#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪।
আট’টা পর্যন্ত নিজের ডেস্কে বসে রোগী দেখল অন্বিতা। ঘড়িতে এখন আট’টা পনেরো। মাহিরের সহকারী তার কাছে এসে বলল,
‘ম্যাডাম, স্যার আপনাকে ডাকছেন।’
‘আপনি যান, আমি আসছি।’
এখন রোগী নেই। অন্বিতা এপ্রোন’টা খুলে চেয়ারের উপর রেখে মাহিরের কেবিনের দিকে গেল। দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করল,
‘আসব?’
‘হু।’
ভেতরে প্রবেশ করল অন্বিতা। মাহিরও ফ্রি এখন। অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘ক্যান্টিন থেকে দু কাপ কফি নিয়ে আসুন।’
ভ্রু কুঁচকাল অন্বিতা। বলল,
‘সামান্য কফি আনার জন্য আপনি আমাকে ডেকেছেন?’
‘জি।’
ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল অন্বিতা। বোঝাল, সে ভীষণ বিরক্ত হয়েছে। তাতে মাহিরের যদিও তেমন কিছু যায় আসেনি। অন্বিতা চলে গেল কফি আনতে।
দশ মিনিট পর দুই কাপ কফি মাহিরের সামনে রাখল অন্বিতা। বলল,
‘এবার যাই?’
‘আপনাকে কি যেতে বলেছি?’
‘তো?’
‘বসুন। বসে আমার সাথে কফিটা পান করুন।’
কথা বাড়ালেই মাহির আরো বিরক্ত করবে, তাই অন্বিতা বসে পড়ল। কফিতে চুমুক বসাল অতঃপর। মাহির বলল,
‘কাল থেকে সন্ধ্যায়ও আমার গাড়ি তোমাকে আনতে যাবে।’
‘স্যার, আমি একা আসতে পারব।’
‘জানি পারবে, তবে আমি তোমাকে নিয়ে বড্ড ইনসিকিউরড।’
তাচ্ছিল্যের সুরে অন্বিতা বলল,
‘তবে তো এখনও কেউ এসে আমার নামে কোনো মিথ্যে বললে আপনি সেটা বিশ্বাস করে নিবেন।’
‘না না, একই ভুল আর কখনো হবে না। আমার শুধু তোমাকে হারানোর ভয়টা কাজ করে। মনে হয়, কেউ যদি এসে তোমাকে আমার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলে, তখন? আমি যে নিঃস্ব হয়ে যাব।’
‘কাউকে ছাড়া কেউ নিঃস্ব হয় না, স্যার; এটা একটা বানোয়াট কথা।’
‘তুমি এত নিষ্ঠুর কেন হয়ে গেলে, অন্বিতা? তোমার সাথে কথা বললে আমার মনে হয়, আমি যেন একটা পাথরের সাথে কথা বলছি।’
অন্বিতা হাসল। শব্দ হলো হাসিতে। তৃপ্তি বোধ করল সে। মাহির ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। অন্বিতার হাসির কারণ সে ঠাহর করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করল,
‘হাসছো কেন?’
‘আপনার কথা শুনে বড্ড শান্তি পাচ্ছি। তার মানে, পেরেছি আমি। নিজেকে এই পাথর বানাতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, স্যার। আজ মনে হচ্ছে, আমি সফল। ভীষণ খুশি লাগছে আমার।’
মাহির ঢোক গিলে। চোখে মুখে অসহায়ত্বের ছাপ। সে যেন তার পুরোনো অন্বিতাকে হারিয়ে ফেলেছে। অন্বিতা নির্মল হাসল। বলল,
‘কী দেখছেন?’
‘দেখছি না, খুঁজছি।’
‘কী?’
‘তোমার মাঝে আমার সেই পুরোনো অন্বিতাকে।’
অন্বিতার ফের হাসল। হাসিতে ঠিকরে পড়ল একরাশ অবজ্ঞা, অবহেলা। বলল,
‘পাবেন না, সেই অন্বিতা তো কবেই মরে গিয়েছে।’
মাহিরের বুকে কেমন ব্যথা হয় যেন। বলে,
‘এভাবে বলো না, আমার কষ্ট হয়।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্বিতা। পুরো কফিটা শেষ করে বলে,
‘আমি একবার ওয়ার্ডের পেশেন্টদের দেখি আসি।’
এই বলে উঠে বেরিয়ে এল সে। নির্জীব, নিস্তব্ধ মাহিরকে ফেলে এল একা। কাউকে হারানোর আফসোস মানুষকে কুরে কুরে খায়। মাহিরের ক্ষেত্রেও এখন তাই’ই হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষকে নিজের দোষে হারিয়ে এখন প্রতিনিয়ত জঘন্য ভাবে আফসোস হচ্ছে তার। এই আফসোসের যেন শেষ নেই। কী বিদঘুটে, কী যন্ত্রণাদায়ক এই আফসোস!
সচরাচর মাহির এগারোটার পর বাড়ি চলে আসে। তবে আজ সে এখনো নার্সিংহোমে’ই। ক্যান্টিন থেকে খাবার এনে চুপচাপ বসে আছে সে। সহকারীকে পাঠিয়েছিল অন্বিতাকে ডেকে আনার জন্য, কিন্তু তার এখনও কোনো দেখা নেই। শেষে বিরক্ত হয়ে সে নিজেই উঠে পড়ল। অন্বিতার খোঁজে পা বাড়াল ওয়ার্ডের দিকে। তবে তার ডিপার্টমেন্টের কোনো ওয়ার্ডে অন্বিতা নেই। খানিকটায় চিন্তায় পড়ল। আবার মেয়েটা একই ভুল করছে না তো। সে একজন ওয়ার্ড বয়কে ডেকে জিজ্ঞেস করল, অন্বিতাকে দেখেছে কি-না। ওয়ার্ড বয় জানাল, সে তাকে শিশুদের চেম্বারে দেখেছে।
কপাল কুঁচকে সেদিকেই হাঁটা ধরল মাহির। আবার মেয়েটা অন্য ডিপার্টমেন্টে গিয়ে কী কান্ড করছে কে জানে? সে যত চায়, তাকে শাস্তি না দিতে, ততই মেয়েটা শাস্তি পাওয়ার সব পথ খুলে বসে।
তিন তলায় উঠে মাহির। শিশুদের চেম্বার সেখানেই। মাহির তিনশ তেরো নাম্বার রুমে গেল। সব বাচ্চাদের সেখানেই রাখা হয়। কেবিনের কাচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল সে। মেয়েটা এখানেই। পাশেই তার পরিচিত এক ডাক্তার। অন্বিতার কোলে ছোট্ট এক বাচ্চা। সে তাকে আদর করায় ব্যস্ত। মাহির বাইরে থেকে দরজায় নক করে। দরজার বাইরে মাহিরকে দেখে ভেতরের দুজন ঘাবড়ে যায়। অন্বিতা আস্তে করে বাচ্চাটাকে তার জায়গায় শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। পাশের ডাক্তারও আসে তার সাথে। মাহির জিজ্ঞেস করে,
‘কোনো সমস্যা?’
ডাক্তারটি জানাল,
‘না না, স্যার, উনি একটু বাচ্চাদের দেখতে চেয়েছিলেন বলে দেখালাম।’
‘ভেতরে যাওয়ার আগে যথেষ্ট সেফটি মেনে গিয়েছেন তো?’
মাহির অন্বিতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল। অন্বিতা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘জি, স্যার।’
‘ঠিক আছে, চলুন এবার।’
মাহির পা চালায়। অন্বিতাও আসে তার পেছন পেছন। দুই তলায় নেমে অন্বিতা তার ডেস্কের দিকে যেতে নিলে মাহির বলল,
‘আগে আমার কেবিনে চলুন।’
অগত্যাই অন্বিতা তার পেছন পেছন চলল। কেবিনে গিয়ে দেখল টেবিল সাজানো খাবারে। মাহির দুটো চেয়ার টেবিল বরাবর রেখে বলল,
‘বসো।’
অন্বিতা ইতস্তত সুরে বলল,
‘আমি পরে খেয়ে নিব।’
‘এখানে বসতে বলেছি।’
‘স্যার, কেউ হঠাৎ কেবিনে এসে আমাদের দুজনকে একসাথে..’
অন্বিতার কথা শেষ করার আগেই মাহির শক্ত গলায় বলল,
‘প্রথমত, তুমি আমার ফিয়ন্সি; আর দ্বিতীয়ত, কারোর কোনো কথাতে আমার কিছু যায় আসে না।’
‘আমার আসে।’
‘আসলেও আমার কিছু করার নেই।’
এই বলে মাহির তার হাত ধরে এনে তাকে চেয়ারে বসাল। নিজে বসল অন্য চেয়ারে।
অন্বিতার অস্বস্তি হচ্ছে। সে হাত গুঁটিয়ে বসে আছে চুপচাপ। মাহির তার দিকে চেয়ে বলল,
‘কী হলো, শুরু করো।’
‘আমি পরে খেয়ে নিতাম…’
‘এখন খাবে তুমি, কোনো বাহানা শুনছি না।’
উপায়ান্তর না পেয়ে অন্বিতা খাবারে হাত দিল। তাদের খাবারের মাঝেই একজন নার্স ছুটে এল কেবিনে। আচমকা নার্সকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে অন্বিতা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাহির ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘তুমি উঠলে কেন, বসো। আর আপনি (নার্সের দিকে চেয়ে) এভাবে হুট করে কেবিনে ঢুকে পড়লেন কেন? অনুমতি নেওয়ার জ্ঞানটুকু নেই আপনার?’
নার্সটি থতমত খেল। আমতা আমতা করে বলল,
‘স্যার, আসলে বাইরে একজন পেশেন্ট এসেছেন। এক্সিডেন্ট কেইস, মনে হয়। অবস্থা শোচনীয়। ইমারজেন্সিতে কাউকে পাইনি, তাই আপনার কাছে ছুটে এলাম।’
মাহির উঠে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এল। অন্বিতাকে বলল,
‘তুমি খাওয়া শেষ করে তারপর উঠবে। আমি পেশেন্টকে দেখে আসছি।’
নার্সের সাথে মাহির বেরিয়ে যায়। মাহির যাওয়ার পর অন্বিতার আর এমনিতেও খেতে ইচ্ছে করে না। তাই খাবার সব গুছিয়ে রেখে দেয়।
হাত ধুয়ে সেও যায় সেই পেশেন্টের অবস্থা দেখার জন্য। ইমারজেন্সিতে রাখা স্ট্রেচারটা। পাশেই নার্স দাঁড়িয়ে ড্রেসিং করছে। মাহির একটু দূরে অন্য একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। অন্বিতা স্ট্রেচারটার সামনে যেতেই থমকে দাঁড়ায়। রক্তাক্ত ব্যক্তিটাকে দেখা মাত্রই ঘাবড়ে যায় সে। ছুটে এসে বলে,
‘অমিত, আপনার এই অবস্থা কী করে হলো?’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/