আশিয়ানা #পর্ব_৫৩ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
211

#আশিয়ানা
#পর্ব_৫৩
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
____________
মোতালেব হোসেন উঠোনে এসে বসলেন। ওঁর হাত অসম্ভব ভাবে কাঁপছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই একটা রোগ দেখা দিয়েছে। মিনারা বিরক্ত হয়ে মোতালেবের দিকে এগিয়ে এলেন। চোখ-মুখ অন্ধকার করে বললেন, ‘ মেয়ে দেখতে অতিথি আসবেন। ঘরে তেমন কিছুই নেই। তাদের আপ্যায়ন করব কি দিয়ে?’
মোতালেব বললেন, ‘ তুমি তো রান্নায় খুউব পটু। নিজের হাতের সেই সব স্পেশাল রান্নাগুলো করে ফেলো। মেয়ে দেখতে এসে তাঁরা আর কতোইবা খাবেন? তাছাড়া জুবিয়াকে কারা দেখতে আসবে ঘটক জন্টু খোলাসা করে কিছুই বলেন নি।’
‘ যাঁরাই দেখতে আসুক, তাদের সামনে ভালমন্দ কিছু খাবার রাখতে তো হবে। তুমি এখুনি বাজারে যাও। এই মাসে জুবিয়া যা বেতন পাঠিয়েছিল ওগুলো থেকে অল্প খরচ করে কিছু কিনে নিয়ে আসো।’
‘ তা না হয় আমি কিনে নিয়ে আসলাম। তুমি সময় মতো রাঁধতে পারবে তো? ওঁরা কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে।’
‘ কিছুক্ষণ বলতে হাতে এখনও চার ঘন্টা আছে। কিপ্টামো কোরো না তো, জলদি বাজারে যাও।’
মোতালেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এরপর বললেন, ‘ ঘরে গিয়ে দেখ, আমার সাদা পাঞ্জাবির পকেটে রাখা গুলো আছে৷ দু-হাজার নিয়ে এসো।’
‘ দুই হাজার দিয়ে হবে টা কী শুনি? জিনিসের যা দাম, মাত্র দুই হাজার টাকার জিনিস চোখেও লাগবে না। ভালো ভালো জিনিস নিয়ে আসবে, ঘটকের থেকে যতটা শুনেছি পাত্র অনেক বড়লোক ঘরের ছেলে। তাদের সমাদরে কোনো কমতি হয় না যেন।’
‘ আরে মিনারা এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? বিয়ে তো এখনো হয়নি। আর বড়লোক ঘরের ছেলের আমাদের অবস্থা দেখে বিয়ে না-ও করতে পারে। তাই শুরুতেই এত খরচ করা কী ঠিক?’
‘ আমি ওতো কথা শুনতে চাই না। আমরা গরীব হতে পারি তবে মন অনেক বড়। আর তুমি খরচের কথা চিন্তা করছ?’
‘ এভাবে যদি মাসে দুই একটা পাত্রপক্ষ মেয়েকে দেখতে আসে আমি নির্ঘাত ফকির হয়ে যাব।’ কপালে হাত রেখে বললেন মোতালেব। কিছু ভেবে আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ‘ তোমার মেয়েকে বলেছ আজ যে ওঁকে দেখতে আসবে?’
‘ বলেছি, বলেছি। গতকাল গাজীপুর থেকে আসার পরপর মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তার ওই একটাই কথা বিয়ে করবে না। গ্রামের হাবাগোবা ছেলে না-কি পছন্দ না। তোমার ছেলে গিয়েছিল সকালের নাস্তা দেওয়ার জন্য সে দরজা খোলেনি। ভেতর থেকে খিল দিয়ে বসে আছে।’ বলে থামলেন মিনারা। মোতালেবের চোখে চোখ রেখে তটস্থ গলায় বললেন, ‘ তোমার মেয়ে তুমি একটু বোঝাও। দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয় না। তাছাড়া আর্থিক বিষয়ও তো আছে।’
মোতালেব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ এত চিন্তা হলে গতকাল ঘটককে সরাসরি না করে দিলেই পারতে, সেটা না করে আরও আসার জন্য অনুমতি দিয়েছ।’
‘ এই প্রথম তোমার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসছে। প্রথম বার কিভাবে না করি? তাছাড়া ওঁর বন্ধু রোদেলা আর উমারও তো বিয়ে হয়ে গেছে বাকি আছে ওঁ।’
‘ আর তুমি ওঁকে ঘাড় থেকে নামাতে চাচ্ছ?’ বললেন মোতালেব।
‘ এসব কি বলছ? কোনো বাপ মা নিজের মেয়েদের নিয়ে এসব চিন্তাও করতে পারে না। আর তুমি বলছ আমি ঘাড় থেকে নামাতে চাচ্ছি। আমার সন্তান! আমার কাছে বোঝা নয়, বুঝলে?’
মিনারা চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। ওঁর জন্য এক সমস্যা একটু কথা কাটাকাটি হলে কান্না করে ভাসিয়ে ফেলে। মোতালেব সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। টাকা ও বাজারথলে নিয়ে রওনা হলেন।

জুবিয়া কখনও শাড়ি পরেনি। মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে বিছানার ওপর বসে আছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি পালিয়ে যেতে। সে উপায় বন্ধ, বাড়ি আসার পরপর মা হাত ব্যাগ নিয়ে নিছে। তার মধ্যে সব টাকা ও ফোন আছে। বাবা অনুরোধ করেছে বলে পাত্রের সামনে যেতে রাজি হয়েছে জুবিয়া। শাড়ি পরতে জানে না, বিষয়টি এমন নয়। ওঁ খুব সুন্দর করে শাড়ি পরতে ও পরাতে জানে। আজ হাত অচল হয়ে গেছে এমন লাগছে। বিছানার ওপর শাড়িটা রেখে সোজা হয়ে বসল জুবিয়া। চোখের পাতায় বার বার তূর্ণর মুখখানা ভেসে উঠছে। ওঁর দুষ্টুমিগুলো মনে পড়ছে। জুবিয়া চোখ বন্ধ করে ফেলল। যদি সব কিছু ঠিকঠাক হয় আর বিয়ে ঠিক হয়ে যায় সে রাতেই গাজীপুরের জন্য বেরিয়ে পড়বে। কোনো কিছুর পরোয়া করবে না। মনে একজন ও বিয়ে করবে আরেকজনকে এটা অসম্ভব। কারো কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হলো, প্রথম বার চিনতে পারে নি। তৃতীয় বার নাম ধরে ডাকায় জুবিয়া দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। মাসুদ দাঁড়িয়ে আছেন। জুবিয়া চটজলদি এগিয়ে এলো। চেয়ার পেতে বলল, ‘ চাচা বসুন।’
মাসুদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখের নিচে মাংস ফুলে ফেঁপে উঠেছে, চোখদুটো লাল টুকটুকে হয়ে গেছে, মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। মানুষ মারা যাওয়ার পর, রাতদিন কান্নাকাটি করলে মুখ যেমন হয়, তেমন দেখাচ্ছে। মাসুদ বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘ মা রে! আজ সকালে শুনলাম তুই গতকাল গ্রামে আসছিস। তাই চট করে চলে আসলাম। আজ তিনদিন আমার রোদেলার কোনো খোঁজ খবর নাই। গতকাল বিকেলে গ্রামে আসার পর শুনতে পারি ওঁরা আমার রোদেলার সঙ্গে কত বড় অন্যায় করছে। আমি বাড়ি থাকলে তো এমন করতে পারত না ওঁরা। সেই দুঃখে আমার ভাগ্নী আমার সাথে যোগাযোগ ও করে না। আমি চৌধুরী বাড়ি গেছিলাম, তাঁরা এই সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমার কথা শুইনা যেন চমকায় গেছে। তারপর ওদের ছেলের সঙ্গে দেখা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ছেলের অনেক গুলো বাড়ি আছে বলে সে কখন কোন বাসায় থাকে তারা জানে না। আমার মন কেমন যেন করে মা। তুই আমারে বল, তোর সাথে কী রোদেলার কথা হয়? আমার মেয়েটা কেমন আছে? ভালো আছে তো?’
জুবিয়া ভারী নিঃশ্বাস ফেলল।

‘ জি, চাচা। রোদেলা খুব সুখে আছে। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে খুব ভালো মানুষ। আমাদের রোদেলাকে সেহরিশ ভাইয়া সব সময় সুখে রাখবে। আমি গত পরশু ও গিয়েছিলাম ওঁর কাছে।’
‘ আমাকে একবার নিয়ে যাবি? আমি নিজের চোখে ওঁকে একটু দেখে আসবো।’
মিনারা এক বাটি বিস্কুট ও পানি নিয়ে এলো। মাসুদ বলল, ‘ কি করছেন ভাবী? আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার দরকার নাই। এসব নিয়ে যান।’
মিনারা বললেন, ‘ অল্প একটু খান ভাই। আজ তো আপনার এই ভাতিজি কে দেখতে আসবে।’ হাসিমুখে কথা বলে পাশে দাঁড়ান মিনারা। মাসুদ উঠলেন। জুবিয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ দোয়া রইল মা। সারাজীবন সুখী হো।’
জুবিয়া বলল, ‘ আমি আগামীকাল শহরে ফিরে যাব। পরীক্ষা সামনেই পড়তে হবে। চাচা, আপনি সকাল সকাল রেডি হয়ে চলে আসবেন। একসাথেই যাব।’
মাসুদ একটা বিস্কুট খেলেন এরপর পানিটুকু পান করে চলে যান।

মোতালেব ও সাজিদ ছোট বেলার বন্ধু। মোতালেবের চেয়ে ওঁর আর্থিক অবস্থা একটু ভালো। লোকটির স্ত্রী দশ বছর আগে মা-রা গেছেন। কোনো সন্তান নেই। স্ত্রীর চলে যাবার পর লোকটা দ্বিতীয় বিবাহ করেন নি। স্ত্রীর স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছেন। সাজিদ মিয়ার ছাঁদ বিশিষ্ট একতলা বাড়ি। এ বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। সারাদিন কাজকর্ম করে একজন কাজের মহিলা কাজ শেষে সন্ধ্যায় চলে যায়। মোতালেবের কথায় ওঁর ড্রয়িংরুমে পাত্রপক্ষর বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাবারের ব্যবস্থা উনিই করেছেন। এতটা আন্তরিকতা দেখানোর জন্য মিনারা লজ্জায় পড়ে যান। বিকেল চারটা বাজে৷ ঘটক পাত্রপক্ষ সঙ্গে নিয়ে সাজিদ মিয়ার বাড়িতে উপস্থিত হয়। চৌধুরী পরিবার কে দেখে আঁতকে ওঠেন সাজিদ ও মোতালেব। তূর্ণ ওঁর মা ও বাবার পাশে বসে। সাদাফ ও সেহরিশ ওঁর সামনের সোফায় বসল। শফিকুল চৌধুরী হুইলচেয়ারে বসা ও ওনার স্ত্রী একা সিঙ্গেল সোফায় বসলেন। মিনারা কিছু বুঝতে পারল না, অপলক তাকিয়ে দেখল। ঘটককে আলাদা করে মোতালেব জিজ্ঞেস করেন ‘ চৌধুরী পরিবার এখানে এসেছেন? তার কারণ কী?’ ঘটক তূর্ণ কে দেখিয়ে তাদের বলে, ‘ ওই যে দেখছেন কচুপাতা রঙের শার্ট পরা ওটাই পাত্র। পাত্রর পাশে ওঁর বাবা মা। তার পাশে ওঁর বন্ধু। আর চৌধুরী সাহেব ছেলের বন্ধুর জন্য মেয়ে দেখতে আসছেন। এটা তো আপনাদের ভাগ্য। শুকরিয়া করুন।’

মোতালেব এখনও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাত্রপক্ষের সঙ্গে নিয়ে আসা জিনিস ও মিষ্টি মিনারার কাছে বুঝিয়ে দিল উমাইয়া। একগাল হেসে বলল, ‘ কেমন আছেন চাচী? জুবি কই?’
‘ উমা, তুই জানতিস যে জুবিয়াকে দেখতে তোর স্বামীর বন্ধু আসবে?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ তাহলে, আমাদের বলিসনি কেন?’
‘ সারপ্রাইজ দিবো বলে। তাছাড়া জুবিয়া হঠাৎ দেখে চমকে যাবে তাই।’
‘ জুবিয়া তো এই বিয়েতে রাজি না মা।’
‘ কারণ ওঁ এখনো পাত্রর মুখ দেখেনি চাচি। একবার দেখলে কি ভয়ানক চমকানো চমকাবে। তুমি তো জানো না চাচি, তূর্ণ ভাইয়া আর জুবিয়া একে অপরকে ভালোবাসে। তাই তুমি এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ চেপে যাবে। ভুলেও ওঁর কানে তুলে দিও না। আর শোনো আমি যে আসছি এটাও বোলো না।’
‘ দুষ্টু মেয়ে কোথাকার। আমাকে এসব আগে বললে কি হত রে?’
‘ তাহলে আর মজা মজা থাকত না৷ এই যে তুমি আমাকে দেখে হঠাৎ চমকে গেছো। এটা কি হত?’
মিনারা ড্রয়িংরুমের দিকে উঁকি দিল। বললেন, ‘ বিয়ের সময় তোর জামাইকে দেখেছি। কিন্তু রোদেলার জামাই কে দেখা হলো না। মেয়েটা কই?’
উমাইয়া হেসে বলল, ‘ ওই যে দেখছ কালো টি-শার্ট পরে বসে আছে। ওইটাই আমাদের রোদেলার বর।’
মিনারা অবাক চোখে তাকিয়ে। বললেন, ‘ বাঃ। বেশ সুন্দর দেখতে।’
উমাইয়া খিলখিল করে হেসে উঠল।
‘ আমাদের বর কী কম সুন্দর?’
‘ না। কিন্তু ওই ছেলেটা বেশি সুন্দর।’ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মিনারা এরপর হুট করে বললেন, ‘ রোদেলাকে আনিস নি কেন? ওঁকে সঙ্গে নিয়ে আসলে ভালো হত না?’
উমাইয়া হতাশ গলায় বলল, ‘ ওঁর যা অপমান হয়েছে। এখুনি গ্রামে আসতে চায়নি। বলেছে পরে মন চাইলে আসবে। আচ্ছা এসব রাখো তো, যাও দেখ ওনাদের কিছু লাগবে কি না।’
‘ আচ্ছা। যাচ্ছি। তুই ও আয়।’

তূর্ণকে একা রেখে ওঁর মা বাবা উঠে গেল। ফারিয়া বেগম একা আছেন বলে ওনার কাছে গিয়ে বসলেন। তূর্ণ লজ্জা পাচ্ছে। মাথা নিচু করে দু-হাত কচলাতে শুরু করেছে। ঠোঁটে ফুটে আছে সেই অমায়িক মুচকি হাসির রেখা। যেন এখানেই সুখ।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here