আশিয়ানা #পর্ব_৪৫ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
55

#আশিয়ানা
#পর্ব_৪৫
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
____________
ঘড়ির কাঁটা ৭টা ছুঁইছুঁই। বেডের পাশে ছোট্ট টেবিল ল্যাম্পের পাশে রাখা এলার্ম ঘড়িটা অনবরত বেজে চলেছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে এলার্মটা বন্ধ করল সেহরিশ। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রুমটা পরিপাটি করে গুছিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। সাদা রঙের পর্দাগুলো একহাতে সরিয়ে দিল সে। চকচকে রোদ পিছলে নেমে এলো ঘরের মেঝেয়। বিশাল এই বাড়িটায় সেহরিশ একা থাকে, কাজের ফাঁকে সময় পেলে তার বড় ভাই সোহান মাঝেমধ্যে এসে উঁকি দিয়ে যায়। রফিক চাচা এবাড়িতে থাকতেন, তিনি গত বছর পরিবার নিয়ে দেশে ফিরে যান। সেহরিশ বাড়িটার মায়া ছাড়তে পারেনি। তাই সে সোহানের কাছে ফিরে যায়নি। আজ স্কুল অফ। মেট্রো করে সোহানের সঙ্গে দেখা করতে যাবে সেহরিশ। সপ্তাহে একদিন বড় ভাইয়ের কাছে যায়। কারণ ওই জায়গা থেকে আরবিয়ানা বাড়ি খুব একটা দূরে নয়। সেহরিশ ঘন্টা দুয়েক সময় নিয়ে খাবার বানালো এরপর নাস্তা শেষ করে, রেডি হওয়ার জন্য রুমে এলো। তখন ওর হাতের বাটন ফোনটা বেজে উঠে। সাদাফ কল করেছে, আজ সে কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে। বাড়িতে বসে বোর হচ্ছে সে। সেহরিশ শক্ত গলায় বলল, ‘আমি ভেরোনা যাচ্ছি। ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য। ইচ্ছে হলে যেতে পারিস।’ সাদাফ তিন সেকেণ্ড সময় নিল না। ‘আমি যাব। ১০মিনিট অপেক্ষা কর।’ বলে কল কাটলো। সেহরিশ বাড়ি থেকে বের হয়ে একবার সোহানকে কল করল। সে কোথায় আছে? জানা প্রয়োজন। সোহান কল রিসিভ করে ব্যস্ত কণ্ঠে শুধাল, ‘হ্যাঁ, বলো।’
‘তুমি কোথায় আছো?’
‘অফিসে কেন?’ বলে থামল সোহান। এরপর আবারও শুধাল, ‘তুমি কী আজ ভেরোনা আসতে চাচ্ছ?’
‘জি। আমার বন্ধুও আমার সঙ্গে আসবে।’
‘আজ এসো না। আমার আজ ছুটি নেই। অফিসে আছি। ভীষণ কাজের চাপ। আগামী সপ্তাহে আসলে ভালো হয়। তখন সবাই একসাথে ঘুরতে পারব।’
‘আচ্ছা। তাহলে এখন রাখি।’

সেহরিশ পায়ে পায়ে হেঁটে সাদাফের এপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়াল। এরপর নিচ থেকে আওয়াজ দিয়ে সাদাফকে ডাকল। সাদাফ রেডি হয়ে ছিল। সেহরিশের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোর আসার দরকার ছিল না। আমি তোর বাড়ি যাচ্ছিলাম।’
‘আমরা ভেরোনা যাচ্ছি না। অফিসের কাজে ভাইয়া আজ ব্যস্ত আছেন। আগামী সপ্তাহে যেতে বলেছেন।’
সাদাফ বলল, ‘এখন কী করব?’
‘সিয়েনা যাব৷ শুনেছি জায়গাটা সুন্দর।’
‘জায়গাটার নাম আমি শুনেছি। কিন্তু যাওয়া হয়নি। কিন্তু যতটা জানি সেখানে বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ঘুরতে যায়। বাই এ্যনি চান্স আরবিয়ানা সেখানে আসছে না তো?’
সেহরিশ চোখ দুটো ছোট ছোট করে সাদাফের দিকে তাকাল। এরপর প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘সে আসবে আর তোকে সঙ্গে নিবো। এটা ভাবলি কীভাবে?’
সাদাফ থমথমে গলায় বলল, ‘সেলফিশ।’

রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। দক্ষিণা বাতাস বইছে জোরে, বাতাসের তীক্ষ্ণতায় সাদাফের চুলগুলো অগোছালো হয়ে কপোলদ্বয়ে ছড়িয়ে পড়ল। একহাত দিয়ে চুলগুলো পিছনদিকে ফেলে দিল সাদাফ। এরপর সেহরিশের পিছু পিছু যেতে লাগল। সাদাফ হুট করে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর গম্ভীর স্বভাবটা আমার বিরক্ত লাগে। তুই মানুষ না-কি রোবট? এতদিন ধরে আমাদের বন্ধুত্ব অথচ তোকে একবার হাসতে দেখি না।’
ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকাল সেহরিশ। আধো আধো কণ্ঠে বলল, ‘একা মানুষের শত্রু নেই। একা থাকা স্বস্তির। কারণ আগেপিছে কোন ঝামেলা পাকানোর মানুষ থাকে না। এজন্য আমি বন্ধু বানাই না। সবাই বন্ধু হওয়ার যোগ্য নয়, বন্ধু তাকে বানানো উচিত যে আপদ বিপদের সময় সঙ্গে থাকবে। বিপদে পালিয়ে যাওয়া বন্ধু শত্রুর চেয়ে ভয়ংকর। আর কারণে অকারণে হাসিঠাট্টা আমার পছন্দ না।’
‘আমাকে বন্ধু করলি কেন?’ জানতে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাদাফ। সেহরিশ চাপা গলায় বলল, ‘এর উত্তর তোর মাঝেই আছে। খুঁজে দেখ উত্তর পেয়ে যাবি।’
বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল। সাদাফ ওষ্ঠদ্বয় মিইয়ে মুচকি হাসল। বক্ষদ্বয় জুড়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল। বাস আসতে দেরি হচ্ছে সাদাফ ওর পকেট থেকে দু’টো চকলেট বের করল। এরপর সেহরিশের দিকে একটা এগিয়ে দিল। সেহরিশ চকিত তাকিয়ে বলল, ‘আমি বাচ্চা না।’
.
.
ছোট্ট একটি শহর, রোমে থেকে প্রায় দুই ঘন্টা দূরত্ব। বাসে বসে হাইওয়ে থেকে পাহাড় গুলো দেখতে লাগল সেহরিশ। চকচকে আকাশ, মৃদু বাতাস, ক্ষীণ পর বাস থামল। সেহরিশ চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখল, একটি খুব ছোট রাস্তা, তিন বা চারটা রেস্তোরাঁ, ছোট এক যাদুঘর। কয়েকদিন থেকে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য শহরে একটি হোটেল আছে। জায়গাটা ছোট কিন্তু খুব সুন্দর। সেহরিশের সঙ্গে সাদাফ আসলে সে রাতটা শহরে থাকত, কিন্তু সাদাফ বাসে উঠতে পারেনি। হঠাৎ রেস্তোরাঁ থেকে কল আসায় সাদাফকে ফিরে যেতে হয়েছে। সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে পাহাড়ের ছোটো পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। সহসা একটা ছোটো মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগল তার। মেয়েটি মাটিতে পরে যায় তার হাতের ফুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে পথে। সেহরিশ হাঁটু গেঁড়ে বসে মেয়েটিকে তুললো। হাত দিয়ে শরীরের ধুলোময়লা ঝেড়ে ফেলে দিতে লাগল। মেয়েটি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সেহরিশ ইটালিয়ান ভাষায় বলল, ‘স্যরি। আমি তোমাকে আসতে দেখিনি।’ মেয়েটি কিছু বলল না। একচোখে তার ফুলগুলো দেখতে লাগল। সেহরিশ দশ ইউরো মেয়েটির হাতে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার ফুলগুলো নষ্ট হয়েছে আমার জন্য। এটা তার মূল্য।’

মেয়েটি মাথা নিচু করে মৃদু হাসল। সে কোনো কথা বলছে না দেখে সেহরিশ অবাক হলো। একটু পরেই মেয়েটির মা এলো। সে বলল, মেয়েটির নাম ইরা এবং সে কথা বলতে পারে না। এবং এখানে তাদের একটা ফুলের গার্ডেন রয়েছে। সেখানে সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটেছে। সেহরিশ মেয়েটির সৌন্দর্য উপেক্ষা করতে পারল না। এজন্য তাদের থেকে কিছু ফুল কিনে নিয়ে পাহাড়ের পথে হাঁটতে লাগল। সহসা সেহরিশের ফোন বাজলো। আরবিয়ানা কল করেছে। কল রিসিভ করে কানে লাগাল সেহরিশ। ওপাশ থেকে মৃদু স্বরে আরবিয়ানা ইতালিয়ান ভাষায় বলল, ‘কোথায় আছ?’
‘সিয়েনা।’ নির্মূল গলায় বলল সেহরিশ। গম্ভীর স্বভাব অধিকারী সেহরিশ রাগ যেন নাকের ডগায় থাকে, তবুও সে কখনও আরবিয়ানার সঙ্গে রাগী কিংবা ধমক দিয়ে কথা বলে না। আরবিয়ানা খুশি হয়ে গেল। প্রফুল্লচিত্তে স্বরে বলে উঠল, ‘সিয়েনা? আমিও এখানে আছি। তুমি কোথায়?’
সেহরিশ বলল, ‘পাহাড় উঠছি।’
‘আমি পাহাড়ের উপরেই আছি। অপেক্ষা করো আমি নেমে আসছি।’
বাঁ হাতে ফুলটা নিয়ে সোজা হয়ে সরু পথ দিয়ে উঠে যেতে দিল সে। আরবিয়ানা সাদা রঙের ওয়েস্টার্ন পোশাক পরনে। পাহাড়ের পথ দিয়ে ধীরেধীরে নামছে, সেহরিশ তাকে দেখতে পেয়ে মৃদু হাসল। আরবিয়ানা এগিয়ে এসে কুটিল হেসে বলল, ‘তুমি এখানে আসবে আমাকে বলোনি তো।’
সেহরিশ মুচকি হাসল। এরপর হাতের ফুলটা আরবিয়ানার দিকে এগিয়ে দিল। বলল, ‘হঠাৎ করেই প্ল্যান হলো তাই বলা হয়নি।’
আরবিয়ানা ফুলটা নিল। সেহরিশ জিজ্ঞেস করল, ‘একা এসেছ?’
‘না। বন্ধুরা সাথে আসছে।’
সেহরিশ ছোট্ট করে বলল, ‘এভাবে কেন এসেছ? হাঁটু দেখা যাচ্ছে।’
আরবিয়ানা মাথা নিচু করে ফেলল। ঠোঁটে ঠোঁট চাপল এরপর থতমত চেহারায় দাঁড়িয়ে গেল। সেহরিশ থামল একটু ঘুরে আরবিয়ানা সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আরবিয়ানা মুখখানা দেখল। বাতাসের জন্য আরবিয়ানার চুলগুলো বার বার উড়ে উড়ে চোখমুখ ঢেকে যেতে লাগল। সেহরিশ একগাল হাসল এরপর ঝুঁকে এসে আরবিয়ানার মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল। তারপর বিমোহিত কণ্ঠে বলল, ‘চুলগুলো বেঁধে ফেলো।’

দুজন একসঙ্গে সিয়েনার পথে হাঁটতে লাগল। এদিকে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে, পথের পাশে দাঁড়িয়ে দুজন সূর্যাস্ত নামা দেখল, সেহরিশ আরবিয়ানার হাতখানা ধরতে চাইল। বার দুয়েক চেষ্টা করে আবারও হাত সরিয়ে নিল। মাথা নিচু করে ঠোঁট উল্টিয়ে রাখল। আরবিয়ানা রাস্তার মাঝখানে দৌঁড়ে গেল। তারপর উচ্চকিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘সেহরিশ! টি আমো।’ [সেহরিশ! আমি তোমাকে ভালোবাসি।]

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here