#আশিয়ানা
#পর্ব_২৩
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
পূর্ব দিকের বৃক্ষের ডালে দুটি পাখি ডানা ঝাপ্টাল, শুঁকনো মরমরে পাতা মাটিতে লুটিয়ে পরে। গাছের ডালে বসেই কয়েক জোড়া পাখি কিচিরমিচির করে ডাকতে লাগল। রাতের আঁধারে সম্পূর্ণ জঙ্গল ঘুরে এসে এক বৃক্ষের গুড়িতে বসে বিশ্রাম নেয় সেহরিশ। শরীর ক্লান্ত হওয়ার চোখ লেগে আসে সেহরিশের। গাছের লতাপাতা বাতাসে নড়েচড়ে উঠল, পাতাগুলির ফাঁক গলিয়ে সূর্যের প্রথম আলো সেহরিশের মুখমণ্ডলে এসে পরতে সে আবছা চোখে চারিদিকে চোখ বুলালো। নড়েচড়ে উঠে বসার সঙ্গে সঙ্গে তার ডান হাতের মুঠোয় নজর গেল। গতকাল রাতের ঘটনা, গাড়ির ভেতর থেকে ফোনটা বের করে যখন টর্চ অন করে তখন লোকটার মুখ স্পষ্ট হয়। চেহারার ঘটন বাঙালির মতন। নিশ্চিত তার ওপর আক্রমণ করার জন্য বাঙালি গুণ্ডাদের ভাড়া করেছে। মাটির ওপর পরে রয়েছে পিস্তল। দ্রুত পিস্তলটা তুলে নেয় সেহরিশ। এরপর জঙ্গলের দিকে ছুটে যায়। অন্ধকারে একজন সুঠামদেহি পুরুষ বিলীন হয়ে যায়। সেহরিশ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। পিস্তলের ভেতর গুলি নেই। সেহরিশ অবাক হলো। সে স্পষ্ট গতরাতে তিনবার গুলির শব্দ শুনেছে। তাহলে এর অর্থ কী? সেহরিশ গম্ভীর চিত্তে বসল। থুতনিতে একহাত রেখে বিরবির করে বলল,
‘ এটা স্পষ্ট হলো যে বা যারা আমার ওপর অ্যাটাক করতে চেয়ে ছিল তারা আমাকে প্রাণে মারতে নয় বরং তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে ভয় দেখানো। নয়তো কিডন্যাপ করা।’
সেহরিশ উঠার চেষ্টা করে আবারও গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসল। গত রাত থেকে সে কিছু খায়নি। শরীরে নুন্যতম শক্তি নেই। এই জঙ্গলের শেষ কোথায়? এটাও তার জানা নেই। ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। কোনোক্রমে ওঠে দাঁড়াল সে। হাত ঘড়িটা সম্ভবত পথেই কোথাও পরে গেছে। সেহরিশ চোখ জোড়া ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। এক একটা গাছ বিশাল বড়বড় গাছের শিকড় গুলি মোটাসোটা। রাতে সে চলার সময় আন্দাজ করেছিল। সেহরিশ একটু এগিয়ে আসার পর দেখতে পেল একটা সরুপথ। সম্ভাবনা রয়েছে এই পথ ধরে সে রাস্তায় উঠতে পারবে।
সিরাজগঞ্জ সদর থানার এসআই এবং পুলিশ ডিপার্টমেন্টের স্পেশাল ফোর্স সেহরিশ কে জঙ্গলে খুঁজতে লাগল। সদর থানার ওসি জঙ্গলের ভেতরে কাঁচা রাস্তায় একটা গাড়ি দেখতে পান। সেহরিশের গাড়িটা দেখে সাদাফ আর তূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায়। পুলিশ এবং বডিগার্ডদের ছাড়াই নিজেদের গাড়িতে ওঠে পরে। সাদাফ গাড়ি চালাচ্ছে। তূর্ণ জানালা দিয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সেহরিশের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। বেশ দূরে একজন লোককে দেখতে পেল তূর্ণ। জঙ্গলের এক দিকের রাস্তা থেকে বের হচ্ছে। তূর্ণ দ্রুত সাদাফকে গাড়ি থামানোর জন্য বলে। এরপর দ্রুত দুজন গাড়ি থেকে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। মধ্যবয়স্ক লোক, মাথায় কাঠের টুকরো। জঙ্গলেই কাঠ কাটেন। সাদাফ তার ফোন বের করে। সেহরিশের ছবি লোকটাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ চাচা, এই লোকটাকে এদিকে দেখেছেন?’
লোকটা বিজ্ঞ চোখে তাকাল। কিয়ৎকাল পর বলল,
‘ না বাবা। এইদিকে লোকজন তেমন আহে না।’
তূর্ণ দ্রুত সাদাফের কাঁধে হাত রাখল। এরপর উচ্চকিত গলায় বলল,
‘ তারাতাড়ি গাড়িতে উঠ। এভাবে সময় নষ্ট করলে চলবে না। সাতটা অলরেডি বেজে গেছে। জানি না সেহরিশ কি অবস্থায় রয়েছে?’
তূর্ণ এগিয়ে গেল। গাড়ির দরজা খোলার জন্য উদ্যত হলো সে। সে-সময় গাড়ির দরজায় কারো প্রতিচ্ছবি পড়ে। জঙ্গলের দিক থেকে বেরিয়ে আসছে। তূর্ণ ঘুরে তাকাল। সেহরিশ কে দেখে সে চেঁচিয়ে ওঠে। সাদাফ গাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে মাথা উঁচিয়ে তাকাল। এরপর ছুটে গেল। তূর্ণ আর সাদাফকে দেখামাত্র হাফ ছাড়ল সেহরিশ।
ব্যাহত কণ্ঠে বলল, ‘ আমায় ধর।’
দুই ঘন্টা যাবৎ পুলিশ ইন্সপেক্টর শায়ের মির্জা সেহরিশের বাড়িতে বসে আছেন। সেহরিশ গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। সাদাফ এবং তূর্ণর সঙ্গে কথা বলে উঠে দাঁড়াল সে।
শায়ের শক্ত গলায় বলল,
‘ উনি যখনি হুঁশে আসবেন। থানায় ইনফর্ম করবেন।’
শফিকুল চৌধুরী বললেন,
‘ জি অবশ্যই।’
ফারিয়া সেহরিশের পাশে বসে রয়েছেন। আরুশি এবং মাইমুনা দুজন একসাথে রান্নাঘরের দিকটা সামাল দিচ্ছেন। বাড়ির লোকজনের খাবারের ব্যবস্থা করছে। শফিকুল চৌধুরী ইন্সপেক্টর শায়ের মির্জাকে বার কয়েক সেধে ছিল সকালের নাস্তাটা তাদের সঙ্গেই করার জন্য। কিন্তু শায়ের কাজের তারাহুরো দেখিয়ে চলে যান। সাদাফ তীক্ষ্ণ চাহনিতে সেহরিশের ম্যানেজার দিকে তাকাল। লোকটা ভয় পেয়ে যান এবং দৃষ্টি মাটির ওপর ফেললেন। তূর্ণ এদিকওদিক তাকাল। তখন আরুশি রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তূর্ণ আরুশিকে ডাকলো। আরুশি এগিয়ে এলো তূর্ণর সামনে দাঁড়িয়ে শুধাল,
‘ কিছু বলবা ভাইয়া?’
তূর্ণ বলল,
‘ হুম। ঠাণ্ডা পানি হবে?’
‘ হ্যাঁ হবে। তুমি বসো। আমি নিয়ে আসছি।’
মাইমুনা ব্যস্ত হাতে একপলক আরুশির দিকে তাকাল। এরপর বলে উঠল, ‘ ফ্রিজে লেবু রয়েছে। গতকালই বাজার থেকে কামরুল চাচা নিয়ে আসছেন। লেবু, চিনি দিয়ে ঠাণ্ডা শরবত বানিয়ে দাও। ওদের ভালো লাগবে।’
আরুশি বলল,
‘ আমি বানাবো? যদি ভালো না হয়?’
মাইমুনা বলল,
‘ তুমি চুলার কাছে আসো। আমি শরবত বানিয়ে দিচ্ছি।’
মাইমুনা বেশি করে শরবত বানিয়ে গ্লাসে ভরে দিল। আরুশির উদ্দেশ্য বলল, ‘ বাড়ির ভেতরে তুমি শরবত দিও। আর বাহিরে গার্ডদের জন্য শরবতের ট্রে নীলু আপাকে দিয়ে পাঠাইও। ওদের সামনে তোমার যাওয়ার দরকার নাই।’
মারিয়া ওর প্রিয় পুতুল কোলে নিয়ে ড্রয়িংরুমে ছুটাছুটি করছে। আরুশি ওকে দেখে ধমক দিয়ে উঠল। হুট করে পরে গেলে ব্যথা পাবে। সাদাফ নরম হয়ে আরুশিকে বলল, ‘ ছোটো মানুষ এখনই দুষ্টুমি করবে। ওকে বকিস না৷’
সেহরিশের ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পর। ঘুম থেকে উঠেই সাওয়ার নেওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকে গেল। সাদাফ আর তূর্ণ বিছানায় বসে সেহরিশের বের হওয়ার অপেক্ষা করছে। কোমরে একটা তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বের হলো সেহরিশ। হাতের মুঠোয় অন্য একটা তোয়ালে নিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছে নিতে লাগল। এরপর আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তূর্ণ জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাদাফ দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেহরিশ হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে। সেহরিশ তোয়ালে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখে এরপর কাপড়ের ভাজ থেকে পিস্তলটা বের করে বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলল। ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকাল সাদাফ।
তূর্ণ শুধাল,
‘ পিস্তল?’
সেহরিশ গম্ভীর চিত্তে বলল,
‘ যে লোকটা আমার গাড়ির পিছনে ছিল। এটা তার কাছেই ছিল। আশ্চর্য জনক হলো পিস্তলে একটা গুলিও নাই।’
সাদাফ বিষ্ময় নিয়ে বলল,
‘ কাউকে সন্দেহ করছিস?’
আলমারির কাভার্ড থেকে টিশার্ট বের করে পরে নিল সেহরিশ। সাদাফের মুখপানে একবার তাকাল। নির্মল গলায় বলল, ‘ নাহ।’
৮টা বাজে। সেহরিশের রুমে এসে ফারিয়া দু’বার ডেকে গেছেন। রাত অনেক হচ্ছে, এখুনি রাতের খাবার খেতে হবে। বাধ্য হয়েই খাবার টেবিলে এসে সবাই বসে গেল। ফারিয়া আজ নিজ হাতে সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিবেন। জোর করে মাইমুনা কেও টেবিলে বসিয়ে দিয়েছেন। সেহরিশের মুখোমুখি বসেছে সাদাফ।
সেহরিশ বিমোহিত গলায় বলে উঠল,
‘ সাদাফ?’
ডাক শুনে চোখ তুলে তাকাল সাদাফ। সেহরিশ বলল,
‘ আগামীকাল ২৯ এপ্রিল। তোকে পাত্রীর বাবা মা দেখতে আসবেন।’
খাবার মুখে বিষম খেল সাদাফ। কাশি উঠে গেল তার। সেহরিশ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে। ফারিয়া দ্রুত এগিয়ে এলেন। এক গ্লাস পানি সাদাফের দিকে এগিয়ে দিলেন এবং সাদাফের মাথায় অনবরত চাপড় দিচ্ছেন।
তূর্ণ হতবিহ্বল অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘ পাত্রী কে?’
সেহরিশ তূর্ণর দিকে তাকানোর আগ্রহ পেল না। শান্ত স্বরে বলল,
‘ উমাইয়া সুলতানা।’
চলবে….