
কাঁদবেন না। আমি চলে যাচ্ছি।
চলে যাচ্ছি উমা।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here