আশিয়ানা #পর্ব_৩১ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
187

#আশিয়ানা
#পর্ব_৩১
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
পরিবার ও গ্রামের সকলের মাঝে খুশি ও আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে। ছেলে-মেয়ের বিয়ে একসাথে হওয়ায় খুশি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। শফিকুল চৌধুরী গ্রামের সব মানুষ কে বিয়ে উপলক্ষে পোশাক বিতরণ করেছেন। নতুন পোশাক পেয়ে সকলেই বেশ উল্লাসিত। সাদাফ ও আরুশি দুই ভাই বোনের বিয়ে চৌধুরী বাড়িতেই হবে। এ নিয়ে সমস্ত আয়োজন এক সপ্তাহ ধরে চলছে। বিয়ের একদিন আগেই উমাইয়ার বাবা-মা চৌধুরী বাড়িতেই চলে আসবেন। আরুশির হবু বর অনিক ঢাকা থেকে সিরাজগঞ্জ এসেছে দুদিন হলো। সিরাজগঞ্জেই তার পূর্ব পুরুষের বাড়ি রয়েছে সেখান থেকেই বিয়ে সম্পূর্ণ করবেন। এই বিয়েতে সকলের উল্লাস বেশিরভাগ সাদাফ কে ঘিরে। উমাইয়া দেখতে শুনতে সুন্দরী এতে অবশ্য কারো মাথা নেই। তবু লোকজনের কটু কথা লেগে রয়েছে। এত বড় সেলেব্রিটি একজন কৃষকের মেয়ের প্রেমে কিভাবে পড়ল? এটা নিয়েই সকলের মনে হাজারও প্রশ্ন। অবশ্য এইসব কথা সাদাফের কর্ণপাত এখনো হয়নি। বিয়ের আর মাত্র দুদিন বাকি আছে। আজকের দিনের ভেতর বর কনে’দের সমস্ত পোশাক কেনাকাটা করা হবে। শফিকুল চৌধুরী হুইলচেয়ারে করে শপিংমলে যেতে পারবেন না। এজন্য সমস্ত দায়িত্ব সেহরিশের কাঁধে তুলে দেওয়া হলো। শহরের বিখ্যাত ডিজাইন-কে হায়ার করে সিরাজগঞ্জ নিয়ে আসে সেহরিশ। দু’দিনের ভেতর দুজন কনের বিয়ের লেহেঙ্গা তৈরি করতে হবে তাকে। সেহরিশের সাথে অনান্য কাজে হাত লাগিয়ে কাজ করছে তূর্ণ।

আরুশি সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এসে দাঁড়াল। বাবা-মা এবং বড় ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির সকল আত্মীয় স্বজনরা বিয়ে উপলক্ষে গতকাল বাড়িতে এসেছেন। বাড়ির আনাচকানাচে বড়রা ও ছোটো বাচ্চারা গিজগিজ করছেন। এককোণে দাঁড়ানোর ও জায়গা নেই, তার উপরে বাড়ির সামনেই ভিড় জমে আছে কতশত সাংবাদিকেরা। তূর্ণর মা আরুশিকে দেখে কাছে টেনে নিলেন। গালে-মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে দোয়া করলেন।

আরুশি বলল,

‘ আন্টি আপনারা খাবার খেয়েছেন?’

তূর্ণর মা বললেন,

‘ সকাল দশটা বাজে। এখনো কেউ না খেয়ে থাকে নাকি?’

আরুশি আবার বলল,

‘ আমি তো এখনো খাবার পাইনি।’

তূর্ণর মা স্নেহময় কণ্ঠে বললেন,

‘ কেনো? দেখেছ কাণ্ড। বিয়ের কনে কে-ই কেউ খাবার দেয়নি।’

মাইমুনা ভেতরঘর থেকে ছুটে এলো। বাড়ির কাজ ও অতিথিদের সামলাতে সে হিমশিম খাচ্ছে। তূর্ণর মা মাইমুনার উদ্দেশ্য বললেন,

‘ বড় বউ এখনো ননদ কে খাবার দাও নাই, কোই ছিলা এতক্ষণ?’

মাইমুনা একবার আরুশির দিকে তাকাল। তারপর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘ বাহিরে মানুষ জন বেশি দেখে তোমার আর তোমার বড় ভাইয়ার জন্য খাবার আমাদের রুমে রেখে আসছি। যাও গিয়ে খেয়ে নাও। কিছুক্ষণ পর আবার মার্কেট যেতে হবে। হলুদের জিনিসপত্র কেনাকাটা বাকি।’

আরুশি বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। বাড়ির ছোটো থেকে বড় এবং কলেজের বন্ধুরা সবাই এখন বিয়ে নিয়ে মজা করছে। আরুশির হঠাৎ বিয়ে নিয়ে বন্ধুদের মধ্যেও কম হৈ-হুল্লোড় হয়নি। সবাই নিজেদের মতন আনন্দ উল্লাসে মেতে আছে। সেহরিশ বাড়ির ডেকোরেশনের দিকে নজর দিল। তূর্ণ হঠাৎ তার পেছন থেকে সরে যায়। সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে উঠে আসে সাদাফের রুমে। অন্ধকার রুম ঘুটঘুটে আঁধারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে সে। তূর্ণ মুরব্বিদের মুখে শুনেছে বিয়ের সময় বর-কনের ঘুম বেড়ে যায়। বিয়ের ঘুম ঘুমাচ্ছে সাদাফ। তূর্ণ একহাতে রুমের লাইট অন করল। এবং তারপর জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে থাই খুলে দিল। কাঠখোট্টা রোদের আলো এসে উপচে পড়ে রুমের মেঝেয়।

তূর্ণ খাটের পাশে এসে দাঁড়িয়ে। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,

‘ লোকজন ঠিকই বলে যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া প্রতিবেশীর ঘুম নাই।’

বেশ কিছুক্ষণ ডাকার পর সাদাফ উঠল না। নড়েচড়ে পাশ বদলে শুয়ে রইল। তূর্ণ হাঁফ ছেড়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হুট করেই সাদাফের উপর থেকে শুজনি সরিয়ে ফেলল। তারপর সাদাফের দুপা ধরে টেনেটুনে বিছানা থেকে নামিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল,

‘ ভাই আজ তোর বিয়ে? জলদি ওঠ। রেজিস্ট্রার বসে আছে।’

সাদাফ খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, একহাতে মাথাটা চেপে ধরে সন্দেহ চোখে তূর্ণর দিকে তাকাল।

সাদাফ জিজ্ঞেস করল,

‘ আজ বিয়ে? কিভাবে সম্ভব? বিয়ের তো দুদিন বাকি ছিল।’

তূর্ণ সাদাফকে বোকা বানানোর জন্য বলল,

‘ মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? ঘুমানোর আগে কিছু খেয়েছিস? গতকালই তোর গায়ে হলুদ হলো। আজই ভুলে গেছিস?’

সাদাফ গম্ভীর চিত্তে বসে রইল। গতকালের কোনো কিছুই সে মনে করতে পারল না। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে এলো, পুরো বাড়ি খুঁজে সে সেহরিশকে বের করে।

সেহরিশ জিজ্ঞেস করে,

‘ রাতে ঘুমাস নি? চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?’

সাদাফ সোজাসুজি প্রশ্নে চলে আসলো। সে শুধাল,

‘ আমাকে একটা কথা বল, আজ কী আমার বিয়ে?’

সেহরিশের ভ্রু কুঁচকে গেল। চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,

‘ নেশা করছিস? কীসব বাজে বকছিস?’

সাদাফ গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এরপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

‘ ঘুম থেকে টেনেটুনে তুলে বলল আজ নাকি আমার বিয়ে। অথচ বিয়ে দুদিন পর আমার মাথা কাজ করছিল না।’

সেহরিশ এক পা দুপা হেঁটে সাদাফের সামনে দাঁড়াল। জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ কে বলেছে আজ বিয়ে?’

সাদাফ বলল,

‘ কে আবার তূর্ণ।’

সেহরিশ মৃদু হাসল বলল,

‘ বিশ্বাস করার আর মানুষ পেলি না? শেষমেষ তোকেও বোকা বানিয়ে ছাড়ল।’
.
.
বিকেল ৪টা বাজে শপিং মলে এসেছেও সন্ধ্যার আগে বের হতে পারেনি। ঘড়িতে এখন ৭:১৫মিনিট। এখনো প্রায় বহু জিনিস কেনা রয়ে গেছে। ফারিয়া বেগম লিস্ট দেখে দেখে জিনিস কিনছেন। একটা জিনিসও বাদ দিবেন না। বিয়ের কনেদের থেকে শুরু করে বাড়ির সদস্যদের জন্য ও পোশাক কিনতে হবে। উমাইয়ার দিক থেকে সব খরচ সাদাফ উঠাবে। উমাইয়ার বাবা-কে এক পয়সা খরচও করতে দিবে না সাদাফ। একদম খালি হাতে মেয়ের বিয়ে দিবেন লজ্জায় মাথা নুইয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে রইলেন উমাইয়ার বাবা জসিম মিয়া। সাদাফ ফোনে কথা বলা শেষ করে সবার পিছনে এসে দাঁড়াতেই শ্বশুর মশাইকে দেখতে পেল। তার মনের অবস্থা বুঝে সে এগিয়ে গেল তার দিকে। সাদাফকে দেখে জসিম হালকা হাসল। সাদাফ বলল,

‘ চলুন, ও-ই দিকটা খাবারের জায়গা আছে।’

জসিম প্রথমত যেতে চাইলো না। পরোক্ষণে সাদাফের মনরক্ষার জন্য পাশেপাশে হেঁটে গেল। ওয়েটার বয় আসলো অর্ডার নেওয়ার জন্য। ছেলেটা সাদাফের ভক্ত, আহ্লাদিত বোধ করে প্রথমের সাদাফকে অনুরোধ করল তার সাথে একটা সেলফি তোলার জন্য। সাদাফ তার ইচ্ছা প্রাধান্য দিয়ে তারপর ওদের জন্য সামান্য খাবার অর্ডার করে। জসিম ইতস্তত বোধ করছেন। এমন দামি শপিংমলে তারা এ-র আগে কখনো আসেনি, ফুটপাত থেকেই ঈদের কেনাকাটা করেছেন। আজ এমন জায়গায় এসে কেমন অস্থির লাগছে। মনটা হাঁপাস করছে।

সাদাফ প্রথমের জসিমকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল। এরপর দু-হাত বাড়িয়ে জসিমের হাত ধরে বলল,

‘ আপনাকে চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে একটা বিষয় নিয়ে অধিক চিন্তা করলে হার্টের সমস্যা হয়। আমি হয়তো আপনার সমস্যা টা বুঝতে পারছি কিন্তু বিশ্বাস করুন আপনাকে দোটানায় ফেলবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।’

জসিম বলল,

‘ না, না বাবা। তুমি ভুল বুজতাছো।’

সাদাফ ফের বলল,

‘ আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমি কখনো আপনাকে হতাশ হতে দেবো না। আপনার মেয়ে ও আপনাদের সমস্ত দায়িত্ব আমার, আমি শুধু আপনার মেয়ের জামাই হতে চাই না বরং আপনাদের একজন আদর্শবান ছেলে হয়ে উঠতে চাই। সব কিছু থেকে থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখবেন না। বড় মেয়ের বিয়ে দ্বিতীয় বার আসবে না। তাই মন খুলে আনন্দ করুন। আপনাদের পাশে শক্ত খুঁটি হয়ে আমি সবসময় আছি।’

জসিম আবেগে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেললেন। প্রতিটা বাবার স্বপ্ন থাকে, তাদের মেয়ের জীবনে এমন একজন জীবনসঙ্গী থাকবে। জসিম মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তার মেয়েটা বহু কষ্ট করেছে এবার যেন সে সুখী হতে পারে। জসিমের চোখে অশ্রুজল দেখে সাদাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে আসে। দু’হাতে জসিমকে জড়িয়ে ধরে স্বান্ত্বনা দিতে লাগল।
.
.
কেনাকাটার জন্য উমাইয়ার সঙ্গে জুবিয়া এসেছে। উমাইয়ার জন্য হলুদের শাড়ি জুবিয়া পছন্দ করে দিয়েছে। জুবিয়ার পছন্দ খুব ভাল। এরজন্য চোখ বন্ধ করে ওর পছন্দ করা জিনিস উমাইয়া পরতে পারে। চোখে পড়ার মতন ড্রেসগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে সে। উমাইয়ার প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কেনাকাটা শেষ করে জুবিয়া একটু ওয়াশরুমে গেল। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় ভিন্ন এক কাপড়ের দোকানে মানুষের আকৃতি পুতুলের শরীরে নীল রঙের এক শাড়ির উপর দৃষ্টি আঁটকে যায় জুবিয়ার। নিখুঁতভাবে শাড়িটা দেখতে লাগল সে। কি একটা মনে করে সে দোকানে প্রবেশ করল। এবং কাপড়েই কোডে মূল্য লেখা। একজন মেয়ে স্টাফ এসে জুবিয়াকে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমি কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’

জুবিয়া শাড়িটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ এই শাড়িটির মূল্য?’

‘ অনলি ৬০হাজার টাকা ম্যাম।’

জুবিয়া বার কয়েক চোখের পলক ফেলল। তারপর ছোট্ট করে ‘থ্যাংক ইয়্যু’ বলে জায়গা ত্যাগ করল। মেয়েটি কিছু না বলে দোকানের ভেতরে চলে যেতে নেয়। তখন হুট করে পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে পিছনে তাকায়। হঠাৎ তূর্ণ কে দেখে চেঁচিয়ে উঠে সে।

তূর্ণ নিজ ঠোঁটের উপর হাত রেখে বলল,

‘ আস্তে আস্তে লোকজন শুনতে পারবে।’

মেয়েটি বলল,

‘ স্যরি স্যার।’

তূর্ণ এগোল। তারপর মেয়েটির কাছে জানতে চাইলো,

‘ মাত্রই একটি মেয়ে এই শপের সামনে দিয়ে গেল। সে এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। কী দেখছিল সে?’

মেয়েটি ভাবনা চিন্তা করে জবাব দিল,

‘ ম্যাম, এই শাড়িটা দেখছিলেন।’

তূর্ণ একপলক শাড়িটা দেখল। শাড়ির ডিজাইন বেশ মনকাড়া পছন্দ হলো তার। কথা আর বাড়ালো না। শাড়িটি এক কথায় কিনে নিল তূর্ণ। এবার প্রশ্ন এই শাড়িটা জুবিয়াকে কিভাবে দিবে? মনে মনে ভেবে হুট করে বলল,

‘ যে করে হোক সকলের আড়ালে মিস চিড়িয়াখানাকে শপিংমলের বাইরে নিয়ে যেতে হবে।’

তূর্ণর মা হুট করে ডেকে উঠলেন,

‘ বাবু?’

তূর্ণ হকচকিয়ে গেল। তাত্ক্ষণিক ছুটে গেল সে।

‘ মা, মা চুপ করো। সকলের সামনে বাবু বলে ডাকছো কেন? আমি কী বাচ্চা?’

মা বললেন,

‘ তোর জন্য শার্ট পছন্দ করেছি। সব সময় সাদা রঙের শার্ট পরিস। এবার এই গোলাপি রঙের টা পরবি। তোকে সুন্দর লাগবে।’

তূর্ণ বলল,

‘ কি মা তোমাদের মেয়ে জাতির শুধু গোলাপি রঙেই চোখ আঁটকে যায়। যেন গোলাপির সামনে অন্য রঙ চোখের লাগে না।’

মা বললেন,

‘ তুই বুঝবি না। গোলাপি হচ্ছে ভালোবাসার মিশ্রণে রঙ। এজন্যই গোলাপি রংটা মেয়েদের মনের অনেক কাছে রয়। গোলাপি রঙের সব কিছুতেই মেয়েদের এক আলাদা টান থাকে।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here