#আশিয়ানা
#পর্ব_৩৭
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে চলছে। বেলকনি থেকে ঠাণ্ডা শীতের হাওয়া আসছে। একপলক সেদিকে লক্ষ্য করল সেহরিশ এরপর সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এক পা দু পা করে হেঁটে এলো বারান্দায়। সোজা হয়ে তাড়িয়ে আকাশপানে মুখ তুললো তারপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। সহসা দৃষ্টি নামিয়ে তাকাল বাড়ির সামনে আম গাছটার দিকে। বিশাল বড় গাছটা অনেকটা জায়গা জুড়ে আকাশমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরেই সড়ক, রাস্তার দু’পাশে ল্যাম্পপোস্ট। সন্ধ্যে নামার পরপরই ল্যাম্পগুলো একে একে জ্বলে উঠে। হলদে আলোয় আবছা দু’টো মেয়ের অভয়ব দেখতে পেল সেহরিশ। খানিক নড়েচড়ে উঠল তার চওড়া কাঁধ। তারপর ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে প্রগাঢ় দৃষ্টি ফেলল। অভিলাষ মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করে বলল,
‘ রোদেলা?’
বিখ্যাত গায়ক সাদাফ কাসানোর ওয়াইফ উমাইয়া। বিয়ের আগে রেস্ট্রন্টের কাজটা ছেড়ে দিয়েছে। সাদাফ প্রথমদিন তার গাড়ি করে উমাইয়া কে ভার্সিটি’তে নামিয়ে দিল। সেদিন থেকে আজ দু-দিন হল, ভার্সিটিতে উমাইয়ার ইমেজ পরিবর্তন হয়েছে। সকলে খুব আহ্লাদ করে কথা বলে।
সাদাফ ওর গাড়ি করে উমাইয়াকে ভার্সিটি থেকে রিসিভ করে বাড়ি নিয়ে আসে। রোদেলা আর জুবিয়া ভার্সিটি থেকে সোজা ওদিক দিয়ে রেস্ট্রন্টে চলে আসে। সন্ধ্যে ৭টা বাজল। এইসময় দু’জন মেয়ে একা বাড়ি ফিরবে ঘটনাটি দৃশ্যকটু লাগল আয়ানের। আয়ান ওঁর গাড়ি করে রোদেলা আর জুবিয়া কে নামিয়ে দিয়ে গেল। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত! এখন একটু বিশ্রাম করা দরকার। রোদেলা হাঁটতে নিয়ে একটু থামলো।
‘ আজ রাতের রান্নাটুকু তুই করবি জুবি? আমার শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।’
জুবিয়া আগে আগে হাঁটতে লাগল। বাড়ির কেঁচি গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দারওয়ান কে আওয়াজ দিয়ে রোদেলার দিকে তাকাল,
‘ ঠিক আছে। কি খাবি বল?’
‘ কিছু একটা বানিয়ে দিস তাহলেই হবে।’
‘ আচ্ছা। আজ তোকে আমার স্পেশাল আইটেম রান্না করে খাওয়াবো।’
‘ বেশি কিছু করিস না। যাই করিস দুজন মানুষ হিসাব করে অল্প তৈরি করবি।’
সেহরিশ বেশ কিছুক্ষণ ধরে একস্থানে দাঁড়িয়ে থাকল। রোদেলা গেইট দিয়ে প্রবেশ করল এরপর সরে গেল সেহরিশ। এরপর ড্রয়িংরুমে রুমে এসে দেখল সাদাফ তূর্ণর উদ্দেশ্য বলছে,
‘ তোর ব্যাগপত্র গুছিয়ে দিয়েছি আমার ফ্ল্যাটে অনেকদিন ছিলি। এখন নিজের বাড়ি চলে যা।’
তূর্ণ বলল,
‘ এই রাতের বেলা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছিস। আমি এখন কোথায় যাব?’
সাদাফ বলল,
‘ এই শহরে তোর তিনটা বাড়ি আছে। যে কোনো একটায় চলে যা।’
রোদেলা ও জুবিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য উমাইয়া সামনের ফ্ল্যাটে গিয়েছে। এরইমধ্যে সাদাফ ওদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিয়ে হয়েছে আজ ছয়দিন, অথচ বউয়ের সঙ্গে দু’মিনিট বসে শান্তিমতো কথা বলা-ও দ্বায়। তূর্ণ বিড়াল ছানার মতো সারাক্ষণ এখানে ওখানে ঘুরাঘুরি করে। সেহরিশ সোফায় উপর থেকে তার জ্যাকেটটা তুলে নিল। তূর্ণ তার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমাকে সাথে নিয়ে চল। প্লিজ?’
সেহরিশ বলল,
‘ আমার সঙ্গে দু-দিনের বেশি থাকতে পারবি না। আমি দু-দিন পর ইতালি ফিরে যাব। উমাইয়ার পরীক্ষা এবং পাসপোর্ট সব রেডি করার জন্য বেশ কিছুদিন সময় লাগবে ততদিন সাদাফ দেশেই থাকবে। তুই হয়ত ওঁদের সঙ্গেই যাবি। তো দু-দিন পর তোর নিজের বাড়িতেই ফিরতে হবে।’
তূর্ণ শুধাল,
‘ দু-দিন পর ব্যাক করবি কিন্তু এত তাড়া কিসের? ‘
সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল,
‘ প্রয়োজন।’
.
.
রোদেলার শরীর আগের চেয়ে খারাপ হলো। হাসপাতালে যাওয়ার কথা তুললো জুবিয়া। সামান্য জ্বরে হাসপাতালে যেতে রাজি হলো না রোদেলা। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল। উমাইয়া জুবিয়ার সঙ্গে রান্না শেষ করে। এরপর গরম-গরম স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসে। স্যুপ খাওয়ার পর জ্বর কমার জন্য ঔষধ খাইয়ে দেয় উমা। রোদেলা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর উমা চলে যায়। রুমের জিনিসপত্র এলোমেলো। সাদাফ সময় নিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কয়েকটা ব্যাগে ভরে রাখল। উমাইয়া রুমে এসে জিজ্ঞেস করল,
‘ বড় ভাইয়া ও তূর্ণ ভাই কোথায়? কাউকে দেখছি না।’
সাদাফ একবার উমাইয়ার দিকে তাকাল তারপর বলল,
‘ ওরা চলে গেছে।’
উমাইয়া বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘ আমি তাদের জন্য রান্না করে ছিলাম। তাঁরা না খেয়েই চলে গেছেন।’
সাদাফ এই প্রশ্নের জবাব দিল না। উমাইয়া ফের জিজ্ঞেস করল,
‘ এসব কি করছেন?’
সাদাফ বলল,
‘ আমি এই ফ্ল্যাট কিনেছিলাম তোমার আশেপাশে থাকার জন্য। এখন এই জায়গা থেকে আমার বাড়িতে গিয়ে উঠবো। মেরিনা সিটিতে আমার একটা বাড়ি রয়েছে।’
উমাইয়ার বুক ধুকপুক করে উঠল। সাদাফ এখন তার স্বামী। আর স্বামীর কথা মতো চলা স্ত্রীর কর্তব্য। কিন্তু রোদেলা? তাকে অসুস্থ রেখে কিভাবে চলে যাবে? উমাইয়ার মন মানলো না। দু’দিন পর যাওয়ার জন্য সাদাফ কে রাজি করানোর চেষ্টা করল উমা।
সামান্য জ্বর এসেছিল। মধ্যরাতে জ্বর নেমে শরীর ঘামে ভিজে চিপচিপে হয়ে যায়। রোদেলা উঠে বসল। এরপর জুবিয়ার উদ্দেশ্য বলল, ‘ আমি খুব খারাপ স্বপ্ন দেখছি জুবি।’
জুবিয়া জেগে আছে। স্মার্ট ফোন প্রথম প্রথম চালাতে পারতো না জুবিয়া। আয়ান তাকে আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে দিয়েছে। এবং ফেসবুক নামক অ্যাপে একটা একাউন্ট খুলে দিয়েছে। এখন মাঝরাত পর্যন্ত সে ফেসবুক স্ক্রল করে। জুবিয়া ফোন বালিশের পাশে রাখে এরপর উঠে বসল। রোদেলার কপালে তার হাতখানা রেখে বলল,
‘ শরীর তো ঠাণ্ডা জ্বর নেই।’
জুবিয়া বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর আবারও ফোনটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি স্বপ্ন দেখছিস?’
‘ স্বপ্নের কথা বলতে নাই। কিন্তু খারাপ স্বপ্ন।’ বলল রোদেলা।
‘ ভয় পাইছিস?’ জুবিয়া জিজ্ঞেস করল।
‘ হ্যাঁ।’
বিছানার পাশে ছোটো টেবিল। একহাতে পানির বোতলটা নিয়ে রোদেলার দিকে এগিয়ে দিল জুবিয়া।
‘ পানি খা ভয় একটু কমবে।’
.
.
বাড়ির পিছনে একটা কাঁঠাল গাছ আছে। রোজ ভোরে সূর্য উদয় হওয়ার একটা পাখি এসে বসে সে ডালে। নিয়ম করে রোজ গুনগুন করে গান গায় সে। তার গানের গলা বেশ মনোমুগ্ধকর, প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও এখন আর খারাপ লাগে না। বেশ আরাম করে শুয়ে সে ডাকে মোহিত হতে থাকে সেহরিশ। তবে আজ সে সুরে কোনো মাধুর্য খুঁজে পাচ্ছে না সে। সকাল সকাল মনটা কেমন বিষণ্ণতায় ডুবে গেল। গভীর আলস্য ছেড়ে উঠে গেল সেহরিশ। রাতে তেমন খাওয়া দাওয়া হয়নি। এখন খিদে পেয়েছে। চট করে কিছু বানিয়ে ফেলতে হবে। সময় নিয়ে ফ্রেশ হলো তারপর রুম থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। তূর্ণ ড্রয়িংরুমের কার্পেটের উপর কাচুমাচু হয়ে শুয়ে আছে।
তূর্ণ লম্বা একটা হাই তুলে উঠে বসল। বাঁ হাতে চুলগুলো চুলকাতে চুলকাতে চোখ দুটো খুলে অবাক চোখে চারপাশে তাকাল। রাতে সে রুমে ঘুমিয়ে ছিল কখন যে ড্রয়িংরুমে এসে এখানেই শুয়ে পরছে বুঝতে পারলো না। এরইমধ্যে কিচেন থেকে টুকটাক শব্দ শুনতে পেল। তূর্ণ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।
‘ আমাকে উঠাসনি কেন?’
‘ ঘুমাচ্ছিলি তাই।’
খাবার থেকে সুঘ্রাণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তূর্ণ লম্বা একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
‘ খুব সুন্দর ঘ্রাণ বের হচ্ছে। মনে হচ্ছে খেতেও দারুণ হবে।’
সেহরিশ কিচেন থেকে বের হলো ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল সে। তূর্ণ ওর পিছু পিছু এলো। এরপর খাবার খাওয়ার জন্য মূহুর্তেই মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। খাবার প্রায় মাঝামাঝি হঠাৎ করে বলল,
‘ তোর জীবনে কোনো মেয়ে আসবে না। এটা শিওর। কিন্তু আমার উপর একটু রহম কর ভাই। মিস জুবিয়ার সঙ্গে আমার বিয়েটা ফাইনাল করে দে প্লিজ। তোর কথায় যাদু আছে। যে কেউ তোর কথায় দুই মিনিটে রাজি হয়ে যায়।’
সেহরিশ মাথা নিচু করে খাবার শেষ করল। এরপর চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে সঙ্গে তূর্ণ বসা থেকে উঠে গেল। সেহরিশ কে পিছন থেকে ঝাপ্টে ধরে বলল,
‘ আমাকে বিয়ে করিয়ে দে ভাই। একা একা খাটে ঘুমাতে পারি না। ২৮ বছর ধরে সিঙ্গেল এজন্য খাট-ও আমাকে অভিশাপ দেয়।’
সেহরিশ রক্তিম চোখে তাকাল। বিরক্তমাখা কণ্ঠে বলল,
‘ তোরা এখানে বিয়ে করতে আসছিস?’
তূর্ণ মেরুদণ্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে গেল। এরপর নিস্তেজ স্বরে বলল,
‘ আমার মূল উদ্দেশ্য বিয়ে করা।’
চলবে….