#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।
মাহিরের মাঝে কোনো হেলদোল না দেখে বেশ বিরক্ত হলো অন্বিতা। বাধ্য হয়ে গাছের নিচ থেকে বেরিয়ে এল সে। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মাহির ভিজে একাকার। এখন অন্বিতাও। সে মাহিরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে বলল,
‘আপনার সমস্যাটা কী বলুন তো?’
মাহির হাসল কিঞ্চিৎ। বলল,
‘তুমি।’
অন্বিতা কপাল কুঁচকাল। বলল,
‘আমি আপনার সমস্যা?’
‘হ্যাঁ।’
‘তবে এই সমস্যাকে জীবনে রাখছেন কেন? উপড়ে ফেলে দিন।’
‘অসম্ভব। তুমি আমার জীবনের এমন এক সমস্যা যার কোনো সমাধান আমি চাই না।’
বৃষ্টির দরুন তাকানো মুশকিল। অন্বিতা বলল,
‘আপনি গাছের নিচে আসুন, আর নয়তো গাড়িতে চলুন। এভাবে ভেজার কোনো মানে হয় না।’
অন্বিতা সামনে আগাতে নিলেই মাহির তার হাত ধরে। আটকায় তাকে। অন্বিতা বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘আবার কী হলো?’
মাহির অন্বিতার হাত টেনে তাকে ঠিক তার সামনে এনে দাঁড় করায়। চেয়ারে বসা অবস্থাতেই অন্বিতাকে জড়িয়ে ধরে সে। অন্বিতা চমকায়। বিস্ফোরিত চোখে মাহিরকে দেখে। মাহির তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে আছে। অন্বিতার অস্বস্তি হয় বড্ড। তাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে। মাহির ক্ষীণ সুরে বলে,
‘চিন্তা নেই, সীমা অতিক্রম করব না।’
কম্পিত সুরে অন্বিতা বলল,
‘কেন করছেন এমন?’
মাহিরের নিশ্বাসের গতি বাড়ছে। যতই বলুক, সীমা সে অতিক্রম করবে না, কিন্তু তার বেহায়া মন কি আর তা মানতে চায়। সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্ত করে বলল,
‘আমাকে ক্ষমা করে দাও, অন্বিতা। আমি আর এসব নিতে পারছি না।’
অন্বিতা ঢোক গিলে বলল,
‘এখন এসব কথা বলার সময় না, মাহির। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন যে।’
‘শরীরের অসুখ তো ঔষধ দিয়ে ঠিক করা যায়, কিন্তু মনের অসুখ, এই অসুখের কোনো ঔষধ নেই কেন বলো তো?’
‘এসব কথা এখন থাক না। চলুন, আমরা গাড়িতে গিয়ে বসি।’
মাথা তুলে চাইল মাহির। ঠিক অন্বিতার চোখের দিকে। মাহিরের চোখে চোখ পড়তেই অন্বিতা থমকাল। মাহিরের মুখ চুইয়ে পড়া বৃষ্টির পানিগুলো তার চোখের পানিকে চমৎকার ভাবে আঁড়াল করছে। অন্বিতা বলল,
‘আমাদের যাওয়া উচিত।’
‘আমার ক্ষমা লাগবে, অন্বিতা। তোমার ভালোবাসা লাগবে, তোমাকে লাগবে, ঠিক আগের মতো।’
‘হারিয়ে যাওয়া জিনিস ফিরে আসে না, মাহির।’
‘কেন আসে না? এত নির্দয় তুমি কেন হচ্ছো? কী করলে আমায় ক্ষমা করবে, বলো?’
‘থাক না এসব।’
‘না, থাকবে না। আমি ঠিক কতগুলো দিন শান্তিতে ঘুমাতে পারছি না, তোমার ধারণা আছে? নেই। আমি জানি, আমি ভুল করেছি। তোমাকে অবিশ্বাস করাটা আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল। আমি তখন অন্ধ ছিলাম, মূর্খ ছিলাম, নয়তো সামান্য কয়টা মানুষের কথায় কেউ বুঝি তার ভালোবাসাকে অবিশ্বাস করে? আমাকে তুমি যা খুশি শাস্তি দাও, আমি মাথা পেতে নিব, তবু এই দূরত্বটা আর রেখো না। আমি আর পারছি না।’
অন্বিতা কান্না আটকায়। জোরে শ্বাস ফেলে বলে,
‘একটা মানুষের কাছে তার চরিত্রের চেয়ে দামি কিছু হয় না। সেদিন আপনার ফুপি, আপনার কাজিন আর আপনার বন্ধু মিলে যে নাটকটা সাজিয়েছিল আপনি তা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন। সবার মতো আপনিও সেদিন আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলেছিলেন। জানেন, সেদিন নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিল। মনে হচ্ছিল, আমি এতদিন কাকে ভালোবেসে এসেছি, যে মানুষটা আমাকে নূন্যতম বিশ্বাস অবধি করে না, তাকে!’
মাহির দু হাত জোড় করে। অনুরোধের সুরে বলে,
‘আমি এই সবকিছুর জন্য অনুতপ্ত।’
‘কী হবে এই অনুতপ্ত দিয়ে? আপনার এই অনুতপ্ত কি আমার খুইয়ে যাওয়া সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে?’
‘সম্মান চাও তো? আমি বলছি, আমাদের রিসেপশনে সেই সব মানুষ থাকবেন যারা ঐ অনুষ্ঠানেও ছিলেন। সেদিন সবার সামনে আমি সব সত্যিটা বলব। আমার ফুপি, শশী আর রিয়াল সবাই তোমার কাছে সেদিন ক্ষমা চাইবে।’
‘লাগবে না আমার কিছু। কারোর ক্ষমার প্রয়োজন নেই। আর কাউকে ব্যাখ্যা দেওয়ারও কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কেমন, আমার চরিত্র কেমন, সেটা আমি জানি, তাই আমাকে নিয়ে অন্যকেউ কী ভাবল না ভাবল তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’
‘আমার আসে। আমি তোমার দেওয়া ঘৃণা আর নিতে পারছি না। এবার একটু ভালোবাসো না, প্লিজ।’
অন্বিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। তবে পুরোপুরি না। তারা দুজনেই ভিজে কাক। শাড়িটা লেপ্টে আছে গায়ে। অন্বিতা আঁচলটা সামনে টেনে বলল,
‘এবার বাসায় যাওয়া উচিত। এভাবে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।’
‘আমি তোমার কাছে কিছু চেয়েছি, অন্বিতা।’
‘আমার কাছে দেওয়ার মতো কিছু নেই।’
‘এত নিষ্ঠুর কেন তুমি?’
‘আপনি বানিয়েছেন।’
‘আর একটা বার নরম হও।’
‘কেন, আরো একবার ভেঙে ফেলতে চান?’
‘না, এবার যত্ন করে আগলে রাখব। আই প্রমিজ।’
‘ঠিক আছে, দেখা যাবে। এবার চলুন।’
‘যাব না আমি, শুনেছ? আজ এখানেই থাকব।’
কিছুটা উঁচু গলায় বলল মাহির। অন্বিতা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। একে তো শাড়ি পরেছে, তারউপর ভেজা শরীর; কী মারাত্মক অস্বস্তি হচ্ছে সেটা আর বলে বোঝানোর জো নেই। সে রেগে বলল,
‘ঠিক আছে, আপনি বসে বসে নাটক করুন। আমি চললাম।’
অন্বিতা হাঁটা ধরল। মাহির তাকে থামায় না। সে ক্ষুব্ধ হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। রাস্তায় আসে অন্বিতা। মাহিরের গাড়িটা এখানেই। এই রাস্তায় আর অন্য কোনো গাড়ি আসছে না। সে এক পাশ দিয়ে হেঁটে কিছুটা সামনে আসে। আশেপাশে গাছগাছালি আর পাঁকা রাস্তা ব্যতিত আর কিছুই চোখে পড়ে না তার। এই এক কোথায় এসে ফেঁসেছে কে জানে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও অন্বিতা কোনো গাড়ি দেখা পায় না। পরে হতাশ হয়ে পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে। মাহিরকে দূর থেকে দেখে, সে এখনও একই ভাবে বসে। লোকটা আজ একটু বেশিই ত্যাড়ামি করছে। সে এগিয়ে যায়। মাহিরের সামনে দাঁড়িয়ে রেগে বলে,
‘এভাবে ভেজা শরীরে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব? এবার কিন্তু আপনি বাড়াবাড়ি করছেন।’
মাহির চোখ তুলে অন্বিতার আপাদমস্তক দেখে। এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি। মাহিরের চাহনি দেখে লজ্জা পায় অন্বিতা। খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে বলে,
‘চলুন।’
মাহির চোখের দৃষ্টি সরায়। এই দৃষ্টির সময়কাল যত বাড়বে তার নিজের বেহায়া মনকে সংযত রাখা ততই কঠিন হয়ে পড়বে। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মাহির বলে,
‘আমার কথা না মানা অবধি আমি যাব না।’
‘এতটা বিপদে পড়তে হবে জানলে আমি কখনোই আসতাম না।’
‘এখন বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার একটাই পথ আছে, আমার দাবি মেনে নাও।’
‘না মানলে?’
‘এখানেই থাকতে হবে।’
‘পাগল হয়েছেন? জায়গাটা দেখেছেন আপনি? এখন’ই কী নীরব নিস্তব্ধ, সন্ধ্যা নামলে তো ভূতের আস্তানা মনে হবে।’
‘হোক, তাও আমি নড়ব না। আর আমাকে ছাড়া তুমিও এখান থেকে যেতে পারবে না।’
অন্বিতা বিপদে পড়েছে বেশ। ফোনটাও তার মাহিরের গাড়িতে। আর মাহির মহাশয়, গাড়ি লক করে এখানে আরাম করে বসে আছেন।
চলবে…..
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/