#চৈত্র_শেষে
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ১৯
রাত গড়িয়ে ভোর হলো। অনুর ঘুম হয়নি। সে আগে থেকেই দুই কাপ চা নিয়ে বেঞ্চ এ গিয়ে বসলো। শীতকাল চলে এসেছে। কুয়াশাভরা সাঁঝ সকাল। কেন জানি এই ঋতু টা অনুর ভারী পছন্দ। সামনেই নিম গাছের ফুল থেকে এক অদ্ভুত সুঘ্রান ভেসে আসছে। নিম গাছ ওষুধি গাছ তাই আনিস মিয়া রোপন করেছিলেন। প্রতি শীতে এই সুঘ্রানটার জন্য অনু অপেক্ষায় থাকে। ফুলের সুঘ্রানে সম্পূর্ণ ঘরসহ মোহনীয় করে তুলে। এখন আর এই গাছটা সহজে চোখে পড়ে না।
“আজ তাড়াতাড়ি উঠে গেল আমার মেয়ে! কী ব্যাপার!”
“তুমি এসেছো? আসো। চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
আনিস মিয়া পা বাড়াতে গিয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালেন। কয়েকদিন ধরে শরীরটা দুর্বল দুর্বল লাগছে।
অনু দৌড়ে বাবাকে গিয়ে ধরলো।
” তুমি ঠিক আছো?”
“হ্যাঁ রে।” বলেই তিনি কথা ঘুরানোর চেষ্ঠায় হেসে শুধালো,
“এই যা, আমাকে আগে ডাকবি না! চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।শীতকালে জিনিস তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে যায়।”
অনু বাবার কথায় জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল। কয়েকদিনেই বাবাকে কেমন জানি বয়স্ক বয়স্ক লাগছে। শরীরটা যেন নেতিয়ে পড়ছে! আর কিছু ভাবনাতেই আসছে অনু তা সরিয়ে নিজেকে গা’লি দিল। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে সব শরীর যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা তার অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।
“ঘুমিয়েছিস?”
“হ্যাঁ। হঠাৎ এই কথা কেন!”
“না এমনি জিজ্ঞেস করলাম।”
আনিস মিয়ার কথায় অনু হাসলো। হেসে শুধালো,
“বাবা তুমি আমার সবকিছু এতো সহজে বুঝে নাও কীভাবে?”
আনিস মিয়া হাসলেন। তিনি থেমে আবারো প্রশ্ন করলেন,
“ব্যাগ গুছিয়েছিস?”
“গুছাবো কী! আজকে আর কালকের জন্য দুইটা জামা নিবো।”
“তোর সালিহা আন্টি কল করেছিল। তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার জন্য। উনি ভয় পাচ্ছে যাবি না ভেবে।”
“যাবো অবশ্যই। মানুষটা আমাকে এতো ভালোবাসে। তার উপর এতো ব্যস্ততার মাঝেও বাড়ি বয়ে এসেছে। সেটার মূল্য দিবো না? ”
অনুর কথায় আনিস মিয়া সম্মতি দিয়ে জানালো,
“হ্যাঁ তাও ঠিক। তোর উপর সব।”
“বাবা তুমি যাবে?”
“নারে মা। শরীরটা ভালো লাগছে না।”
আনিস মিয়ার কথায় অনু ভয় পেল। সে শাসনের সুরে শুধালো,
“সে কী! এতদিন কেন বলোনি আমাকে?চলো তোমাকে ডাক্তার দেখাবো।”
“যেদিন তুই ডাক্তার হবি সেদিন তোর কাছ থেকে চিকিৎসা নিবো। তারপর আমার মন আর শরীরের উভয় অসুখ এক নিমিষেই সেড়ে যাবে।” বলেই আনিস মিয়া হো হো করে হেসে উঠলেন।
বাবার হাসি দেখে অনুও হাসলো। সে তো চায় এই মানুষটা এভাবেই সারাজীবন হাসুক।
অনু এবার হাসি বন্ধ করে সিরিয়াস হয়ে মুখ খুলল,
“হাজার এড়িয়ে যাও কিন্তু আমি তোমাকে আগে ডাক্তার দেখাবো। সব চেকআপ করিয়ে তারপর আমি যাবো।”
“দুইদিনের ব্যাপারই তো। তুই তো কালই চলে আসবি। তোকে এনে পরশু ডাক্তার দেখাবো।”
“আমার জন্য কোনো কষ্ট করতে হবে না। আমাকে দিয়ে আসা লাগবে না। আমি চলে যেতে পারবো। তুমি অফিস যেও।”
“ছুটি নিয়েছি দুইদিন।”
অনুর খটকা লাগলো। সে বাবার দিকে এগিয়ে শুধালো,
“বাবা তুমি ভালো আছো তো। মিথ্যা বলছো না তো?”
“আরে দূর! শীতকালে আসলে শ্বাসকষ্টটা একটু বাড়ে এই যা। বুড়ো হচ্ছি। এগুলো লেগে থাকবেই। তুই গিয়ে ঘুরে আয়।” বলেই তিনি চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
“তোমাকে এভাবে রেখে আমি যাবো না কোথাও। আমার মন বসবে না। আমি না যাই?”
আনিস মিয়া হেসে দিলেন।
“আরে বাবা আমার কিছু হয়নি। তুই নিশ্চিন্তে যা। আমি ফিটফাট আছি।”
আনিস মিয়ার কথায় অনু অভিমানী কণ্ঠে জানালো,
“নিজের খেয়াল রাখবে বাবা। ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে নিবে।”
“একদিনের জন্যই তো যাচ্ছিস।
“তবুও। তোমাকে ছাড়া আমার একটা দিনও অনেকগুলো মাসের মতো মনে হয়।”
“পাগলী আমার।” বলেই আনিস মিয়া মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন আর অনুও বাবাকে দুহাতে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলো।
——
হলুদের দিন। অনু দুপুরে এসেছে। আনিস মিয়া জোরাজোরি করে এসেছিলো। এসেই অনুকে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছে। অনু অনেক করে বলেছে যাতে রয়ে যায় কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা। উনি থাকবে না মানে থাকবে না। ঘুমের ব্যাঘাট ঘটলে আনিস মিয়ার শরীর খারাপ লাগে বিধায় অনুও আর বাঁধা দেয়নি।
বিকেল গড়িয়ে আসছে। অনু উঠানে এক পা দু’পা করে হাঁটতে লাগলো। উঠানের এক কোণে ছোটখাটো হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। সালিহা আন্টির ইচ্ছে ছিল বিধায় বিয়েটা গ্রামেই হচ্ছে। তাই ছোটখাটো করেই আয়োজন। শুধু ঘরোয়া ভাবে কাবিনটাই হবে আপাতত। সন্ধ্যা গড়িয়ে আসতেই অনুর শীত অনুভূতি হলো। চারদিকে কুয়াশাভরা বিকেল। অনু গায়ের চাঁদর ভালোমতো জড়িয়ে উঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল। সালিহা আন্টির এই বাড়িটা গ্রামের শুরুতে হওয়ায় একপাশে সব বিস্তীর্ণ মাঠ। দূর দূরান্ত যতটুকু চোখ যায় শুধু বিল আর বিল। অনু বিলের দিকে দৃষ্টি দিল। বিলের মাঝে একটা সরু আইল। সারাদিন মাঠে কাজ করা সারি সারি কৃষকরা সরু আইল দিয়ে বড়ো রাস্তায় উঠে পড়ছে। অনু তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যা নামতেই সবার যেন ঘরে ফেরার তাড়া!
সাহিল ব্যস্ত সময় পাড় করে গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে উঠানের এক পাশে মেয়ে অবয়ব দেখে থেমে গেল । এইবার আর রিমা ভেবে কোনো ভুল হলো না তার। পেছনের অবয়ব দেখেই সে অনুকে চিনতে ভুল করেনি।
সাহিল অনুর দিকে পা বাড়ালো। অনুর পাশে গিয়ে বিলের দিকে দৃষ্টি রেখে বেশ কিছুক্ষন নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।
অনু তার পাশে কারোর অস্তিত্ব পেয়ে ফিরে তাকালো। সাহিল ভাই! অনু কথা খুঁজে পেল না। সে নিজেকে সামলাল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কেমন আছেন?”
সাহিল উত্তর দিল না। মলিন হেসে শুধালো,
“মনে আছে তবে আমাদের?”
“কেন থাকবে না?”
“ভেবেছিলাম আসবে না।”
“আসলাম তো। আন্টি এতো কষ্ট করে গিয়েছেন। না এলে কেমন দেখায়!”
“সবার কথা ভাবো দেখছি।”
“ভাবতে হয়।”
সাহিল আর জবাব দিল না। সে জায়গা প্রস্থান করলো।
সাহিলের ঘরে ঢুকে যাওয়ার পানে অনু তাকিয়ে রইল। এই কেমন দায়সারা ভাব!
——-
হলুদের রাত। সবাই সাহিলকে হলুদ দিচ্ছে। যদিও সাহিল বেশ বিরক্ত সবার উপর। শুধুমাত্র সালিহা বেগমের জন্যই সে এসবে রাজি হয়েছে। মায়ের জন্য সব করতে পারে সে। তার মুখায়ব দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে সত্যিকারের অর্থে এসবে বিরক্ত। অনু সবার দৃষ্টি এড়িয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল।
একে একে সবার হলুদ লাগানো শেষে সবাই অনুকেও ডাকলো। অনু বারণ করা সত্ত্বেও সবার জোরাজোরিতে বাধ্য হয়ে সাহিলের সামনে এলো।
অনু হলুদ ছুঁয়ে দিতেই সাহিল দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। অতীতের স্বপ্নের মতো করে কল্পনার মানুষটিকে প্রথমবারের মতো সে ছুঁয়ে দিল। তাও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ভাবে!
অনু হলুদ দেওয়ার সময় সাহিল দৃষ্টি সরিয়ে নিল। সে পাশ ফিরে গেল।
অনু হলুদ দিয়েই সবার দৃষ্টি এড়িয়ে জায়গা প্রস্থান করলো। অনুর যাওয়ার পানে সাহিল তাকালো। মনে মনে আওড়ালো, “এতদিনের স্বপ্নের দিন তাহলে নিষিদ্ধভাবেই ফুরোলো!”
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। ভুল থ্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল। ভালোবাসা রইল।)