একটি_অপ্রেমের_গল্প #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ২৪।

0
60

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৪।

জ্বর নিয়েই পরদিন হাসপাতালে গেল মাহির। সে গিয়ে তার কেবিনে বসার কিছুক্ষণ বাদেই অন্বিতা প্রবেশ করল সেখানে। তাকে দেখে মাহির অবাক হয়ে বলল,

‘তোমাকে না আজ ছুটি দিলাম?’

‘আপনি এই শরীরে চলে এলেন, তাই আমিও এসেছি।’

মাহির কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘বাহ, আমার জন্য এত মায়া!’

‘জ্বর কমেছে আপনার?’

‘কী জানি, বুঝতে পারছি না।’

অন্বিতা চোখ সরু করে বলল,

‘ডাক্তার হয়ে সামান্য জ্বরের পরিমাণ ধরতে পারছেন না।’

মাহির মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘উঁহু।’

‘থার্মোমিটার কোথায়? মাপুন তো, দেখি।’

‘নেই।’

‘এখানে নেই? ঠিক আছে, আমি আপনার সহকারীকে বলে আনাচ্ছি।’

‘কোথাও নেই। পুরো হাসপাতালে কোথাও থার্মোমিটার নেই।’

অন্বিতা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,

‘আমাকে কি আপনার বোকা মনে হয়?’

মাহির ঠোঁট চেপে বলল,

‘একটু একটু।’

ক্ষুব্ধ হলো অন্বিতা। বলল,

‘মজা না করে, থার্মোমিটার আনতে বলুন।’

‘আরে মেয়ে শুনো, ডাক্তারদের কেবল মেশিনের উপর নির্ভর হলে হয় না। মাঝে মাঝে নিজের সেন্স অফ হিউমারকেও কাজে লাগাতে হয়। এদিকে এসো, মাথায় হাত দিয়ে দেখো জ্বর কেমন।’

অন্বিতা বেশ বুঝতে পারছে, মাহিরের ছলা কলা। সে তাও কিছু বলল না। মাহিরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কপালে হাত রাখল। তারপর একবার গাল, গলাও ধরে দেখল। মাহির চোখ বুজে অনুভব করল সেই নরম হাতের অনুগ্র স্পর্শ। অন্বিতা হাত সরিয়ে নিল। বলল,

‘এখনও পুরোপুরি যায়নি।’

‘এখন চলে যাবে, তুমি ছুঁয়েছ না।’

অন্বিতা নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। মাহিরের কথার বিপরীতে বিরক্ত মনা হয়ে বলে,

‘আপনার কথা শুনলে কেউ বলবে, আপনি যে একজন ডক্টর? কলেজ পড়ুয়া ছেলেরাও আজকাল যথেষ্ট পরিপক্ক কথাবার্তা বলে।’

‘তোমার নজর আজকাল কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের দিকে যাচ্ছে কেন, শুনি? ব্যাপারটা তো সুবিধার ঠেকছে না।’

মাহির ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে শুধাল। মাহিরের হেয়ালিপনা অন্বিতা ঠাহর করতে পারছে বেশ। সে বলল,

‘কথা কম বলে কাজ করুন। আমি আসছি।’

‘রোগী আসবে দশটা থেকে। ক্যান্টিন থেকে কফি নিয়ে এসো দুইটা, মাথা ধরেছে।’

অন্বিতা রগড় সুরে বলল,

‘কফি লাগবে না। আমি না ছুঁয়েছি, চলে যাবে।’

মাহির ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

‘আমার পুরো শরীর ব্যথা করছে, ম্যাডাম। একটু ছুঁয়ে দিয়ে সাহায্য করুন।’

অন্বিতা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বলল,

‘আপনি এত অসভ্য!’

এই বলে অন্বিতা দ্রুত কেবিন ত্যাগ করে। মাহিরের হাসির মাত্রা আরো বাড়ে তখন।

মাহিরের কেবিনে সহকারী এসে কফি দিয়ে যায়। মাহির জিজ্ঞেস করে,

‘কফি কেন?’

‘ম্যাডাম বললেন, আপনাকে দেওয়ার জন্য।’

‘ম্যাডাম কোথায়?’

‘উনার ডেস্কে গিয়ে বসেছেন।’

‘আরেকটা কফি উনার ডেস্কে দিয়ে আসুন।’

সহকারী মাথা হেলিয়ে বলল,

‘ঠিক আছে, স্যার।’

ডেস্কে বসে রোগী দেখছিল অন্বিতা। হঠাৎই বাইরে হৈ চৈ শোনা যায়। কারোর কান্নার আওয়াজ আসছে। সে রোগী দেখা শেষ করে বাইরে বের হলো। করিডোরে তার’ই বয়সী একটা মেয়ে অস্থির ভাবে কেঁদে চলছে। তার সামনেই স্ট্রেচারে একজন বৃদ্ধ লোক শায়িত। ততক্ষণে সেখানে মাহির সহ বেশ কয়জন ডাক্তার উপস্থিত। মাহির লোকটিকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

‘উনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন।’

পাশের ডাক্তার বলল,

‘স্যার, জীবিত তো?’

মাহির পালস্ চেক করে বলল,

‘পালস্ একেবারে কম। একবার ইসিজি করান দ্রুত।’

মেয়েটা তখন চট করে এসে মাহিরের পায়ের সামনে পড়ে যায়। চমকে দুই কদম পিছিয়ে যায় মাহির। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করে,

‘আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দিন, স্যার। বাবা ছাড়া আমার কেউ নেই। আপনি আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দিন প্লিজ।’

মেয়েটার এত আকুতি মিনতি দেখে অন্বিতার বড্ড মায়া হয়। মনে পড়ে তার বাবার কথা। তার বাবাও হার্ট অ্যাটাক করেই মারা গিয়েছিলেন। বাবা ছাড়া একটা সন্তান কতটা অসহায় তার চেয়ে ভালো সেটা কেউ বলতে পারবে না হয়তো।

মাহির মেয়েটাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তবে বাঁচা মরা একজনের হাতেই, আপনি দোয়া করুন।’

এই বলে ইসিজি রুমের দিকে গেল সে। অন্বিতা এসে মেয়েটাকে ধরে উঠাল। বলল,

‘কাঁদবেন না। ইনশাল্লাহ, আপনার বাবা ঠিক হয়ে যাবেন। অ্যাটাক করেছেন আনুমানিক কতক্ষণ আগে?’

‘ভোরের দিকে করেছিলেন।’

‘তাহলে এত লেইট করলেন কেন? আরো আগে নিয়ে আসতেন।’

মেয়েটার কান্নার বেগ বাড়ল। বলল,

‘অনেক আগেই রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু রাস্তার জ্যামে এতটা লেইট হয়েছে।’

মেয়েটা এই পর্যায়ে অস্থির হয়ে অন্বিতার দুই হাত চেপে ধরে বলল,

‘খুব লেইট হয়ে গিয়েছে? আমার বাবাকে কি এখন আর বাঁচানো যাবে না?’

‘না না, এমন ভাববেন না। দোয়া করুন, আপনার বাবাকে সুস্থ হয়ে যাবেন।’

এই বলে সে মেয়েটাকে নিয়ে একটা চেয়ারে বসাল। এক বোতল পানি এনে তার হাতে দিয়ে বলল,

‘পানি’টা খেয়ে, এখানে বসে দোয়া করুন। আমি দেখে আসছি।’

মেয়েটি অন্বিতার হাত ধরে অনুরোধ করল,

‘দেখবেন, আমার বাবা যেন বেঁচে যায়।’

অন্বিতা মেয়েটির গালে হাত বুলিয়ে চলে এল। কী বলবে সে, ডাক্তার যতই চিকিৎসা করুক, সৃষ্টিকর্তার উপরে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা তো কারোর নেই।

সে ইসিজি রুমের বাইরে এসে দাঁড়ায়। ভেতরে ইসিজি চলছে। কাজ শেষে মাহির বের হয়। অন্বিতাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মাহিরকে দেখে অন্বিতা চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করে,

‘কী অবস্থা উনার? ক্রিটিকাল কিছু?’

‘রিপোর্ট তো তাই বলছে। সমস্যা হচ্ছে অ্যাটাক’টা অনেক আগেই হয়েছে। তবে উনারা কেউ বুঝতে পারেননি। আর সমস্যাটাই এই জায়গায়। যত বিলম্ব, তত’ই রোগীর মৃত্যু সম্ভাবনা বেড়ে যায়।’

‘এভাবে বলবেন না। কিছু একটা করুন। উনার মেয়ে বাইরে খুব আশা নিয়ে বসে আছেন।’

‘চেষ্টা তো করব। তবে ভাগ্যের উপর তো আর আমাদের হাত নেই।’

‘চেষ্টা করলে আল্লাহ সফল করেন। যেভাবেই হোক, মানুষটাকে বাঁচিয়ে দিন।’

মাহির কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘তুমিও দেখছি অন্যসবার মতোই কথা বলছো? ডাক্তার মানুষ বাঁচাতে পারে না, অন্বি।’

অন্বিতা ঢোক গিলে। তার এই মুহুর্ত তার বাবার শেষ মুহুর্তের কথা মনে পড়ছে। কান্না পাচ্ছে তার। সে কোনোরকমে কান্না চেপে বলে,

‘যতটুকু পারেন করুন, মেয়েটাকে আশাহত করবেন না।’

এই বলে অন্বিতা চলে আসে সেখান থেকে। মাহির এখন আর অন্বিতাকে নিয়ে না ভেবে দ্রুত রোগীর অপারেশনের ব্যবস্থা করে।

ডেস্কে অস্থির চিত্তে বসে আছে অন্বিতা। তার কেন ভয় হচ্ছে কে জানে। বার কয়েকবার মেয়েটাকে গিয়ে দেখে এসেছে সে। মেয়েটা কাঁদছে। তারও অস্থির লাগছে, দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

_________

অপারেশন শেষ। মাহির বেরিয়ে আসে। দরজার বাইরে মেয়েটা দাঁড়ান, পাশেই অন্বিতা। মেয়েটা গিয়ে উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল,

‘স্যার, আমার বাবা ঠিক আছে তো?’

‘অপারেশন হয়েছে। তবে আমরা এখনও পুরোপুরি কিছু বলতে পারছি না। আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করুন।’

‘অপারেশনের পরেও আরও অপেক্ষা করতে হবে? কেন? আমার বাবা কি সুস্থ হবে না?’

মেয়েটা মেঝেতে বসে পড়ল। তার কান্নার শব্দে চারদিক ঝমঝম করছে। অন্বিতা এসে সামলাল তাকে। নানা ভাবে তাকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সেও তো জানে, এই সময় কোনো কিছুতেই মন ভোলানো যায় না। তাও কোনোরকমে মেয়েটাকে বসিয়ে দিয়ে সে মাহিরের কাছে এল। জিজ্ঞেস করল,

‘উনি কি এখনও বিপদমুক্ত নন?’

‘না। আমরা চেষ্টা করেছি অনেক। তবে উনার পালস্ বাড়ছেই না। তাও আশাবাদী, আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব। তুমি মেয়েটাকে বোঝাও। বলো, ধৈর্য্য ধরতে।’

‘এই সময় কি ধৈর্য্য ধরা যায়? আমার বাবাও হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে আসার পর ডাক্তার বলেছিলেন, “আমাদের হাতে আর কিছুই করার নেই, আপনারা মানসিক ভাবে প্রস্তুত হউন, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।” ঐ মুহুর্তটা যে আমার আর মায়ের জন্য কতটা ভয়ংকর ছিল সেটা শুধু আমরা জানি। তাই এইটুকু বুঝতে পারছি, মেয়েটাকে এখন হাজার বুঝালেও মেয়েটা বুঝবে না।’

মাহির কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজন নার্স ছুটে এসে বলল,

‘স্যার, পেশেন্টের হার্টবিট একেবারে চলছেই না। এখনই একবার আসুন।’

মাহির ছুটে গেল ভেতরে। মেয়েটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। অন্বিতা চেয়ে রইল অসহায় চোখে। দোয়া করল, মেয়েটা যেন এতিম না হয়।

চলবে….

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here