#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫।
‘স্যার, আসব?’
‘ইয়েস, প্লিজ।’
ফাইল নিয়ে ভেতরে গেল অন্বিতা। মাহিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘স্যার, কমপ্লিট।’
ফাইলটা হাতে নিল মাহির। বলল,
‘আমার কেবিনে আসা যাওয়ার জন্য তোমার অনুমতি নিতে হবে না।’
‘ঠিক আছে স্যার, সবাইকে এই নিয়মটা জানিয়ে দিব।’
মাহির তার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলে,
‘এটা শুধু তোমার জন্য, অন্যকারোর জন্য না।’
‘কেন স্যার, এস অ্যা এমপ্লয়ি সবার সব ধরণের অধিকার ভোগ করার অধিকার আছে। তাহলে শুধু আমি কেন?’
রাবির ক্ষুব্ধ হলো। বলল,
‘আজকাল বড্ড ঘাড় ত্যাড়া হয়ে যাচ্ছো তুমি।’
‘সেটা অবশ্য আপনার থেকেই শিখেছি।’
‘কী বললে?’
‘না, তেমন কিছু না। আর কি কোনো কাজ আছে?’
‘বসে থাকো এখানে, এটাই তোমার কাজ।’
‘আমি বসে থাকলে ভেতরে পেশেন্ট আসবে কী করে, স্যার? আপনার তো পেশেন্ট দেখার সময় হয়ে গিয়েছে।’
‘ডানপাশে একটা চেয়ার এনে বসো, কোন পেশেন্ট কোন সমস্যার কথা বলছে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে।’
অন্বিতা বলল,
‘স্যার, সব কাজ কি শুধু আমিই করব? ক্যান্টিনে বাকি ডাক্তার’রা সবাই গল্প করছে। ওদেরও কিছু কাজ দিন।’
‘সেই ব্যবস্থা আমি করব, তোমাকে এত ভাবতে হবে না।’
‘আমি তবে ওদের সাথেই গিয়ে কাজ করি।’
রাবির ধমক দিয়ে উঠে বলল,
‘বাংলা কি বুঝো না তুমি? যেটা বলেছি সেটা করো। ঐ চেয়ারটা এনে বসো এখানে।’
অন্বিতার রাগ হলেও দমিয়ে নিল নিজেকে। একটা চেয়ার এনে বসল রাবিরের ডান পাশে। সহকারীকে ডেকে পাঠাল রাবির। সে আসতেই বলল,
‘পেশেন্ট আসলে সিরিয়াল করে ভেতরে পাঠিয়ে দিবেন, আর বাকি ডাক্তারদের বলুন ইমারজেন্সিতে থাকার জন্য। সেখানে কোনো পেশেন্ট আসলেই যেন আমাকে জানায়।’
সহকারী মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। রাবির কিছু একটার ফাইল দেখছে মনোযোগ দিয়ে। অন্বিতার এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না। সে ক্ষীণ সুরে একবার বলল,
‘স্যার, আমি একবার ইমারজেন্সিতে যাই?’
রাবির চোখ ঘুরিয়ে চাইতেই আবার চুপসে গেল সে। এরই মাঝে শুরু হলো পেশেন্ট আসা। অন্বিতা এই প্রথম রাবিরের পাশাপাশি বসে পেশেন্টের প্রতি তার একাগ্রতা দেখছে। কী সুন্দর সে পেশেন্টের সমস্যার কথা জানতে চাইছে, তাকে ভরসা দিচ্ছে, ঔষধ দিচ্ছে। অন্বিতা বসে বসে শিখছে সব। তিন চারজন পেশেন্ট যাওয়ার পর এবার একেবারে অল্প বয়সী একটা মেয়ে আসে। দেখে মনে হয়, সবে কলেজে পা দেয়া চটপটে তরুণী। সে এসে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অন্বিতা তার দিকে চেয়ে বলে,
‘আপনি বসুন।’
মেয়েটি তাও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। মাহির এবার ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।’
মেয়েটি বসল। চোখের পলক পড়ছে না তার। অন্বিতা খেয়াল করল, মেয়েটা চোখ দিয়েই রাবিরকে গিলে খাচ্ছে। সে বিস্মিত হলো খুব। এইটুকু একটা মেয়ে, তার দ্বিগুণ বয়সী লোকের দিকে এত মোহ নিয়ে কী করে তাকিয়ে আছে। রাবির জিজ্ঞেস করল,
‘আপনার সমস্যার কথা বলুন, প্লিজ।’
মেয়েটি উদ্বেগ দেখিয়ে বলল,
‘আমার আজকাল কোনোকিছুতেই মন বসছে না। বুকের ভেতরটা খালি ধরাস ধরাস করে। মনে শান্তি পাইনা একটুও। আমার কি খুব কঠিন রোগ হয়েছে, ডাক্তারসাহেব?’
রাবির কিছু বলার আগেই অন্বিতা বলে উঠল,
‘আরে না না, তেমন কিছু না। এটা কোনো রোগের মধ্যেই পড়ে না। শুনো, পড়াশোনায় মনোযোগ দাও, পরিবারকে সময় দাও। অন্যকোনো দিকে মন না গেলেই হবে। দেখবে আস্তে আস্তে বুকের ধরাস ধরাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাও যদি না হয়, তবে আবার এসো; নতুন একটা মেশিন এসেছে, এটা দিয়ে আমরা বুকের ভেতরে এমন গিট দেই, বুক আর তখন ধরাস ধরাস করতে পারে না, একেবারে স্বাভাবিক হয়ে যায়। পরবর্তীতে তুমি আসলে না হয় আমরা এই মেশিনটা তোমার উপর ট্রাই করে দেখব, কেমন?’
মেয়েটি ভীত সুরে বলল,
‘মেশিন কেন, ঔষধ দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আহা, তুমি বুঝতে পারছো না। ঔষধের মেয়াদ তো স্বল্পস্থায়ী, খাওয়া বন্ধ করে দিলেই আবার সমস্যার শুরু। কিন্তু মেশিনটা দিয়ে একটা গিট দিলেই দেখবে, একেবারের জন্য সমাধান পেয়ে গিয়েছ।’
মেয়েটি এবার চট করে তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘থাক, আমি একদম সুস্থ আছি, আমার কোনো মেশিনের প্রয়োজন নেই।’
এই বলেই দ্রুত কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। রাবির হতবাক। কী হলো, বোধগম্য হচ্ছে না তার। অন্বিতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘এটা কী হলো?’
‘সবসময় কেবল ঔষধ দিয়েই রোগ দূর করা যায় না, মাঝে মধ্যে এসব টোটকাও এপ্লাই করতে হয়।’
রাবির এখনো বিস্মিত। অন্বিতা বলল,
‘এত অবাক হওয়ার কিছু নেই, স্যার। মৌচাক দেখে মৌমাছি এসেছিল, তাড়িয়ে দিয়েছি।’
‘কীসব হেয়ালি কথাবার্তা বলছো তুমি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘ওসব আপনি কখনো বুঝতেও পারবেন না। আপনি বরং আপনার কাজে মনোযোগ দিন।’
রাবির বিরক্ত হয়ে ফের তার কাজে মনোযোগ দিল। একের পর এক পেশেন্ট সে দেখেই যাচ্ছে। যেন ক্লান্তহীন অনন্ত এই সময়। অন্বিতার কোমর ধরেছে এবার। টানা তিন ঘন্টা এভাবে বসে থাকা যায়। এখন লাঞ্চ ব্রেক চলছে। পেশেন্টের সিরিয়াল আবার বিকেলে।
রাবির বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে নাও, কেন্টিন থেকে খাবার এলে একসাথে খাব।’
‘না। মা আমার জন্য খাবার প্যাক করে দিয়েছেন। আমি এটাই খেতে পারব।’
‘বাহ, তাহলে তো বেশ ভালো। তবে কেন্টিন থেকে খাবার আনতে বারণ করে দেই?’
‘কেন, আপনি কেন বারণ করবেন?’
‘এই না বললে, মা খাবার প্যাক করে দিয়েছেন।’
‘ঐটা আমার জন্য, আপনার জন্য না।’
‘তোমার থেকেই একটু শেয়ার করলেই হবে।’
অন্বিতা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
‘আমি আমার জিনিস কারার সাথে শেয়ার করি না।’
রাবির অন্বিতার দিকে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল,
‘এত স্বার্থপর?’
‘হ্যাঁ, অনেক। মায়ের রান্না আমার কাছে ভালোবাসা, আর আমি আমার ভালোবাসায় কারোর ভাগ বরদাস্ত করতে পারি না।’
রাবিরের চোখ মুখ মলিন হয়ে উঠে। সে ক্ষীণ সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘তবে আমার বেলাতে কী করে বরদাস্ত করেছিলে?’
‘অতিরিক্ত আঘাতে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান খুইয়ে বসে, আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।’
রাবির আরো এক কদম এগিয়ে আসে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,
‘আমার শেষ দৃষ্টিও কেবল তোমাকেই খুঁজছিল, একবার কেন এলে না, অন্বি?’
অন্বিতা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। রাগে গা রি রি করে উঠে তার। বাজখাঁই সুরে বলে উঠে,
‘নূন্যতম লজ্জাবোধ থাকলে এই কথাটা আর কখনোই জিজ্ঞেস করবেন না।’
এই বলে অন্বিতা কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। রাবির একা দাঁড়িয়ে। বিক্ষিপ্ত হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে তার। বুকে ব্যথা হচ্ছে তীব্র। নিজের একটা ছোট্ট ভুলে সে আজ সবকিছু হারিয়ে বসেছে, হারিয়ে বসেছে তার ভালোবাসার মানুষকে। আর কখনো পাওয়া হবে কি-না সেটাও জানে না। শুকনো মরুভূমির ন্যায় হৃদয় তার অন্বিতার জন্য হাহাকার করছে। একবার খুব করে ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে তাকে। একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে, বলতে, “আর একটা সুযোগ দাও, অন্বি। ওয়াদা করছি, আর একটুও কষ্ট পেতে দিব না তোমায়। তুমি কেবল একবার ফিরে এসো অন্বি, একবার।”
রাবির শক্ত করে নিজেকে। ছেলে মানুষের না-কি কাঁদতে হয় না, তারউপর সে ডাক্তার। ডাক্তার’রা তো রোবট, কান্না তাদের জন্য হারাম। তাই আর কাঁদল না সে। সহকারীকে ডেকে বলল,
‘সকল ইন্টার্ন ডাক্তারদের বলুন, আজকের মতো বাড়ি চলে যেতে। আর কাল যেন আবার সময় মতো চলে আসেন।’
সহকারী বলল,
‘আচ্ছা, স্যার।’
‘আর শুনুন, ক্যান্টিন থেকে খাবার আনতে বারণ করবেন। আমি এখন কিছু খাব না।’
‘কেন স্যার? কোনো সমস্যা বা অন্যকিছু খাবেন?’
‘না, সমস্যা নেই কোনো। আমার ইচ্ছে করছে না, তাই খাব না। আপনাকে যা বলা হয়েছে আপনি আপাতত সেইটুকুই করুন।’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/