আশিয়ানা #পর্ব_৩০ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
209

#আশিয়ানা
#পর্ব_৩০
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
দেখতে দেখতে আজ এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এর মাঝে উমাইয়ার সঙ্গে সাদাফের সম্পর্কে আরও দূরত্ব বেড়েছে, সাদাফ বার কয়েক উমাইয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলেও উমাইয়া দেখা করেনি। ভার্সিটি ও কাজের বাহানা দিয়ে পুরোপুরি সাদাফ কে উপেক্ষা করেছে উমা। আজ শুক্রবার। মে মাসের ৯ তারিখ। সেহরিশ ওদের বাংলাদেশে প্রথম কনসার্টের আয়োজন পুরো দমে চলছে। সন্ধ্যে, ৭টায় কনসার্ট শুরু হবে। গতকালই সকল টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। তবুও অনেকেই টিকিট পায়নি বলে আফসোস করছে। দেশের অনান্য জায়গায় যে ফ্যানস আছেন তারা অনেকেই দুদিন আগেই ঢাকা চলে আসছে। যারা আসতে পারেনি, তারা একবুক হতাশা নিয়ে টিভির পর্দায় প্রিয় গায়ক দের দেখে মন জুড়াবে। রিহার্সাল করে হাঁপিয়ে ওঠে সাদাফ। তূর্ণ পানির একটা বোতল সাদাফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আর ইয়্যু ওকে?’

সাদাফ উপর-নীচ মাথা দুলালো অর্থাৎ সে ঠিক আছে। এরপর বলল,

‘ ওরা আজ যাবে?’

‘ আমি জুবিয়ার সঙ্গে কথা বলে ছিলাম। তারা কেউই ঢাকা যাবে না।’

সাদাফ বুক ভারী হয়ে আসলো। তূর্ণ বলল,

‘ একটু রেস্ট কর। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ঢাকার উদ্দেশ্য বের হতে হবে।’
.
.
বছরের মাঝামাঝি সময় ঢাকা শহর জুড়ে জমজমাট কনসার্টের বিশাল আয়োজন চোখে পড়ার মতো। সন্ধ্যা ৭টার দিকে মঞ্চে উঠবেন এআই ব্যান্ডের তিনজন সদস্য, সেহরিশ ফাতিন চৌধুরী, মাহাবুব তূর্ণ, সাদাফ কাসানো। বছরের মাঝামাঝিতেও বিপুল সাড়া পাওয়া গেছে। গত কাল ঘন্টা পাঁচেক এর ভেতর সমস্ত টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে। দূর দুরান্ত থেকে অনেক ফ্যানস আসতে পারেনি। তারা না আসতে পারায় দুঃখ প্রকাশ করেছে। ৪টা বাজে এখানে এসে পৌঁছায় এআই ব্যান্ডের সদস্যরা। তারা কনসার্ট শুরু হওয়ার আগে একবার চারিদিক ঘুরেফিরে দেখে রেস্টরুমে গিয়ে বসে।

সাদাফের মন বিষণ্ণতায় ডুবে আছে। মলিন মুখে আয়নায় নিজের পরিধান করা পোশাক ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিল। তূর্ণ চেয়ারে বসে আছে, মেক-আপ ও হেয়ার আর্টিস্ট সময় নিয়ে ওদের সাজিয়ে তুলছেন। তূর্ণ একপলক সাদাফকে দেখে নিয়ে বলল,

‘ মন খারাপ?’

সাদাফ আয়না’তেই একবার তূর্ণ কে দেখে জবাব দিল,

‘ না। ভাগ্য খারাপ।’

সেহরিশ বলল,

‘ এখানে ভাগ্যের কোনো দোষ নেই, সব দোষ তূর্ণর। সে-ই উমাইয়ার বাবাকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছে এবং উমাইয়ার বাবা তিনি নিজের মেয়ের বিয়ের কথা বলেছেন। বাঙালী মেয়েদের এই একটা বাঁধা, একজন ছেলেকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালো বাসলেও পরিবারের সিদ্ধান্তের সামনে ঝুঁকে যায়। বাবা-মার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েই উমাইয়া সাদাফের থেকে দূরত্ব বাড়িয়েছে। বেচারি সে জানেও না তার কার সাথে বিয়ে ঠিক হইছে।’

সাদাফ পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল। সেহরিশের উদ্দেশ্য বলল,

‘ উমাইয়া সেদিন বলেছেন উনি আমাকে পছন্দ করেন না।’

সেহরিশ শক্ত ও গম্ভীর গলায় শুধাল,

‘ যখন ও তোকে এই কথাটা বলেছিল তখন ওর চোখ ভেজা ছিল?’

সাদাফ ভেবে বলল,

‘ হ্যাঁ। উনি কান্না করছিলেন।’

সেহরিশ নির্বিকার চূড়ান্তে বলল,

‘ মেয়েদের চোখের ভাষা বুঝিস না। চোখ দেখে বলতে পারিস না তোকে ভালোবাসে না-কি বাসে না? কেমন পুরুষ তুই?’

তূর্ণ অতর্কিতভাবে বলে ওঠল,

‘ ও নকল পুরুষ।’

সাদাফ চোখ বড়োবড়ো করে তূর্ণর দিকে তাকাল। এরপর সে বলল,

‘ একটু বুঝিয়ে বলবি?’

সেহরিশ বলল,

‘ তোকে ফিরিয়ে দেবার সময় উমাইয়া কান্না করছিল কারণ একটাই, উমাইয়া তোকে অসম্ভব ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষ কে নিজের থেকে দূরে সরানোর যন্ত্রণা, কষ্ট, যেটা মুখ দিয়ে বলতে পারছিল না উমাইয়া, সেটাই চোখের কার্নিশ দিয়ে বেয়ে গড়িয়ে গেছে।’

সাদাফ চেয়ার টেনে বসল। এবং ফোঁস ফোঁস করে কয়েকবার ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আমি ওনাকে ভুল বুঝলাম।’

সেহরিশ এগিয়ে এসে সাদাফের কাঁধে হাত রাখে। এরপর নির্মূল গলায় বলল,

‘ কনসার্ট-টা ঠিকমতো কর। বাকিটা পরে সামলে নিবো।’
.
.
আয়ান নাছোরবান্দা। দুইঘন্টা উমাইয়া আর জুবিয়ার পিছু পিছু ঘুরে অবশেষে বাহিরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য ওদের রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে। মাসের শুরু আগামীকাল ওরা বোনাস পাইছে, গ্রামে পাঠানোর জন্য টাকা আলাদা করে তুলে রাখে, বাড়িওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে যা আছে সেগুলো দিয়ে মাস কোনোরকমে পার হয়ে যাবে। তার উপর এসে জুটলো আয়ানের হঠাৎ ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে, গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রথম বার দেখা করবে একা যেতে লজ্জা পাচ্ছে সে। এজন্যই উমাইয়া ও জুবিয়াকে সাথে নিয়ে যাবে। রোদেলা বাড়ি একা থাকবে ভেবে তাকেও নিয়ে যাওয়ার প্ল্যানিং হয়। রোদেলার এই বিকেল বেলা কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই, তবুও জুবিয়ার জোরাজুরিতে সে রাজি হলো। আয়ান বাড়ি থেকে আসার সময় একেবারে রেডি হয়ে আসছে। জুবিয়া, উমাইয়া আর রোদেলা রেডি হওয়ার জন্য ত্রিশ মিনিট সময় নিল। এরপর একসাথে আয়ানের গাড়িতে উঠে বসে।

আয়ান ফ্রন্ট সিটে বসা ওরা তিনজন পিছনে বসেছে। আয়ান লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর তড়িঘড়ি করে ড্রাইভারকে বলল,

‘ জসিম চাচা গাড়ির মধ্যে ভূমিকম্প, ঝড়তুফান হয়ে গেলেও ব্রেক করবেন না।’

জুবিয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল। সন্দেহভাজন করে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

আয়ান বিস্মিত গলায় বলল,

‘ একবার ভেতরে গেলেই বুঝবি।’

কনসার্ট শুরু হবে ৭টায়। বিকাল ৫টা বাজে গেট খোলে দেওয়া হয়েছে। সিরিয়াল বজায় রেখে সবাই ভেতরে প্রবেশ করে নিজনিজ সিটে বসে গেল। উমাইয়া গাড়ি থেকে নামতেই চাচ্ছিল না। সে কোনোভাবে সাদাফের সামনে পরতে চায় না। জোরাজোরির এক পর্যায়ে আয়ান ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ উমারাণী প্লিজ নেমে আয়। এখানে কিন্তু অনেক পুলিশ আছে। এভাবে আমাদের দেখলে ভাববে তোকে আমি কিডন্যাপ করেছি। আমি জেলখানায় যেতে চাই না। প্লিজ নেমে আয় বোন আমার।’

সেহরিশ কনসার্টের প্রথম সারির চারটা টিকিট আগেই আয়ানকে দিয়েছিল। এবং বলেছিল, যে করেই হোক উমাইয়া কে নিয়ে আসতেই হবে। সাদাফের মন খারাপ আর নিতে পারছিল না সেহরিশ। আয়ান সবাই কে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং নিজেদের সিট খুঁজে গিয়ে প্রথম সারিতে বসল। জুবিয়া সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ সবার সামনের সিটের টিকিট তুই ম্যানেজ করলি কিভাবে?’

আয়ান ভাব সাব নিয়ে বলল,

‘ আয়ান মির্জার কাছে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।’

রোদেলা জিজ্ঞেস করল,

‘ তোমার গার্লফ্রেন্ড কোথায়? সে এখনো আসলো না। কখন আসবে?’

আয়ান হালকা হেসে বলল,

‘ তোমাদের নিয়ে আসার জন্য মিথ্যা বলেছি। আসলে ও অনেক বকবক করে। আমার মাথা ধরিয়ে ফেলে তাই কনসার্টের বিষয়ে কিচ্ছু বলিনি।’

৬:৫৫মিনিট। আর মাত্র পাঁচ মিনিটের অপেক্ষা। সকল ফ্যানস’রা ঘড়ি ধরে সময় গুনতে লাগল। অবশেষে তাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ৭টা বাজলো। উপস্থাপকের কিছু কথার পর এআই ব্যান্ডের সকলে মঞ্চে উপস্থিত হলো, সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে তাদের নামের ধ্বনি শোনা গেল। সকল ফ্যানস’রা একসাথে ওদের নাম নিয়ে চিৎকার করে উঠে।

৪০,০০০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে কনসার্ট শুরু হলো, তাদের মনোমুগ্ধকর গান এবং ড্যান্সের মাধ্যমে মঞ্চ নিমিষেই মাতিয়ে তুললেন তিনজন তারকা। মঞ্চের পিছনে বিগস্কিনে তাদের দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও একবার চিৎকারের ঢেউ বয়ে গেল। সেহরিশ, তূর্ণ এবং সাদাফ মঞ্চের তিনদিকে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সাইডে পানির বোতল রাখা আছে। একটা বোতল তুলতে নিয়েই হুট করেই সাদাফের চোখ পড়ল উমাইয়ার উপর। যেনো কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল সাদাফ।

সাদাফ, তূর্ণ এবং সেহরিশের ড্যান্সের কঠিন স্টেপ গুলো শুরু হলো। তাদের ওমন স্টেপ দেখে ভয়ে দুহাতে চোখ বন্ধ করে ফেলল রোদেলা, উমাইয়া আঁতকে ওঠে জুবিয়ার হাত শক্ত করে ধরল। এক সময় তিনজন আবার তিন দিকে ছড়িয়ে গেল। মাইক হাতে নিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গান গাইতে লাগল। তূর্ণ গান গাইতে গাইতে হঠাৎ হাত আকাশের দিকে তুলে নাড়াতে লাগল। সেসময় হঠাৎ সাদাফের শরীর খারাপ হয়, একহাত বুকের ওপর চেপে ধরে মঞ্চে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে সাদাফ। এমন পরিস্থিতি দেখে ফ্যানদের মধ্যে হৈচৈ আলোড়ন তৈরি হয়। উমাইয়া চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে মঞ্চে সাদাফের দিকে তাকাল। বুকে হাত রেখে কষ্টে কাতরাচ্ছে। কেউ তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না। সাদাফের কষ্টটা যেন সাদাফ নয়, উমাইয়া নিজের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারল। সে আচমকা সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মঞ্চের দিকে দৌঁড় লাগাল।

তূর্ণ আর সেহরিশ একটু পর খেয়াল করল সাদাফ কে। ওরা গান বন্ধ করে সাদাফের দিকে এগিয়ে যাবে সেসময় তূর্ণ খেয়াল করে দুজন গার্ড উমাইয়াকে মঞ্চে উঠার জন্য বাঁধা দিচ্ছে। উমাইয়া কান্না করছে এবং চেষ্টা করছে মঞ্চে উঠার। তূর্ণ দাঁড়িয়ে গেল। মাইক হাতে বলে উঠল,

‘ উনাকে আসতে দিন।’

গার্ড দুজন পিছনে ঘুরে তূর্ণর দিকে তাকাল। তূর্ণ আবারও বলল উমাইয়াকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। দুজনেই সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। উমাইয়া তাত্ক্ষণিক ছুটে এলো, সাদাফের মুখোমুখি হাঁটু ভেঙে বসে কুন্দনরত অবস্থায় সাদাফের দুগালে আলতোভাবে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,

‘ কি হয়েছে আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’ বলে থামল উমাইয়া। ঘুরে তাকাল সেহরিশের দিকে খানিক উঁচু গলায় চেঁচিয়ে বলল,

‘ আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন।’

সাদাফ মুখে কিছু বলল না। সহসা উমাইয়ার দু-হাত শক্ত করে ধরে ওর কাছে টেনে নিল। সকল ক্যামেরা এখন সাদাফ আর উমাইয়ার দিকে স্থির। সাদাফ উমাইয়া কে তার বক্ষের সাথে চেপে ধরে আছে। তারপর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ তোমারে দেখিলে বুক পিঞ্জরে কম্পন সৃষ্টি হয়। ভয়াবহ কম্পন; যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে।’

উমাইয়ার কান্না এতেও থামল না। সাদাফ বিড়বিড় করে বলল,

‘ এখুনি এত কান্না কোরো না। বিয়ের পর বিদায়ের জন্য একটু বাঁচিয়ে রাখো সখী।’

উমাইয়া ঠিক বুঝতে পারল না, সাদাফের কথার অর্থ। সাদাফ উমাইয়ার হাতে হাত রেখে উঠে দাঁড়াল। এবং সবার উপস্থিতিতেই সে উমাইয়া এবং তার বিয়ের সুসংবাদ সবাইকে জানিয়ে দিল। খবরটি অনেকের মনে আনন্দ নিয়ে এলো আবার অনেকের মনে বিষাদ। সব তারকাদের এমন কিছু ফ্যানস থাকে যারা তাদের শুধু আইডল ভেবে ভালোবাসে না। বরং তাদের কখনো পাবে না জেনেও নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে এবং তাদের সঙ্গেই কল্পনায় একটা জগৎ তৈরি করে। সাদাফের বিয়ের খবরটি সকলের কানে আসামাত্র কতজনের মন টুকরো হয়েছে তার হয়তো হিসেব নেই।

উমাইয়া বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সাদাফ মৃদু হেসে পুনরায় তাকে আলিঙ্গন করে বিস্তারিত সব খুলে বলল। অভিমানে খানিক গাল ফুলালো উমাইয়া।

তূর্ণ এগিয়ে এলো বলল,

‘ এখন তো আমি ভাবী বলতে পারি?’

উমাইয়ার মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে উপর নিচ মাথা দুলিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ।’

উপস্থিত সকলের দৃষ্টি সাদাফ আর উমাইয়ার উপরে স্থির হলেও সেহরিশের দৃষ্টিতে শুধু রোদেলা। নিজ বান্ধবীর আনন্দে সে ভীষণ আনন্দিত মন খুলে হাসছে সে। রোদেলার হাস্যোজ্জ্বল মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না সেহরিশ। অদ্ভুত এক মায়া তার মুখে ওই হাসিতে সেহরিশের মনকে খুব করে টানে। সহসা মাথা ঝাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকাল সেহরিশ। পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার জন্য মাইকে কিছু কথা বলতে লাগল।

______________

গতকাল রাতে গাজীপুর ফিরতে প্রায় দু’টো বেজে যায়। আজ সকাল সকাল সিরাজগঞ্জ যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কেউ ঘুম থেকে উঠতে পারেনি। সকলে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। সকাল থেকে প্রায় পঞ্চাশ টা কল দিয়ে ফেলেছেন ফারিয়া বেগম। শফিকুল আশপাশের মানুষের সাহায্য নিয়ে সমস্ত আয়োজন শেষ করে ফেলেছেন। আরুশি এবং সাদাফের বিবাহ একসাথে একই দিনে সম্পূর্ণ হবে। ১৫মে বিবাহের দিন। বাড়ির ছেলেগুলো বাড়িতে না থাকলে কোনো কাজ জমে? একজনও ফোন তুলছে না। অবশেষে উপায় না পেয়ে সেহরিশের ম্যানেজার কে কল করেন ফারিয়া। ম্যানেজার জেগে ছিলেন, কল রিসিভ করে জানিয়ে দিলেন, স্যাররা সবাই রাতে সিরাজগঞ্জ উপস্থিত থাকবেন। তূর্ণ ওর বাবা-মা কে নিয়ে আসার দায়িত্ব তার ম্যানেজার কে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

তূর্ণ’র বাবা-মা দুপুর দুইটা নাগাদ আসলেন সাদাফের ফ্ল্যাটে। এরইমধ্যে সবাই উঠে ফ্রেশ হয়ে গেছে। একসাথে খাবার দাবার শেষ করে এরপর সাদাফ একবার উমাইয়ার সঙ্গে দেখা করে আসে। সাদাফ সেহরিশকে জানায় আজ সে ওদের সাথে যাবে না। কারণ উমাইয়ার সঙ্গে সিরাজগঞ্জ যেতে চায়। এই নিয়ে কোনো আপত্তি জানায় নি সেহরিশ। বিকেল পাঁচটা নাগাদ সকল প্রকার তৈয়ারি শেষ করে বাড়ি থেকে বের হলো ওরা। বাড়ির সামনেই বেশ কিছু সাংবাদিক ভিড় জমিয়েছে, তাদের বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে দেখা গেল সেহরিশ কে। বেশিরভাগ প্রশ্ন ছিল সাদাফ ও উমাইয়া কে ঘিরে। সেহরিশ অবশ্য তাদের অনেক প্রশ্ন স্কিপ করে গেছে। সেহরিশ চায় না, উমাইয়া সাদাফের সামনে নিজেকে ছোটো মনে করুক। মানুষের জীবনে টাকা, আধিপত্য নামজোশ সব কিছু নয়। সেহরিশের কাছে মানুষের মন, ও ভালোবাসাটাই ম্যাটার করে।

রোদেলা এবং জুবিয়ার জন্য আলাদা এক গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে সেহরিশ। তূর্ণ তার বাবা-মায়ের সঙ্গেই গাড়িতে উঠে বসল। অল্পর জন্য জুবিয়ার সঙ্গে মায়ের পরিচয় করিয়ে দিতে পারেনি। সেহরির তার ম্যানেজারের সঙ্গেই গাড়িতে উঠে। সাদাফ উমাইয়ার পাশাপাশি বসে আছে। গাড়িটা বাসস্ট্যান্ডে এসে থামলো। নামার পূর্বে সাদাফ ভালো করে মাস্ক ও মাথায় ক্যাপ পরে নিল। যাতে করে লোকজন তাকে চিনতে না পারে। এরপর গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারের উদ্দেশ্য বলল,

‘ আমরা যে বাসে উঠব তার পিছু পিছু আপনি আসবেন।’

উমাইয়ার হাত নিজ হাতের মুঠোয় নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সাদাফ। দুটো টিকিট কেটে নিল। এরপর দুমিনিট অপেক্ষা করতেই বাস চলে আসে। দুজন একসাথে বাসে উঠেছে। পাশাপাশি সিটে বসেও হঠাৎ আলাদা হতে হলো। একজন মহিলা তিনি সম্ভবত গর্ভবতী, এবং তিনি পর্দাশীল নারী। হাতে-পায়ে মোজা এবং বোরকা ও হিজাবের জন্য তার চোখ বা শরীরের এক অংশ ও দেখা গেল না। সিটগুলো পুরো ভরে গেছে। এবং মহিলার সিটের পাশে একটা পুরুষের সিট। পরপুরুষের সাথে বসতে তিনি ইতস্তত বোধ করছেন। তা দেখেই নিজ সিট থেকে উঠে গেল সাদাফ। মহিলাটিকে তার সিটে বসতে দিয়ে সে মহিলার সিটে বসল। উমাইয়া অবাক হলো, সাদাফের আন্তরিকতা দেখে মনে মনে খুশিও হলো সে।

উমাইয়া বাসের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। আজকের অনুভূতি’টা অন্য রকম। সে নিজেও ধরতে পারছে না, কেমন? হুট করেই বুকের ভেতর ধুকপুক করছে আবার পরোক্ষণেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠছে। কেমন মিশ্রণ অনুভূতি যার একাংশ জুড়ে শুধু ভালোলাগা। এই পুরো ভালোলাগা টুকু ঘিরে শুধু সাদাফ।

সাদাফ সামনের সিটের জানালার পাশেই বসেছে। হঠাৎ সামনে তাকাতে ঘাবড়ে উঠল উমাইয়া। সাদাফ সিটের ওপর হাঁটুতে ভড় দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকেই দেখছে। একহাত গাল ছুঁইছুঁই এবং ঠোঁটে প্রস্ফুটিত হাসি। উমাইয়া চমকায়িত কণ্ঠে বলল,

‘ হাত-পা ব্যথা করবে তো এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো?’

সাদাফ পাত্তা দিল না। সে বলল,

‘ তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় ধুঁকছে মন।
হাত-পায়ের নিছক বাহানা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিবো।’

আধঘন্টা এভাবেই বসে থাকল সাদাফ। সে তার কথা থেকে বিন্দুমাত্র নড়লো না। ঘড়িতে সময় ৮:১৫ মিনিট। সারাদিনের ক্লান্তি ভড় করে উমাইয়ার চোখে। সে জানালার সঙ্গে মাথা হেলান দিয়ে রেখে ঘুমিয়ে যায়। সাদাফ মৃদু হাসল তার এই কাণ্ড দেখে তারপর সিটের ওপর দিয়ে একটু এগিয়ে এসে উমাইয়ার মাথাটা তার বাঁ হাতের তালুতে রাখল। রাস্তার উঁচুনিচু জায়গায় চাকা পরলে বাস নড়েচড়ে উঠে তখন উমাইয়ার মাথা জানালার সঙ্গে লাগামাত্র ব্যথায় কুঁকড়ে উঠবে উমা। তাকে সে ব্যথা থেকে বাঁচানোর জন্য সাদাফ চেষ্টা করছে। দু-ঘন্টা ঘুমিয়ে উঠল উমাইয়া। সিরাজগঞ্জ কড়ুইতলা এসে বাসের হেলপার সকলকে নামার জন্য তাড়া দিতে লাগল। তার উচ্চ কণ্ঠ শুনেই মূলত উমাইয়ার ঘুম ভাঙে। সাদাফের হাতের তালুতে মাথা রেখে উমা এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল ভাবতেই বিস্ময়াভিভূত তাকিয়ে রইল সে। দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে বিস্ময় ও বিরক্তিমাখা কণ্ঠে উমাইয়া বলল,

‘ আমাকে জাগিয়ে তুলতে পারেন নি? এতক্ষণ হাত দিয়ে রাখছেন নিশ্চিত ব্যথা করছে।’

সাদাফ আকর্ণ হেসে বলল,

‘ মনের তৃপ্তি উমা।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here