#আশিয়ানা
শারমিন আক্তার বর্ষা
(৫৫)
দু-একবার রিং বাজার পর বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিল রোদেলা। সেহরিশ কল দিচ্ছে, রোদেলা বিছানার উপর সোজা হয়ে বসে কলটা রিসিভ করল। সহসা ফোনের ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন গলায় সে বলল,
‘ হ্যালো রোদ! শুনতে পাচ্ছো?’
‘ হ্যাঁ বলুন, শুনতে পাচ্ছি।’
‘তুমি কোথায়?’
‘ আমি বারান্দায় আছি। আপনি কোথায় আছেন সারাটা দিন। বাসায় আসলেন না কেন?’
‘ আমি বাসার নিচে আছি। তুমি চাদর মুড়ে নিচে এসো।’
‘ এখন?’
‘ ভয় পাচ্ছ? শোন রোদ, একটি সম্পর্ক বিশ্বাস, আস্থা, সাহচর্য, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা টিকিয়ে রাখে। আমি আশা করি তুমি আমার উপর কখনও বিশ্বাস হারাবে না।’
‘ কিন্তু সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে অনেক চাহিদা পূরণ করতে হয়।’
‘ আমার চাহিদা নেই।’
রোদেলা দাঁড়িয়ে কথাগুলো হজম করল। হৃৎপিণ্ড এখন ধড়ফড় করছে। ভালোবাসা ছাড়া কি সম্পর্ক হয়? হয় না। তবে কি সেহরিশ ও তাকে তার বাবার মতো ছেড়ে চলে যাবে? রোদেলা আর ভাবতে পারল না। মাথাটা চক্কর দিল যেন।
রোদেলা একটা চাদর খুঁজতে লাগলো তারপর চাদরটা গায়ে জড়িয়ে পাঁচ মিনিট পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। সদর দরজার সামনে কয়েকজন দেহরক্ষী দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলাকে দেখে তারা দশ হাত দূরে সরে মাথা নিচু করে রাখে। একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন ম্যাম? আপনার এভাবে বাইরে যাওয়া নিরাপদ নয়।’
রোদেলা শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনার স্যার রাস্তায় আছেন। তিনি আমাকে যেতে বললেন।’
দেহরক্ষী সামনে থেকে সরে গেল। তিনি বললেন, ‘স্যরি ম্যাম। আপনাকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। তাই আমি পথ আঁটকে দাঁড়িয়েছি। কিছু মনে করবেন না, আপনি আমাদের সাথে আসুন।’
সেহরিশের কথাটা রোদেলার কানে গানের মতো বাজছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রোদেলা গম্ভীর মুখে সেহরিশের দিকে তাকাল। সেহরিশ রোদেলাকে এভাবে দেখতে অভ্যস্ত নয়। তার অস্বস্তি লাগছে। রোদেলা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তারপর গাড়িতে উঠে বসল। সেহরিশ তাকে কোথাও নিয়ে এসেছে। গাড়ি থেকে নামল।
এই নিশি রাতে জ্যোৎস্না প্রস্ফুটিত হয়েছে। চারপাশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, ল্যাম্পপোস্টগুলো মিটমিট করছে। সেহরিশ ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়াল। রোদেলা বলল, ‘কী ভুতুড়ে পরিবেশ। আমরা এখানে কেন আসছি?’
রোদেলা ভয় পাচ্ছে, সেহরিশের পাশে এসে দাঁড়াল।
সেহরিশ বলল,
‘ ভয় পেয়ো না, তোমার থেকে বিশ হাত দূরে দশজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমাদের দেখছে।’
‘ ওঁরা কারা?’ জিজ্ঞেস করল রোদেলা।
সেহরিশ মৃদু স্বরে বলল,
‘ তুমি খুব ভয় পাও রোদেলা।’
রোদেলা জবাব দিল না। সে হঠাৎই গম্ভীর হয়ে ওঠে সেহরিশকে মুগ্ধ চোখে দেখছে। সেহরিশ বলল, ‘কি ভাবছ?’
সেহরিশ থামলেও রোদেলা কথা বলল না। তারা চুপচাপ হাঁটছে। রোদেলা তাকাল। তার চোখে মুখে কৌতূহল। এত রাতে দুজন যাচ্ছে কোথায়? সেহরিশ তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
‘ কিছু না।’ বলে চুপ করে রইল রোদেলা। তারপর বলল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
সেহরিশ জবাব দিল না। সে হাঁটছে। রোদেলার অস্বস্তি হতে লাগল। ফলে সেহরিশকে হঠাৎ ভয় লাগতে লাগল তার। নিজের অজান্তেই ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল সে। কিন্তু সেহরিশের মধ্যে তেমন তাড়া নেই। সেহরিশ বলল, ‘খোলা মাঠে বসে কখনো আকাশ দেখেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘ইতালিতে প্রায় আকাশ দেখতাম কিন্তু দেশে এসে সে সুযোগ হয়নি। আমার সাথে আকাশ দেখবে রোদ?’
সেহরিশের এমন অদ্ভুত সরলতায় অবাক হলো রোদেলা।
যেন মেঘমুক্ত, এক শান্ত আকাশ। ইচ্ছে করছে সে আকাশে উড়ে যেতে। এখন রোদেলার ভয় করছে না। সেহরিশ তার থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। রোদেলার হঠাৎ সেহরিশের জন্য মায়া লাগতে লাগল।
‘ আমরা হয়তো পৌঁছে গেছি।’ বলে খানিক কী ভাবল সেহরিশ। তারপর আবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ এইখানেই হওয়ার কথা বা হয়তো আমরা হারিয়ে গেছি।’
রোদেলার হাসি পাচ্ছে। তবে সে এবারও কথা বলল না। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল সেহরিশের দিকে। সেহরিশ বলল, ‘ চল, আরেকটু এগিয়ে যাই।’
‘চুক্তি ছিঁড়ে ফেললেই মুক্তি মিলে.. আমাকে ছেড়ে দিন।’
মাটির দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল রোদেলা। সেহরিশ চমকে উঠল, এবং স্তব্ধ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
‘আমার শরীর থেকে কলঙ্ক মুছে ফেলতে আপনি সেদিন আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমি সারাজীবন আপনার বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনেটুনে কোন সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। আমাকে ডিভোর্স দিন।’
সেহরিশ রেগে গেল। চোয়াল শক্ত, মুষ্টি বদ্ধ। হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করছে। সেহরিশ পলক ফেলল। আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারল না। উত্তেজিত হয়ে রোদেলার বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। রোদেলার বুকটা কেঁপে উঠল। রোদেলা বিষণ্ণ চোখে তাকাল। তার চোয়াল চেপে গেছে কিন্তু দৃষ্টি ঝাপসা।
হঠাৎ রাগ করে লাভ নেই। তাই গরম না হয়ে ঠাণ্ডা রাখা জরুরি। সেহরিশ দৃঢ় ও গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ডিভোর্সের কথা বলার সাহস কী করে হল? তুমি কি মনে কর যে আমি গ্রামের দুই জনকে ভয় পেয়ে তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি? ওই পুরো গ্রামের সব মানুষ আসলেও আমার কিছুই করতে পারবে না। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি চোখও খুলি না, তুমি কি করে ভাবলে মানুষের কথায় যে কাউকে বিয়ে করব? আমি চেয়েছিলাম বলেই তোমাকে বিয়ে করেছি। এমন কেউ জন্মায়নি যে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে জোর করার সাহস করবে। তুমি আমার রোদেলা, পৃথিবী উল্টে গেলেও তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেও পারবে না। যদি কর আমি সব শেষ করে দেব।’
রোদেলা বুঝতে পারল না সেহরিশ হঠাৎ রেগে গেল কেন। সেহরিশের আকস্মিক পরিবর্তনে সে দিশেহারা হয়ে পড়ল। রোদেলা ব্যথিত চোখ তুলে তাকাল। সেহরিশ কোথাও না তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। সেহরিশ জিভের ডগা দিয়ে শুঁকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিল।
চারদিক অন্ধকার দেখে হকচকিয়ে ওঠে রোদেলা। সুবিশাল আকাশ কিন্তু নীরব-প্রাণময়৷ এত বিশাল মাঠের মধ্যে বড়বড় গাছ সেখান থেকে সারাক্ষণ ডাক ভেসে আসছে রাতপাখির। রোদেলা এখন কি করবে বুঝতে পারল না। কয়েক মূহুর্ত পর সেহরিশ ফিরে এলো। মেরুদণ্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে সে। শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘বাড়ি চলো।’
গভীর রাত। আকাশে রূপালী চাঁদ। মাথার উপরে একটি পূর্ণিমার চাঁদ আর পাশে চাঁদের মতোই সুন্দর দেখতে রোদেলা পাশাপাশি হাঁটছে। সেহরিশ মুগ্ধ চোখে চাঁদের দিকে তাকিয়ে তারপর মাথা নিচু করে রোদেলার দিকে তাকায়। চাঁদ মনে হয় তার পাশেই হাঁটছে। জোনাকিপোকার আলো ম্লান হয়, সেহরিশ রোদেলার মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল।
ওঁর মুখে মায়াবী হাসি। সেহরিশ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রোদেলার মুখ এতই মায়া যে সেহরিশ তার চোখের সাগরে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায়। সেহরিশ সত্যিই রোদেলাকে একটু ছুঁতে চায়, ওর হাত ধরে হাঁটতে চায়। এই অনুভূতির সুখটা একটু অন্যরকম, আগে কখনো সে অনুভব করেনি। দুজনের কেউই একটা কথাও বলল না। তারা নিশ্চুপ। একটি গলিপথ পার হয়ে একটি খালের কাছাকাছি আসে, ব্যাঙ জোরে জোরে ডাকছে।
সেহরিশের হঠাৎ মনে হল আকাশ থেকে বৃষ্টির রূপে জ্যোৎস্না পড়ছে। সে থেমে গেল। তারপর একবার চারদিকে তাকাল। সে আবার হাঁটতে শুরু করে দেখল রোদেলার শাড়ির আঁচল মাটি আঁচড়াচ্ছে। সেহরিশ বাঁকা করে হাসল। সে এগিয়ে গেল। সে সাথে সাথে একটু ঝুঁকে পড়ে রোদেলার শাড়ির আঁচলটা হাতে ধরে তার পিছনে হাঁটতে থাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সেহরিশ অনুভব করল তার হৃদস্পন্দন তীব্র হল।
কিছুক্ষণ পর ওরা রাস্তায় উঠে এল। চারজন দেহরক্ষী ছুটে এগিয়ে গেল। একটা ওয়াকি-টকি মুখের সামনে ধরে ইংরেজিতে বলল, ‘স্যার আসছেন। প্রস্তুত হও।’
অন্ধকার পথ কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ করে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল সে। দুজনে তড়িঘড়ি করে গাড়ির দরজা খুলে দিল। সেহরিশ গাড়ির দরজাটা হাতে ধরে একপাশে দাঁড়াল। রোদেলাকে বলল, ‘উঠো।’
চলবে….