আশিয়ানা #পর্ব_৪৩ #শারমিন_আক্তার_বর্ষা

0
214

#আশিয়ানা
#পর্ব_৪৩
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_____________
রাত সাড়ে ন’টা বাজে। অতিথিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে সেহেরিশ। শক্ত, সুঠাম দেহটা ঘামে ভিজে ছেঁতছেঁতে। কপালে এলেমেলো ভাবে পরে আছে এক গুচ্ছ চুল। বারান্দা এসেই রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেল সেহরিশ। ভারী নিঃশ্বাস ফেলে ভেতর রুমের দিকে তাকাল। সাদাফের বাড়ির নিচতলায় দক্ষিণ কোণে একটি বারান্দা আছে। প্রবেশদ্বারের পাশেই কাঠের ফ্রেমের কাচের জানালা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেতরের সব কিছু অতি অবলিলায় দেখা যায়। ভেতর থেকে একটা গানের আওয়াজ ভেসে আসে সেহরিশ আকাশের দিকে তাকাল এরপর হঠাৎ দৃষ্টি নামিয়ে আবারও জানালার উপর রাখলো সে। দেখল রোদেলা পশ্চিম দিকের এককোণে এসে মাত্রই দাঁড়াল, তার মাথার উপর ছোট্ট ছোট্ট কিছু হলুদ বাতি জ্বলছে। আকাশী রঙের শাড়ি পরিহিত রমণীর দিকে কয়েক মিনিটের জন্য দৃষ্টি আঁটকে গেল তার। বেশ কিছুক্ষণ পর একটু সরে দাঁড়াল।
তূর্ণ হুট করে এসে বলল, ‘তোকে খুঁজছে।’
সেহরিশ সহজ ভাষায় শুধাল, ‘কে?’
‘সাদাফ।’
সেহরিশ ভ্রু কুঁচকালো। গম্ভীর গলায় আবারও শুধাল,’কেনো?’
তূর্ণর হাতে একটা কলা। সে খেতে খেতে প্রত্যুত্তর করল,
‘ওঁ তোকে ডাকছে। আমাকে কী বলছে কেন ডাকে? তোকে ডাকছে, তোকেই বলবে।’
সেহরিশ পায়ে পায়ে এগোল। তূর্ণর সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ তার কান মলে দিতে দিতে লাগল, ‘পাক্কা বড়দের মতন কথা শিখে গেছিস।’
তূর্ণ আহত গলায় বলল, ‘আমার বিয়ের চিন্তা ভাবনা কিছু করছিস? এত লেট হচ্ছে কেন? কত্তো রাত হয়ে গেল আমাদের বিয়ে নিয়ে এখনও জুবিয়ার সঙ্গে একটা কথাও বলিস নি। কখন বলবি?’
সেহরিশ কান থেকে হাত সরিয়ে নিল। এরপর প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল, ‘সাদাফ কি বলে শুনি, এরপরই জুবিয়ার সঙ্গে আলাপ করবো। ওঁ যদি তোকে চায় তারপর ওর বাবা মায়ের সঙ্গে বিয়ের বিষয়ে কথা বলতে যাব।’

সেহরিশ ড্রয়িংরুমে এলো। সাদাফ দেখে উমাইয়ার সঙ্গে এগিয়ে গেল। উমাইয়া সেহরিশ কে বড়ো ভাইয়ের মতন কদর করে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। সাদাফ কিছুক্ষণ পর বলল, ‘আমি ভাবছিলাম উমাইয়া কে নিয়ে আগামীকাল একবার কিশোরগঞ্জ যাব।’
সেহরিশ বলল, ‘কবর যিয়ারত করার জন্য?’

সাদাফ মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ! বাবা মা তো নেই। দেশ থেকে চলে যাওয়ার আগে একবার নিজ শহরটা উমাইয়া কে দেখাতে চাই। শ্বশুর বাড়ি যাওয়া নিয়ে মেয়েদের অনেক শখ থাকে। সেটা অল্প হলেও ওঁর পূরণ হবে।’
তূর্ণ আচমকা সরল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘সবাই চলে যাবি, আমার বিয়ের কী হবে?’
উমাইয়া প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল। বলল, ‘তূর্ণ ভাইয়া বিয়ে পাগল হলেন কিভাবে?’

তূর্ণ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। মুখে কোনো রা নেই তার। প্যান্টের পকেটে ফোনটা বেজে উঠল। ফোন হাতে নিয়ে মুখ, শক্ত করে এককোণে চলে গেল সেহরিশ। কোম্পানি থেকে কল আসছে। কিছু সমস্যা হয়েছে, তার সমাধানের জন্য সেহরিশকে প্রয়োজন। সেহরিশ চার পাঁচ দিনের সময় নিল। আগামীকাল সপ্তাহে সে ফিরে যাবে। এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত! সেহরিশ তার ম্যানেজার কে কল করে, ওঁর চলে যাওয়ার জন্য সব কিছু প্রস্তুত রাখার জন্য বলে সে কল কাটলো। ফোনের স্কিনে চোখ রাখা সোজা পথে হাঁটতে নিয়ে আচমকা রোদেলার সামনে পরে গেল।

সেহরিশ তার রংচটা স্বভাব, সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে সেটা লক্ষ্য না করে, রাগান্বিত স্বরে ধমক দিল। রোদেলা কেঁপে ওঠে, মাথা নিচু করে বলল, ‘আ’ম স্যরি! আমি ইচ্ছে করে করিনি।’

সেহরিশ মাথা তুলে তাকাল। রোদেলা কে দেখে সে ঠোঁট চাপলো, মেয়েটা তাকে এমনি ভয় পায় সেখানে সে নিজের অজান্তে আজও ধমক দিল। সেহরিশ প্রাগঢ় দৃষ্টি ফেলল, রোদেলা থরথর করে কাঁপছে। সেহরিশ নিজের উপর রাগ চাপলো বুক চিঁড়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে সে সাদাফের দিকে এগিয়ে গেল। রোদেলা জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উমাইয়া দেখল রোদেলাকে, সে এগিয়ে এসে রোদেলার কাঁধে হাত রাখে নির্মূল স্বরে বলল, ‘কি হয়েছে তোর? মাথা ঘুরচ্ছে?’
‘আমার কিছু হয়নি।’ বলল রোদেলা।
‘এত ঘামছিস কেন?’ বলে উমাইয়া তাঁর শাড়ির আঁচল টেনে রোদেলার কপোলদ্বয় মুছে নিয়ে আবারও বলল, ‘কি হলো বল? কি হয়েছে?’

আয়ানের সঙ্গে ইশার দেখা হয় না প্রায় সাতদিন হলো। এরইমাঝে আয়ান বহুবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। সাদাফের ইনভাইটেশন পেয়ে সে এসেছে, প্রায় রাত ন’টার দিকে। সবার সাথে টুকটাক কথা বলে একজায়গায় বসে। সকাল থেকে কিছু খায়নি সে। খাবারের আইটেম গুলো দেখে তার ক্ষুধা লাগছে। একা একা খেতে লজ্জা বোধ করছে, এজন্য জুবিয়াকে তার সামনে বসিয়ে খেতে শুরু করে। অতিথিদের অনেকে চলে যেতে শুরু করেছে। হাতেগোনা দশ কিংবা বারোজন এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন।

জুবিয়া কিঞ্চিৎ বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল, ‘জলদি কর, এত আস্তে আস্তে খাচ্ছিস রাত পেরিয়ে সকাল হবে তো।’
আয়ান বলল, ‘খাবার খেতে হয় আস্তেধীরে, দ্রুত খেলে খাবারের মজা পাব না।’
জুবিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। কড়া গলায় বলল, ‘তুই থাক। আমি যাই।’

সাদাফ ফোনে কিছু বের করে এরপর সেটা সেহরিশ কে দেখালো, ভিডিওটি দেখামাত্র রাগ, ক্ষোভে সেহরিশের নাকের ডগা লাল হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলল সাদাফের দিকে, তূর্ণ পাশ থেকে বলে উঠল, ‘তোকে জানিয়ে ছিল?’
সেহরিশ কথাবার্তা বাচনভঙ্গি চেঞ্জ করে বলল, ‘না।’
সাদাফ বলল, ‘যে গাছ বড় হয়ে আগাছা হবে তাকে শুরুতেই উগড়ে ফেলতে হয়। ওদের সাহস দিনদিন বেড়ে চলেছে।’
সেহরিশ ওষ্ঠদ্বয় বাঁকা করে রহস্যময় হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল, ‘সাহসীদের দেখতেও ভাল লাগে।’

বেগুনি রঙের শাড়ি পরিহিত একজন রমণী পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেহরিশের দিকে। সে পেছনে দাঁড়িয়ে সরু চোখে দেখে বলল, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি।’

তূর্ণ কপোলদ্বয় কুঁচকে তাকাল, সাদাফ একপলক মেয়েটিকে দেখল এরপর দুর্বোধ্য দৃষ্টি ফেলল সেহরিশের দিকে। সেহরিশ ঘুরে তাকাল চোখ দুটো ছোট ছোট করে দেখল, পরোক্ষণেই সেহরিশ স্তম্ভিত হয়ে গেল। মেয়েটিকে তার চেনা ঠেকলো৷ মনে করার চেষ্টা করল, কোথায় দেখেছে?
সাদাফ বলল, ‘আপনি?’

মেয়েটি কারো সঙ্গে কথা বলল না। সে উৎসুকভাবে সেহরিশকে দেখছে, উমাইয়া দূর থেকে দেখে জুবিয়া আর রোদেলাকে নিয়ে এগিয়ে এলো সাদাফের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মেয়েটি কে?’
সাদাফ বলল, ‘আমরা চিনি না। আজ প্রথম দেখলাম।’

নীরব দাঁড়িয়ে আছে মানুষ গুলো, সবকিছু স্তব্ধ, চারপাশ নীরব হয়ে আছে। কোনো শব্দ নেই আশেপাশে, নীরবতা ভেঙে কথা বলল মেয়েটি, ‘আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কিছু বলুন।’
তূর্ণ উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, ‘আপনি কে? এখানে কিভাবে আসলেন?’ বলে থামল তূর্ণ। এরপর উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সিকিউরিটি কোথায়?’

মেয়েটির মুখখানা কালো হয়ে গেল। সে বলল, ‘আমি নীতি। কাউকে ডাকবেন না প্লিজ, আমি অনেক কষ্ট করে এখানে আসছি।’

সেহরিশের নিশ্চুপ থাকা যেন তার সহ্য হচ্ছে না, নীতির চোখ দিয়ে আলগোছে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল, বিচলিত মনটা টুকরো টুকরো হয় ভেঙে পড়ার সঙ্গে সে অনুনয় করে বলল, ‘আপনি প্লিজ কথা বলুন।’ বলে থামল নীতি এরপর এক পা এগিয়ে এলো, তার বাঁ হাতখানা সকলের সামনে উন্মুক্ত করে কণ্ঠস্বর করুণ করে বলল, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি তার প্রমাণ দেখুন আপনার নামটাও আমি আমার হাতে ট্যটু করেছি।’

নীতির অনুরোধেও তার দিকে তাকাল না সেহরিশ তার দৃষ্টি রোদেলার দিকে। পরোক্ষণে রাগে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠে সেহরিশ। এরপর কোনো কথা না বলে চলে যেতে উদ্যত হলো, আচমকা মেয়েটি তার হাত ধরে ফেলল আকুতি ভরা গলায় বলল, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’

নীতির হঠাৎ হাত ধরায় সেহরিশের রাগ বাড়লো। নীতির হাত থেকে নিজের হাতটি সরিয়ে একটা জোরে ধমক দিল। তার কঠিন স্বভাব দেখে সকলেই অবাক হলো, ভয় পেয়ে যায় রোদেলা আলগোছে উমাইয়ার পিছনে গিয়ে আড়াল হলো সে।

সেহরিশ তখন হিংস্র হয়ে বিক্ষিপ্ত স্বরে বলল, ‘আমাকে সর্বক্ষণ ফলো করেছ, আমি কিছু বলিনি। কিন্তু তোমার সাহস কি করে হলো, আমার সামনে এসে এই কথা বলার? এরপর আমার সামনে আসলে ছেড়ে কথা বলব না। সোজা পুলিশ ধরিয়ে দিবো।’

শরীর থেকে রাগ ঝারতে ঝারতে সেহরিশ হনহনিয়ে চলে গেল। নীতি আঁচলে মুখ চেপে কান্না শুরু করল রোদেলা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রোদেলা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়াল, কণ্ঠ দিয়ে যেন কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। নীতি উদ্বিগ্ন চোখে একবার সবাইকে দেখে নিল এরপর লজ্জায় চলে যেতে লাগল। সেহরিশের আচরণ দেখে ব্যথীত হলো রোদেলা, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তূর্ণর উদ্দেশ্য বলল, ‘সে এত রূঢ় কেন?’

তূর্ণ বোকা বোকা চোখে রোদেলার দিকে তাকাল আধো আধো কণ্ঠে বলল, ‘সে রূঢ় নয়; পরিস্থিতি তাকে রূঢ় বানিয়েছে। নারীদ্বয়, নারীসঙ্গী সে পছন্দ করে না। এর কারণ-ও একজন নারী!’
রোদেলা কম্পিত গলায় বলল, ‘নারী?’

দুইজনের এই কথার মাঝে বাকি অতিথি গুলো চলে যান। রোদেলা সোফার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তূর্ণ পাশে বসে বেশ কিছুক্ষণ পর আবারও বলল, ‘সেহরিশ এর মর্মান্তিক অতীত! সে আজও ভুলতে পারেনি। সে সব সময় মেয়েদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। পাশে হাজার সুন্দরী রমণী বসে থাকলেও সে ওদের দিকে তাকায় না। আমরা ওকে বুঝিয়েছি, মুভ অন করার জন্য! তারপর সে কি বলেছে, জানো?’
রোদেলা জবাব দিল না। দু’টি চোখে তাকিয়ে রইল। তূর্ণ বলল, ‘ সে বলেছিল, জীবনে মেয়েদের আসার পর খুশি কম ঝামেলা বেশি হয়।’

সাদাফ মলিন হাসল। এরপর চাপা গলায় বলল, ‘সেহরিশ ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করা পছন্দ করে না। তূর্ণ যেহেতু আজ প্রসঙ্গ তুললো সেজন্য তোমাদের বলতে ইচ্ছে করছে। বহু বছর ধরে এই যন্ত্রণা আমি আর তূর্ণ নিজেদের ভেতর পুঁষে রাখছি। তবে এই কথা আমাদের বাহিরে যায় না যেন।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here