আশিয়ানা #পর্ব_৪১ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
57

#আশিয়ানা
#পর্ব_৪১
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
যেদিকে চোখ যায় শুধু বিশাল বিস্তীর্ণ মাঠ ও খেত। বিশাল সবুজ মাঠের মাঝখানে হঠাৎ খেলুড়ে বাচ্চাদের দেখে চোখ আটকে যায়। সেখানে বাচ্চারা আলাদা ভাবে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলছে। একটু দূরে একটা পুকুর স্বচ্ছ জলে ভাসছে জলকুটির বেশ জাঁকজমক ভাবে সাজানো। সেহরিশ হঠাৎ সাদাফের সঙ্গে কথা বলা শেষ করল। ইচ্ছে করে আজ বিকেলে সাদাফকে নিয়ে এই জায়গাটায় আসছে সে। খোলামেলা জায়গায় থাকলে যদি একটু মন ভালো হয় তার এই আশা। কুটিরে সাজানো জিনিসপত্র দেখলে ১৯৯৯ সালের কথা মনে পরে যায়। বেশ কিছু হারিকেন ঝুলে আছে সন্ধ্যা হলে এগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। সাদাফ এগোল সেহরিশের পিছু পিছু তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘এইখানে আসার এখনও বলিসনি। তোর হঠাৎ কি হয়েছে বল? মনমরা লাগছে তোকে।’
সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে কেউ ফলো করছে।’
সাদাফ চমকালো। ভ্রুযুগল কুঁচকে শুধাল, ‘কে? তুই দেখছিস?’
সেহরিশ বলল, ‘গতকাল সন্ধ্যায় বৃষ্টি হচ্ছিল তখন আমি বারান্দায় ছিলাম। আমার বাড়ির রোডের বিপরীতে একটা জলপাই গাছ আছে। সেখানেই কেউ লুকিয়ে ছিল। বারবার মাথা বের করে দেখছিল আমাকে। যেন নজর রাখছে। এর আগেও আমি তাকে লক্ষ্য করেছি।’
‘তোর কাউকে সন্দেহ হয়?’ বলে থামল সাদাফ। মূহুর্তে চট করে বলে উঠল, ‘জোহান?’
সেহরিশ ডানে-বামে মাথা নাড়ল, ‘না। তার এত সাহস হবে না। আর আমার মনে হচ্ছে আড়ালে থাকা আগন্তুক কোনো নারী।’
সাদাফ পরিস্কার কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘নারী?’

রোদ মাখা জলকুটিরে দিকে তাকিয়ে রইল সেহরিশ। পাশে সাদাফ কোনো কথা বলল না। দুই সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল সে। পরমূহুর্তে মনে হলো সাদাফ কিছু বলতে চায়। কিন্তু সে কিছু বলল না। সেহরিশ খানিকটা এগিয়ে চারপাশে তাকিয়েই বেশ ভালো লাগল। পুকুরের দু’পাশে লম্বা লম্বা কাঠ গাছগুলো আকাশমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশ একটা আওয়াজ শুনতে পেল দূর মাঠের মাঝখানে বাচ্চারা ফুটবল খেলছে ওদের চিৎকার চেচামেচির আওয়াজ। সেদিকে তাকিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল সেহরিশ। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে গুটিয়ে নিল হঠাৎ করেই মনে হল সে বড়ো হয়ে গেছে। সেহরিশ শুধাল, ‘কোথায় ওঁ?’
‘কে? তূর্ণ?’
‘হ্যাঁ অনেকদিন হল দেখছি না। কোনো খোঁজ নেই।’
‘ওঁর মা ওঁকে দেখতে চাইছে। দুদিন হলো বাবা মায়ের কাছে গিয়েছে। আজ সম্ভবত চলে আসবে।’
সেহরিশ জিজ্ঞেস করল, ‘জুবিয়া কে নিয়ে তূর্ণ কতটা সিরিয়াস? নাকি সে অন্য মেয়েদের মতন জুবিয়াকেও শুধু লাইক করে?’
সাদাফ বলল, ‘তূর্ণ অনেক মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করেছে। কিন্তু জুবিয়ার সঙ্গে এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই চোখে পরেনি। আমার মনে হচ্ছে তূর্ণ জুবিয়াকে ভালোবাসে। এজন্য সে জুবিয়ার সাথে রিলেশনে জড়ায়নি বরং বিয়ে করতে চায়।’
সেহরিশ বলল, ‘বিয়ের পর ওর যদি আবার অন্য কাউকে পছন্দ হয় তখন?’
‘শুট করে দিস।’ বলে উচ্চস্বরে হাসল সাদাফ। যেন সে কোনো কৌতুক বলেছে। সেহরিশ চিন্তা ভাবনা করে বলল, ‘আমায় ভাবতে দে। আর একটা কাজ করতে পারিস তুই।’
‘কি কাজ?’
‘তূর্ণকে আজই চলে আসতে বল। এবং আগামী দুই এক দিনের ভেতর একটা গেটটুগেদার অনুষ্ঠান কর। সেখানে তূর্ণ আর জুবিয়া কে থাকতেই হবে। আমি তূর্ণর বিয়ের কথাবার্তা বলব তারপর ইতালি ব্যাক করব। এখানে আমার অস্বস্তি হচ্ছে দিনকে দিন তা বাড়ছে। দ্রুত কাজ শেষ করে চলে যাব।’
‘কেমন অস্বস্তি? ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন?’
‘না। তেমন কিছু নয়।’ বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সেহরিশ। তারপর সাদাফের উদ্দেশ্য আবারও বলল, ‘উমাইয়া কে রেখে যাবি না-কি সমস্ত কিছু গুছিয়ে তারপর সঙ্গে নিয়ে যাবি?’
‘পাসপোর্ট ভিসা এসবে প্রায় সপ্তাহ পনেরো দিন লাগবে। তারপর সঙ্গে নিয়ে যাব।’
‘ওর বাবা রাজি?’
‘সিরাজগঞ্জ আমার একটা জায়গা আছে। সেখানে বাড়ি নির্মাণ করার চিন্তা ভাবনা করছি। উমা আমার স্ত্রী হওয়ার পর ওর পরিবারের দায়িত্ব টাও আমার। আমি ওনাদের ছেলে হতে চাই। আর তাছাড়া আমি চাই তুই দুই একদিনের ভেতর একবার সেখানে গিয়ে জায়গাটা দেখে আয়।’
সেহরিশ বলল, ‘তোর ইতালি ব্যাক করার জন্য আরও মাস খানেক সময় লাগবে। কিন্তু তূর্ণ?’
‘তূর্ণ কী?’ জানতে চাইল সাদাফ।
‘তূর্ণর সলো সং এর কথা ভুলে গেছিস? আগামী মাসে সেটা। তূর্ণ বিয়ে করে এখানে থাকবে তারপর জুবিয়াকে নিয়ে যাবে অনেক সময়ের ব্যাপার।’
সাদাফ বলল, ‘জুবিয়া থাকবে। তূর্ণ পরে এসে নিয়ে যাবে।’
সেহরিশ ভ্রু কুঁচকাল, ‘নতুন বর। বউ রেখে দূরদেশে চলে যাবে?’

সাদাফ হেঁটে গেল। সেহরিশের পাশের চেয়ারটা টেনে সে বসল। এরপর চারপাশে একবার তাকিয়ে সেহরিশের মুখপানে দৃষ্টি স্থির করল। দুই দিনে মুখটা শুঁকিয়ে গেছে। মনে হল, ঠিক মতো খাবার খাচ্ছে না। সাদাফ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমাদের বন্ধুত্ব প্রায় তেরো বছর হতে চলল। সেই প্রথম দিন থেকে তোকে দেখছি আমি ও তূর্ণর ভেতর নিজের খুশি খুঁজিস। তূর্ণ বড়ো হয়েও যেন সে ছোট্টটি রয়েগেছে নতুন টি-শার্ট কেনার পর প্রথমে তোকে দেখাতে চলে আসে। তোর বলা টি-শার্ট টাই সে পরে। তূর্ণ তোকে অসম্ভব ভালোবাসে কিন্তু তার চেয়েও বেশি তুই বাসিস। এজন্য তূর্ণর সব রকম বাঁদরামো মুখ বুঁজে সহ্য করিস। বলা বাহুল্য তূর্ণ কে নিজের ছেলের মতোই আদর যত্ন দিয়ে মানুষ করছিস। কিন্তু কতদিন? এবার তো ওর বিয়ের চিন্তা ভাবনা করছিস। আমি বিয়ে করলাম। তূর্ণর বিয়ে দিবি তারপর তোর কী হবে? এখন যখনতখন আমাকে কল করিস না। ভাবিস উমাইয়া আছে। তূর্ণর সঙ্গে তাই করবি। তারপর তুই একা হয়ে যাবি না? আমরা চাই তুই নতুন করে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নে। নতুন করে কাউকে আপন কর। এভাবে আর কতদিন? আর কত নিজেকে কষ্ট দিবি? তোর এভাবে পালানো আমাদের সহ্য হচ্ছে না। নতুন করে জীবন যাপন করাটা দোষের কিছু নয় সেহরিশ।’
সেহরিশ নিশ্চল চেয়ে দেখল সাদাফকে। তারপর মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। হঠাৎ করেই সেহরিশের মন খারাপ হয়ে গেল। মুখ ভার করে বলল,

‘অনূভুতি গুলো কাঁচের মতো হয় ভেঙে গেছে জোড়ানো মুশকিল। একবার করা ভুল দ্বিতীয় বার করা বোকামি। অতীত নিয়ে পরে থাকার মতো সময় আমার নেই। সেসব পুরোনো কথা। পাস্ট ইজ পাস্ট! ভুলে যাওয়া উত্তম। আমি ভুলে গেছি তোরাও ভুলে যাব।’

সাদাফ বলল, ‘তাহলে পালাচ্ছিস কেন?’
.
.
ভোরের আলো ফুটেছে। ঘড়িতে প্রায় সাতটা বাজে। দরজার কাছ থেকে ভেসে এলো সাদাফের কণ্ঠ। সাদাফ কড়া গলায় বার দুয়েক তূর্ণ কে ডেকে গিয়েছে। তূর্ণ গতকাল রাতে বাড়ি ফিরেছে। তূর্ণর সঙ্গে সাদাফের এখনই কথা বলা প্রয়োজন। তূর্ণ ঘুম থেকে উঠে এলো ড্রয়িংরুমে। মুখ ভার করে সাদাফের সামনের সোফায় বসে রইল সে। সাদাফ তূর্ণর চোখে-মুখে চেয়ে দেখল। তারপর সহজ কণ্ঠে বলল,

‘জুবিয়া কে তোর মনের কথা জানিয়েছিস?’

তূর্ণর ঘুম চট করে উধাও হয়ে গেল। সে প্রশ্ন করল,

‘না। কেনো?’

‘সেহরিশ তোর আর জুবিয়ার বিয়ে নিয়ে দুই পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চায়। তোদের বিয়ের পর ওঁ ইতালি চলে যাবে। তুই যদি এখনও জুবিয়া কে তোর মনের কথা না জানাস তাহলে সেহরিশ নিজে জানাবে বলেছে।’ ইচ্ছে করে শেষে মিথ্যে বলল সাদাফ। কারণ এভাবে না বললে তূর্ণ সাহস করে জুবিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আগে বাড়াবে না। সেহরিশের কথা শুনে সাহস করেই প্রপোস করবে। তূর্ণ আঁতকে উঠল। কঠিন থেকে সহজ হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

‘ওঁ কেন করবে? আমি ভালোবাসি। প্রপোস ও আমি করব। কাল-ই করব।’

সাদাফ ভ্র বাঁকিয়ে ঠেস দেওয়া কণ্ঠে বলল,

‘কাল?’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here