আশিয়ানা #পর্ব_৩৪ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
200

#আশিয়ানা
#পর্ব_৩৪
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
গাড়ি এসে থামল চৌধুরী বাড়ির সামনে। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন চারজন পাহারাদার। সাদাফের গাড়িটা চিহ্নিত করে দু’জন দৌঁড়ে গেলেন এরপর পুরো গেইটটা খুলে একপাশে দাঁড়িয়ে যান। ড্রাইভার নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করেন। রোদেলা গাড়ি থেকে নেমে এক দৃষ্টিতে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিল। বিশাল জায়গা জুড়ে পুরনো দিনের জমিদার বাড়ি৷ এখন চৌধুরী বাড়ি নামেই পরিচিত। ছোটোবেলায় রোদেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রায়ই বাড়ির বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখত, এবং তখন থেকেই মনে মনে চাইত, বাড়িটা ভেতর থেকে ঘুরে দেখার। আজ তার সেই ইচ্ছাটা পূরণ হলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রোদেলা। গাড়িটা গেইট দিয়ে ভেতর ঢুকতে রোদেলার চোখে পরল তিনটা পথ। প্রথম ও সোজা পথটা বাড়ির সদরদরজায় গিয়ে থেমেছে। বামদিকে গ্যারেজের পথ। এছাড়াও বাড়ির ডানদিকে ফুলের বাগান। বাগানের মাঝখানে একটা টেবিল ও চারপাশে চেয়ার রয়েছে। রোদেলা দাঁড়িয়ে পড়ল, ভালো করে দেখল সেখানে দুজন লোক বসা। প্রথম জনকে সে চিনতে পারল শফিকুল চৌধুরী হুইলচেয়ারে বসে আছেন। দ্বিতীয়জন কে চিনতে সক্ষম হলো না রোদেলা। বাড়ির সদর দরজার দিকে রওনা দিল। কিছুটা এগিয়ে আসতে দেখতে পেল বিশাল এক উদ্যান। সেখানে একজোট হয়ে বসে আছেন বেশ কিছু নারীদ্বয়। উমাইয়া আসছে দেখে এগিয়ে আসলেন ফারিয়া এবং শুধা।

ফারিয়া হাসিমাখা মুখে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ দুপুর তো হতে চলল। এই সময় হলো তোমার ফিরে আসার?’ বলে থামলেন ফারিয়া। এরপর রোদেলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘ ওঁ তোমার সেই বান্ধবী? যাকে নিয়ে আসার জন্য ছুটে গিয়েছ?’

উমাইয়া মৃদুস্বরে বলল,

‘ হ্যাঁ, আন্টি। আসলে ওঁ কাজের বাহানা দিয়ে আসতে চায়নি। আমি না গেলে হয়ত আসতোই না।’

ফারিয়া অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন,

‘ সে কি কথা? বান্ধবী যদি বান্ধবীর বিয়েতে না আসে তাহলে কি বান্ধবীর বিয়েতে মন বসে? বিয়ের মতো কঠিন সময় আত্মীয়দের আগে কাছের বন্ধুদের সঙ্গ বেশি প্রয়োজন। কারণ মন তখন বন্ধু-বান্ধবীদের দিকে বেশি টানে। এই দেখ, তোমাদের মতন সময় আমাদেরও ছিল। অথচ এখন বন্ধু-বান্ধবী কারোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই।’

রোদেলা চাপা হাসল। তারপর বলল,

‘ আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।’

ফারিয়া হাসল। রোদেলার থুতনি ছুঁয়ে বলল,

‘ তুমি খুবই মিষ্টি। আমাদের গাঁয়ের মেয়ে অথচ এতদিনে একবারও তোমাদের দেখিনি।’

জুবিয়া জিজ্ঞেস করল,

‘ আন্টি এই দুপুর বেলা এতগুলি ইলিশ মাছ কে নিয়ে আসছে?’

ফারিয়া বললেন,

‘ কে আবার? আমার ছোটো ছেলে। দুই ছেলে শখ করে আজ বাজারে গিয়েছিল। বড় ছেলে যত সবজি পেয়েছে নিয়ে আসছে। আর ছোটো ছেলে মাছের বাজারে যত ইলিশ মাছ দেখেছে কিনে নিয়ে আসছে। এই দুজনকে নিয়ে আমি পরেছি মহাবিপদে। বিয়ের সময় উটকো কাজ। বাবুর্চি দুপুরের রান্না বসিয়েছে, আমি ভাবলাম মাছগুলো ভাজা হলে দুপুরে সবাই খেয়ে ফেলতে পারবে। তাই সকলে মিলে কাটতে বসেছে।’

ফারিয়া থামলেন। তারপর বললেন,

‘ অন্দরে যাও। সোজা গিয়ে বাঁ দিকে সিঁড়ি পথ। একদম দুইতলায় চলে যাবা। সেখানে আরুশি আছে। ওঁ তোমাদের রুম দেখিয়ে দিবে। তিনটার দিকে পার্লার থেকে দু’জন মেয়ে আসবে তোমাদের সাজানোর জন্য। এখন রুমে গিয়ে একটু রেস্ট করো।’

উমাইয়ার পিছু পিছু যেতে লাগল রোদেলা। শুধা ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললেন। এরপর ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ আপা ওই মেয়েটি কে? দেখতে কিন্তু ভীষণ মিষ্টি। কথা ও বলে ছটফট করে।’

ফারিয়া মৃদু স্বরে বললেন,

‘ তোমার হবু বউমা আপা। তোমার ছেলে তূর্ণ ওঁকেই তো পছন্দ করে।’

শুধা ফের জিজ্ঞেস করলেন,

‘ ওঁর নাম?’

‘ জুবিয়া রহমান।’ বললেন ফারিয়া।
.
.
বিয়ের সব আয়োজন হবে বাড়িতেই, অনুষ্ঠানের জন্য সাজানো হয়েছে বাড়ি। খাবার দাবারের আয়োজন হিসেবে জাঁকজমক ভাবে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে চৌধুরী বাড়ির পাশে বিশাল খোলা মাঠে। চৌধুরী বাড়িতে লেগেছে নতুনত্বের ছোঁয়া, অন্দরে মিলেছে ফুলের তোড়ায় প্রকৃতির মেলা। চারিদিকে বিয়েবাড়ির মরশুম। বিকেল হলো, এদিকে বাড়ির মেয়ে-বউ ও আত্মীয় স্বজনরা হলুদ-লাল শাড়ি পরে তৈরি হতে লাগল। তারপর বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরাঘুরি করতে লাগল। আরুশির কাজিনরা সেজেগুজে ছবি তোলার পাল্লা দিয়েছে। যে ছবিটা বেশি সুন্দর হবে, সেটা ফেসবুকে পোস্ট করবে। বাঙালি বিয়ের সাবেক নিয়মকানুন মেনেই হলুদে থাকবে মেহেন্দি, সঙ্গীত, নাচ এরপর গায়ে হলুদ মাখানো হবে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ঘড়িতে সময় ৭:২৫মিনিট। খোলা লনে দু’টি বসার স্থান সাজানো হয়েছে। একটায় উমাইয়া আর সাদাফ ও দ্বিতীয়টায় আরুশি এবং অনিক পাশাপাশি বসে আছে। স্টেজের সামনে ফাঁকা জায়গায় সঙ্গীত, ও নাচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। একটু দূরেই আত্মীয় স্বজন এবং হলুদে আমন্ত্রিত মেহমানরা পরিবেশের মজা নিচ্ছেন। দু’জন হেনা আর্টিস্ট বিয়ের কনেদের হাত মেহেন্দি দিয়ে রাঙিয়ে তুলছেন। আরও দু’জন হেনা আর্টিস্ট বাকিদের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতে লাগল। তূর্ণর পিছু নিয়েছে কয়েকজন। ওদের আবদার তূর্ণর মুখে গান শুনবে। তবে যে সে গান নয়, বাংলা গান। তূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল। মাইক হাতে নিয়ে এদিক ওদিক কাউকে খুঁজতে লাগল সে। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখল জুবিয়া এদিকটায় হেঁটে আসছে। লাল রঙের শাড়ি পরিহিত সে। তূর্ণ মুচকি হাসল। জুবিয়ার শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে চোখ রেখে একটা বাঙালি গান ধরল সে।

‘ কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না

ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে…’

লাল চুড়ি, হালকা লিপস্টিক ও চিকন করে কাজল। সাধারণ হলুদ-লাল ডুরে শাড়ি, সঙ্গে ফুলের হালকা টিকলি। চুলগুলো খোঁপা করে কয়েকটা গোলাপ ফুল খোঁপায় গেঁথে দিয়েছে রোদেলা। নিতান্ত অতি সাধারণ ভাবে সেজেছে সে। এভাবে শাড়ি পরে রুম থেকে বের হতে খানিক লজ্জা বোধ করছে। বারংবার আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে লাগল রোদেলা। কোনোদিক দিয়ে তাকে দেখতে সং লাগছে কী? সবাই দেখে হেসে গড়াগড়ি খাবে না তো? বারবার এমনটা মনে হতে লাগল। জুবিয়া এতক্ষণ রোদেলার জন্য অপেক্ষা করছিল। দু’জনের হলে একসঙ্গে নিচে যাবে। রোদেলা তৈরি কিন্তু নিচে যেতে সংকোচ করছে দেখে জুবিয়া এক প্রকার বিরক্ত হয়ে চলে যায়। রোদেলা একবার বাথরুমের দিকে তাকাল, মন বলছে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলতে। একই সঙ্গে মস্তিষ্ক বলছে, অন্য কথা। খোলা জানালা দিয়ে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। এই কণ্ঠটা রোদেলার চেনা। সে ঢাকা কনসার্টে শুনেছে। পরোক্ষণে মনে হলো এটা তূর্ণর কণ্ঠ। রোদেলা আগে কখনো শাড়ি পরেনি। ওঁর যত ভয় এখানেই। হাঁটতে নিলেই মনে হচ্ছে কুঁচি খুলে যাবে কিংবা সে শাড়ির সঙ্গে পা পেঁচিয়ে পড়ে যাবে। বাঁ হাতে কুঁচি খানিক উঁচু করে সিঁড়ি পর্যন্ত হেঁটে এলো। সব জায়গায় মানুষ গিজগিজ করছে। সিঁড়িতেও তিন চারজন দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। রোদেলা কে দেখে একবার ওর দিকে তাকাল তারপর আবার নিজেদের কথায় লেগে যায়।

বাড়ি ভর্তি মানুষ কাউকেই চিনে না রোদেলা। সন্দিহান দৃষ্টিতে প্রতিটা মানুষের সাজগোছ দেখতে লাগল সে। সকলের মাঝে নিজেকে কেমন তুচ্ছ মনে হলো। এরপর লনে এসে দাঁড়াল। বসার জন্য কোনো চেয়ার খালি নেই। তূর্ণ গান গাইছে দেখে মানুষের ভিড়, দাঁড়ানোর জায়গা ও সীমিত। এত মানুষের ভিড়ে জুবিয়াকে খুঁজে পেল না রোদেলা। একবার উমাইয়াকে দেখে সে অন্য দিকে চলে যেতে উদ্যত হলো। মাথার উপর ঝাড়বাতি গুলো টিপটিপ করে জ্বলছে। রোদেলা মৃদু হাসল। এক সময় হেঁটে হেঁটে বাগানের দিকে চলে আসলো। এই দিকটা শান্ত ও ছিমছাম পরিবেশ, তূর্ণর গান এখানে দাঁড়িয়েও বেশ শোনা যাচ্ছে। রোদেলা আরেকটু এগিয়ে গেল। ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর মন ফুরফুরে হয়ে উঠল তার। এই জায়গায় তাকে দেখার মতন কেউ নেই ভেবেই প্রশান্তি অনুভব করল। পরোক্ষণেই মনে হলো এই সময় তার উমাইয়ার পাশে থাকা উচিত। তারাহুরো করে উঠে দাঁড়াল রোদেলা। শাড়ি ধরে দ্রুত হাঁটতে নিয়ে হঠাৎ কিছু পায়ের সঙ্গে লেগে যায়। রোদেলা ঝুঁকে বসল। একটা তাঁরের সাথে পা আঁটকে গেছে। দু-হাতে তাঁরটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল।

বাড়ির ভেতর অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সেহরিশ। কোথাও গিয়ে শান্তি পাচ্ছে না। বার বার ইতালি থেকে কল আসছে। যত দ্রুত সম্ভব ইতালি যাওয়ার জন্য প্রেসার দিচ্ছে ওদের কোম্পানির অনার। সেহরিশ ফোনে কথা বলতে বলতে বাগানের দিকে এগিয়ে গেল। সেহরিশের বাঁ হাতে সফট ড্রিংকে ভরা একটা গ্লাস। রোদেলা বসা থেকে আচমকা উঠে দাঁড়ায়। সেহরিশের সাথে ধাক্কা লাগল রোদেলার। হাতের গ্লাসটা উল্টে পড়ল। রোদেলার শাড়ি ভিজে গেছে। গ্লাসটা নিচে পড়ে অদ্ভুত শব্দ তুললো। সেহরিশ চোখ-মুখ খিঁচে শক্ত ও গম্ভীর গলায় ধমক দিল,

‘ চোখে দেখতে পাও না?’

সহসা রোদেলা মুখ তুলে তাকাল। বিস্মিত গলায় বলল,

‘ আমি আপনাকে আসতে দেখিনি। আ’ম স্যরি।’

সেহরিশ পূর্বের চেয়ে আরও গম্ভীর গলায় বলল,

‘ আপনি? সব সময় আপনার জন্য আমাকে বিপদে পরতে হয়। এখনো সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। যাচ্ছেন না, কেন?’

রোদেলা হালকা কেঁপে উঠল। চোখে একটু জল আসলো। রোদেলা মাথা নিচু করে বাগান থেকে বেরিয়ে সোজা লনে চলে গেল। এখানটায় এখন মানুষ নেই, অনেকেই হাতে মেহেদী পরতে স্টেজে ভিড় করেছে। কয়েকজন নাচ-গানের আসরে বসে আছে। রোদেলা একপাশে দাঁড়িয়ে গেল। উমাইয়ার চোখ যেন এতক্ষণ রোদেলা-কেই খুঁজছিল। চোখের ইশারায় বার কয়েক রোদেলাকে নিজের কাছে ডাকলো উমাইয়া। রোদেলা হাত দিয়ে ইশারা করল ওঁ এখানেই ঠিক আছে।

জুবিয়া হাতে মেহেদী পরছে। পাশেই বসে আছে তূর্ণ, হেনা আর্টিস্ট কিভাবে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছেন সেটাই দেখছে সে। তূর্ণ হঠাৎ জুবিয়ার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ হাতের মাঝে আমার নামটা লিখবেন। তারপর দেখবেন মেহেদীর রঙ গাঢ় হবে।’

জুবিয়া বলল,

‘ আপনার হাতের উপর আমার হাতটা রাখি? তাহলে ডিজাইন আরও সুন্দর হবে। এবং আপনার হাতের স্পর্শে মেহেদীর রঙ গাঢ় নয় বরং কুচকুচে কালো হবে। ভালো না?’

তূর্ণ অনিচ্ছুক হাসল। সাদাফ বলল,

‘ তূর্ণ?’

‘ হু।’

‘ সেহরিশ কোথায়?’

‘ দেখিনি।’

‘ একটু দেখ। খুঁজে এখানে নিয়ে আয়।’

তূর্ণ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,

‘ ওঁ আসবে না। ওঁর এসব ফাংশন পছন্দ না। ভুলে গেছিস।’

‘ তবুও… একটু যা।’

‘ পারব না।’
.
.
চৌধুরী বাড়ির প্রাঙ্গণে এক অভিমানী নারীর চোখ বেয়ে পড়া ফোঁটা কয়েক চোখের জল আড়াল হয়নি সেহরিশের দৃষ্টি থেকে। সেহরিশের হৃদয়ে বাঁধা পড়ল ভীতি চোখের টলমল করা ফোঁটা কয়েক অশ্রু। সামান্য এক গ্লাস ভাঙ্গায় এমন আচরণ মেয়েটি ডিজার্ভ করে না। অন্ধকারে হুট করেই রোদেলা সামনে চলে আসে। কোম্পানির সিইওর সাথে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল সেহরিশের, সিইওর উপর জমা রাগ রোদেলার উপর ঢেলে দিয়েছে। সেহরিশ রাগের কারণে তখন খেয়াল করেনি রোদেলার শাড়িটা ভিজে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় ধরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে লনের সমস্ত আয়োজন ও সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। রোদেলাকে দেখতে পেল সেহরিশ। উজ্জ্বল আলোর কারণে হলুদ রঙের শাড়ির ভেজা জায়গা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। এরপর ফোন হাতে নিয়ে কাউকে কল করল সে।

ভেজা শাড়ির জন্য ইতস্তত বোধ করছে রোদেলা। এখান থেকে একটু নড়লেই কারো না কারো চোখে পড়বে সে। তখন অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ভয়ে নড়তে পারছে না। রুমে গিয়ে চেঞ্জ করবে তারও উপায় নেই। এই শাড়িটা চেঞ্জ করে তাকে থ্রিপিস পরতে হবে। আর পুরোনো থ্রি-পিস পরে রোদেলা এখানে আসতে পারবে না। নিজের করুণ অবস্থার উপর ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।

দশ মিনিটের মাথায় একজন লোক বাইক নিয়ে আসলেন। সেহরিশের ম্যানেজার লোকটার সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এবং ক্যাশ কিছু টাকা লোকটার হাতে থামিয়ে দিলেন। বাগানেই দাঁড়িয়ে আছে সেহরিশ। ম্যানেজার এসে বললেন,

‘ স্যার এই যে নিন।’

সেহরিশ পার্সেলটা ওনার হাত থেকে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। রোদেলার সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বলল,

‘ আমার সাথে চলুন।’

রোদেলা বলল,

‘ কোথায়?’

‘ প্রশ্ন করবেন না। চুপচাপ চলুন।’

রোদেলা এদিক ওদিক তাকাল। এত অল্প সময়ে বোধগম্য হলো না সে কী করবে? অজ্ঞতা সেহরিশের পিছু পিছু যেতে লাগল। সেহরিশ বড়োবড়ো পা ফেলে অনেকটা এগিয়ে গেছে। হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখল রোদেলা অনেক পিছনে পরে আছে।

সেহরিশ গলা তুলে বলল,

‘ একটু তারাতাড়ি হাঁটুন।’

সেহরিশ দুই সিঁড়ি উপরে, রোদেলা দুই সিঁড়ি নিচে ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগল। সেহরিশ একপলক তাকাল রোদেলার দিকে। তারপর চটজলদি দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। সেহরিশ বলল,

‘ ভেজা কাপড় পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চেঞ্জ করেন নি কেন?’

রোদেলা দাঁড়িয়ে গেল। অকপটে বলল,

‘ কাপড় বদলে পরার মতন এক্সট্রা কাপড় নেই।”

সেহরিশ ঘুরে তাকাল রোদেলার অভিমুখে। তারপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলে উপরে এসে জিজ্ঞেস করল,

‘ আপনারা কোন রুমে উঠেছেন?’

আরুশির পাশের ঘরটি দেখাল রোদেলা। সেহরিশ ধাক্কা দিল ভেতর থেকে বন্ধ। বার কয়েক ডেকেও কারো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আরুশির রুমের সামনে গিয়েও ফিরে আসলো, রুম লক করা।

‘ আমার রুমে চলুন।’ বলল সেহরিশ।

রোদেলা আঁতকে ওঠা কণ্ঠে শুধাল,

‘ কেনো?’

বলিষ্ঠ দেহের মানুষটা পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াল। রোদেলার দিকে সাদা কাগজে পেঁচানো একটা বস্তু থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ আমার জন্য আপনার শাড়িটা নষ্ট হয়েছে। তাই অর্ডার করেছি। এর ভেতর আপনার জন্য একটা শাড়ি রয়েছে। এখানের প্রায় সব গুলো রুমই ব্লকড। তাই আমার রুমে যাবেন শাড়ি পরে আবার চলে আসবেন। নেগেটিভ ভাবার কিছু নেই। আপনি চেঞ্জ করার সময় আমি রুমের বাহিরেই থাকব।’

সেহরিশ রুমের লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। সে অন্ধকার রুমে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এজন্য বেশিরভাগ সময় রুমের লাইট অফ করে অন্ধকার বানিয়ে রাখে। রোদেলা রুমে প্রবেশ করার আগে রুমের লাইট গুলো অন করল সেহরিশ। রোদেলা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এমন সুন্দর ও গোছানো রুম সে জুবিয়ার ফোনে দেখেছে। আধুনিক ও আকর্ষণীয় জিনিসপত্র দিয়ে বেশ পরিপাটি সাজানো গোছানো। রুমের সবকিছু সাদা রঙের, যেন এক টুকরো সাদা মেঘ। সেহরিশ রোদেলাকে বাথরুম দেখিয়ে দিল এরপর কোন নল’টা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। সব দেখিয়ে দিয়ে সে রুমের বাহিরে চলে যায়।

রোদেলা কাগজের ভেতর থেকে কাপড়টা বের করে। শাড়িটি দেখল নিমিষেই অবাক চোখে বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। মিষ্টি কালার কটন সুতির নরম কাপড়। হলুদ শাড়ি বদলে মিষ্টি রঙের শাড়ি পরে নিল রোদেলা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে নিল। মুখের সাজ ঠিকঠাক আছে। শুধু খোঁপার ফুলগুলো মরে মরে গেছে। রোদেলা চুল থেকে ফুলগুলো তুলে রাখল এরপর খোলা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দেয়। তারপর চিরুনি দিয়ে একবার চুল আঁচড়ে নিয়ে রুম থেকে বের হলো।

রোদেলা মিষ্টি রঙের শাড়ি পরেছে। ওর ফর্সা ত্বকে, শাড়িটা কী ভীষণ সুন্দর মানিয়েছে। প্রথম দেখায় চোখ সরাতে পারল না সেহরিশ। শাড়ির উপরে খোলা চুলগুলো সেহরিশকে টানছে খুব। না চাইতেও বারংবার চোখ গিয়ে পরছে রোদেলার উপর। সেহরিশ মাথা নিচু করে ফেলল। রোদেলা কাছাকাছি এসে দাঁড়াল সেহরিশ মৃদুস্বরে বলল,

‘ দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলুন, নিচে যাই।’

সেহরিশ ইতোমধ্যে ঘেমে-নেয়ে উঠেছে। কপাল বেয়ে স্রোতের মতন নেমে গেল ফোঁটা ফোঁটা স্বেদজল। রোদেলা হাতের কাপড়টা তুলে ধরে বলল,

‘ এগুলো কোথায় রাখব?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here