আশিয়ানা #পর্ব_৪৪ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
57

#আশিয়ানা
#পর্ব_৪৪
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
সাল ২০০৫। জানালা দিয়ে দুর্ভেদ্য চোখে স্কুল মাঠে বিশাল গাছটার দিকে দৃষ্টি ফেলল সেহরিশ। গাছের পাতাগুলির ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিচ্ছে সোনালী রোদের ঝলকানি ঘাসের উপর পড়ছে। অন্য দিকে গাছের ছায়া গিয়ে পড়ছে। পড়াশোনার ফাঁক দিয়ে বিমর্ষ ম্লান মুখে সেদিকে তাকিয়ে রইল সে। চতুর্থ ক্লাসের পর পনেরো মিনিটের পর বিরতি দেওয়া হলো, সেহরিশ আলগোছে বই পত্র গুছিয়ে রেখে হলওয়েতে এসে ভেন্ডিং মেশিন থেকে জলখাবার গ্রহণ করে। স্কুল ছুটি হবে দুপুর একটা বাজে। স্কুলভরা ছাত্র-ছাত্রী অথচ সেহরিশ কাউকে বন্ধু বানায় না। অনেকে বন্ধু হতে আসে এবং সেহরিশ তাদের কিছু বলে না দেখে তারা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। অনেকে তার এই গম্ভীর স্বভাবটার জন্য তাকে অপছন্দ করে। এসব কখনও গায়ে মাখে না সে। স্কুল ছুটির পর সবসময় কানে হেডফোন দিয়ে সে গান শুনে এবং হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডে আসে। বাসের একটা সিটে বসে চোখ বন্ধ করে সে গান শুনে। আজ স্কুল ছুটি হলো, ক্লাস থেকে বের হওয়ার শুরুতে জোহানের সঙ্গে সামন-সামনি হলো, জোহান ওর চারজন বন্ধু নিয়ে সেহরিশের পথ আঁটকে দাঁড়াল। স্পষ্ট ইতালিয়ান ভাষায় জিজ্ঞেস করলো, ‘নিজেকে বড়ো সেয়ানা মনে করছিস? একদিন জায়গা মতন দিবো না। সেদিন টের পাবি, আমি কী জিনিস।’

সেহরিশ তার কথার কোনো প্রত্যুত্তর করেনি। ভদ্রতা বজায় রেখে মুচকি হাসল এরপর মাথা নিচু করে চলে গেল। জোহান অবাক চোখে সেহরিশ কে চলে যেতে দেখল, দু-হাত কচলাতে শুরু করে বলল, ‘একদিন সুযোগ বুজে ওকে ধোলাই করতে হবে। আমাকে উপেক্ষা করা বুঝাব।’

স্কুল থেকে বের হয়েই সেহরিশ তার হেডফোনটা বের করে কানে দিল এরপর কিছু ইংলিশ গান চালু করে। প্যান্টের পকেটে দু-হাত গুঁজে নির্জন পথ দিয়ে হাঁটতে লাগল। রোমের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে রাস্তার পাশে নানা রঙের ফুল গাছগুলো। বেশ কিছু ফুল রাস্তায় বিছিয়ে পড়ে আছে। সেহরিশ একপলক গাছের ফুলগুলো দেখল এরপর মাটিতে পড়ে থাকা ফুলগুলো দেখে মৃদু হাসল। মূহুর্তে ছোট্ট বেলার একটা ঘটনা মনে পড়ল সেহরিশের। তখন সম্ভব তার দশ বছর, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরার পথে ফুলগাছ দেখতে পেলেই সে ফুলটি ছিঁড়ে নিত৷ বেশ কিছু বাড়ির বিল্ডিং টপকিয়ে ওপাশে গিয়েও ফুল তোলার রেকর্ড আছে ওর। ফুল হাতে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই প্রথমে পুরো বাড়িতে মা-কে খুঁজে বের করা যেন ওঁর প্রথম কাজ। ফারিয়া সব সময় চুলগুলো খোঁপা করে রাখত আর সেহরিশ এসে সে খোঁপাতে ফুল গুঁজে দিয়ে মা-কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে খিলখিল করে হেসে উঠল। ইতালি এসেছে সে পাঁচ বছর, সেই বারো বছর বয়সকালে বাবা শরিফুল চাচা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গে জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এখন সতেরো বছর চলছে। কিছুমাস পর আঠারো বছরের হয়ে যাবে।
ছোট বেলার অভ্যেস মায়ের খোঁপায় ফুল গুঁজে দেওয়া, ইতালি আসার পর সে অভ্যেসটা বন্ধ হয়ে যায়। এজন্য প্রায় পাঁচ বছর ধরে হাত দিয়ে কোনো ফুল স্পর্শ করেনি। সেহরিশ নিষ্পলক ভাবে ফুলগুলো দেখে পা বাড়াল। কিছুটা দূর এগিয়ে এসে দেখল একজন ছেলেকে চারজন ছেলে মিলে পেটাচ্ছে। সে ছেলেটা রাস্তায় পড়ে মার খাচ্ছে। সেহরিশ কান থেকে হেডফোন খুলে ব্যাগে ভরে রাখল তারপর ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল। চারজন কে ধরে দুই একটা পাঞ্চ মারার পর তারা উল্টোদিকে পালিয়ে যায়। আহত ছেলেটি মাটিতে শুয়ে আকুতি মিনতি করছে। সেহরিশ ঝুঁকে বসল এরপর ছেলেটির শরীর থেকে রক্ত ঝরছে দেখে একটা ট্যাক্সি ডাকলো, এরপর হাসপাতালে ভর্তি করালো তাকে। এক ঘন্টা পর, ডাক্তার আজহিক ছেলেটার সঙ্গে সেহরিশ কে দেখা করার সুযোগ দেন। হাসপাতালের বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা, সেহরিশ কে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল।

সেহরিশ বলল, ‘উঠতে হবে না, শুয়ে থাকুন।’
সেহরিশ ইংলিশে কথা বলল। ছেলেটার চোখদুটো চকচক করে উঠল। সে হুট করে বলল, ‘আপনি বাঙালি?’
‘আপনি কিভাবে বুঝলেন?’
‘বাঙালি মানুষের কণ্ঠে আলাদা মাধুর্য রয়েছে। তারা যে ভাষাতেই কথা বলুক না, কেন? তাদের কণ্ঠে বাঙালির শুভাস লেগে থাকে।’
সেহরিশ মৃদু হাসল। বলল, ‘আমি সেহরিশ।’
‘আমার নাম সাদাফ মোজাম্মেল। আপনাকে অসম্ভব ধন্যবাদ! আমাকে ওইসব বখাটে ছেলেদের থেকে বাঁচানোর জন্য।’
‘আপনি এই সময় ওই রাস্তা দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন?’
‘ওইদিকে একটা পিৎজা ডেলিভারি ছিল।’
‘ওহ আচ্ছা। আপনার তাহলে লোস হয়ে গেল না?’
‘হ্যাঁ, তা অবশ্য হয়েছে। মালিকের কাছে একটু বকুনি খাব। ব্যস।’
সাদাফের চেহারা ও কথাবার্তা শুনে তার বয়স বেশি হবে বলে মনে হলো না। দ্বিধা ছেড়ে সেহরিশ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এমনিতে কী করেন? আর আপনার বয়স?’
‘আমি একজন স্টুডেন্ট। পড়াশোনার পর ছয় ঘন্টা সময় পার্টটাইম জব করি। আমার বয়স ১৭ চলছে।’
সেহরিশ বলল, ‘আমি এখন আসি। আমি হাসপাতালের বিল মিটিয়ে দিয়েছি। আপনাকে কে নিতে আসবে?’
‘আমার বাবা কে কল দিলে তিনি আসবেন। কোনো সমস্যা হবে না।’
সেহরিশ চলে যেতে লাগল। একসময় পিছু ডাকল সাদাফ। সাহায্য করার জন্য সেহরিশের থেকে ওর ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখল। কোনো এক সময় থ্যাংক ইয়্যু একটা ব্যুকে পাঠাবে। বিকেলে বাড়ি ফিরল সেহরিশ। দুপুরের খাবার টেবিলের উপর রাখা আছে সে খাবারটুকু শেষ করে রুমে চলে গেল। পড়তে বসল। হঠাৎ উদাস চোখে বারান্দায় তাকাল, একজোড়া হলুদ পাখি এসে নিচে নামল। টুক টুক করে হাঁটছে। হঠাৎ মায়ের কথা খুব মনে পড়ল সেহরিশের। বাড়িতে ফোন করে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে শেষ করে। তারপর বইয়ের ভাজে মুখ গুঁজে টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ে।

সাদাফের কল এলো দু-দিন পর। একদিন কথা বলে দুজন দেখা করে এরপর রোজ ওদের পথে দেখা হত এবং সময় অসময় সাদাফ তাকে কল করে গল্প বলা করে। সেহরিশ কখনো বিরক্ত প্রকাশ করেনি, কেন যেন সাদাফের কথাগুলো ওর শুনতে ভালো লাগে। প্রায় সময় সাদাফ কল করে সেহরিশের ফোন বন্ধ পায়। একদিন জিজ্ঞেস করেই বসে সাদাফ, ‘তোর ফোন বন্ধ থাকে কেন? জানিস আমার কত টেনশন হয়?’

সাদাফের সঙ্গে বন্ধুত্ব দু’মাস হতে চলল। সাদাফ এখন সেহরিশের একজন বিশস্ত বন্ধু। চোখ বন্ধ করে তাকে সব বলা যায়। এতদিন সে সাদাফের কাছে লুকিয়েছে, তাই আজ একবার জিজ্ঞেস করার পরপর সেহরিশ লজ্জাজনক হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে বলল, ‘আমার একজন গার্লফ্রেন্ড আছে। তার নাম আবরিয়ানা। আমি যখন ওর সঙ্গে থাকি তখন আমার ফোন বন্ধ থাকে।’
সাদাফ বিস্মিত গলায় বলল, ‘আমাকে এতদিন বলিস নি কেন? আমার থেকে এত বড় একটা সত্য লুকিয়েছিস?’

রাগ করল সাদাফ। তবে আবরিয়ানার ছবি দেখামাত্র সে রাগ উধাও হলো। মেয়েটি ফর্সা ও মিষ্টি দেখতে। সেহরিশ জানালো তার এক বছরের প্রেম এবং সে আবরিয়ানা’কে অসম্ভব পাগলের মতন ভালোবাসে। আবরিয়ানা সেহরিশের থেকে তিনমাসের ছোটো। গতকাল ওদের সম্পর্কের এক বছর পূর্ণ হবে। এই নিয়ে কিছু বিশেষ প্ল্যানিং করতে চায় সে। সেহরিশ মাথা নিচু করে ফেলল। সাদাফের দিকে তাকাতেও কেমন লজ্জা লাগছে ওর। সাদাফ জিজ্ঞেস করল, ‘গার্লফ্রেন্ড আছে এজন্য মেয়েদের ইগনোর করিস?’
‘হ্যাঁ। আমার একজন ব্যক্তিগত মানুষ আছে। তবে আমি অন্যদের দিকে তাকাব কেন? আমার সমস্ত ভাললাগা ভালোবাসা শুধু আবরিয়ানা ঘিরে। আমি দ্রুত বড় হয়ে তাকে বিয়ে করব।’
সাদাফ ফিসফিস করে বলল, ‘হাই স্কুলের গন্ডি এখনো শেষ হয়নি বস। এরইমধ্যে বিয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করছিস। বাহ।’
সেহরিশ দৃঢ় গলায় বলল, ‘আমি এখনো আবরির হাতখানা স্পর্শ করিনি। হালালের অপেক্ষায়।’
.
.
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ে সেহরিশ। আজ তার আরবিয়ানার সঙ্গে বারগ্যামো শহরে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। সকাল সকাল পৌঁছাতে না পারলে পুরো শহর ঘুরা হবে না। এজন্য ত্বরিতগতিতে রেডি হলো সেহরিশ এরপর ব্যস্ত হাতে নাস্তা করে বাড়ি থেকে বের হলো। মেট্রোতে আগে এসে অপেক্ষা করছিল আবরিয়ানা। সে সেহরিশ কে দেখে একটি হাসি উপহার দিল। তারপর দুজন একসাথে একটা মেট্রো তে উঠে দাঁড়াল। বসার জন্য সিট আছে তবুও দুজন পাশাপাশি একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। আবরিয়ানা জিজ্ঞেস করল, ‘এইখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন?’

সেহরিশ মৃদু স্বরে বলল, ‘এ-ই জায়গা আমি আগেও গিয়েছিল, ভাইয়া বারগ্যামো শহরে কাজের সূত্রে গিয়েছিল এবং সাথে আমাকে নিয়ে যায়। এখান থেকে বাহিরের দৃশ্যটা অসম্ভব সুন্দর দেখা যায়। অপেক্ষা করো, আমরা একসাথে দেখব।’

জানালা দিয়ে বাহিরে বেশ কিছু দৃশ্য দেখে চোখ আটকে গেল আবরিয়ানার। সে প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘আমাকে আগে নিয়ে আসোনি কেন? ইশশ, কত সুন্দর।’
আকাশ একদম পরিস্কার, চকচকে রোদ থাকায় দেখতে চমৎকার লাগছিল। বিশাল বড় বড় পাহাড়ের রেঞ্জ, শ্বেত শুভ্র বরফের আবরণে ঢাকা। মাঝে মাঝে পাহাড়ের মাঝে লেক, আর তা ঘিরে গড়ে উঠা জনবসতিগুলোও চোখে পড়ছে। তো এই সুন্দর সুন্দর দৃশ্য দেখে আবরিয়ানা খুশিতে ডগমগ করতে লাগল। মেট্রো থেকে নামার পর দু’জন পাশাপাশি হেঁটে এদিক সেদিক করে দিন কাটাল। পুরো শহরটা ঘুরে শেষ করতে পারল না। তার আগেই বিকেল হয়ে গেল। এবার ওদের ফিরতে হবে। পাহাড়ে ঘেরা শহরের একপাশে ছিমছাম সুন্দর খাবারের হোটেল। এখন তেমন ভিড় নেই। দুজন একসঙ্গে বসে ভরপেট খাবার খেয়ে বাসে উঠে পড়ল। মিনিট দশ পর বাস থেকে নেমে মেট্রোর দিকে এগিয়ে গেল।

সুর্য প্রায় ডুবি ডুবি অবস্থা, ওঁরা সন্ধ্যার ট্রেনে উঠল। ট্রেনের সিটে বসে আছে আরবিয়ানা। তাকে ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সেহরিশ থেকে একটু দূরে বসে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাল, পাহাড় দেখা গেল ও একটু পর পর পাহাড়ি গ্রামগুলো দেখা যাচ্ছে। দূরের পাহাড়গুলো ও দৃশ্যমান লাগল। সেহরিশ লাজুক স্বরে বলল, ‘ভয় নেই। আমি আছি।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here