#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।
কেবিনের বাইরে বর্তমানে রোগীদের লাইন। অন্বিতা তাইভিদকে গিয়ে বলল, সে একটু জরুরি ভাবে মাহিরের সাথে কথা বলতে চায়। তাইভিদ পরের রোগীর সিরিয়াল আসার আগে তাকে যেন সুযোগ করে দেয়। তাইভিদ তাই করল। কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাল অন্বিতা। ওয়ার্ড বয়কে দেখল সেখানেই অস্থির বদনে দাঁড়িয়ে আছে। সে গুমোট স্বরে বলল,
‘ভেতরে আসুন।’
অন্বিতার পেছন পেছন সেই ওয়ার্ড বয়ও পদার্পণ করল সেই কেবিনে। তাইভিদ এর কারণ বুঝতে না পেরে সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে রইল কেবল। অন্বিতাকে এই সময় দেখে মাহির খানিক অবাক। আবার পাশেই এক ওয়ার্ড বয় দেখে চিন্তিতও হলো সে। জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে, অন্বিতা? কোনো সমস্যা?’
অন্বিতা চোখ ঘুরিয়ে একবার ওয়ার্ড বয়কে দেখে নিয়ে মাহিরকে বলল,
‘নয় নাম্বার ওয়ার্ডের একজন পেশেন্টের সাথে এই ছেলে বাজে ব্যবহার করেছে। তাকে খারাপ স্পর্শ করেছে। একটু আগে সেই পেশেন্ট নিজেই আমাকে বলেছে সেটা।’
আঁতকে উঠল ওয়ার্ড বয়। ঢোক গিলে ভীত চোখে তাকাল মাহিরের দিকে। মাহিরের চোয়াল দৃঢ় হলো। চোখের দৃষ্টি হলো শাণিত। বলল,
‘এসব কী? তুমি পেশেন্টকে স্পর্শ করেছ?’
ছেলেটা কেঁপে উঠল বোধ হয়। তার ঠোঁটগুলো কাঁপছে তিরতির করে। কম্পিত সুরে বলল,
‘ননা সস্যার, আসলে ম্যাডামের হয়তো কোনো ভুল হয়েছে। আমি তো অন্য কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে কোনো পেশেন্টকে স্পর্শ করিনি।’
‘উদ্দেশ্য যেটাই হোক, আপনি স্পর্শ করবেন কেন? আর একটা জিনিস জানেন তো, মেয়েরা খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারে কোনো স্পর্শটা ভালো আর কোনটা খারাপ। তাই ভুলেও মিথ্যে বলবেন না।’
অন্বিতা সরোষে বাক্য ব্যয় করল। ছেলেটার ভয় বাড়ল এক লহমায়। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। কিছু বলার মতো সৎ সাহসও নেই তার। মাহির কটমট করে চেয়ে বলল,
‘ভুল করে আবার মিথ্যে বলছো? তুমি পেশেন্টকে স্পর্শ করেছ কোন সাহসে? আবার এখানে এসে গলা উঁচু করে সত্য লুকাচ্ছো, এত সাহস হয় কী করে তোমার?’
দমে গেল ছেলেটা। আর্তস্বরে বলল,
‘স্যার, আর হবে না।’
অন্বিতা ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
‘উনাকে ক্ষমা করবেন না, মাহির। এই ধরণের ছেলেদের ক্ষমা করাটা শোভা পায় না। উনারা শাস্তির’ই কাম্য।’
মাহির ধাতস্ত করল নিজেকে। আজকে সকাল থেকে একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে যেন। সে মেঘমন্দ্র স্বরে বলল,
‘কাল থেকে তোমাকে আর কাজে আসতে হবে না। এই মাসের বেতন তুমি পেয়ে যাবে। যাও এখন।’
ছেলেটা হু হু করে কেঁদে উঠল। এত তাড়াতাড়ি সে এভাবে হেনস্থা হবে ভাবেনি। সে চট করে ছুটে এসে মাহিরের পায়ে পড়ে। ভেজা সুরে বলে,
‘ক্ষমা করুন, স্যার। আর কখনও এমন হবে না। কাজ থেকে বের করে দিলে আমি মা’কে কী খাওয়াব? স্যার, শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিন। ম্যাডাম, ক্ষমা করে দিন। দয়া করুন।’
অন্বিতা সন্তপ্ত সুরে বলল,
‘এই কথা আগে মনে ছিল না? মনে খারাপ চিন্তা আসার আগে মায়ের কথা মনে পড়ে না? তখন মনে পড়ে না, মা’কে কী খাওয়াবেন?’
‘ভুল হয়ে গিয়েছে, ম্যাডাম। শয়তানের প্ররোচনায় ভুল করে ফেলেছি। দয়া করে মাফ করে দিন।’
মাহির ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে বলল,
‘ঠিক আছে, মাফ করব। তবে তুমি আজ থেকে আর ওয়ার্ড বয়ের দায়িত্ব পালন করবে না। তুমি আমার কেবিনের বাইরে বসে রোগীদের টোকেন কাটতে সাহায্য করবে। এছাড়া আর তোমার কোনো কাজ নেই। আর চিন্তা করো না, বেতন তোমার কমবে না। তবে এরপর আর কোনোদিন যদি এমন কোনো কাজের চিন্তা মাথায়ও এনেছ, তাহলে ডিরেক্ট পুলিশের হাতে তুলে দিব। মনে থাকবে তো?’
ছেলেটা সিক্ত চোখে সহসা মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘জি স্যার, জি স্যার, মনে থাকবে। আর জীবনেও এমন কিছু করব না।’
‘যাও এখন।’
ছেলেটা হুরমুরিয়ে কেবিন ছাড়ল। সে যেতেই গাঢ় নিশ্বাস ফেলল অন্বিতা। মাহির পূর্ণ মেদুর চোখে তাকাল অন্বিতার দিকে। কোমল স্বরে বলল,
‘তোমার প্রতিটা আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে, অন্বি। সবসময় এভাবেই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, এই সাহস আর শক্তি তোমার চিরস্থায়ী হউক।’
অন্বিতা কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,
‘আর আপনার এই দয়ালু মনটাও যেন চিরস্থায়ী হয়। আপনার বিচারে আমি প্রসন্ন হয়েছি। তবে পরেরবার এমন কিছু করলে কিন্তু অবশ্যই কঠোর হতে হবে।’
মাহির মাথা ঝাঁকাল। অন্বিতা বলল,
‘আসছি তাহলে।’
‘কেন?’
অন্বিতা সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘বাইরে বাকি পেশেন্টরা অপেক্ষা করছেন।’
মাহির ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলল। সেই নিশ্বাসের অর্থ বুঝে ঠোঁট চেপে হাসল অন্বিতা। বলল,
‘এত হা হুতাশ করতে হবে না, ডাক্তারসাহেব। আর মাত্র কয়টা দিন। আসছি।’
মাহিরের প্রত্যুত্তর এর অপেক্ষা না করেই অন্বিতা দ্রুত কেবিন ছাড়ল। সে জানে, মাহির উত্তর এখন মোটেও সুবিধাজনক হবে না। বরং গাল, কান আরক্ত করার মতোই কিছু একটা বলে বসবে সে। বাইরে আসতেই দেখল ছেলেটা একটা চেয়ারে বসা। পাশেই তাইভিদ ভ্রু কুঁচকে ছেলেটাকে দেখছে। অন্বিতা তার দিকে চেয়ে বলল,
‘উনাকে একটু নজরে নজরে রাখবেন। আর উল্টাপাল্টা কিছু দেখলেই স্যারকে জানাবেন দ্রুত।’
তাইভিদ মাথা হেলিয়ে বলল,
‘আচ্ছা, ম্যাডাম।’
___________________
রাত্রি আরম্ভ ক্ষণ। চারদিকে ম্রিয়মান অন্ধকার। সে সময় ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বদনে বাসায় ফেরে মাহির। প্রধান ফটক পেরিয়ে বসার ঘরে পা রাখতেই দেখে সোফায় দাদু আর ফুপি বসা। সে সৌজন্যতা দেখিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতেই জিনিয়া বেগম ডাকেন। ফিরে চাইল মাহির। বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে আসছি, ফুপি।’
এই বলে সে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। ফিরল পাক্কা বিশ মিনিট পর। সোফায় এসে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,
‘কেন ডাকছিলে?’
জিনিয়া বেগমের চোখ মুখ ক্ষেপাটে। রোষপূর্ণ চোখে চেয়ে আছেন মাহিরের দিকে। মাহির কপাল কুঁচকাল। বলল,
‘কী হলো, কিছু বলছো না কেন?’
‘এই তোমার নীতি, মাহির? আজ শশীর চেয়েও তোমার কাছে তোমার ঐ সহকারী বড়ো হয়ে গেল? ঐ একটা বাইরের ছেলেকে তুমি শশীর চেয়েও বেশি বিশ্বাস করলে?’
এতক্ষণে আসল ঘটনা ঠাহর করতে পেরে কপালের ভাঁজ সোজা করল মাহির। দরাজ গলায় বলল,
‘আমি সত্যটাকেই বিশ্বাস করেছি, ফুপি। এখানে বাইরের বা ভেতরের বলে কেউ নেই। যে সত্য আমি তাকেই বিশ্বাস করব।’
কুপিত স্বরে জিনিয়া বেগম বললেন,
‘ওহ, তোমার চোখে তাহলে আমার মেয়ে মিথ্যেবাদী? শুনেছ, বাবা?’
বৃদ্ধ লোকটি মাথা তুলে তাকালেন এবার। মাহিরের দিকে পরিশ্রান্ত বদনে চেয়ে বললেন,
‘তোমার সহকারী’ই যে সত্য বলছে, তার কী প্রমাণ মাহির? সেও তো মিথ্যে বলতে পারে।’
‘শশীও যে সত্য বলছে তার কোনো প্রমাণ নেই, দাদু। তাই শুধুমাত্র মুখের কথার ভিত্তিতে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।’
উত্তেজিত হয়ে উঠলেন জিনিয়া বেগম। বাজখাঁই স্বরে বললেন,
‘শুনলে শুনলে, বাবা? তোমার আদরের নাতির কথা শুনলে? এই তোমার নাতি তোমার আদর্শে বড়ো হয়েছে? এটা তোমার আদর্শ?’
মাহিরের দাদু লাঠির পর দুই হাত রেখে মাথা নিচু করলেন। এই নাতিকে তিনি বড্ড আদর দিয়ে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেঅঁ। নিজের শিক্ষায়, আদর্শে বড়ো করেছেন। আজ তার আদর্শে এভাবে আঙ্গুল উঠায় বড্ড কষ্ট পেয়েছেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘আমি তোমার থেকে এটা আশা করিনি, মাহির। তুমি আমাকে কষ্ট দিয়েছ।’
এই বলে লাঠিটা চেপে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর শম্বুক গতিতে হেঁটে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। সোফায় বসে রইল মাহির। জিনিয়া বেগম বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে সেখান থেকে উঠে গেলেন। মাহির প্রলম্বিত শ্বাস টানল। মাঝে মাঝে নিজেকে বড্ড একা মনে হয়। মনে হয় যেন এত মানুষ থেকেও তার কেউ নেই।
চলবে…..
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/