#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৯।
চায়ের কাপে চুমুক বসাতেই মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল অন্বিতার। এই কয়দিনের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মনটা শীতল হলো।
চায়ের বিল মিটিয়ে ফের গন্তব্যের দিকে হাঁটা ধরল দুজন। অন্বিতা জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কি আপনার ফ্রেন্ড এর সাথেই থাকেন?’
‘জি।’
অন্বিতা এক পল চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা, আপনাদের বিল্ডিং এর ই ফোর এ কে থাকেন, আপনি কি জানেন?’
অয়ন তাকাল তার দিকে। অন্বিতা অপ্রস্তুত হেসে বলল,
‘আসলে হয়েছে কী, ঐ ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে রোজ’ই কেউ একজন গান গায়; বেশ চমৎকার উনার গলা। কিন্তু ঐ মানুষটাকে আমি আজ অবধি দেখিনি। তাই আপনার কাছে জানতে চাওয়া।’
অয়ন প্রসন্ন হেসে বলল,
‘দুঃখিত। আমার সারাদিনটা বাইরেই কাটে। কোন ফ্ল্যাটে কে থাকে সেই সম্পর্কে আমি খুব একটা অবগত নই।’
‘ওহ, ইট’স ওকে।’
তারপর আবার মিনিট দুয়েক পরে অন্বিতা ফের জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি গান করতে পারেন?’
‘না, তেমন একটা না।’
‘একদিন পার্কে আপনার বন্ধুর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। সেদিন পার্কে কেউ একজন গান গাইছিলেন, আপনার বন্ধু বলেছিলেন, গানটা না-কি উনার কোনো এক বন্ধু গাইছেন। তাই ভাবলাম, আপনি না-কি।’
এই কথার উত্তরে অয়ন আর কোনো জবাব দেয়না। কারণ ততক্ষণে তারা নিজেদের বাসার কাছে চলে এসেছে। অন্বিতারও আর উত্তর জানার খেয়াল নেই। সে অয়নকে বিদায় জানিয়ে চলে এল নিজ বাসায়।
দরজা খুলে রুমের আলো জ্বালাল অয়ন। হাসপাতালে থাকার মতো কঠিন কাজ দুনিয়াতে আর একটাও নেই বোধহয়। শরীরটা কেমন যেন ম্যাচ ম্যাচ করছে। মাথাটাও ধরেছে বেশ। একটা লম্বা শাওয়ার নিতে পারলেই হয়তো ঠিক হবে সব। নিজের ঘরে এল। তার রোজকার কাজের ন্যায় রুম জুড়ে ঝুলিয়ে রাখা ছবিগুলো একবার একবার করে দেখ নিল সব। কিঞ্চিৎ হাসল। তারপর চলে গেল গোসলে।
অন্বিতা ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। আজকাল ঐ গানওয়ালা আর গান গাইছে না। কী হলো তার? অন্বিতার সেদিনের বলা কথাগুলোতে কি ছেলেটা খুব বেশি কষ্ট পেয়েছে? সেজন্য গান গাইছে না? হাতের কফির মগের কফিটা ঠান্ডা হচ্ছে। সেদিকে তার মন নেই। সে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে ঐ বারান্দার দিকে। এরই মাঝে বারান্দায় সেই ছায়ামানবের আগমন ঘটে। অন্বিতার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। ছেলেটা কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
থতমত খেল অন্বিতা। অপ্রস্তুত হলো বেশ। বলল,
‘আপনাকে দেখে অবাক হয়েছি, তাই।’
‘কেন? অবাক হওয়ার মতো কিছু কি হয়েছে?’
অন্বিতা দু মিনিট খুইয়ে জবাব দিল,
‘আপনার স্বর’টা আমার চেনা চেনা লাগছে।’
‘রোজ তো আমার গলার গান শুনেন, চেনা চেনা লাগাটাই স্বাভাবিক।’
‘না না, সেজন্য না। আমি আপনার সাথে সরাসরি কথা বলেছি।’
‘এই যে এখনও বলছেন।’
‘আহা, এভাবে না। আপনি সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি অয়ন?’
ছেলেটার মুখায়ব দেখা যাচ্ছে না বলে তার প্রতিক্রিয়াও বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে বলল,
‘কে অয়ন?’
‘কেন, আপনি।’
‘আমি কেন অয়ন হতে যাব?’
‘তবে আপনি কে?’
‘আমি ফানুস।’
‘ফানুস?’
‘হ্যাঁ, ফানুস। সুখের ফানুস। একদিন সব সুখ নিয়ে আকাশে উড়ে যাব।’
ছেলেটার কথার আগা মাথা কিছুই বোধগম্য হলো না অন্বিতার। সে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। ছেলেটা জিজ্ঞেস করল,
‘আজকাল বারান্দায় আসেন না যে? হাসপাতালে কি খুব চাপ যাচ্ছে?’
‘জি। আপনাদের বিল্ডিং এর একজনের এক্সিডেন্ট হয়েছে, শুনেছেন?’
‘জি, শুনেছি। উনাকে আপনার হাসপাতালেই রাখা হয়েছে, দারোয়ান বলল আজ।’
‘দারোয়ান কী করে জানল? উনার বন্ধু ব্যতিত তো এই কথা কেউ জানে না।’
‘সেটা আমি কী করে বলব, বলুন?’
‘কী জানি! আমার তো মনে হয়, সব আপনিই বলতে পারবেন।’
‘কফিটা শেষ করেছেন?’
এতক্ষণে কফির কথা স্মরণে আসে অন্বিতার। মগের দিকে চেয়ে বলল,
‘ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।’
‘গরম করে নিয়ে আসুন, আমি এখন গান ধরব।’
‘না থাক। ভাবছি, আপনার গান শুনে কফি খাওয়ার অভ্যাসটা বদলাতে হবে। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর তো আর আপনাকে পাব না গান শোনার জন্য।’
‘এক কাজ করতে পারেন; আপনার কোনো ননদ থাকলে তার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিন, তখন ননদ জামাই আপনাকে সারাদিন গান শুনাবে।’
অন্বিতা হাসল। বলল,
‘ননদ জামাই ননদকে গান না শুনিয়ে আমাকে কেন গান শুনাবে? ননদের সংসারে ঝামেলা লাগাব না-কি?’
‘ভাবির জন্য এইটুকু ঝামেলা পোহাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
ফের হাসল অন্বিতা। বলল,
‘থাক, এত গভীরে না ভাবলেও হবে। তবে আমার বিয়েতে আমি আপনাকে অবশ্যই দাওয়াত দিব, আপনার গান শোনার জন্য।’
‘জি, আমি অবশ্যই আসব।’
অন্বিতা আর কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে ফিরে এল। সেই অজ্ঞাত ছেলেটা আর গান ধরল না। সেও চলে গেল নিজের ঘরে। অন্বিতা বিছানায় বসল গিয়ে। দুই জন মানুষের গলা একই রকম হয়? আজ অয়নের সাথে কথা বলার সময়ও এমন মনে হচ্ছিল তার। অয়ন’ই যদি এই অজ্ঞাত ছেলেটা হয়ে থাকে, তবে তিনি মিথ্যে কেন বললেন? আর অমিত, সেও তো প্রথম থেকে মিথ্যেই বলে এসেছেন। কেন? সত্যিটা জানলে কী হবে? আর অজ্ঞাত ছেলেটাই বা কেন নিজেকে সামনে আনতে চাইছেন না? নিজেকে লুকিয়ে লাভ কী উনার?
এসব নিয়ে ভাবতে বসলে সেই ভাবনা আর শেষ হবে না। আপাতত তাই সব চিন্তা সাইডে রেখে তেলের বোতল সাথে নিয়ে মায়ের রুমে গেল সে।
পরদিন সকালে নার্সিংহোমে গিয়ে নিজের ডেস্কে বসতেই মাহিরের সহকারী এসে খবর দিল, মাহির তাকে ডাকছে। আজ মাহিরের ডাকার কারণ অন্বিতা আগে থেকেই অবগত। কাল গাড়ি করে যায়নি, সেটা নিশ্চয় মাহিরের কান অবধি চলে গিয়েছে। তাও গেল সে। অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। মাহির ফাইল দেখছে কীসের একটা। অন্বিতা বলল,
‘স্যার, ডেকেছিলেন?’
ফাইল বন্ধ করে অন্বিতার দিকে চাইল সে। গম্ভীর সুরে বলল,
‘আজ তোমার ছুটি।’
অন্বিতা অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘কেন, স্যার?’
‘এমনি। তুমি এখন বাসায় গিয়ে তৈরি হও, আজ দুপুরে আমরা বাইরে খাব।’
অন্বিতার কপালে ভাঁজ পড়ল। ভাবল, হঠাৎ বাইরে কেন খাবে। আজ কী স্পেশাল কিছু আছে। অনেক চেষ্টা করেও আজকের দিনটা বিশেষ হওয়ার কোনো কারণ সে খুঁজে পেল না। মাহির বলল,
‘কী ব্যাপার, এখনো দাঁড়িয়ে আছো যে?’
অন্বিতা ইতস্তত সুরে বলল,
‘আজকে কি কিছু আছে?’
‘কেন? তোমাকে নিয়ে কি আমি এমনিতে বাইরে খেতে পারি না? কিছু থাকা লাগবে।’
‘না, আসলে….’
‘আসলে নকলে হিসেব না কষে বাসায় যাও। আমি ঠিক দুপুর দুটোয় তোমার বাসার নিচে থাকব।’
অগত্যাই মাথা হেলিয়ে অন্বিতা বেরিয়ে এল। নার্সিংহোমের বাইরে আসতেই দেখল, অয়ন অমিতকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে এগিয়ে যায় অন্বিতা। জিজ্ঞেস করে,
‘বাসায় যাচ্ছেন?’
অমিত কিঞ্চিৎ হেসে বলল,
‘জি। আপনি কোথাও যাচ্ছিলেন?’
‘জি, আমিও বাসায় যাচ্ছিলাম।’
অমিত অবাক হয়ে বলল,
‘আজ এত তাড়াতাড়ি আপনার ডিউটি শেষ?’
‘না মানে, আসলে স্যার বলেছেন, আজকে আমার ছুটি।’
‘ওহ, তাহলে তো ভালোই হলো। আজকে একটু রেস্ট নিতে পারবেন।’
‘জি।’
অয়ন একটা রিক্সাকে ডাকল। অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘আপনি উঠে পড়ুন।’
‘না না, আপনি উনাকে নিয়ে যান আগে। আমি অন্য একটা রিক্সাতে চলে আসব।’
অমিত বলল,
‘এটা দিয়েই চলে যান। আমরা রিক্সা পেয়ে যাব।’
‘আপনার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হবে। আপনারা উঠে পড়ুন।’
‘না না, আমি এখন একদম ঠিক আছি। প্লিজ, আপনি যান। আমরা পরের রিক্সাতে আসছি।’
তাদের সাথে কথায় না পেরে রিক্সায় চড়ে বসল অন্বিতা। তাও কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল, অসুস্থ মানুষটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/