আশিয়ানা #পর্ব_৪০ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা _____________

0
55

#আশিয়ানা
#পর্ব_৪০
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
ইদানিং প্রায় দিন সন্ধ্যার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। পুরো দিন আকাশ মেঘমুক্ত থাকলেও সন্ধ্যার পর কালো মেঘে আকাশ বুঁদ হয়ে থাকে। আজও সন্ধ্যার পর দেখতে পাওয়া গেল আকাশের বাজে অবস্থা। এই বুঝি বৃষ্টি নামলো নামলো। বাহিরে ভারী হাওয়া বইছে। সেহরিশ নিশ্চুপে এসে জানালার পাশে বসল এরপর আলতো হাতে জানালা খুলে দিল। হাওয়ার ঝাপটায় জানালার পর্দাগুলো উড়তে লাগল। ঠাণ্ডা শীতেল হাওয়ায় সেহরিশের হৃদয় শীতল হয়ে উঠল। জানালার বাইরে তুমুল বর্ষণ, এমন বর্ষণের ধারা দেখতে দেখতে একটা কথাই কেবল মনে নাড়া দিয়ে ওঠল। সেহরিশ বিড়বিড় করে বলল, ‘এই একই বর্ষণের জল তোমার জানালার বাইরেও কি ঝরছে এখন রোদ?’ বুক ভারী হয়ে আসলো সেহরিশের। সে বার দুয়েক দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এরপর আস্তে করে জানালার পাশ থেকে উঠে গেল। এই বর্ষণ যেন তাকে টানছে। সেহরিশ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। উল্টো ধারায় বইছে বৃষ্টি। ছিটেফোঁটা এসে উপচে পরছে, সেহরিশের শার্ট ভিজে যাচ্ছে। তবুও রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। সেহরিশ এলোমেলো চোখে একবার আকাশের দিকে দৃষ্টি ফেলল। তারপর মাথা নিচু করে সড়কের দিকে তাকাল। আম গাছটার নিচে ল্যাম্পপোস্টটায় কিছু দিন ধরে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এই নিভু নিভু করে আবার হুট করে জ্বলে উঠে। বৃষ্টিতে সে দৃশ্যটি দেখতে ভালো লাগল সেহরিশের। আচমকা মনের কোণে আলোড়ন তৈরি হলো মনে পরল সেদিন সন্ধ্যার কথা, সেদিনও এমন বৃষ্টি হচ্ছিল। সেহরিশ এখানে দাঁড়িয়ে সাদাফের সঙ্গে কথা বলছিল। তখুনি সে দেখতে পায় একজন মেয়ে আম গাছটার নিচে দাঁড়ানো বৃষ্টির জন্য প্রায় ভিজতে বসেছে। অচেনা একজন মানুষ কে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অবশ্য তখনও জানত না, মানুষটা আসলে রোদেলা হবে। তবে যেদিন জানতে পারে সেদিন বুকের ভেতর হঠাৎ করে মোচড় দিয়ে উঠেছিল। এর যথাযথ কারণ আজও জানে না সেহরিশ। আজ কাল রোদেলার কথা প্রায় মনে পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে সেহরিশের হৃদয় শূন্যতায় ভরে যায়। সেহরিশ নিষ্পলক চোখে তাকাল ধারালো কিছু একটা কেবল মাথার ভিতরে বাজতে লাগল। সেহরিশ বলল, ‘রোদ আপনি জানেন না, আপনাকে ঘিরে আমার হৃদয় জুড়ে বিশাল শূন্যতার মেলা। সে শূন্যতা পৃথিবীর সব শূন্যতার চেয়েও শূন্য, গভীরতার চেয়েও গভীর। যতবার বৃষ্টির মাঝে ওই গাছটার দিকে তাকাই ততবার ওই শূন্যতায় আমি আরো বেশি ডুবে যাই, একা হয়ে যাই।’ বলে থামল সেহরিশ। এরপর খানিক সময় চুপ করে থেকে আবারও তেজশূন্য গলায় বলল,

‘আপনাকে তো আপন করে
পাবো না, তবু
এই না পাওয়ার বেদনা
কোথা থেকে এলো রৌদ্রময়ী?’

সেহরিশ মিনিট দশেক পর রুমে ফিরে এলো। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছে নিয়ে তারপর রুমের বুকশেলফ থেকে একটা ইংলিশ বই বের করে দেখল। টেবিলের ওপর বসে তারপর আস্তে আস্তে পাতা উল্টাতে লাগল। এতক্ষণে বৃষ্টি কমে গেছে। কিন্তু ঠাণ্ডা বাতাস বইছে এখনও। খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে এতে বইয়ের দু’একটা পাতা আপনা আপনি উল্টে গেল। ১০২ নাম্বার পৃষ্ঠায় এসে থেমে গেল সেহরিশ। লাল টকটকে গোলাপ ফুল মর্মরা হয়ে আছে। ডান হাতখানা বাড়িয়ে ফুলের ডালটা তুলে নিল। এই তো সেদিন ফুলটা নিয়ে এসেছিল দেখতে দেখতে সাতদিন হয়ে গেল। সাতদিন আগে রোদেলা কে শেষ বার দেখেছিল সেহরিশ তারপর আর দেখা হয়নি। হঠাৎ করে সেদিনের ঘটনা মনে পড়ল।

রাস্তায় প্রচুর ভিড় বাজার, মার্কেটের দবেশিরভাগ মানুষ পথে এসে দাঁড়িয়ে আছে। একজন মানুষ দাঁড়াবে সেই জায়গা টুকু নেই। এবং সাথে মিডিয়া সাংবাদিক আছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জ্যাম পরে গেছে। সেহরিশ ঠোঁট উল্টিয়ে রাগ দমন করার চেষ্টা করছে। সাদাফের কল পেয়ে সে এই জায়গায় এসেছে। একটা রেস্ট্রন্টের ঠিকানা সেন্ট করে আসার জন্য বলেছে সাদাফ। এখানে আসার পর গাড়ি থেকে পা ফেলতে পারছে না। বডিগার্ড ছাড়া কোথাও বের হওয়া দ্বায়। সেহরিশ পুলিশ কল করল। পুলিশ পারবে তাকে এখান থেকে উদ্ধার করার জন্য। পুলিশ আর বডিগার্ড একসঙ্গে আসলো। সবাই কে সাইড করে সেহরিশ কে গাড়ি থেকে নামানো হয়। সেহরিশ ওর ম্যানেজার কে দেখে বলল, ‘এখন থেকে আমার সিকিউরিটি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দাও।’

সাদাফ পুরো রেস্ট্রন্ট বুক করে নিয়েছে। মানুষজন ভরা ছিল। এক এক করে সকলে চলে গিয়ে চারপাশ ফাঁকা হয়ে গেল। কোনো কোলাহল নেই নিস্তব্ধ চারপাশ। রোদেলা বলল, ‘ শুধু শুধু পুরো রেস্ট্রন্ট বুক করার দরকার কী ছিল? আমরা তো এখুনি চলে যাব।’

সাদাফ বলল,

‘ সেহরিশ আসছে ওঁর জন্যই।’

তূর্ণ বলল,

‘ সেহরিশ কোলাহল পছন্দ করে না। এখানে এসে এত কোলাহল দেখামাত্র সাদাফের উপর রেগে যেত।’

রোদেলা হকচকিয়ে গেল। হঠাৎ বলল,

‘ আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি।’

একটু এগিয়ে গেল। ওয়েটার কে জিজ্ঞেস করল ওয়াশরুম কোথায়? সিঁড়ির ডানপাশের দিকে একটু গেলেই ওয়াশরুম। রোদেলা বেশ কয়েকবার পানি দিয়ে মুখ দিয়ে নিল। সেহরিশ আসবে শুনে শরীরের লোমহর্ষক অবস্থা হয়েছে। লোমগুলো অবিশ্বাস্য ভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ভয়ে শরীরের রক্তচঞ্চলন বন্ধ হয়ে আসতেছে। রোদেলা টিস্যু নিল, ভেঁজা মুখ ভালো করে মুছে নিয়ে তারপর বের হলো। হাত দুটো সমানে কচলাতে শুরু করল। মনে মনে দোয়া করতে লাগল কোনোভাবে সেহরিশের সামনে পরতে চায় না। সেহরিশ স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা বললেও রোদেলার মনে হয় সে ধমকিয়ে কথা বলে। প্রতি আওয়াজে রোদেলা কেঁপে ওঠে। সেহরিশের বাড়িতে জোজো যতক্ষণ ছিল সে খুবই আদর যত্নে ছিল। একারণে সেহরিশ জোজোর খুব পছন্দের হয়ে গেছে। এটা সেদিন সেহরিশের ওদের বাসায় যাওয়ার পর রোদেলা বুঝতে পারে। জোজো বারান্দা থেকে উঠে এসে সেহরিশের পায়ের কাছে বসেছিল। রোদেলা তড়িঘড়ি করে আসতে নিল হঠাৎ কারো পিঠের সঙ্গে ধাক্কা খেলো রোদেলা। পরোক্ষণেই সিঁড়ি দিয়ে পরে যেতে নিল। সেহরিশ পাশ ঘুরে রোদেলা কে দেখল তারপর চটজলদি রোদেলার হাত ধরে নিল। এরপর সোজা হয়ে দাঁড়াল রোদেলা। শরীর অসম্ভব কাঁপছে, গলা শুকিয়ে আসছে, কপালে ঘাম জড়ো হয়েছে, বুকের ধুকপুকুনি বাড়ছে। সেহরিশ স্মিত হাসলো। রোদেলার এহেন ভীরু চাহনি ভীষণ করে আকর্ষণ করে সেহরিশকে। রোদেলা ভাবলো সেহরিশ তাকে এখনি ধমকাবে। কিন্তু মূহুর্তেই রোদেলা অবাক হয়ে গেল সেহরিশ কিছু না বলে ভেতরে চলে গেল। রোদেলা চেয়ার টেনে বসল। তার থেকে একটু দূরে বসে আছে সেহরিশ। রোদেলা ওর চেয়ার থেকে একবারও উঠলো না আর এদিকওদিক তাকালও না৷ এই সুযোগ নিয়ে বহুবার বহুক্ষণ রোদেলার দিকে তাকিয়ে ছিল সেহরিশ। রোদেলার জন্য নুডলস অর্ডার দিয়েছিল সাদাফ। সামান্য খেয়ে রোদেলা সোজা হয়ে বসল। তার কিছুক্ষণ পর রোদেলা আচমকা সেহরিশের দিকে তাকাল। রোদেলা এইসময় তাকাবে যেন আগে থেকেই অনুমান করতে পারছিল সেহরিশ। সে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেলল। রোদেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বিড়বিড় করতে লাগল। একটা গ্লাস সেহরিশ ওর সামনে রাখে সে গ্লাসে রোদেলার প্রতিবিম্ব দেখে মুখ টিপে মৃদু হাসল সেহরিশ।

শুঁকনো ফুল থেকেও স্বল্প ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। ফুলটা আবার বইয়ের ভাজে রাখল সেহরিশ। তারপর বইটা বুকশেলফে রাখল। শীর্ণ পায়ে হেঁটে এলো আয়নার সামনে। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সেহরিশের নিজের প্রতি সন্দেহ হলো নিজের প্রতিবিম্ব কে শুধাল,

‘ তোমাকে ভয় কেন পায় রোদ?
কি করেছ?’

সেহরিশ বিস্মিত হলো। সে বোধহয় জানে সে কী করেছে? নির্বিকার মুখে নিজের দিকে তাকাল। অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়াল সেহরিশ। রোদেলার সঙ্গে প্রথম দেখার পর তৃতীয় দেখা হয়েছিল থানায়। পুলিশ ও সে মেয়েটাকে কম ভয় দেখায়নি। সে অবস্থায় রোদেলার তাঁকে ভয় পাওয়ার যথাযথ কারণ সে নিজেই। সেহরিশ ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে পড়ল।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here