আশিয়ানা #পর্ব_৪৮ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
48

#আশিয়ানা
#পর্ব_৪৮
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
____________
আকাশে মেঘ জমেছে ঘন কালো গভীর মেঘ। চারদিকে গুমোট অন্ধকার, বাতাস নেই কোথাও একচিলতে। জুবিয়া রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটতে শুরু করল। আশেপাশে কোথাও ফাঁকা রিকশা দেখতে না পেয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল সে। জুবিয়ার মনে পড়ল ওর তিন বন্ধু একসাথে চলাচল করার কথা। টলমলে চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল জুবিয়া। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে রাকিব সে দূর থেকে জুবিয়াকে লক্ষ্য করছে। একসময় হেঁটে হেঁটে জুবিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর একহাত তুলে রাখল জুবিয়ার কাঁধে। জুবিয়ার চোখ ভর্তি জল, ওঁ মাথা তুলে পাশে থাকা মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করল। আবছা অস্পষ্ট দেখল সে। রাকিব দু-হাত নিয়ে রাখল জুবিয়ার গালের উপর চাপা গলায় শুধাল,

‘ জুবি কাঁদছ কেন? কি হয়েছে তোমার?’

জুবিয়া নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। যত কান্না বুকের ভেতর চাপা দিয়ে রেখেছিল সহসা সব যেন উগরে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। শব্দহীন হয়ে গেল জুবিয়া। চোখ বেয়ে টুপটুপ করে ফোঁটা কয়েক অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। ছোটো বেলার তিন বান্ধবী সময়ের অভাবে আজ তিন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। উমাইয়া সে সংসার সামলাচ্ছে, রোদেলা গ্রামে এবং এত মানুষের কোলাহলে সে একা নিঃস্বর মতন দাঁড়ানো। এমন একদিন আসবে যখন রোদেলা তারও বিয়ে হবে। তখন? সে আরও একা হয়ে পরবে। এসব চিন্তাগুলোর জন্য মনে হচ্ছে মাথার ভেতর টসটস করে কিছু ছিঁড়ে যাচ্ছে। জুবিয়াকে এমন অবস্থায় রাকিব কখনো দেখেনি। ভালোবাসার অধিকার দেখিয়ে হঠাৎ আলিঙ্গন করে বলল,

‘ জুবি শান্ত হও। শান্ত হও তুমি। এই তো আমি আছি তোমার পাশে। আমাদের ভালোবাসার দোহাই তুমি শান্ত হও।’

জুবিয়া নিজেকে শান্ত করতে পারল না৷ সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তার কান্না অন্ধকারকে আরও জমাট করে। রাতের শান্ত রাস্তায় আছড়ে পড়ে চিৎকার করতে চাচ্ছে জুবিয়া তারপর হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেল।

তূর্ণ গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগেই এখানে আসছে জুবিয়াকে রিসিভ করার জন্য। হঠাৎ রাকিবের আগমনে ক্রোধে মাথা নিচু করে ফেলল তূর্ণ। ইচ্ছে করছিল এখুনি গিয়ে অচেনা ছেলেটার নাক ফাটিয়ে দেই। তূর্ণ মাথা তুলে তাকাল, জুবিয়া এখনও ছেলেটার বাহুতে মাথা লুকিয়ে রাখল। তূর্ণ চোখ জোড়া পিটপিট করে গাড়িতে উঠে বসে গেল। শক্ত গলায় বলল,

‘ ড্রাইভার! ড্রাইভ করুন।’

ড্রাইভার লুকিং গ্লাসে একবার তূর্ণকে দেখল।

‘ স্যার! যার জন্য আসছি সে কী আজ আসবেন না?’

তূর্ণ ধমকের স্বরে বলল,

‘ আপনাকে যা বললাম তাই করুন।’

জুবিয়ার শ্রবণেন্দ্রিয় প্রবেশ করল রাকিবের কণ্ঠ। সে চোখ দুটো খুললো এরপর হঠাৎ রাকিবকে নিজের থেকে ছিটকে দূরে ফেলল। দুই পা পিছনে চলে গেল রাকিব। আচমকা জুবিয়া এমন আচরণ করবে সে ধারণা করতে পারেনি। জুবিয়া রাগান্বিত স্বরে ধমক দিল,

‘ আমাকে টাচ করার তোমার সাহস কী করে হয়? এর আগেও সাবধান করেছি আমার আশেপাশে ঘোরাঘুরি না করার জন্য। এরপরও যদি এমন করো তোমাকে আমি সত্যি সত্যি পুলিশে ধরিয়ে দিবো। মনে রেখো তোমার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’ বলে জুবিয়া এলোমেলো দৃষ্টিতে পথের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা খালি রিকশা দেখতে পেল জুবিয়া। তারাহুরো করে রিকশাওয়ালাকে ডেকে রিকশায় উঠে বসল সে।

এখন মধ্যরাত! তখন চাঁদ উঠেছে আকাশ জুড়ে তূর্ণ চারতলা বাড়ির সিঁড়িতে এসে দাঁড়াল খোলা আকাশের নিচে। এরপর আকাশের দিকে তাকাল, আকাশজুড়ে বিরাজ করছে জোৎস্নামাখা চাঁদ। একফালি চাঁদ ওর চোখেমুখে আঁছড়ে পড়ল তূর্ণর মায়াময় চেহারাটা একসময় শান্ত দেখাল। বুকের বাঁ পাশে দুমড়ানো ব্যথা অনুভব করলো। সহসা গুড় গুড় করে মেঘ ডাকতে লাগল। ঝড়বৃষ্টি আসবে না কী দেখার জন্য আবারও আকাশের দিকে চাইল তূর্ণ। চোখের কার্নিশ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে নিচে পরল। বেশ খানিক পর তূর্ণ ছাঁদ থেকে নিচে নামল। টলমলে পায়ে হেঁটে রুমে এলো তূর্ণ এরপর বিছানার উপর বসে তার ফোনটা বের করে। তারপর কল তার ম্যানেজার কে এবং সে কল রিসিভ করার পরপর তূর্ণ তটস্থ কণ্ঠে বলল,

‘ ইমার্জেন্সি ইতালির টিকিট বুকিং করুন। যতদ্রুত সম্ভব আমি এই দেশ মধ্যে দেশ ছাড়তে চাই।’ বলে থামল তূর্ণ এরপর আবারও বলল, ‘ লেট যেন না হয়।’
.
.
সাদাফ গম্ভীর হয়ে সোফায় বসে আছে তার পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তূর্ণ। সাদাফ কঠিন চোখে তাকিয়ে শুধাল,

‘ আজ দুটোয় তোর ফ্লাইট এবং তুই এখন রেডি হয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য বের হচ্ছিস। অথচ এত ইম্পর্ট্যান্ট কথাটি আমাকে জানানসি। তাছাড়া সেহরিশ জানে?’

তূর্ণ প্রশ্ন শুনে তাকাল। উদাস, মলিন মুখ, আগের হাস্যোজ্জ্বল ভাবটা আর নেই। তূর্ণর জবাব এলো কিয়ৎক্ষণ পর সে বলল,

‘ কেউ জানে না। আমার এখানে থাকার ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি যেতে চাই।’

কণ্ঠস্বর আরও গম্ভীর করে সাদাফ বলল,

‘ কিছু হয়েছে? আমাদের থেকে তুই কিছু লুকচ্ছিস না তো?’

তূর্ণ ম্লানমুখে বলল,

‘ কিছু হয়নি। আমার একাকীত্ব প্রয়োজন। তোদের এখানকার কাজ শেষ হলে চলে আসিস।’

তূর্ণ সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়াল, পিছু পিছু এসেছে সাদাফ ও উমাইয়া। তূর্ণর হাবভাব উমাইয়ার কাছে স্বাভাবিক লাগেনি। তার চোখ দুটো ভয়ংকর লাল হয়ে আছে। উমাইয়া বার কয়েক জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে? প্রত্যুত্তরে জোরপূর্বক হাসি উপহার দিল তূর্ণ। এরপর সাদাফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। তূর্ণর সেফটি জন্য ওর গাড়ির সামনে দুটো গাড়ি ও পেছনে দুটো গাড়িতে বডিগার্ড রয়েছে।

তূর্ণ চলে যাওয়ার পরপর রুমে আসলো উমাইয়া। বিছানার উপর বসে জুবিয়াকে কল দিল সে। সকাল সকাল আয়ানের কল পেয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভার্সিটিতে আসতে হলো জুবিয়া কে। সে ক্যাম্পাসে বসে আয়ানের উপেক্ষা করছে। এই সময় উমাইয়ার কল পেয়ে দ্রুত রিসিভ করে জুবিয়া। পেটের ভেতর অনেক দিনের কথা জমে গেছে। জুবিয়া এক এক করে সব বলা শুরু করল। এবং কথার পিঠে হাসতে লাগল সে। ইতস্তত ও জড়তা কাটিয়ে গতকাল রাতের কথাও উমাইয়ার কাছে খুলে বলল জুবিয়া। এতদিন পর রাকিব কোথা থেকে আসলো আর তাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে এই বিষয়টা মনে পরলে এখনো রাগে শরীর রী রী করছে তার। উমাইয়ার কপোলদ্বয়ে চিন্তার ছাপ পড়ল। গতকাল রাতে সাদাফের সঙ্গে তূর্ণর কথা হচ্ছিল, তখন উমাইয়া তার পাশে বসে ছিল। সাদাফ রাতের ডিনার করার জন্য তূর্ণকে ওদের বাড়িতে আসার জন্য বলে, তখন তূর্ণ বলে সে জুবিয়ার রেস্তোরাঁয় যাচ্ছে। উমাইয়া গম্ভীর মুখে জুবিয়ার সব কথা শুনলো এরপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

‘ তূর্ণ তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল গতকাল রাতে। তোর কী ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?’

জুবিয়া ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল,

‘ না। আমার সঙ্গে তো দেখা হয়নি।’

উমাইয়া বলল,

‘ তূর্ণ তোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল পাগলী। আর ওঁ তোকে রাকিবের সঙ্গে দেখে ফেলছে। এজন্যই তূর্ণ আজই ইতালি চলে যাচ্ছে।’

জুবিয়া মেঘস্বরে শুধাল,

‘ তুই শিওর?’

‘ হ্যাঁ। তূর্ণ এয়ারপোর্টের জন্য মাত্রই বেরিয়ে গেছে। ওর চোখ কেমন রক্তিমবর্ণ হয়ে ছিল। মনে হয় পুরো রাত ঘুমোয়নি।’

জুবিয়া আচমকা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। উমাইয়ার সঙ্গে কথা শেষ করে কল কাটল। ক্যাম্পাস ঘুরে আয়ানকে খুঁজে বের করল সে। এরপর আয়ানের গাড়িতে উঠে বসল দুজন। আয়ান চিন্তান্বিত গলায় বলল,

‘ তুই এমন করছিস কেন? কি হয়েছে?’

জুবিয়া বলল,

‘ এখন কিছু জিজ্ঞেস করিস না, আমাকে শুধু এয়ারপোর্টে নিয়ে চল।’

রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। মোটামুটি ফাঁকা আছে। এয়ারপোর্টে আসার জন্য এক ঘন্টা সময় লাগল। জুবিয়া গাড়ির দরজা খুলে বের হলো এরপর দৌঁড়ে ভেতরের দিকে যেতে নিল। গাড়ি পার্ক করে, আয়ান ওর পিছু পিছু ছুটে গেল। ইমিগ্রেশন এর থেকে একটু দূরে এসে থামল জুবিয়া। ইমিগ্রেশনের আশেপাশে লোকজনের তুমুল ভিড় দেখল সে। জুবিয়া হাঁসপাঁস করে ছুটে এলো। মানুষজন ঠেলে সামনের দিকে তাকাল। কালো রঙের পোশাক পরিহিত কয়েকজন লোকের মাঝখানে তূর্ণকে দেখতে পেল জুবিয়া। ভক্তরা যেন তূর্ণর কাছে যেতে না পারে সেজন্য পুলিশ পাহারায় রয়েছেন। সকলের কণ্ঠের মাঝখানে জুবিয়ার কণ্ঠটি মিলিয়ে যাচ্ছে। চোখের কোণে জল জমাট হলো জুবিয়ার। তূর্ণ ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেল। জুবিয়া হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল এরপর চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে বলল,

‘ তূর্ণ!’

তূর্ণ হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। কিছু একটা ভেবে আবারও পিছনে তাকাল এরপর ভিড়ের মধ্যে একনজর দেখল, আয়ান দু-হাত উপরে তুলে লাফাচ্ছে। আয়ানকে দেখে সেদিকে প্রগাঢ়, দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকালো তূর্ণ। সহসা আয়ানের পাশে দাঁড়ানো জুবিয়াকে দেখে থমথমে মুখে তাকাল তূর্ণ। জুবিয়া চোখ খুলে দেখল, তূর্ণ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। জুবিয়া একজন পুলিশকে উপেক্ষা করে ইমিগ্রেশনের দিকে দৌঁড়ে যেতে লাগল। এক পায়ের সঙ্গে আরেক পা লেগে জুবিয়া আচমকা মাটিতে পরে গেল। সহসা তূর্ণ ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে ছুটে আসলো। জুবিয়ার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসল তূর্ণ। জুবিয়া আচমকা তূর্ণকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। জুবিয়া নিথর হয়ে বসে রইল। তূর্ণ জুবিয়াকে জড়িয়ে ধরে নিরব ভঙ্গিতে বসে আছে। জুবিয়া তূর্ণর কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ ভালোবাসি।’

চলবে….
[নোটঃ আজকের পর্বটা আপনাদের কাছে এলোমেলো লাগতে পারে। এইটুকু লিখতে অনেকটা সময় লাগছে। ভুলক্রটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমি সময় করে গুছিয়ে নিবো। পর্ব ছোটো হওয়ার জন্য কেউ কিছু বলবেন না সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন এবং আগামী পর্ব বড় করে দিবো। ইন শা আল্লাহ!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here