#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪।
“মাহির আশহাব” নেইমপ্লেটের উপর নামটার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে দরজায় টোকা দিল অন্বিতা। ভেতর থেকে রাশভারী এক স্বর ভেসে এল,
‘কাম ইন।’
অন্বিতা সাহস জুগাল মনে। ভেতরে প্রবেশ করল।
‘আমাকে ডেকেছিলেন, স্যার?’
মাহির চোখ তুলে তাকাল তার দিকে। বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে গা এলাল চেয়ারে। গম্ভীর সুরে বলল,
‘তোমার ব্যবহারে আমি অবাক হচ্ছি।’
‘আমিও, স্যার।’
মাহির ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘মানে?’
‘এই যে আপনি আমাকে এখন আবারও “তুমি” বলে সম্বোধন করছেন, এটাতে আমি অবাক হচ্ছি খুব।’
মাহির হাসল। বলল,
‘আমার ফিয়ন্সিকে আমি যা খুশি বলব, তোমার কী?’
অন্বিতা দু কদম এগিয়ে এসে রূঢ় সুরে বলল,
‘ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, এখন এখানে আপনার ফিয়ন্সি দাঁড়িয়ে নেই; যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি একজন ইন্টার্ন ডক্টর, তাকে আপনি “আপনি” বলেই সম্বোধন করবেন।’
মাহির ক্রূর হেসে বলল,
‘বাহ, কী দাপট তোমার! আমি ভয় পাচ্ছি।’
‘আমাকে কেন ডেকেছেন?’
অন্বিতার বিরক্তির সুর। মাহির ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘তেমন কিছু না, একা ভালো লাগছিল না বলে একটু সঙ্গ দিতে ডেকেছি।’
অন্বিতার রাগ হচ্ছে। তাও সংযত করল নিজেকে। বলল,
‘স্যার, আপনি দয়া করে আপনার মাত্রা অতিক্রম করবেন না। অন্যথায় আমি মেডিকেল বোর্ডে কমপ্লেন করতে বাধ্য হব।’
মাহির শব্দ করে হাসল এবার, যেন অন্বিতা বেশ মজার কিছু বলেছে। অন্বিতার চোয়াল শক্ত করল। বলল,
‘আমি নিশ্চয় মজার কিছু বলিনি?’
নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠল মাহির। অন্বিতার দিকে এগিয়ে এল। টেবিলের উপর বসে সান্দ্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তার উপর। ভ্রু কুঁচকাল অন্বিতা। লোকটা এভাবে তাকালে তার অস্বস্তি হয়। মাহির হেয়ালির সুরে বলল,
‘আমার নার্সিংহোমে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকেই ভয় দেখাচ্ছো?’
‘অন্যায় করলে শাস্তি সবাইকেই পেতে হয়।’
‘প্রতিদিন যে তুমি তোমার উপেক্ষার তীব্র দাবানলে আমার হৃদয় পুড়াচ্ছো, তাতেও বুঝি শাস্তি হচ্ছে না?’
অন্বিতা অন্যদিকে তাকাল। বলল,
‘স্যার, দয়া করে পার্সোনাল আর প্রফেশনালকে গুলিয়ে ফেলবেন না। এই নার্সিংহোমে থাকা অবস্থায় আমি কেবলই আপনার জুনিয়র, আপনার এমপ্লয়ি, নাথিং এলস্।’
মাহির তার কথার বিপরীতে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
‘পৃথিবীর শেষ মাথাতে গেলেও তুমি কেবল আমার ভালোবাসা, এটাই তোমার একমাত্র পরিচয়।’
অন্বিতার এসব কথা পছন্দ হচ্ছে না। বুক ধরফর করছে, এগুলো আর এখন সহ্য করতে পারে না সে।
‘স্যার, দয়া করে কোনো কাজ থাকলে বলুন, নয়তো যেতে দিন আমায়। এখানে আমি কাজ করতে এসেছি, আপনার প্রেমালাপ শুনতে নয়।’
বিষন্ন হাসল মাহির। সে কি এত’ই ফেলনা হয়ে গেল? নিজের জায়গায় গিয়ে বসল আবার। একটা ফাইল অন্বিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘নয় নং ওয়ার্ডের রোগীদের শারীরিক অবস্থা এখানে রেকর্ড করে আনুন।’
ফাইলটা হাতে নিল অন্বিতা। এই কেবিন থেকে বের হতে পারলেই যেন বাঁচে সে। সে ঘুরে দাঁড়াতেই মাহির বলল,
‘আপাতত রেহাই পাচ্ছো বলে ভেবো না, সবসময় এভাবে ছাড় পাবে। প্রেমালাপ শোনার পারমানেন্ট ব্যবস্থা অতি শীঘ্রই করব।’
অন্বিতা আর ফিরে তাকাল না। লোকটার সাথে কথা বাড়ানোর ইচ্ছা আর জাগল না তার। তাই বেরিয়ে এল। ফুরিয়ে আসা দমটা যেন এবার ফিরে পেল সে। ঘনঘন দুবার নিশ্বাস ফেলে পা বাড়াল নিজের কাজের দিকে।
রোগীদের রোগের কথা শুনলে দুঃখ হয় অন্বিতার। তার তখন ইচ্ছে করে, চিকিৎসার মতো দীর্ঘমেয়াদী এক প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে, এক ঝলকেই কোনো এক ম্যাজিক করে সমস্ত রোগ দূর করে দিতে। কিন্তু ডাক্তার’রা আর তো ম্যাজিশিয়ান না।
একে একে সবার হিস্ট্রি জানা শেষে এবার শেষ রোগীর সামনে দাঁড়াল সে। রোগীর পাশে তার মেয়ে আছে বোধ হয়। অন্বিতা জানতে চাইল, রোগীর কী হয়েছে?
মেয়েটি বলল,
‘বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন, এই নিয়ে চারবার। সবাই বলেছিল, মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ আমার সহায় হবেন, আর বিশ্বাস ছিল মাহির স্যারের উপর। সেদিন ছুটিতে ছিলেন তিনি, অথচ আমার হাহাকারে ছুটে এসেছিলেন। বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন আমার বাবাকে। আমি উনার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।’
অন্বিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষটা সবাইকে বাঁচাতে চায়, অথচ নিজের ভালোবাসাকে মেরে ফেলার আগে একবারও ভাবেনি। অন্বিতা বিষন্ন মনে আওড়াল,
‘ডাক্তার সাহেব, আপনি কেবল আমার ক্ষেত্রেই বড্ড নিষ্ঠুর।’
শেষটুকু সেরে ক্যান্টিনের দিকে যায় সে। একটা কফি খাবে। সেখানে গিয়ে সে তার বাকি কলিগদেরও পেয়ে যায়। মেয়েরা তাকে দেখে বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘স্যার, কী কাজ দিয়েছেন তোমাকে?’
অন্বিতা তাদের ফাইলটা দেখিয়ে বলে,
‘এই যে রোগীদের হিস্ট্রি রেকর্ড করতে বলেছেন।’
মেয়েটার নাম তমা, যে মাহিরের কাছাকাছি থাকার জন্য এই অতিরিক্ত চাপটুকু নিতে চেয়েছিল। সে আফসোসের সুরে বলল,
‘এই কাজটা তো আমিও করতে পারতাম, স্যার আমাকে কেন নিল না?’
অন্য একটা মেয়ে, তার বান্ধবী হয় বোধহয়। বলল,
‘তোর যে নজর খারাপ স্যার বোধ হয় আগেই বুঝেছিলেন, তাই আর নিজের জীবনের রিস্ক নেননি তিনি।’
মেয়েটার কথা শুনে সমস্বরে হেসে উঠল সবাই। তমা ক্ষুব্ধ সুরে বলল,
‘এবার কিন্তু বেশি বেশি বলছিস, তিন্নি।’
তিন্নি হাসি আটকে বলল,
‘মিথ্যে কী বলেছি; নজর খারাপ না থাকলে কি আর প্রথম দেখাতেই স্যারের প্রেমে পড়ে যেতি?’
মেয়েটা লজ্জামাখা সুরে বলল,
‘অমন একটা হ্যান্ডসাম ডাক্তার, প্রেমে না পড়ে উপায় আছে?’
অন্বিতা বিরক্ত হচ্ছে তাদের কথায়। ঐ লোকটাকে নিয়ে এত আহ্লাদির কী আছে। সে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘তোমরা কেউ কফি খাবে? কফি নিয়ে আসি?’
সবাই বারণ করল, তারা আগেই খেয়েছে। অন্বিতা তাই একাই গেল কফি আনতে। কফি নিয়ে একটু আলাদা একটা বেঞ্চে বসে অন্বিতা। মাহিরকে নিয়ে মেয়েদের এত মাতামতি তার সহ্য হচ্ছে না। তবে সে জানে, এটা হিংসা নয় বরং বিরক্ত।
কফির কাপে চুমুক বসাতেই ফোনটা বেজে উঠে তার। হাতে নিয়ে দেখে “আভা”। রিসিভ করে,
‘কিরে দোস্ত, কেমন চলছে সব?’
আভার কন্ঠে যথেষ্ট উৎসাহ। অন্বিতা মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,
‘একটুও ভালো না।’
‘কেন কেন, মাহির ভাই নেই সেখানে?’
‘উনি আছে বলেই তো সময়টা খারাপ যাচ্ছে।’
আভা হাসে। বলে,
‘কী যে বলিস না তুই, অমন একটা ফিয়ন্সি থাকলে কারোর দিন আবার খারাপ যায় না-কি?’
‘হ্যাঁ, দূর থেকে বসে তোমার কাছে সবকিছু মধুর মতোই লাগবে। যে সামনে থাকে সে জানে, কোনটা মধু আর কোনটা করলা।’
‘কিন্তু মাহির ভাই তো আস্ত একটা মৌচাক, এত মধু তুই উপেক্ষা করবি কী করে?’
‘বাইরে থেকে দেখলে সবাইকেই মৌচাক’ই মনে হয়, সেই মৌচাকের ভেতরে আদৌ মধু আছে কি-না সেটা কেবল যে গভীরে যায় সে বোঝে।’
আভা গম্ভীর সুরে বলল,
‘ভাইকে নিয়ে তোর এত অভিযোগ কেন, বলতো?’
‘এমনভাবে জিজ্ঞেস করছিস, যেমন তুই কিছু জানিস না। জীবনের কোনো কথা লুকিয়েছি তোর কাছ থেকে?’
‘কিন্তু সবকিছু জেনে বুঝে দ্বিতীয় সুযোগটা তুই’ই দিয়েছিস, এখন তবে এমন করছিস কেন?’
‘বাধ্য হয়েছি আমি। দেশে ফেরার পর থেকেই উনি যা শুরু করেছিলেন, আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।’
‘শোন, সুযোগ যখন একবার দিয়েছিস তখন মন থেকে মেনে নে না। দেখ, ভাইয়া হয়তো এবার সত্যিকারের অর্থেই ভালোবাসবে তোকে।’
নিজেকে শক্ত করল অন্বিতা। বলল,
‘যখন প্রয়োজন ছিল, তখন ভালোবাসা পাইনি। আর এখন আমার সব প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে।’
‘এমন করলে তো তুই কষ্ট পাবি, অন্বিতা।’
‘সমস্যা নেই, আমার আজকাল সব সয়ে যায়। আচ্ছা, রাখি এখন; কাজ আছে।’
‘বেশ, ভালো ভাবে কাজ কর। অল দ্যা বেস্ট।’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/