#আশিয়ানা
#পর্ব_৪৬
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
____________
গভীর অরণ্য! দুরধিগম্য পাহাড় পথে ট্রেন চলছে। সুনসান চারপাশ, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেহরিশ। মাস দুয়েক হবে আরবিয়ানার সঙ্গে সেহরিশের দেখা হয়নি। দুজন পড়াশোনার মাঝে এত ব্যস্ত ছিল যে দুদিন বা একদিন পরপর ফোনে একটু কথা হত, আজ রাত হওয়ার পর থেকে সেহরিশের মনটা কেমন আরবিয়ানার জন্য ছটফট করছে। সে দ্বিতীয় বার না ভেবে ভেরোনা যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেল। মেট্রোতে এখন মানুষজন তেমন নেই। গ্রীষ্মের কড়া উত্তাপ রাতের এই সময়ে দ্বিগুণ লাগতে লাগল। শার্টের বোতাম দুটো খুলে কোনোরকমে হাত নাড়িয়ে বাতাস করতে লাগল। মেঘলা আকাশ একটা তাঁরাও নেই। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আনমনে হাঁটছে সেহরিশ। রাত দুইটা ঊনত্রিশ। এই সময় একটা খোলা দোকান দেখতে পেল। আরবিয়ানার কথা ভেবে সেহরিশ দৌঁড়ে এলো দোকানটার সামনে। লোকটা প্রস্তুত হচ্ছিলেন দোকান বন্ধ করার জন্য। আর পাঁচ মিনিট দোকান খোলা রাখার জন্য সেহরিশ তাকে অনুরোধ করে। ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন, ‘কি নিতে চাচ্ছ বাবা? যা নিবা একটু তাড়াতাড়ি নেও। বাড়িতে আমার স্ত্রী একা আছে। আমার জলদি যেতে হবে।’
সেহরিশ কোমল স্বরে বলল, ‘আমি বেশি সময় নিবো না।’
আরবিয়ানার পছন্দ, অপছন্দ বিষয়ে সবই জানে সেহরিশ। তাই দেরি না করে ওর পছন্দের চকলেট ও আইসক্রিম নিয়ে নিল। এই আইসক্রিমটা সহজে গলে যায় না। এজন্য অনায়াসে ক্যারি করা যায়। আরবিয়ানার বাড়ির কাছাকাছি আসতে মিনিট বিশ সময় লাগল। ঘরের আলো জ্বলছে এর অর্থ আরবিয়ানা এখনো জেগে আছে। সম্ভবত রাত জেগে পড়াশোনা করছে। সেহরিশ পকেট থেকে ফোন বের করে তারপর আরবিয়ানাকে কল দিল। একবার রিং হওয়ার পরপর কল রিসিভ করল সে। সেহরিশ ঠোঁটের কোণা মৃদু প্রসারিত করে বলল, ‘নিচে এসো।’
আরবিয়ানা ফোন হাতে বারান্দায় ছুটে এলো। ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়ানো সেহরিশের অভয়ব দেখে শুধাল, ‘তুমি এখানে কি করছ?’
সেহরিশ মোহিত কণ্ঠে বলল, ‘তোমাকে অনেকদিন দেখিনি।’
আরবিয়ানা হাল্কা হেসে নিচে নেমে আসলো। সেহরিশ তার দিকে চকলেট ও আইসক্রিম এগিয়ে দিল। ‘এতরাতে এগুলো কোথায় পেলে?’
‘একটা দোকান খোলা পেয়েছিলাম।’
আরবিয়ানা ও সেহরিশ একটা কাঁঠের বেঞ্চের উপর মুখোমুখি বসল। এই নিশি রাতে আবেগ মিশিয়ে আরবিয়ানার দিকে একবার তাকাল সেহরিশ। পরোক্ষণেই আচমকা তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নিল। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। হৃৎস্পন্দন তীব্র গতিতে ছুটছে যেন। সেহরিশ তার হাতখানা বুকের বা পাশে চেপে ধরল। বিড়বিড় করে বলল, ‘কি জানি, কি হচ্ছে?’
সেহরিশের কথা আরবিয়ানার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আজকের রাতটা অন্যরকম লাগতে লাগল কেমন শিরশির অনুভূতি হচ্ছে, যেন গায়ে কাঁটা ফুটছে। সেহরিশ উঠে দাঁড়াল এরপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখল একটা গাছে বেশ কিছু সাদা রঙের ফুল ফুটে আছে। গাছটার নাম জানা নেই সেহরিশের তবে হেঁটে গাছটার কাছে আসলো। আলগোছে একটা ফুল তুলে নিল। আরবিয়ানা প্রায় সময় খোলা চুলে সেহরিশের সামনে আসে আর সেহরিশ তাকে চুল বাঁধতে বলে। এজন্য কিছুক্ষণ আগে এপার্টমেন্ট থেকে নিচে আসার সময় চুল বেঁধেই আসছে। সেহরিশ দ্রুত বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো তারপর আরবিয়ানার চুলের খোঁপায় ফুলটা গুঁজে দিল সে। আরবিয়ানা হাস্যরত বলল, ‘সামনে একটা কফিশপ আছে। পুরো রাত খোলা থাকে। যাবে?’
সেহরিশ বলল, ‘এতরাতে তোমাকে নিয়ে ওখানে যাব না। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন চলো তোমাকে বাড়ির সামনে পৌঁছে দেই।’
আরবিয়ানা বাড়ির সরুপথ দিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ সেহরিশ পিছু ডাকল। চনমনে কণ্ঠে বলল, ‘দাঁড়াও! আরেকটু দেখি।’
.
.
সময়ের গতিপথ কখনও কারো জন্য থেমে থাকে না। সে তার মতন বয়ে চলে। সেহরিশের ১৮বছর পূর্ণ হলো আজ। গতকাল রাত ঠিক বারোটা বাজে কল দিয়ে উইশ করে সাদাফ। এরপর এক এক করে অনেকেই কল ও মেসেজ করে ভালোবাসা জানিয়েছে। আরবিয়ানা তার প্রিয় মানুষ, এবং প্রিয় মানুষের সঙ্গে প্রতিটি মূহুর্ত সুন্দর ও অমায়িক হয়। রাত জেগে কথা বলার এক পর্যায়ে কখন যে সকাল হয়ে যায় বুঝতেই পারেনি তারা। চারটা বাজে কল রেখে তারপর ঘুমাতে যায়।
বিকাল চারটা বাজে সাদাফ কল করে সেহরিশের ঘুম ভাঙালো। এবং বলল সন্ধ্যায় দেখা করার জন্য। আজ অবশ্য আরবিয়ানার সঙ্গে কোনো প্ল্যান নেই। গতকাল রাতেই সে বলেছে আজ বাসা থেকে বের হতে পারবে না। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা এজন্য বাবা মায়ের কড়া শাসনে আছে সে। সাদাফের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে নেই। প্রতিদিন ওর কথায় বিরক্ত হয়ে যায় সেহরিশ। রোজ নতুন নতুন গল্প, ও কথা খুঁজে নিয়ে আসে এরপর সেহরিশকে সামনে বসিয়ে বলতে শুরু করে। সেহরিশ ফোন কানে লাগিয়ে আবারও শুয়ে পরল। সাদাফ রাগমিশ্রিত গলায় সেহরিশ কে রেস্তোরাঁর সামনে যেতে বলে কল কেটে দিল।
খাম খেয়ালি করে আরও দু’ঘন্টা ঘুমিয়ে উঠল সেহরিশ। ইচ্ছে হল আজ কালো রঙের পোশাক পরবে। ঢিলেঢালা কালো শার্ট, ও একটা কালো প্যান্ট পরল। সময় নিয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে তারপর হাতে একটা ঘড়ি পরে নিল। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় একবার আরবিয়ানার নাম্বারে কল দিল সে। আরবিয়ানাকে নিয়ে ভাবতেই খুশি হয়ে যায় সেহরিশ। ঠোঁটের কোণা প্রসারিত হয়। এরপর বাসে করে সাদাফের রেস্তোরাঁয় এলো। সাদাফ ফ্রী হতে হতে রাত ন’টা বেজে গেল। রাতের একটা লাস্ট অর্ডার রয়েছে। ওইটা করেই সে ফ্রী হবে এবং দুই বন্ধু একসাথে জন্মদিন পালন করবে। সাদাফ ইতোপূর্বে ছোট্ট করে একটা আয়োজন করে রাখছে। সেসম্পর্কে সেহরিশ জানে না। রেস্তোরাঁর এককোনায় বসে আছে সেহরিশ। সাদাফ এলো।
সেহরিশ ভ্রুকুটি কুঁচকে শুধাল, ‘এটা কেনো?’
‘আজ রাতের লাস্ট অর্ডার। হোম ডেলিভারি। যদিও এড্রেস একটা হোটেলের দেওয়া আছে। ব্যাপার না, এইটা ডেলিভারি করার পর আমার ছুটি। তারপর দুজন সোজা আমার এপার্টমেন্টে চলে যাব।’
সেহরিশের যেতে ইচ্ছে করল না। সাদাফ ওর হাত ধরে টেনেটুনে মোটরসাইকেলে উঠিয়ে বসালো। সেহরিশ কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি বাসে আসি?’
সাদাফ বলল, ‘ফেলব না। চুপ করে বোস।’
হোটেলের রিসিপশনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সাদাফ। রিসিপশনের পুরুষ লোকটার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সাদাফ জানালো এই হোটেলের আট নম্বর রুম থেকে খাবার অর্ডার আছে। পুরুষ লোকটি রুম নম্বর ৮ এ কল দিল। একজন পুরুষ লোক জানালেন তিনি খাবার অর্ডার করেছেন। এরপর রিসিপশনের লোক সাদাফের নাম কাগজে লিখে ওদের ভেতরে যেতে অনুমতি দিলেন।
সেহরিশ নাক-মুখ কুঁচকে বলল, ‘আমাকে দিয়ে এইসব করানোর জন্য তোর কাছে আসতে বলেছিস?’
সাদাফ দুই সিঁড়ি উপরে আছে। সে সেহরিশের দিকে ঘুরে তাকাল এরপর বলল, ‘একটু কাজে সাহায্য করে এখন রাগারাগি করছিস। তাছাড়া বিশেষ দিন ঘরে বসে কি করতিস শুনি? আরবিয়ানা তো আজ তোর সঙ্গে দেখা করতেও আসেনি। আর ওর সঙ্গে আলাদা প্ল্যানিং-ও ছিল না। তবুও এত রাগ?’
সেহরিশ এই কথার জবাব দিল না। সাদাফের পিছুপিছু হেঁটে আট নম্বর রুমের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। সাদাফ দু’বার কলিংবেল চাপলো। কিন্তু দরজা কেউ খুলছে না। বিরক্ত হয়ে তৃতীয় বার কলিংবেল বাজানোর পর একজন অর্ধনগ্ন পুরুষ দরজা খুললেন এবং ওনার পাশে একজন অর্ধনগ্ন নারী পুরুষ লোকটার শরীরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। সাদাফ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল, চোখ দুটো মূহুর্তে লাল টকটকে হয়ে গেছে। সহসা সাদাফের হাত থেকে খাবারের প্যাকেটটি মাটিতে পড়ে যায়। সেহরিশের কাছে আরবিয়ানার ছবি বহুবার দেখেছে সাদাফ আরবিয়ানাকে দেখে চিনতে বিড়ম্বনা হলো না তার। সাদাফ মর্মাহত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, ‘আরবিয়ানা?’
সেহরিশ ফোন হাতে আবারও চেষ্টা করল আরবিয়ানাকে কল করার কিন্তু সিমটা এখনও বন্ধ। বোধহয় আজ সে তাকে অসম্ভব মিস করছে। সেহরিশ মাথা নিচু করে আপনমনে মৃদু হাসল। সহসা সাদাফের কণ্ঠে আরবিয়ানার নাম শুনে চমকে তাকাল সে। সেহরিশ বার কয়েক চোখের পলক ফেলল এরপর এক পা দু পা করে হেঁটে সাদাফের পাশাপাশি দাঁড়াল। আরবিয়ানাকে এরূপ অবস্থায় দেখে নিমিষে চোখ দুটো নামিয়ে ফেলল সেহরিশ। শরীরের শক্তিগুলো এক অদৃশ্যশক্তি শুষে নিল যেন। আচমকা পেছনদিকে পরে গেল সেহরিশ। শ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহ যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কেমন নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে ও চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছে। চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হলো। পলকহীন দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল। বিচার বিবেচনা করার মতন মানসিকতা ক্ষীণ সময়ের জন্য হারিয়ে ফেলল সে।
সাদাফ একপা এগিয়ে আসলো এরপর একহাতে পুরুষ লোকটার গলা টিপে ধরে অন্য হাতে মারতে আরম্ভ করে। আরবিয়ানার উপর সমস্ত রাগ, জেদ লোকটার উপর ঝারতে লাগল সে। আরবিয়ানা দ্রুত শরীরে একটু কাপড় জড়িয়ে নিল। এরপর চিৎকার চেঁচামেঁচি শুরু করে। হোটেলের একজন কর্মচারী কণ্ঠস্বর শুনে এগিয়ে আসলেন এবং মারামারি আটকানোর চেষ্টা করে সে সাদাফের হাত ধরল। সাদাফ পূর্ণ শক্তি দিয়ে কর্মচারী ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। সে উল্টোমুখে ছিটকে এসে পরল সেহরিশের সামনে। পাথরের মূর্তির মতন বসে থাকা সেহরিশকে ভালো করে দেখতে লাগল ছেলেটা। দেখে মনে হলো অনূভুতিহীন একজন মূর্তি। নিস্তেজ শরীর, শুধু শ্বাস প্রশ্বাস চলছে। কোনে কিছুর খেয়াল নেই তার।
হোটেলের ম্যানেজার পুলিশে কল করেন। দশ মিনিট অন্তরে পুলিশ আসলেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পাঁচজনকে থানায় নিয়ে আসলেন। কর্মচারী ছেলেটা বার বার ক্রোধিত দৃষ্টিতে সাদাফকে দেখছে, তার জন্যই সে এমন বিপদে পড়ল। সাদাফ প্রথম আঘাত করেছে, এবং কারেম নিজেকে বাঁচাতে পরে সাদাফকে মারে৷ এজন্য কারেমের জিজ্ঞাসাবাদ ও এফআইআর এর পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সাদাফের জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলো, সেহরিশ কে কয়েক বার প্রশ্ন করেও তার কোনো উত্তর পাননি অফিসার। সাদাফ অশ্রুসিক্ত চোখে সেহরিশের দিকে তাকাল। সেহরিশের মনের অবস্থা চিন্তা করে তার চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে গেল। অফিসার এবার কর্মচারীর উদ্দেশ্য বললেন, ‘বাঙালি? নাম কী?’
ইতস্তত ও জড়তা কাটিয়ে সে বলল, ‘তূর্ণ স্যার! মাহাবুব তূর্ণ।’
তূর্ণ মাথা নিচু করে দাঁড়ানো। সে কোনোভাবে জেলে যেতে চায় না। অফিস সাদাফের ছয়মাসের জেল হবে জানালেন। সাদাফ মাথা নিচু করে ফেলল।
এওআই কোম্পানির সিইও ‘হার্ড এন’ পুলিশ স্টেশনে আছেন দীর্ঘক্ষণ। তিনি পাশের টেবিলে বসা। পুলিশ ও সাদাফের সব কথা শুনতে পান। সন্ধ্যায় ওনার ছেলেকে পুলিশ এরেস্ট করেছেন। ছেলের জামিনের জন্য বসে অপেক্ষা করছেন। সেসময় থেকে সেহরিশ, সাদাফ ও তূর্ণকে লক্ষ্য করছেন তিনি। ওনার কোম্পানির জন্য নতুন কিছু গায়ক প্রয়োজন। সেহরিশের গাম্ভীর্য ওনাকে আকর্ষণ করলেন। রহস্যময় হাসি হাসলেন তিনি। বহুদিনের উদ্দেশ্য এবার পূরণ করবেন। যে কোম্পানিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আগের গায়কগুলো চলে গেছেন সেই কোম্পানিকে সাফল্যের চুড়ায় নিয়ে যাবেন হার্ড এন। এবং তার সিঁড়ি হবে সেহরিশ, সাদাফ ও তূর্ণ। লোকটার চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে এক ঘন্টার ভেতর তিনজনের বিল করে ছাড়িয়ে নিলেন।
রাত বারোটা বাজে। হার্ড এন ওনার পছন্দের একটা রেস্তোরাঁয় আসলেন। সবার জন্য কিছু খাবার অর্ডার করেন। অনেক রাত হয়েছে প্রায় সবাই ক্ষুধার্ত। সাদাফ হাত বাড়িয়ে সেহরিশের হাতখানা মুঠোয় নিয়ে রাখল। সেহরিশ চোখের পলক ফেলল। হার্ড এন সবাইকে খাবার খেতে বললেন, তূর্ণ খেতে শুরু করে। সাদাফ এখনও সেহরিশের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে এই বুঝি সেহরিশ তার মনের ভেতর জমা সমস্ত রাগ উগড়ে ফেলবে, সব কিছু ভেঙে চিৎকার করবে। সাদাফের ধারণা মতো সেহরিশ কিছুই করল না। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার মাঝে শুধু নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে রইল।
হার্ড এন বললেন, ‘তোমাদের আমি ছাড়িয়েছি একটা কারণে, তোমাদের আমার জন্য কাজ করতে হবে।’
সাদাফ নির্বিকার চিত্তে শুধাল, ‘আমরা আপনার কি কাজে আসবো?’
‘তোমাদের আমার কোম্পানির হয়ে গান গাইতে হবে। এক, এক জমজমাট কনসার্ট উপহার দিতে হবে।’
‘কীহ? আমরা আর কনসার্ট?’ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলল তূর্ণ।
‘আমরা কেউ গায়ক নই। আমাদের পক্ষে এটা সম্ভব হবে না।’ বলল সাদাফ।
‘মায়ের পেট থেকে কেউ শিখে আসে না। জন্মের পর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু শিখে। তোমাদের দেখে আমার মনে হয়েছে তোমরাই পারবে। তোমাদের কোনো কষ্ট করতে হবে না। আজ থেকে তোমাদের সব দায়িত্ব আমার। আমি তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করব। তোমরা শুধু রাজি হও।’
সাদাফের পাশেই গম্ভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে বসে আছে সেহরিশ। ঘন ঘন ভারী নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। পাথরের নিচে চাপা পড়ে ছিল, পাথরটা সরাতেই যেন এই নিঃশ্বাস। সেহরিশ সোজা হয়ে দাঁড়াল। প্যান্টের পকেটে দু-হাত গুঁজে শক্ত ও গম্ভীর গলায় বলল, ‘আপনার শর্তে আমরা তখনই রাজি হবো যখন আপনি আমার শর্তে রাজি থাকবেন।’
হার্ড এন তার হাতখানা বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘বলো তোমার কি চাই?’
সেহরিশ আগের চেয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘সময় হলে ঠিক বলব।’
সাদাফ চমকাল,থমকাল সেহরিশের কথায়। এই সেহরিশকে সে চিনে না। সাদাফ বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘একবার চিন্তা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হত, না।’
সেহরিশ নির্বিকার চূড়ান্তে বলল, ‘আমার কথাই শেষ কথা।’ এরপর তার ভয়ংকর রক্তিম চোখজোড়া তূর্ণর উপর নিক্ষেপ করল, ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তূর্ণ। সাদাফ তূর্ণর হাতটা ধরে বিড়বিড় করে বলল, ‘ভয় পেয়ো না। ওঁ এমনই।’ বলে থামল সাদাফ। এরপর আবারও বলল, ‘তোমার আমাদের সঙ্গে থাকতে আপত্তি নেই তো? আমরা তোমাকে আমাদের ছোটো ভাইয়ের মতন আদর যত্নে রাখব।’
হার্ড এন এবার সবার নাম পরিচয় জানতে চাইলেন, সাদাফের নামটির শেষ অংশ মোজাম্মেল এই বাক্যটি হার্ড এন সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারছেন না। বার বার ভুল বলছেন। হার্ড এন প্রশস্ত স্বরে বললেন, ‘সাদাফ তোমার সার্নেইম চেঞ্জ করতে হবে। এই ধরো..’ এই চিন্তা ভাবনা করে বললেন, ‘এটা ইংলিশ নাম কাসানো, তোমার এখনকার নাম হবে সাদাফ কাসানো।’
হার্ড এন -এর পরিকল্পনা মতন সব চলতে লাগল। ছয়মাস অনবরত ট্রেনিং ও প্রাকটিস চলল, সেহরিশ অবসর সময়ে এসেও প্রাকটিস করা শুরু করে। বাহিরের কোনো কিছু তাকে আর টানে না। সে সম্পূর্ণ রূপে গান ও ড্যান্সের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিল। এবং ২০০৫ সালের শেষের দিকে এওআই মিউজিক বয়ব্যান্ডের প্রথম গান মুক্তি পায়। তিনটি অপরিচিত মুখ সে সময় বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। এরপর এক এক করে তিনটা গান রিলিজ করে। অবশেষে চার নম্বর গানের সময় মানুষের তাদের প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা দেখতে পায়। ২০০৭ এ চতুর্থ কনসার্ট মাতিয়ে তুললো তিনজন যুবক। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। এই সাফল্যের পিছনে হার্ড এন চেয়ে অধিক পরিশ্রম, কষ্ট করেছে সেহরিশ। তার প্রতিটা গাইডলাইন ফলো করতে বাধ্য হয়েছে এওআই মিউজিক কোম্পানি।
_______________
সাদাফ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। তূর্ণ এক গ্লাস পানি সাদাফের দিকে এগিয়ে দিল। পানি পান করে নিরব বসে রইল সাদাফ। পুরোনো স্মৃতিগুলো দগদগে হয়ে জেগে উঠল যেন। তূর্ণ বলল, ‘আরবিয়ানা আগে থেকেই সেহরিশকে ধোঁকা দিচ্ছিল। সেহরিশ বিশ্বাস করে কিন্তু সেই বিশ্বাস ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয় আরবিয়ানা। সেদিনের পর আরবিয়ানার সঙ্গে সব রকম সম্পর্ক ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এবং আমাদেরও নিষেধ করে, আমরা কখনও যেন ওর সামনে ওই নাম না তুলি। সেহরিশ এমনটা দেখানোর চেষ্টা করে, সে অতীতের সব ভুলে গিয়েছে, কিন্তু এটা সত্য নয়! কোথাও আজও সে আরবিয়ানাকে মনে করে। এজন্যই প্রায় সময় কনসার্ট শেষ করেই সে আমাদের না বলে একা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। আমাদের তখন ভীষণ চিন্তা হয় ওর জন্য। সাদাফের বিয়ের দিন সে এজন্যই গায়েব হয়ে যায়। ও নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে যখন হেরে যায় তখন সবকিছু ছেড়ে নির্জন কোথাও চলে যায়।’
সাদাফ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘সেহরিশ একটা গাছ। আমি আর তূর্ণ সে গাছের পাখি। যখন ইচ্ছে হয় তখন ওই গাছে গিয়ে বসি তারপর উড়ি এবং সবশেষে ওইগাছেই বাসা বাঁধি। তেরো বছর হলো ওঁকে চিনি। বারো বছর হলো ওর পরিবর্তন নিজের চোখে দেখলাম, এই বারো বছরে তাকে একটি বারও হাসতে দেখিনি।’
কথায় কথায় তূর্ণ বলল, ‘এই বিষয় নিয়ে তোমরা কেউ সেহরিশের সামনে কখনও কথা বোলো না। ওঁ রাগলে কিন্তু খুব ভয়ংকর।’
রোদেলা মাথা নিচু করে রাখল। একটা মানুষকে না জেনে তার প্রতি ভুল ধারণা করা ঠিক নয়। নিজের ভুলটুকু বুঝতে পেরে লজ্জিত অনুভব করছে সে। যে লোক আকাশসম ভালোবেসে এত বাজে ভাবে ঠকেছে। তার পক্ষে দ্বিতীয় বার কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন বা অসম্ভব।
রাত আরও গভীর হওয়ার আগে বাড়ি ফিরতে হবে রোদেলা ও জুবিয়ার। দুজন মেয়ে মানুষকে একা ছাড়তে পারবে না সাদাফ। এজন্য ওদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য তূর্ণকে বলা হলো, হঠাৎ তূর্ণ বলল ওর ভালো লাগছে না। সাদাফ তার ম্যানেজারকে বলল ওদের ঠিকঠাক মতো বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। রোদেলা যাওয়ার আগেও বারবার করে সাদাফ ও তূর্ণর কাছে ক্ষমা চাইল।
ঘুটঘুটে অন্ধকার, জুবিয়া আগে আগে হেঁটে চলে গেছে। পা টিপে টিপে হাঁটতে লাগল রোদেলা। গাড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। সাদাফের বাড়ির উত্তর দিকে একটা ল্যাম্পপোস্ট, তার নিচে একটা গাড়ি দাঁড়ানো। গাড়ির ভাম্পারের উপর বসে আছে সেহরিশ। হাঁটুর উপর এক হাত রাখা এবং সে হাতে আগুনের মতন কিছু জ্বলজ্বল করছে। শূন্য আকাশের দিকে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল সেহরিশ। হঠাৎ বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠল রোদেলার।
চলবে….