আশিয়ানা #পর্ব_৫০ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
55

#আশিয়ানা
#পর্ব_৫০
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
____________
(দ্বিতীয় খণ্ড)

কাঁচা কাঁচা রোদ মাখা সকাল, সমস্ত আকাশ শুভ্র মেঘের স্রোতে ঝরে পড়েছে পৃথিবীর বুকে, রাস্তার দু’ধারে সবুজ গাছপালায় আঁকাবাঁকা, শুভ্র দিনে গাছ ঘেঁষে উড়ছে পাখপাখালি। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চারপাশ। আনন্দিত হাওয়ার তালে তালে প্রজাপতি উড়ে আসছে। লঘু গতিতে ছুট যাচ্ছে সময়ের স্তুপ, নদীর বুকে নিবিড় জলতরঙ্গের শ্বেত; মাঠের মধ্যখানে কতগুলো গরু একমনে ঘাস ছিঁড়ছে। গাছের তলায় ঝরে আছে জীবন্ত ফুলের বিলাস। চতুর্দিক কী শান্ত! গাছের ডালপালার ফাঁক ফোকড় দিয়ে এক ফালি সোনালী রোদ্দুর এসে রোদেলার মুখমণ্ডলে আছড়ে পরছে। ঝিকঝিক আলোর পরশ লাগল রোদেলার চোখেমুখে, বাতাসের হিল্লোলে কপাল দিকের কিছু চুল অগোছালো ভাবে উড়তে আরম্ভ করে। গাড়ি চালাচ্ছে সেহরিশ ফাঁকে ফাঁকে একপলক দু’পলক রোদেলার ঘুমন্ত মুখটার দিকে চোখ বুলিয়ে দেখল। এক রাতে বিশ্রীভাবে মেয়েটার জীবন পাল্টে গেল। সেহরিশ গাড়ি থামাল। একটু ঝুঁকে এসে রোদেলার মুখটা গভীরভাবে লক্ষ্য করছে। গালের ওপর পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট ফুটে আছে। সেহরিশের রাগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেল। রাগ ও ক্ষোভে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, যে-সকল মানুষ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে তাদের সকলকে একটা ঘরে বন্দি করে তারপর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে তার। ভোর বেলা সেহরিশের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে রোদেলা। গাড়িতে উঠে বসার পর থেকেই নিজেকে গুটিয়ে রাখে। সিটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে বসে কখন ঘুমিয়ে গেছে টের পায়নি সেহরিশ। জানালার গ্লাস নামানো দমকা হাওয়ায় ধুলোবালি উড়ে আসছে। রোদেলা জানালার দিকে ঝুঁকে গিয়ে মাথা গলিয়ে রাখল। অসাবধানতার জন্য এক্সিডেন্ট হতে পারে। সেহরিশ ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। রোদেলাকে সিটে সোজাসুজি বসানোর জন্য নিজ হাতটা বাড়িয়ে দিল। সহসা রোদেলার অনুমতি ছাড়া তাকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করল না সেহরিশের। পরোক্ষণেই ইতস্ততবোধ করে হাতখানা নামিয়ে ফেলল।

সেহরিশ উঁচু গলায় রোদেলাকে ডেকে বলল,

‘ রোদ? রোদেলা।’

রোদেলার শ্রবণেন্দ্রিয়ে সেহরিশের কণ্ঠস্বর পৌঁছাল সে হম্বিতম্বি করে নড়েচড়ে উঠে বসল। হাতের উল্টোপিঠে ধীরে ধীরে চোখ কচলাতে শুরু করে রোদেলা সেহরিশের মুখপানে তাকাল। মূহুর্তেই ঘুম ছুটে গেল তার কম্পিত গলায় শুধাল,

‘ আমায় ডেকেছেন?’

সেহরিশ বলল,

‘ হ্যাঁ। এক্সিডেন্ট হতে পারে জানালার ওপর থেকে মাথা সরাও।’

রোদেলা মুখে কিছু বলল না। যথাসম্ভব ভয়ভীতি লুকিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিল। চারপাশে পিনপতন নীরবতা শোভমান। সেহরিশ গম্ভীরচিত্তে বসে থাকল। রাস্তা ফাঁকা। গাজীপুর আসতে তিনঘণ্টার বেশি সময় লাগল না। বাড়ির গেইটের কাছাকাছি এসে গাড়ি থামাল সেহরিশ। এরপর গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির সদরদরজার দিকে এগিয়ে গেল তারপর কলিংবেল চাপল।। রোদেলা ধীরগতিতে গাড়ি থেকে নামল এরপর সেহরিশের পিছু পিছু সদরদরজার কাছে এসে দাঁড়াল।

সকাল সাতটা বাজে। তূর্ণ ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। আচমকা কলিংবেলের আওয়াজ শুনতে পায়। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে ফোনে সময় দেখল। সেসময় সেহরিশের কল আসলো। মাথার চুলগুলো এলোমেলো ভাবে কপালে ছড়িয়ে আছে তূর্ণর। সে কোনোরকম বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। তারপর সিঁড়ি ভেঙে প্রথম তলায় আসে। সদরদরজা খোলা মাত্র সেহরিশের মুখখানা দেখে তূর্ণ ঠোঁটে একগাল হাসি লেপ্টে নিয়ে বলল,

‘ ওয়েলকাম ব্যাক।’

সেহরিশের পাশে রোদেলাকে দেখামাত্র তূর্ণর কপাল দিকের চামড়ায় কিঞ্চিৎ ভাজ পড়ল। ঠোঁট থেকে হাসিটুকু নিমিষেই হারিয়ে যায়। তূর্ণ বিরসমুখে সেহরিশকে জিজ্ঞেস করল,

‘ রোদেলা আর তুই একসঙ্গে কিভাবে পসিবল?’

সেহরিশ শক্ত কণ্ঠে বলল,

‘ ভাবী বল।’

তূর্ণ বিস্ময়াভিভূত চমকে উঠল। ডান ভ্রু উঁচু করে সেহরিশকে দেখল। রোদেলা কিংকর্তব্যবিমুঢ় দাঁড়িয়ে আছে। তূর্ণ ম্লানকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ ভাবী?’

সেহরিশ ওর শরীর থেকে জ্যাকেট খুলে ড্রয়িংরুমের সোফার ওপর রাখে এরপর টি-শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে নিল। রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে রাতের ঘটনা বৃত্তান্ত বর্ণিত করল সেহরিশ। রোদেলা হেঁটে এসে তূর্ণর পাশাপাশি দাঁড়াল। তূর্ণ বোকাবোকা চোখে রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে। সেহরিশ রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এসে রোদেলার মুখোমুখি দাঁড়ায়। এরপর পূর্বের চেয়ে আরও শক্ত কণ্ঠে বলল,

‘ আইসব্যাগ নাও।’

রোদেলা মাথা নিচু করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশ কী বলল? সে যেন শুনতে পায়নি। সেহরিশ চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে দুর্বোধ্য দৃষ্টি ফেলল রোদেলার ওপর। চোয়ালদ্বয় শক্ত করে ধমক দিয়ে বলল,

‘ নাও বলছি।’

তূর্ণ এখনো বিশ্বাস করতে পারল না যেন। সে ড্রয়িংরুমে পায়চারি করতে লাগল। আর একটু পরপর ঘুরে সেহরিশকে দেখছে। সেহরিশ সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছে, রোদেলা তাকে অনুসরণ করছে মাত্র। চার দেয়ালের একটা রুমে এসে থামল। সেহরিশ তার গম্ভীর স্বভাব বজায় রেখে বলল,

‘ আমি যতদিন বাংলাদেশে আছি তুমি এই ঘরে থাকবে। আমার সাথে তোমার নাম যুক্ত হওয়ায় তোমাকে অবশ্যই আমার সাথে ইতালি যেতে হবে। আজ থেকে তুমি আমার।’

সেহরিশ শার্টের দু’টো বোতাম খুলতে খুলতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রোদেলা আগে একবার সেহরিশের বাড়িতে এসেছিল। এই রুমটার সঙ্গে সে পরিচিত। জোজোকে এই রুম থেকেই নিয়ে যায় সে। তখন সেভাবে খেয়াল করে দেখেনি কিছুই। রোদেলা বিছানার উপর বসে। রুমের ছোটো বড় জিনিসগুলো চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগল। রুমের প্রতিটা জিনিস সাদা রঙের- শুধু পর্দার রঙ কালো।

বেলা অনেক হয়েছে। সেহরিশ রান্নাঘরে এসে রোদেলা ও তার জন্য নিজ হাতে নাস্তা বানালো। রোদেলার খাবার একটা ট্রে করে তার রুমে নিয়ে যেতে লাগল সেহরিশ। অনুমতি ছাড়াই সেহরিশ রুমে ঢুকলো সহসা তাকে দেখে রোদেলা দাঁড়িয়ে গেল। আঁড়চোখে রোদেলাকে আপাদমস্তকে একপলক দেখে হাতের ট্রে ছোট্ট টেবিলের ওপর রেখে সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ প্রথমবার রুমে খাবার নিয়ে এলাম। এরপর নিজের খাবার নিজেকেই তৈরি করতে হবে। এটা আমার বাড়ি তাই তোমাকে আমার মতো করে চলতে হবে। বসতে বললে বসবে আর দাঁড়াতে বললে দাঁড়াবে। ক্লিয়ার?’

রোদেলা নিশ্চুপ। মুখে কোনো রাঁ নেই। সেহরিশের কথা শুনে ডানে মাথা নাড়াল শুধু। সেহরিশ ফাস্টএইড বক্স থেকে দুটো ট্যাবলেট খাবারের ট্রের পাশে রেখে তটস্থ গলায় বলল,

‘ খাবারের পর ওষুধ খাবে। ব্যথা কমবে।’

রোদেলা নিরব ভঙ্গিতে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। সেহরিশকে সামনে রেখে খেতে সংকোচ হচ্ছে তার। রোদেলা শুঁকনো গলায় বলল,

‘ আপনি খাবেন না?’

সেহরিশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ আমার স্নান প্রয়োজন। খাবার পরে খাবো।’

সেহরিশ একটা তোয়ালে নিয়ে তাত্ক্ষণিক বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। হাত বাড়িয়ে শাওয়ার অন করে তার নিচে দাঁড়ায়। টপটপ করে ঝিরিঝিরি পানি পরছে। সেহরিশ ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বুক হালকা করল। বুক ধুকধুক করছে ডান হাতখানা হৃদপিণ্ডের ওপর রাখে। সেহরিশ একহাতে কপালের চুলগুলো সরিয়ে পেছন দিকে ফেলল। এরপর ভেজা শরীরে বাথরুমের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

সেহরিশ রোষপরবশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ কেন আমি রোদেলার সাথে এমন আচরণ করছি যে সে কেবল একটি বস্তু?’ কথাটি বলে আয়নার নিজ প্রতিবিম্বর থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। ভেজা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে সেহরিশ অকপটে বলল, ‘ রোদেলার সামনে আমার কি হলো জানি না? অদ্ভুত এক উন্মাদনা আসে শরীরের ভেতরে। আমি একটা কথা বলতে যাই আর মুখ খুলতেই আরেকটা বলি। রোদেলা! রোদেলা! আমি নিশ্চিত যে সে মনে করে আমি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার প্রতি খারাপ আচরণ করি।’

সেহরিশ স্নান সেরে রুমে এলো। রোদেলা নেই। ফর্মাল পোশাক পরে, ভ্রু কুঁচকে রোদেলাকে খুঁজতে খুঁজতে নিচে নেমে আসলো সেহরিশা দেখল রোদেলা নিচ তলার একটা রুমে বসে খাবার খাচ্ছে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রোদেলার খাবার খাওয়া দেখে কুটিল হাসলো সেহরিশ। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করে তূর্ণ। এরপর শুঁকনো গলা ভিজিয়ে নিতে নিতে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল। শীঘ্রই তূর্ণ লক্ষ্য করে সেহরিশ দরজার আড়ালে লুকিয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সেহরিশের ঠোঁটের হাসি দেখে তূর্ণা অবাক, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুখটা সামান্য হাঁ করা। মুখ থেকে পানি আস্তে আস্তে বেরিয়ে চিবুক ভিজে যাচ্ছে। সেহরিশ তূর্ণর দিকে তাকাল। হতভম্ব সে সোজা হয়ে দাঁড়াল এরপর ঠোঁট কামড়ে ধরে খাবার টেবিলের দিকে হাঁটা দিল। তূর্ণ বোতল হাতে হেঁটে এলো সেহরিশের পিছু পিছু। সেহরিশ তার জন্য নাস্তা বানিয়ে টেবিলে রেখে যায়। এখন না দেখতে পেয়ে তূর্ণর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল,

‘ আমার ব্রেড কই?’

তূর্ণ থমকাল; জিভ কামড়ে বলল,

‘ তোর জন্য ব্রেকফাস্ট ছিল? তোকে রুমে খাবার নিয়ে যেতে দেখে ভাবলাম তুই রুমে খাবি। আর আমার জন্য খাবার টেবিলে রেখে গেছিস। তাই আমি খেয়ে ফেলছি।’

সেহরিশ একহাত চেয়ারের ওপর রাখে এবং তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তূর্ণর ওপর। তূর্ণ শুঁকনো ঢোক গিললো আমতা আমতা করে বলল,

‘ ইউটিউব দেখে রান্না শিখেছি। দুই মিনিট দাঁড়া, আমি তাড়াতাড়ি নাস্তা করে দিচ্ছি।’

তূর্ণ রান্নাঘরে এলো। সে কি করবে বুঝতে পারছে না? একটু পর একটা প্যান নিল। চুলোয় প্যান বসানোর পর অল্প অল্প করে তেল ও সব মসলা দিয়ে এক মগ পানি ঢেলে দিল সহসা প্যানে আগুন ধরে যায়। প্রথমবার রান্না করতে এসে প্যানে আগুন ধরিয়ে ফেলছে। দরজার কাছে এসে তূর্ণ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর মাথা গলিয়ে দেখল সেহরিশ খাবার টেবিলে বসে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছে। তূর্ণ নাস্তা বানানোর জন্য ফিরে এলো এরপর ব্রেড, সসেজ, ডিম, মটরশুটি, টমেটো, মাশরুম এবং শেষে কফি দিয়ে একটি সাধারণ ইংরেজি ব্রেকফাস্ট তৈরি করে। সেহরিশ অবাক চোখে তাকাল তূর্ণর দিকে। তূর্ণকে দেখে তার মুখ গর্বে জ্বলজ্বল করছে। সেহরিশ ঠোঁটে হাসি নিয়ে খেতে লাগল।সামান্য খাবার মুখে নিতে সেহরিশের মুখখানা বিকৃত হয়ে উঠল। ঠোঁট জোড়া উল্টে চোখের বিস্ফরিত ও বিমূঢ় অবস্হায় একদ়ৃষ্টে চেয়ে থাকল তূর্ণর দিকে। সেহরিশ খাবারের প্লেট তূর্ণর দিকে একটু ঠেলে এগিয়ে দিল। তারপর বলল,

‘ খেতে ভালো হয়েছে। তুইও টেস্ট কর।’

মানুষ প্রশংসা শুনতে পছন্দ করে। তূর্ণ প্রথম খাবার বানালো আর সেহরিশের কাছ থেকে প্রশংসা শুনলো। আবেগে আপ্লুত হয়ে চেয়ারে বসল সে। মুখে অল্প খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করলে চোখ ও মুখ বিকৃত হয়ে গেল তার। তূর্ণ মুখ থেকে খাবার ফেলে দিতে দ্বিধা করল না। সেহরিশ চমকে উঠে জোরে হেসে উঠল। হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে সেহরিশ বলল,

‘ সাকসেস!’

তূর্ণ বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

‘ ছিহ!’

চলবে..…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here