আশিয়ানা #পর্ব_৩৬ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
211

#আশিয়ানা
#পর্ব_৩৬
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
সেহরিশ রুমের একপাশে নিস্তেজ হয়ে বসে রইল। হঠাৎ একটা কান্না সেহরিশের গলা থেকে ছিটকে বেরুতে চাইলো।আর সঙ্গে সঙ্গে সেহরিশ জলন্ত ম্যাচলাইটের উপর হাত রাখল। এভাবে পেরিয়ে গেল বেশ কিছু সময় অস্বস্তি টুকু আগুনে উগরে দিতে স্বস্তি পেল সেহরিশ। অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে আছে। শরীরটা অবশ লাগছে হাতে ভর দিয়ে উঠতে নিয়ে দেখল, শরীরের অবশিষ্ট শক্তিটুকু খুইয়ে। সহজ হতে চেষ্টা করল সেহরিশ। হঠাৎ তার মনে হতে লাগল পিছন মানে অতীত আর সে কখনও পিছনে ফিরে তাকাবে না। সেহরিশ বিড়বিড় করে বলল, ‘ কখনও না।’

সেহরিশ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। এরপর হেঁটে বারান্দায় এসে খোলা আকাশের দিকে তাকাল সহসা রোদেলার মুখ ভেসে উঠল। সেই সঙ্গে সেহরিশ উঠানের দিকে তাকাল, মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সেহরিশ পরিস্কার গলায় প্রশ্ন করল, ‘ কে ওখানে? রোদেলা?’

সেহরিশ চোখ বন্ধ করে ঠোঁট মুচড়ে দাঁড়াল। উঠানে কেউ নাই। একটা রশি তার উপর একটা কাপড় ঝুলানো। বাতাসে কিঞ্চিৎ নড়ছে। সেহরিশ একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর হাতখানা মাথায় চেপে ধরে বলল, ‘ হঠাৎ রোদেলা মনে হলো কেন? রোদেলা-ই কেন? আর তার নামটাই বা আমার মনে আছে কিভাবে?’

কি হচ্ছে বুঝতে পারছিল না সেহরিশ। ঠিক করল রুমে ফিরে যাবে। গায়ে চাদর টেনে চুপটি করে শুয়ে থাকলে হুট করে ঘুম চলে আসবে। সহসা বাড়ির দক্ষিণ দিকে নজর পরতে চমকে উঠল সেহরিশ, বেশ কিছু আলো মাটি থেকে একটু উপরে উড়তে দেখল সে। প্রগাঢ়, দুর্বোধ্য দৃষ্টি ফেলল সেহরিশ, পরোক্ষণে বুঝতে পারলো এটা একটা পোকা। রাতের আঁধারে এদের শরীরের একটা অংশে হলদে-সোনালী আলো জ্বলে। জোনাকিপোকা। এক পশরা নিটোল চাঁদ মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো, জ্যোৎস্নার শোভা ছড়িয়ে আকাশে জ্বলজ্বল করছে। এক দুটো জোনাকি উড়ে আসে সেহরিশের বারান্দায়।

সেহরিশ ওদের উড়তে দেখে বলল, ‘ আমার বুকের ভেতর বড্ড জ্বালা করে। আমার বেরঙ জীবনে তুমি কে রোদের দ্যুতি?’
.
.
বিয়ে এবং বৌ-ভাত দুটো দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে পেরিয়ে গেল। আজ উমাইয়ার বাবা সাদাফ ও উমাইয়াকে তাদের বাড়ি নিয়ে যাবেন ফিরানির নিয়ম কানুন পালন করার জন্য। বিয়ের দ্বিতীয় দিন বৌ-ভাত এর অনুষ্ঠানের পর নবদম্পতি কে দু’দিনের জন্য শ্বশুর বাড়ি যেতে হয়। এবং সেখানে গিয়ে নতুন বর প্রথম বার বাজার করে এবং দ্বিতীয় দিন বউ রেখে চলে আসে। সাদাফ কিছুক্ষণ পরই চলে যাবে এবং কিছুক্ষণ পর আরুশি ও অনিক চৌধুরী বাড়ি আসবে। দুদিন পুূর্ণ একবারও সেহরিশ কে কেউ দেখেনি। হলুদের রাতে শেষ বার দেখা যায় এরপর আর কেউ তাকে পায়নি। সেহরিশ তূর্ণর ফোনে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, সে বিয়েতে থাকবে না। কারণ অস্বস্তি।

তূর্ণ মেসেজটি পড়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এমন খুশির সময় সেহরিশের মন খারাপ জেনেও কিছু করতে পারল না তূর্ণ। এই একটা জায়গায় বাঁধা সে। সেহরিশকে আর মেসেজ দিয়ে বিরক্ত করল না তূর্ণ। অস্বস্তি টুকু কমে গেলে যেখানে গিয়েছে সেখান থেকে ফিরে আসবে। সাদাফকে জানানোর পর দীর্ঘ সময় বিছানায় বসে রইল সাদাফ। অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ সেহরিশ কে লাস্ট কখন দেখেছিস?’

‘ আমি দেখিনি।’

এরপর আজ দু’দিন কোনো খবর নেই। বাড়ির প্রায় সবাই জিজ্ঞেস করেছিল সেহরিশের কথা। হঠাৎ কোথায় গিয়েছে? জানতে চেয়েছিল অনেকেই। সাদাফ তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, ‘ ইমার্জেন্সি প্রয়োজনের জন্য শহরে গিয়েছে।’

ফারিয়া ছেলের হঠাৎ না বলে চলে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়লেন। এরপর বেশ কয়েকবার কল করেন। রাতের দিকে সেহরিশের একটা ভয়েস মেসেজ আসে, ‘ আমি ফিরব মা। এখন নয় কিছুদিন পর। তুমি সকল নিয়ম মেনে ওদের বিয়ে সম্পূর্ণ করো।’

নতুন জামাই দেখার জন্য বাড়ি ডিঙিয়ে এসেছেন প্রতিবেশীরা। সাদাফ কে দেখে অনেকেই খুশি হয়েছেন এবং অনেকে কানাকানি শুরু করে বলেন, ‘ এই মাইয়ার লগে রাজপুত্রের মতন ছেলে কপাল গুনে বর পাইছে।’
তাদের মধ্যে কয়েকজন নারী হিংসে জ্বলে পুড়ে উঠলেন। এরপর ফিরে গেলেন নিজেদের বসতবাড়িতে। উজ্জ্বল মিয়া তার পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সাদাফের পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন। রাত পোহালো এবং ভোর সকালে মুরগ ডাকের সঙ্গে ঘুম ভাঙলো সকলের। সকালের নাস্তার জন্য গ্রামের বৈশিষ্ট্য ভরা খাবার ও পিঠাপুলি সাদাফের সামনে দেওয়া হলো এবং একটু পরই সাদাফকে কুলদ্বারা নিয়ে বাজারে যেতে হবে। বাজার করার জন্য।

সাদাফ ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ সেহরিশের কোনো আপডেট?’

‘ না। ফোন টাও বন্ধ।’

সাদাফ বাজার থেকে যা যা কিনে নিয়ে এসেছে। সে-সব আজ রান্না করা হবে। সাদাফ আর তূর্ণ সড়কের পাশে আমগাছটার নিচে মাচায় বসে আছে। ঠাণ্ডা হাওয়া এসে শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। একপলকে ধান ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে দেখল বাতাসে কি সুন্দর করে পাঁকা গানগুলো ঢেউ খেলছে। সব জায়গায় ধান কাঁটা হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেতে এখনো ধান আছে। তবে কেটে ফেলার প্রস্তুতি চলছে। তূর্ণ একটা মাঠ দেখতে পেল, ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা সেখানে খেলা করছে। কিছুটা দূরে একটা ফুলের গাছ। গাছের তলায় বিছিয়ে রয়েছে ঝরাফুল। সাদাফ হুট করে বলে উঠল, ‘ তূর্ণ ওদিকে দেখ।’

তূর্ণ তাকিয়ে দেখল, আট বা নয় বছরের দু’জন ছেলে ধান ক্ষেতের মাঝখানে সরু পথ দিয়ে দৌঁড় যাচ্ছে। তূর্ণ মুচকি হাসল। সাদাফ বলল, ‘ ওরা পরে যাবে তো।’

তূর্ণ বলল, ‘ পরবে না। ওঁরা গাঁয়ের ছেলে। এসব নিত্যদিনের ঘটনা।’

উজ্জ্বল মিয়া কিছু ফলমূল মেয়ের সামনে দিয়ে বললেন, ‘ এগুলো কাট মা। তারপর সাদাফ বাবা আর তূর্ণ বাবা রে দিয়ে আয়। ওরা মাচায় বইসা আছে। মুখে কিছু দিক।’

উমাইয়া মাথা নেড়ে ফলগুলো ধুয়ে কাটতে লাগল। গোল করে বসে আছে রোদেলা ও জুবিয়া। উমাইয়া একবার জুবিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ আয়ান কল করেছিল?’

‘ না। আমি কল দিয়েছি সেটাও ধরেনি।’

‘ আমাকে কথা দিয়েও আয়ান কথা রাখেনি। বলেছিল ওঁ আমার বিয়েতে আসবে। কিন্তু এখন ফোনও তুলছে না।’

রোদেলা বলল,

‘ হয়ত কোনো সমস্যা হয়েছে। তাই আসতে পারেনি।’

উমাইয়া বলল,

‘ আল্লাহ না করুক। সব যেন ভালো হয়।’

রোদেলা বলল,

‘ আমি এখন বাসায় যাই। মামা বলছে তারাতাড়ি যাওয়ার জন্য। মামির শরীর টাও তেমন ভালো না।’

‘ দুপুরে খেয়ে যাবি না?’

উমাইয়া ফল কেটে ছোটো ছোটো পিরিচে রেখে একটা ট্রের উপর সাজিয়ে রাখল। জুবিয়া দুটো টুকরো নিয়ে মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, সহসা চোখ পড়ল তূর্ণর দিকে। উজ্জ্বল মিয়ার টিনের ঘরটার পাশে একটা কদমফুল গাছ। গাছ থেকে কিছুটা দূরে এক বাগান বিলাস গাছ। গাঢ় গোলাপি রঙের ফুল হয়। গাছ থেকে ফুল ছিঁড়তে দেখল তূর্ণকে।

জুবিয়া খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে এগোল। তূর্ণর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আচমকা বলে উঠল, ‘ চুরি করছেন?’

তূর্ণ ঘুরে তাকাল। জুবিয়াকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

‘ তোমার জন্যই নিচ্ছিলাম।’ বলে আর দেরি করল না তূর্ণ। দু পা এগিয়ে এলো জুবিয়ার দিকে তারপর নিজ হাতে জুবিয়ার চুলের খোঁপায় ফুলের ডালটা গেঁথে দিল। ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘ মৃগাক্ষী।’

জুবিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ কি?’

তূর্ণ হাল্কা হেসে বলল,

‘ ফুলের ফোপাঁতে ফুল সুস্নিগ্ধ লাগছে।’
.
.
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। নতুন বর ও তার বন্ধু দুপুরে তেমন কোনো খাবারই মুখে দিতে পারেনি। এই নিয়ে নানা জনের হাজার কথা। মা এসে সাদাফকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ রান্না বুজি ভালো হয়নি বাবা? তাই দুপুরে খাইতে পারো নাই।’

সাদাফ হাসিমুখে বলল, ‘ রান্না ভালো হয়েছে মা। আপনি অযথা চিন্তা করবেন না। আপনাদের ভালোবাসা পেয়ে বুঝলাম মা বাবার ভালোবাসা কেমন হয়। আর খাবার বিষয়টি। আমরা খেতে পারিনি সেহরিশের জন্য। ওর জন্য মন কেমন কেমন করছিল।’

‘ এখন কিছু আইনা দেই বাবা? অল্প খাও।’

‘ না, না। এখন আর খাব না।’

‘ তোমাদের এই জায়গায় থাকতে কষ্ট হয়। আমরা বুঝি, গরীব মানুষ বাবা। একটু মানাই নেও।’

উমাইয়া বাহির থেকে ঘরে ঢুকল। এরইমধ্যে টেবিলের উপর ফোনটা বেজে উঠল। উমাইয়া এগিয়ে গেল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল আয়ান কল দিচ্ছে। একবার কেটে দিতে চেয়েও রিসিভ করল।

ওপাশ থেকে প্রথমেই আয়ান অগুনিত বার স্যরি বলল। এতে অবশ্য উমাইয়ার রাগ কিছুটা হলেও কমেছে। উমাইয়া জিজ্ঞেস করল, ‘ আমার বিয়েতে আসিস নি কেন?’

আয়ান বলল,

‘ আমার আম্মু অসুস্থ। চারদিন ধরে হসপিটালে ছুটাছুটি করছি। ফোন কোথায় ছিল নিজেও জানি না। তোর বিয়েতে না আসার রিজন। আ’ম সো স্যরি। প্লিজ রাগ করে থাকিস না।’

উমাইয়ার মন নরম হলো। জিজ্ঞেস করল,

‘ আন্টি এখন কেমন আছেন?’

‘ আলহামদুলিল্লাহ এখন ভালো আছে। শোন তোকে যে জন্য কল করেছি।’

‘ কিছু বলবি?’

‘ হ্যাঁ। দুদিন পর এক্সাম। সম্ভব হলে আজই গাজীপুর চলে আয়। শুনছস কি বলছি?’

উমাইয়া চমকে গেল।

‘ দুদিন পর? আমাদের আগে বলিস নি কেন?’

‘ আমি একমাস ভার্সিটির সামনেও যাইনি। আজ সকালে তুহিন কল করে বলছে। তারপর গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজড হইছি। এখন বল কবে আসবি?’

‘ আগে ওদের জানাতে হবে। তারপর দেখি চেষ্টা করব আগামীকাল সকালেই বের হওয়ার।’ কল কাটলো উমাইয়া। তপ্ত শ্বাস ফেলে ঘরের বাহিরে এলো তারপর সাদাফ ও বাবার সঙ্গে পরীক্ষার বিষয়ে আলোচনা করল। আগামীকাল সকালে গাজীপুর রওনা দিবে জানালো সাদাফ।
.
.
সময় তার মতো করে কেটে যাচ্ছে। এক একটা দিন ভীষণ ভারী লাগছে। চোখের পলকে দুদিন পার হয়ে গেল। সেহরিশের ফোন এখনও বন্ধ। তূর্ণ ড্রয়িংরুমে পায়চারি করছে। সেহরিশ মাঝেমধ্যে না বলে চলে যায়৷ তবে এত বেপরোয়া কখনো হয়নি। সাদাফ বলল, ‘ পুলিশের সঙ্গে কথা বলব? সিরাজগঞ্জে ওঁর উপর একবার অ্যাটাক হয়েছিল। যদি তেমন কিছু হয়?’

তূর্ণ সোফায় বসল। চিন্তায় পা কাঁপছে। তূর্ণ এলোমেলো কণ্ঠে বলল, ‘ অতীত কে মনে রাখার কী দরকার? ভুলে গেলেই হয়। কেন করে এমন? কোথায় আছে? কি করছে? কিছু খেয়েছে না-কি না। চারদিন ধরে নিখোঁজ।’

সাদাফ লক্ষ্য করল, তূর্ণর চোখে পানি। তূর্ণর দূর্বলতা সেহরিশ। ভীষণ কষ্টতেও তূর্ণ কখনো কান্না করে না। শুধু তখনই ওঁর চোখে জল দেখা যায়, যখন সেহরিশ না বলে চলে যায়।

কলিংবেল বাজার শব্দ হলো। সাদাফ উঠার জন্য উদ্যত হলো। তূর্ণ বলল,

‘ তুই বোস। আমি দেখছি।’

ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল তূর্ণ। বাঁ হাতের তর্জনী আঙুলে কার্নিশ ভেজা অশ্রুজল টুকু মুছে নিয়ে দরজা খুললো তূর্ণ। এক পলকের জন্য তূর্ণ ভেতরটা কেঁপে উঠল অগোছালো চুল, ও সেই পুরোনো টি-শার্ট পরনে দাঁড়িয়ে আছে সেহরিশ। ঠোঁটে লেপ্টে আছে এক অমায়িক হাসি। সেহরিশ তার ডান হাতখানা শূন্যে তুলে পাঁচ আঙুল মেলে বলল,

‘ হাই।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here