#আশিয়ানা
#পর্ব_২৫
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
‘ আয়ান সেই কখন থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তোদের এতক্ষণেও হলো না? আর কতক্ষণ লাগবে রেডি হতে?’ উমাইয়া ঝাঁঝাল গলায় বলে চটজলদি খাটের দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার ওপর রাখা এলোমেলো জামাগুলো ভাজ করতে করতে আবারও তাড়া দিল সে। রোদেলা মৃদু গলায় বলল, ‘ আমি রেডি। জুবিয়া সেই দেরি করছে।’
উমাইয়া ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিছানার ওপর বসে বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল, ‘ ভার্সিটিতে আমরা বাসে করে যেতে পারতাম। সেখানে শুধু শুধু আয়ান কে ডেকে নিয়ে এলো। আর এখন তারই হচ্ছে না।’ বলে থামল উমাইয়া। এরপর বিছানা থেকে ওঠে সোজা বাথরুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাথরুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ তুলে জুবিয়া কে ডাকলো। জুবিয়া উচ্চতর কণ্ঠে জবাব নিল, ‘ পাঁচ মিনিট।’
রোদেলা নির্মূল কণ্ঠে বলল, ‘ আয়ান ভাই, সে অনেকক্ষণ যাবৎ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। একদিক থেকে সে আমাদের মেহমান-ই বটে। বাড়িতে আসা মেহমান কে বাহিরে বসিয়ে রাখা ভালো দেখায় না। তাকে বরং বাসায় নিয়ে আয়।’
রোদেলা কথা শেষ করা মাত্র উমাইয়া ফুঁস করে বলে ওঠল,
‘ এটা ভুলেও করিস না। তুই এখানে আসছিস একমাস হতে চলল। এখনো বাড়িওয়ালীর মতিগতি ঠিকঠাক ভাবে বুঝে উঠিসনি। উনি যদি জানতে পারেন, বাসায় ছেলে নিয়ে আসছি সোজা গ্রামে বাবার কাছে কল দিয়ে বলে দিবেন। এরপর হবে উল্টো ঝামেলা। গ্রামের লোকজন বলবে মেয়েগুলো শহরে গিয়ে খারাপ হয়ে গেছে। এর আগেও এমন হতে হতে বেঁচে গেছি। ভুলেও এমন কাজ চিন্তা করিস না। বাড়িওয়ালী খুব ডেঞ্জারাস।’
রোদেলা শুঁকনো গলায় বলল, ‘ আয়ান বাড়ির নিচেই দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িওয়ালী খালা ওর গাড়িতে আমাদের উঠতে দেখলে কিছু বলবেন না?’
উমাইয়ার কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাজ ফেললো। এরপর বলল, ‘ এক মিনিট আয়ান কে কল করে বলি, গলির মাথায় দাঁড়ানোর জন্য। আমার মোবাইলটা কোথায়?’
বিছানার বালিশের নিচে রাখা মোবাইলটা হুট করে বেজে ওঠে। রোদেলা দ্রুত ফোনটা উমাইয়ার দিকে এগিয়ে দেয়। উমাইয়া বলল, ‘ বাবা কল দিছে। তুই বোস। আমি কথা বলে আসি।’
ফোন হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল উমা। কলটা রিসিভ করে ফোন কানে লাগিয়ে প্রথমেই সালাম দিল সে। তারপর বলল, ‘ আসসালামু আলাইকুম বাবা। কেমন আছো তুমি?’
উমাইয়ার বাবা জবাব নিলেন খানিক বাদে, ‘ ওয়া-আলাইকুমুস সালাম মা। আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোরা কেমন আছিস?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই ভালো আছি। আম্মা কেমন আছে? আর বোনেরা কোথায়? তুমি নিশ্চয়ই টাকার জন্য কল দিয়েছো? আমি এমাসে নার্সিসার জবটা ছেড়ে দিছি। নতুন জায়গায় চাকরি নিছি সেখানে এখনো স্যালারি দেয়নি। স্যালারি পেলেই তোমাকে অর্ধেক পাঠিয়ে দেবো।’
উজ্জ্বল ইসলাম কিঞ্চিৎ রোমন্থন গলায় বললেন, ‘ আমি কি তোর কাছে শুধু টাকার জন্য কল করি?’
উমাইয়া সঙ্গে সঙ্গে জিব কাটলো। প্রতিমাসে এক তারিখ থেকে কল করা শুধু করেন উমাইয়ার বাবা উজ্জ্বল ইসলাম। আজ হঠাৎ কল করেছেন দেখে উমাইয়া ভাবে তিনি সম্ভবত টাকার জন্য কল করেছেন। উমাইয়া ইতস্তত করে জবাব দিল, ‘ আমি আসলে সে রকম কিছু বলতে চাইনি বাবা। মাসের শেষ তো আমি ভাবলাম।’
উমাইয়ার কথা শেষ হওয়ার পূর্বে উজ্জ্বল ইসলাম রাগী গলায় বললেন, ‘ শোন, আমি তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। সামনের মাসে যখনই কল দেবো গ্রামে চলে আসবা। ছেলের পরিবার তোমাকে দেখতে আসবে।’
উমাইয়া স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার বাবার বলা কথাগুলো যেন তার বুঝতে সমস্যা হয়েছে। সে পূনরায় জিজ্ঞেস করার আগেই উজ্জ্বল কল কেটে দেন। উমাইয়া পাথরের মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর রুম থেকে বার কয়েক আওয়াজ দিয়েও উমাইয়ার সাড়াশব্দ না পেয়ে বারান্দায় এলো রোদেলা। উমাইয়া কে ওর কাছে স্বাভাবিক লাগছে না। তাই নিকটে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, ‘ চাচা কি বলছেন? তুই বা থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
উমাইয়া রোদেলার সামনে থেকে চলে যায়। উমাইয়ার হঠাৎ বদল দেখে অবাক হলো রোদেলা। জুবিয়া রুম থেকে বের হতে হতে রোদেলাকে ডাকলো। আয়ানের গাড়িতে চড়ে চারজন একসাথে ভার্সিটিতে পৌঁছালো। উমাইয়া নিরব ভঙ্গিমায় বসে রইল পুরো দিন। কারো সাথে কথা বলেনি। আয়ান হুট করে জুবিয়ার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘ ওর কি হইছে? আজ এমন বুতুম পেঁচার মতো বসে আছে কেন?’
জুবিয়া আফসোস নিয়ে বলল, ‘ জানি না। আমাদের সঙ্গেও কথা বলছে। রোদের থেকে শুনছি বাসা থেকে বের হওয়ার আগে চাচা কল দিছিল। তিনি হয়তো কিছু বলছেন।’
বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে ওরা বাড়ি ফিরে এলো। তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। অন্য দিন হলে এই সময় রেস্ট্রন্টে গিয়ে কাজে লেগে পড়তো ওরা। উমাইয়ার আজ কাজে যাওয়ার ইচ্ছে টুকু নেই। ধুপ করে কল দিয়ে বিয়ের কথা বলে কল কেটে দিল তার বাবা৷ সে রাজি কি নয়, একবার জিজ্ঞেস অব্ধি করল না। সিঁড়ি ভেঙে উপরে ওঠে দরজার লক খুলতে গিয়ে চমকে ওঠে জুবিয়া। হুট করে বলে ওঠল, ‘ সামনের ফ্ল্যাটের সাদাফ ভাইয়া সম্ভবত সিরাজগঞ্জ থেকে চলে আসছেন। দেখ তার ফ্ল্যাটের সামনে কিছু বাক্স রাখা আছে।’
উমাইয়া একপলক, দু’পলক বাক্সগুলোর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকতে উদ্যত হল। পিছন দিক থেকে হাসির আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল উমাইয়া৷ সাদাফ আর তূর্ণ দুজন হাসাহাসি করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠে আসছে। উমাইয়াকে কে খুশিমুখে এগোতে নেয় সাদাফ। সহসা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে উমা। সাদাফ কিঞ্চিৎ অবাক হল ঘুরে তাকাল জুবিয়া এবং রোদেলার দিকে। জুবিয়া দাঁড়িয়ে সাদাফকে বিস্তারিত জানাতে লাগল। রোদেলা উমাইয়ার পিছু পিছু রুমে ছুটে এলো। সহসা উমাইয়ার হাত ধরে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘ উমা। আজ তোর কি হয়েছে? সারাদিন কারো সাথে কথা বলিসনি। দুপুরে ঠিকমতো খেলি না। সাদাফ ভাই কেও উপেক্ষা করলি। তুই তো এমন না। কি হয়েছে আমায় বল…’
উমাইয়া তার ভেতর আঁটকে রাখা কান্নাটাকে হঠাৎ উপচে ফেলল। রোদেলা কে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল সে। কান্না জড়িত গলায় বলল, ‘ আমি অন্য লোককে বিয়ে করব না। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করছে।’
দরজার সামনে এসে সবেমাত্র দাঁড়াল জুবিয়া। উমাইয়ার কথা শুনে তার চোখ বড়সড় হয়ে গেল। চটজলদি এগিয়ে এলো সে উমাইয়ার কাছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘ ছেলে কে তুই জিজ্ঞেস করিসনি?’ বলে থামল জুবিয়া তারপর আবারও বলল, ‘ তুই উজ্জ্বল চাচাকে এখুনি কল কর, বল যে অন্য কাউকে বিয়ে করবি না। তোর পছন্দের মানুষ আছে।’
উমাইয়ার কান্না বাড়লো। সে কোনোমতে বলল, ‘ বাবা সব ব্যবস্থা করে ফেলছে। সব কিছু পাকা হয়ে গেছে। যখন আমাকে কল করবে তখন আমাকে গ্রামে যেতে বলছে। ওরা দেখতে এসে বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবে।’
জুবিয়া রুদ্ধ গলায় বলল, ‘ আমি এখুনি সাদাফ ভাইয়াকে বলে আসি। তিনি নিশ্চয়ই এর একটা বিহিত করতে পারবেন।’
উমাইয়া তাত্ক্ষণিক জুবিয়ার হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। জুবিয়াকে সামনে বসিয়ে শ্লেষের স্বরে বলল, ‘ ওনাকে বলার দরকার নেই। তুই তো জানিস বাবা এক কথার মানুষ। যা বলেন তাই করে। সেখানে শুধু শুধু ঝামেলা করে মান সম্মান নষ্ট করার দরকার নাই। ওনি জানতে পারলে হয়তো কষ্ট পাবেন। তার চেয়ে ভালো অল্পতেই সব শেষ হয়ে যাক।’
রোদেলা চমকায়িত কণ্ঠে শুধাল, ‘ তুই বলছিস এই কথা? উমা, তুই-ও তো ভাইয়াকে ভালোবাসিস।’
উমাইয়া হঠাৎ করে রোদেলার ওষ্ঠদ্বয়ের ওপর তার হাতখানা রাখল৷ কণ্ঠ খাদে পরিণত করে এলোমেলো স্বরে বলে ওঠল, ‘ মেয়ে মানুষের ভালোবাসতে নেই।’
চলবে….