আশিয়ানা শারমিন আক্তার বর্ষা (৫৪)

0
54

#আশিয়ানা
শারমিন আক্তার বর্ষা
(৫৪)
সেহরিশ বিয়ে করেছে এই খবরটা শফিকুল চৌধুরীর কান পর্যন্ত এসে পৌঁছিয়েছে একটু দেরি করে। তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে বারান্দায় বসে আছেন। সকালের চা দিতে আসলো ফারিয়া বেগম। শফিকুল চৌধুরীর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তিত। স্বামীর দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলেন ফারিয়া বেগম। শফিকুল চৌধুরী বিরক্ত বোধ করলেন। ফারিয়া চলে যাচ্ছিল, শফিকুল চৌধুরী বললেন, ‘তোমার বিয়ে ছেলে করেছে, একবার বলার দরকার মনে করেনি? নতুন বউ নিয়ে শহরে চলে গেছে। লোকজন কি সব বলাবলি করছে। আমাদের এখানে একবার আসলে কী ক্ষতি হত?’

ফারিয়া তার স্বামীর দিকে তাকায়নি। যাওয়ার সময় তিনি বললেন, ‘ ওঁর ব্যাপার ওঁকেই বুঝতে দাও। সে আগেই আমাদের কিছু বলেনি। এখন কি বলবে?’

শফিকুল চৌধুরীর স্ত্রীর বলা কথাগুলো এখন তিতা তিতা লাগছে। তিনি সেহরিশের সাথে কথা বলেন না। এজন্য সরাসরি ফোন করে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছেন না। তার মেয়ের বিয়েতে রোদেলা নামের মেয়েকে উনি দেখেছেন কিছুক্ষণ। সে খুব সুন্দরী ও বিনম্র ছিল। যেহেতু বিয়ে হয়ে গেছে পুত্রবধূ হিসেবে অপছন্দ নয়। বাড়ির বউকে, বাড়িতে নিয়ে আসা খুবই জরুরি বলে মনে করছেন তিনি।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৫টা বাজে। জনমানবহীন সুনশান চর্যাচর। আশেপাশে কেউ নেই। স্বাচ্ছন্দ্যে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা গাছের নিচে থামে তূর্ণ জুবিয়াকে ইশারায় বলল, ‘আমার কাছে এসো।’
জুবিয়া তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
হঠাৎ তূর্ণর নাকে বেলীফুলের পরিচিত গন্ধ অনুভূত হল, বেলীফুলের ঘ্রাণ খুব তীব্র। একটু খোঁজাখুঁজির পর একটা গাছ পেল। গাছটা ফুলে ভরা। তূর্ণ জুবিয়ার হাতটা হাতের মুঠোয় ধরে বলল, ‘আমি প্রায় একটা স্বপ্ন দেখি। তুমি কি শুনবে?’

তূর্ণর প্রশ্ন শুনে জুবিয়া কৌতূহলভরে তাকাল। তূর্ণ ডান হাত দিয়ে মাথার টুপি খুলে সবুজ ঘাসের ওপর রাখল, তারপর সাদা মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি মাঝে মাঝে এই স্বপ্নটা দেখি, আমরা বিয়ে করেছি এবং বিয়ের অনেক বছর পর আমাদের কোন সন্তান হয়নি। তারপর হঠাৎ একদিন তুমি আমার কাছে এসে বললে আমরা বাবা-মা হবো। সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন আমি আমাদের সন্তানের পৃথিবীতে আসার অপেক্ষায় থাকি। তারপর একদিন সকালে আমাদের একটি মিষ্টি চেহারার বাচ্চা হয়েছিল। আমি অনেকক্ষণ ধরে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখি।’
জুবিয়া বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়ে না ছেলে?’

তূর্ণ এবার একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘এটা বলতে পারব না। কারণ আমার স্বপ্ন সেখানেই শেষ।’ বলে থামল তূর্ণ। একটু পর আবারও বলল, ‘আমাদের চলে যাওয়ার সময় জুবিয়া এগিয়ে আসছে। বিয়ের দুদিন পর আমাদের চলে যেতে হবে। তোমাকে বলা হয়েছিল আমার একটা কনসার্ট আছে। অন্যরা না গেলেও আমাকে যেতেই হবে।’ তূর্ণ ভারী নিঃশ্বাস ফেলে জুবিয়ার চোখের দিকে তাকাল। তারপর জুবিয়ার মাথায় একহাত রেখে বলল, ‘চিন্তা করো না। আমার কনসার্টের পর আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো?’

জুবিয়া বলল, ‘ভালো লাগছে না, মাথা ঘুরছে, চলুন বাসায় চলে যাই।’
তূর্ণ হাসি চাপলো। ঠাট্টা করে বলল, ‘আমার সামনে আসলেই তোমার মাথা ঘুরায় কেন?’
জুবিয়া তাকাল। তূর্ণ বলল, ‘কাল যখন আমরা তোমাকে দেখতে যাই তখন তুমি আমাদের সামনে এসে এতটাই চমকে গিয়েছিলে যে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলে।’
জুবিয়া কাপড় গুটিয়ে ঘাসের উপর বসল। নদীর বুকে ঢিল ছুঁড়ে বলল, ‘মোটেই না। আমি ওটা নাটক করে ছিলাম।’

আচমকা অবাক হয়ে তাকাল তূর্ণ। জুবিয়া বলল,
‘আমি জানতাম না আপনি আমাকে দেখতে আসবেন। আমি যেহেতু বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না, সবার সামনে একটু নাটক করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছিলাম। তাই আমি অজ্ঞান হওয়ার ভান করে মেঝেতে পড়ে যাই। যখন সবার কণ্ঠ আমার কানে পৌঁছায় তখন বুঝলাম আমাকে উত্যক্ত করার জন্য এগুলো আপনার বা উমাইয়ার পরিকল্পনা। কিন্তু তখন আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলার অভিনয়ে ছিলাম তাই আমি উঠতে পারিনি এবং নাটকটি চালিয়ে যেতে হয়েছিল। আপনি উত্তেজিত হয়ে যখন বারবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন তখন আমার হাসি পাচ্ছিল, কষ্ট করে হাসি আটকে রাখতে হয়। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আর কাল তো রোদেলা ওখানে ছিল না, ওঁ থাকলে ঠিক বুঝতে পারত আমি অভিনয় করছি।’

পথের দুই’ধারে চকচকে সবুজ পাতার আড়ালে উঁকি দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট হলুদ ফুল। গড়ন অনেকটা সূর্যমুখী ফুলের মতো। পথের এই জায়গাটা যেন ভৃঙ্গরাজের হলুদ আভা। জুবিয়া তার স্মার্ট ফোনে কয়েকটি ছবি তুলে নিল। এরপর একটা ফুল ছিড়ে কানে গুঁজলো দেখে তূর্ণ মুচকি হাসলো। এরপর তূর্ণ জুবিয়ার খোলা চুলে কয়েকটি ফুল ছিঁড়ে গেঁথে কোমল স্বরে বলল, ‘কিছু কথা মন বলে না, চোখ বলে দেয়,
পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য দেখার অধিকার
শুধু এই দু-চোখ রাখে।
কিছু সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ হয় না,
কিছু সৌন্দর্যের রং হয় না,
তুমি সুন্দর, তুমি চঞ্চল,
তুমি হৃদ, তুমি হৃদস্পর্শী।’

.
চার দিন পর। জুবিয়া গ্রাম থেকে শহরের জন্য রওনা দিবে। ওঁর সাথে যাবেন মাসুদ মিয়া। বহুদিন পর ভাগ্নীকে দেখবেন।
ভেবে পাচ্ছেন না তার মুখোমুখি কিভাবে দাঁড়াবে? সেহরিশের বাসার গেটে দাঁড়িয়ে আছে রোদেলার মামা মাসুদ। আশেপাশে বেশ কয়েকজন কালো পোশাক পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে। মাসুদ আসলেই রোদেলার মামা কিনা তা যাচাই না করে তারা তাকে ঢুকতে দেবে না। কথা বলতে না পেরে সেহরিশকে ফোন করে জুবিয়া। কিছুক্ষণ পর ভেতরে প্রবেশের অনুমতি মিলল। জুবিয়া ঘরে ঢুকে সোজা ড্রয়িং রুমের সোফায় চলে গেল। মাসুদ তার পাশে বসল। খুব কৌতূহল নিয়ে বাড়িটা দেখছে মাসুদ। জানালা থেকে একটু দূরে ড্রয়িং রুমটা এখানে বসে আকাশ দেখা যায়, আলো, বাতাস, রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ, মনে হয় পুরো শহরটাই হাতের মুঠোয়। মাসুদ বলেন, ‘ রোদেলা কই, আসছে না কেন? তুই বলেছিলি তো যে আমরা আসব?’
জুবিয়া বলল,
‘হ্যাঁ চাচা।’

লাল টুকটুক শাড়ি পরেছে রোদেলা। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে আসছে সে। মাসুদ অবাক হয়ে তাকায়। তার মনে হলো এই রোদেলা সেই রোদেলা নয় যাকে সে ছোটবেলা থেকে বড় করেছে। এই রোদেলা এক রাজবাড়ির রানী। রোদেলা দৌঁড়ে এলো। মামার হাত ধরে কাঁদতে লাগল। মাসুদ অনেক কথা বলেছেন এবং ওই রাতে ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।
রোদেলা কান্না থামিয়ে বলল,
‘ তুমি ক্ষমা চাইছ কেন মামা? তোমার তো দোষ নেই।’

মাসুদ খানিকটা সময় নিয়ে বলল, ‘ সব আমারই দোষ। তোর বয়স ছিল ৭ বছর, তোর মায়ের অসুস্থতার কারণে তোর বাবা আমার বোনকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর শুনলাম সে আবার বিয়ে করেছে। তখন আমার মা বলেন, তার মেয়ে যতই অসুস্থ হোক মেয়েকে রাস্তায় থাকতে দেবেন না। বছর চলে গেল আর মা মারা গেল। তার কিছুদিন পর আপার স্বাস্থ্যের অবনতি হয় আর আপা মারা যাবার আগে তোর সব দায়িত্ব আমাকে দিয়ে দেয়। আপা বলে ভাই, আমার শেষ আশ্রয় আমার মেয়ে তাকে দেখে রাখিস। আর ভাবিস তোর বড় আপা বেঁচে আছে তোর ভাগ্নির মাঝে। তারপর সংসার দেখভাল করার জন্য বিয়ে করি। আমি তখন প্রায় লক্ষ্য করি পুতুল তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। আমি তাকে সতর্ক করলে সে আরও খারাপ আচরণ করত। এভাবেই তুই বড় হয়েছ, তবুও তোর প্রতি তার অবিচার কমেনি। পরের লোকের কথায় তোকে কলঙ্কিত করে বিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ রে মা, চৌধুরী সাহেবের ছেলে তোকে কোনো কষ্ট দিয়েছে? তারা খুব ভালো। কিন্তু তাদের ছোট ছেলে কেমন আমরা জানি না। যদি সে তোর সাথে অন্যায় করে, আমাকে বলিস আমি সাহেবের সঙ্গে কথা বলব।”

মাসুদের চোখ ভিজে গেছে। রোদেলা বলল, ‘মামা, আমাকে দেখলে তো কি মনে হচ্ছে আমি কষ্টে আছি?’
‘ না মা, আল্লাহ তোকে রানী বানিয়েছেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি তুই ভালো আছিস, আমি এখন নিশ্চিন্ত থাকতে পারব। আর শোন, তোর জন্য আমার ঘরের দরজা চিরকাল খোলা থাকবে। এই অসহায় মামার কথা মনে পড়লে আমায় দেখতে আসবি।’

মাসুদ চলে যেতে চাইল। রোদেলা তাকে যেতে দেয়নি। মেয়ের জামাই বাড়িতে আসছে, একদিন থেকে তারপর যেতে দিবে। রোদেলা বলল, ‘উনি বাসায় নেই, ওনার সাথে দেখা না করে চলে যাবা কিভাবে? আজ তোমাকে থাকতেই হবে।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here