আশিয়ানা #পর্ব_২৪ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
193

#আশিয়ানা
#পর্ব_২৪
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
চাঁদের হদিশ নেই। বাতাসের সঙ্গে এক সাঁতসেতে, গন্ধ নাকে এলো। আকাশের চেহারা পাল্টাচ্ছে ঘন-কালো মেঘে ছেঁয়ে যাচ্ছে। সরু পায়ে ছাঁদে হাঁটছে সেহরিশ। সে-সময় মাথার ওপর কয়েকটা বাদুড় উড়ে গেল। হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেল দাঁড়িয়ে পড়ল সেহরিশ। সাদাফ জিজ্ঞেস করল, ‘ আমি শব্দ করিনি। তোর পিছনে কেউ রয়েছে তুই না দেখে বুঝিস কিভাবে?’ সেহরিশ নড়ছে না। সাদাফ এগিয়ে এসে পূণরায় জিজ্ঞেস করল, ‘ কি হলো? চুপ যে?’ সেহরিশ জায়গা অতিক্রম করে হালকা গলায় বলল, ‘ আমার ১০/১৫ ফিট্ দূরত্বের ভেতর যদি কেউ থাকে আমি অটোমেটিক বুঝতে পারি। তার নিঃশ্বাস এবং তাকিয়ে থাকায় আমার সিক্স সেন্স স্পষ্ট জানান দেয়, সামওয়ান দেয়ার।’ তূর্ণ এগোল। এরপর তূর্ণ সেহরিশের হাত জড়িয়ে ধরল। তূর্ণ বলল, ‘ ভাই, তুই যেভাবে সাদাফের হবু শ্বশুর মশাইকে রাজি করিয়ে ছিস সেভাবে আমার টাও করিয়ে দে।’ ছাঁদে বেশ কয়েকটি লাইট জ্বলছে। সেহরিশ স্পষ্ট তূর্ণর মুখটা দেখতে পেল। ভ্রু পল্লব বাঁকিয়ে শুধাল, ‘ তোর বিয়ে?’ তূর্ণ লজ্জামাখা গলায় বলল, ‘ হুম।’ সেহরিশ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘ তোর বাবা-মা ওনাদের নিয়ে এখানে তোর বাড়িতে ওঠ। তারপর সময় করে জুবিয়া ওর বাবার সঙ্গে আলাপ কর। খানিক সময়ের ব্যাপার তবে বিয়ে পাকাপোক্ত করার দায়িত্ব আমার।’ তূর্ণ সঙ্গে সঙ্গে রেগে গেল। তূর্ণ রাগত গলায় বলল, ‘ তুই আমার পক্ষ নিস না কেনো?’ বলে খানিক থামল তূর্ণ। বিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘ আমার বাড়ি? এখানে আমার বাড়ি রয়েছে? আমি মনে পরছে না।’ বলে থামল তূর্ণ। এরপর সেহরিশ জায়গা পরিত্যাগ করে। তূর্ণ চটপট পায়ে চলছে সেহরিশের পিছু। সাদাফ পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল। সেহরিশ সিঁড়ি ভেঙে তার রুমের সামনে আসামাত্র সাদাফ ওর হাত ধরল৷ নিরর্থক প্রশ্ন করল, ‘ আমাকে জানাসনি কেন?’
‘ কোন ব্যাপারে?’
‘ আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলছিস অথচ আমায় জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি।’
সেহরিশ শ্লেষের স্বরে বলল, ‘ তুই যে কচ্ছপের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিস। সেভাবে চলতে থাকলে মনে হয় না, একবছরেও কিছু হবে। এরচেয়ে ভালো বিয়ে করে ইতালি নিয়ে চল। তারপর ইচ্ছে মতো প্রেম করে শখ চুকিয়ে নিবি।’
সেহরিশ রুমের ভেতর ঢুকে গেল। এরপর দরজা বন্ধ করে ফেলল। তূর্ণ হেঁটে এসে সাদাফের হাত জড়িয়ে ধরে ফ্যাকাশে গলায় বলল, ‘ আমার বিয়ে কবে হবে?’

সাদাফ তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকাল তূর্ণর দিকে। তারপর জোর করেই তূর্ণর হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে লাগল। তূর্ণ উজবুক এর মতো দ্বিতীয় তলা থেকে নিচ তলায় নেমে এলো। শফিকুল আর ফারিয়া ড্রয়িংরুমে সোফায় পাশাপাশি বসে কথা বলছেন। তূর্ণ হঠাৎ এসে তাদের মাঝখানে জায়গা করে বসে গেল।অভিমান ভরা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ আমি তোমাদের ছেলে নই?’ শফিকুল হতচকিত দৃষ্টিতে একবার ফারিয়াকে দেখলেন৷ এরপর বললেন, ‘ সোহান, সেহরিশ, আরুশি মতো তোরাও আমাদের সন্তান।’ তূর্ণ গম্ভীর এবং ফিচেল স্বরে বলল, ‘ না। তোমরা শুধু আরু আর সাদাফকে ভালোবাসো আমাকে একটু বাসো না।’ ফারিয়া অবাক হলেন। তূর্ণর কাঁধে একহাত রাখলেন তিনি। বললেন, ‘ তুমি এসব কি বলছ বাবা? এত বছর ধরে তোমাদের কখনো আলাদা ভাবছি আমরা?’ বলে থামলেন ফারিয়া। একহাতে তূর্ণর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এরপর বললেন, ‘ তুমি যখনই দেশে এসেছ, প্রতিবার আমাদের সঙ্গে দেখা করে গেছ। তোমাকে পর কিভাবে ভাবি?’ তূর্ণ দেনামনা করতে লাগল। সহসা ফারিয়ার কাঁধে মাথা রাখল তূর্ণ। মিনমিনে আওয়াজে বলল, ‘ তোমরা সাদাফের বিয়ে দিচ্ছ। আমারও বিয়ে দাও।’ শফিকুল বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। পিটপিট করে তাকিয়ে রইলেন। ফারিয়া শব্দ করে হেসে উঠল, ‘ তোমার পছন্দের কেউ রয়েছে?’ তূর্ণ তাত্ক্ষণিক মাথা ঝাঁকাল। যেন সে এই প্রশ্নের অপেক্ষাই করছিল। চিরল গলায় বলল, ‘ হ্যাঁ।’ শফিকুল হাল্কা হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কে সেই ভাগ্যবতী নারী? নাম কী? বাড়ি কোথায়?’

_____________

শফিকুল চৌধুরীর বাবা দু-গ্রামের মাতব্বর ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গ্রামের লোকজনকে দু’হাতে আঁগলে রাখেন। তিনি মারা গেছেন দুই যুগ পেরিয়ে গেছে তবুও লোকজনের মনে তার প্রতি ভালোবাসা শ্রদ্ধা আগের মতোই রয়েছে। শফিকুল চৌধুরী আর্মিতে ছিলেন তিনিও গ্রামের লোকজনের থেকে প্রসংশা ভালোবাসা পেয়েছেন। বংশগত ভাবে চৌধুরী বাড়ির নাম রওশান এখনো বজায় রয়েছে। এক নামেই এখানকার সকলে চিনে। উমাইয়ার বাবা আর তার স্ত্রী সকাল সকাল বাসা থেকে বের হলেন। গতকাল সেহরিশ কে ওনারা কথা দিয়েছেন। আজ সকালেই তাদের বাড়িতে তারা যাবেন। গরিব হলেও ওনারা এক কথার মানুষ। কথা যেহেতু দিয়েছেন অবশ্যই রাখবেন। রিকশাওয়ালে বেশি কিছু বলতে হলো না। শুধু বলল, ‘ দেওয়ান চৌধুরীর বাড়ি যাব।’
চারিদিকে বিশাল গাছের সারি। তার মাঝখানে এক সাদা রঙের বিশাল গেইট। রিকশার বেলের আওয়াজে দারওয়ান কেঁচি গেইট খুলে উঁকি দিলেন। কিন্তু ধমকানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ সক্কাল সক্কাল বেজ বাজাও কেন? কাকে চাও?’
‘ সেহরিশ বাবা আসতে বলেছিলেন।’
সেহরিশের নাম শুনে কেঁচি গেইট পুরোপুরি খুলে বেরিয়ে এলো দারওয়ান। এরপর তিনি শুধালেন, ‘ আপনি উমাইয়া ম্যাডামের বাবা মা?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ আমার সাথে ভেতরে চলুন। আপনারা আসবেন রাইতেই ছোটো সাহেব বলে রাখছিল।’

সাদাফ থরথর করে কেঁপে ওঠে। এই অনুভূতিটা সে চিনে। এমন অনুভূতি এর আগে হয়েছিল, যখন সে প্রথম বার স্টেজে পারফরম্যান্স করে এবং প্রথম প্রথম ফ্যানদের সঙ্গে দেখা করার সময়। তখন অনুভূতি ছিল অন্য রকম। ভালো লাগা এবং মন বিচলিত দুটোই একসঙ্গে হয়েছিল। তবে আজ। কেন?
শফিকুল স্থির হয়ে বসে আছেন। গ্রামের লোকজন এখনো তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে দেখে তার ভালো লাগল। শফিকুল সাদাফ কে নিজের ছেলের পরিচয় দিলেন। এবং এটাও বলে তার আপন বাবা দুনিয়ায় নেই। আত্মীয় স্বজন বলতে দূর সম্পর্কের দুজন চাচা আছেন তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সাদাফের নেই। উমাইয়ার জন্য সাদাফের বিয়ে সম্মন্ধ এসেছে। এটা নিয়ে মনকে মন অস্বস্তি হয়ে আছেন উমাইয়ার বাবা। একজন সেলেব্রিটি তার মতো গরিবের মেয়ে কে বিয়ে কেন করবে? তার জন্য তো দেশের অর্ধেক মেয়ে পাগল। শফিকুল ঘটনা বুঝানোর চেষ্টা করেন। হুট করে নার্গিস বলে উঠলেন, ‘ ছেলে দুধের মতন ফর্সা। আমার পছন্দ হইছে। কিন্তু আমার উমা বিয়ের জন্য রাজি হবে না। ও এখনই বিয়ে করতে চায় না।’ তূর্ণ বলে উঠল, ‘ চিন্তা করবেন না। আমরা ওনাকে রাজি করিয়ে নিব। মে মাসের ৭তারিখে আমাদের কনসার্ট রয়েছে। গাজীপুর গিয়ে তারই প্রাক্টিস করতে হবে। আপনারা বরং আমার হবু ভাবীকে কল করবেন বলবেন ওনার বিয়ে ঠিক করেছেন। শুধু পাত্রর নাম বলবেন না। একটু মজা করব।’ ফারিয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কনসার্ট শেষ করে তোমরা সিরাজগঞ্জ আসবা?’ প্রশ্নটা সেহরিশের জন্য ছিল। এজন্য সেই জবাব দিল, ‘ জি, মা৷ কনসার্ট শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের ভেতর আরুশির বিয়ের ঠিক সামলে নিবেন। ওর বিয়েটা হলেই সাদাফের বিয়ে হবে। এবং তারপর আমরা ইতালি ফিরে যাব। এমনিতে দুই দিনের জন্য এসে মাস দুয়েক হয়েছে গেছে।’ তূর্ণ সেহরিশের হাত চেপে ধরার উদ্যােগ নিল। এরপর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। তীক্ষ্ণ চোখের চাহনি দিয়ে ভস্ম করে দিতে চাইল সেহরিশকে। তূর্ণ মনে মনে অঙ্গীকার করে, তার নিজের জন্য যা করার তাকেই করতে হবে। একদিনে বাবা-মা সামলানো, অন্য দিকে জুবিয়া কে রাজি করানো তারপর তার বাবা মা বুঝানো। ভাবামাত্র তূর্ণর গলা শুঁকিয়ে এলো। সেহরিশ সোজাসাপ্টা ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ বিয়ের পর সাদাফ যদি উমাইয়া কে তার সাথে ইউরোপ নিয়ে যায়। আপনাদের তাতে আপত্তি আছে? যদি আপত্তি থাকে তাহলে জানাতে পারেন।’
ভদ্রলোক ইতস্তত করে বললেন,
‘ না, বাবা। আমাদের আপত্তি নাই। একজন মেয়ের জন্য বিয়ের পর তার স্বামী সব। স্বামীর কথামতো চলাচল করলে আল্লাহ খুশি হন। সেখানে যদি সাদাফ বাবা নিজেই আমাদের মেয়ে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চান৷ আমরা কেন শুধু শুধু বাঁধা দিব? আমাদের তিনটা মেয়ে। সবার বড় উমা। আমাদের আদরের।’ বলে হঠাৎই থেমে গেলেন তিনি। গলার স্বর যেন দলাপাকিয়ে যাচ্ছে। খানিক পর সাদাফের উদ্দেশ্য বললেন, ‘ তোমার কাছে খালি একটাই আবদার বাবা। এই গরিব কৃষক বাপের কাছে আমার মাইয়া সুখে ছিল কম কষ্ট দুঃখেই ছিল। তুমি আমার মেয়েরে একটু খুশি রাইখো। কখনো কষ্ট দিও না।’

ওনারা ওঠে চলে গেলেন। বাহির পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসার জন্য সঙ্গে গেল সাদাফ আর তূর্ণ। তাদের একটা গাড়িতে উঠিয়ে। ড্রাইভারকে সাবধানে পৌঁছে দিতে বলে। সেহরিশ গম্ভীর চিত্তে আরুশির বিবাহের সরঞ্জাম নিয়ে কথা বলতে চাইল। ছেলেকে ব্যক্তিগত ভাবে দেখার পর তার তেমন খারাপ মনে হয়নি। ছেলে কে আরুশির ও পছন্দ হয়েছে। দ্রুত বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করার জন্য বলে ওঠে দাঁড়াল সেহরিশ। সিঁড়ির দিকে একটু এগিয়ে আবারও থেমে গেল সে। চটপটে কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ বিকেলেই গাজীপুর রওনা দিবো।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here