#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৭।
নাস্তা সেরেই নার্সিংহোমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল অন্বিতা। কালকের মতো আজও এই দিকটায় গাড়ি পাচ্ছে না সে। অবশ্য আজ হাতে যথেষ্ঠ সময় নিয়েই বেরিয়েছে। তাই গাড়ি না পেয়েও নিশ্চিন্ত মনে হাঁটা ধরল সে। কিছুটা সামনে যেতেই ঠিক তার কাছাকাছি এসে থামল একটা গাড়ি। কপাল কুঁচকাল অন্বিতা। গাড়ির মালিককে দেখার জন্য চোখের দৃষ্টি সরু করল। গ্লাস নামল গাড়িটার। ভেতর থেকে বেশ ফরমাল গেট আপের একটা লোক বলে উঠল,
‘আপনার কি লিফ্ট লাগবে?’
অন্বিতা অবাক হলো। এই অপরিচিত, অজ্ঞাত লোকটা তাকে লিফটের অফার দিচ্ছে কেন? কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই তো?
‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমি আপনার পাশের বিল্ডিং এই থাকি। কালও আমি দেখেছি, আপনি গাড়ির জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে পরে পায়ে হেঁটে গিয়েছেন। তাই আজ ভাবলাম, আপনাকে লিফট দিয়ে একটু সাহায্য করি। আপনার আপত্তি থাকলে সমস্যা নেই।’
অন্বিতার টনক নড়ল। এই কি তবে সেই গান গাওয়া ছেলেটা? কিন্তু এই কথাটা সে জিজ্ঞেস করবে কী করে?
অপরিচিত লোকটা বলল,
‘এখনো ভরসা পাচ্ছেন না?’
অন্বিতা দুটানায় পড়ল। কী করবে বুঝতে পারছে না। লোকটাকে দেখে খারাপ মনে হচ্ছে না তার। বেশ ভদ্র, কর্পোরেট লোক লাগছে। অন্বিতা বলল,
‘আসলে, এইদিকে গাড়ি পাওয়াটা মুশকিল। সামনে মেইন রাস্তায় গিয়ে গাড়ি নিতে হয়।’
‘জি, আমি বুঝতে পেরেছি সেটা। কোথায় যাচ্ছিলেন আপনি?’
‘অপরাজিতা নার্সিংহোমে।’
‘আসুন, আপনাকে নামিয়ে দেই।’
‘আপনার আবার অফিস যেতে লেইট হয়ে যাবে না?’
‘না, আমার অফিসও ঐ রাস্তাতেই। আপনাকে নামিয়ে দিয়েই চলে যাব।’
অনেকটা ভরসা পেয়ে অন্বিতা তার গাড়িতে চড়ে বসল।
গাড়িটা চলছে আপন গতিতে। অন্বিতার ভীষণ ইচ্ছে করছে একবার জিজ্ঞেস করতে, আপনি’ই কি সেই প্রতি সন্ধ্যায় গান গাওয়া ছেলেটা? কিন্তু সংকোচ বোধের কারণে পারছে না। পরে মনে হলো, সরাসরি জিজ্ঞেস না করে একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়েও তো জানতে পারে। সেই ভেবে সে জিজ্ঞেস করে বসল,
‘আপনি কি এস আর টাওয়ার এ থাকেন?’
‘জি, এস আর টাওয়ার এর চার তালায়।’
অন্বিতা চমকাল। এই তো মিলে গিয়েছে। সে খুশি হলো মনে মনে। যাক সেই ছায়ামানবের দেখা পেয়েছে তবে। গানের মতো মানুষটাও বেশ সুদর্শন। অন্বিতা চট করে সংযত করল নিজেকে। না না, এত গভীরে ভাবা যাবে না।
নার্সিংহোমের সামনে গাড়িটা এসে থামল। লোকটাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ভেতরে চলে এল অন্বিতা। তারপর গিয়ে বসল নিজের ডেস্কে। বসার দু মিনিটের মাথায় খবর এল, ডা. মাহির ডাকছে তাকে। অন্বিতা গভীর শ্বাস টানল। এসে দু মিনিট একটু বসার জো ও নেই।
দরজায় নক করে ভেতরে প্রবেশ করল অন্বিতা। মাহির কোনো এক পেশেন্টের ইসিজি’র রিপোর্ট দেখছে। সে অন্বিতার দিকে না তাকিয়েই বলল,
‘কার গাড়িতে করে এসেছিলে?’
অবাক হলো অন্বিতা। এই লোকটা জানল কী করে? মাহির তখন নিজ থেকেই বলল,
‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই নার্সিংহোমের প্রতিটা আনাচে কানাচে সিসি ক্যামেরা আছে। এবার বলো, কে সে?’
‘পাশের বিল্ডিং এর একজন প্রতিবেশী।’
‘পুরুষ নাকি মহিলা?’
‘এত কিছু জেনে আপনি কী করবেন?’
‘কবর দিব তাকে।’
অন্বিতা আঁতকে উঠে বলল,
‘কী?’
‘তেমন কিছু না, আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিব।’
‘আমি এখনই বিয়ে করব না।’
‘বিয়ে নিয়ে তোমার মতামত জানতে চাইনি। ঐ প্রতিবেশী পুরুষ না মহিলা, সেটা জানতে চেয়েছি।’
অন্বিতা নাকের পাল্লা ফুলিয়ে নির্বিকার সুরে বলল,
‘পুরুষ।’
এতক্ষণে চোখ তুলে তাকাল মাহির। কপালের মাঝ বরাবর তিনখানা সরু ভাঁজ স্পষ্ট তার। চোয়াল শক্ত, চোখের দৃষ্টি কঠিন। বলল,
‘কাল থেকে জীবনের শেষ নিশ্বাস অবধি আমি ব্যতিত অন্য কোনো পুরুষের গাড়িতে উঠবে না।’
তাচ্ছিল্যের সুরে হাসল অন্বিতা। বলল,
‘বেশ তো, তবে কাল থেকে রিক্সা, সি এন জি, বাস এসব আর কোনোকিছুতেই আমি উঠব না। সেসব তো অন্য পুরুষ’ই চালায়, তাই না?’
‘আমি তোমার সাথে মজা করছি না, অন্বি।’
‘আমিও না, স্যার। আপনার হুকুমের এক চুলও নড়চড় হবে না, আমি বরং কাল থেকে প্যাডেলে আসব। তখন আবার লেইট হলে বকাবকি করতে পারবেন না কিন্তু।’
মাহির ক্রূর হাসল। বলল,
‘বেশ মজা নিচ্ছ দেখছি। শুনো, কাল থেকে আমার একটা গাড়ি তোমার বাসায় পৌঁছে যাবে, গাড়ি নিয়ে তোমাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।’
‘খবরদার এমন কিছুই আপনি করবেন না।’
‘অবশ্যই করব।’
‘দেখুন, কোনোপ্রকার বাড়াবাড়ি করবেন না। আমার আপনার গাড়ি লাগবে না, আমি অন্য গাড়ি করে আসতে পারব।’
‘উঁহু, আমার ফিয়ন্সির অন্য পুরুষের গাড়িতে উঠা আমি বরদাস্ত করব না। তাই আমি যেটা বলেছি, সেটাই হবে।’
অন্বিতা রাগ দেখিয়ে বলল,
‘কখনোই না। আমি আপনার গাড়িতে চড়ব না, মানে চড়ব না।’
এই বলেই চলে আসতে নেয় সে। মাহির বলল,
‘কোথায় যাচ্ছেন, ম্যাডাম? একশো তিন নাম্বার কেবিনের পেশেন্টকে দেখে এসে আপডেট জানান এক্ষুনি।’
অন্বিতা আর ফিরে না চেয়েই চলে গেল সেখান থেকে। মাহির নিজের লেপটপে মনোযোগ দিল। গাড়ির নাম্বারটা জুম করে দেখে নিল সে। তারপর কাউকে একটা কল দিয়ে বলল,
‘একটা গাড়ির নাম্বার পাঠিয়েছি; দেখতো, গাড়িটার মালিক কে।’
অতঃপর ফোন কেটে নিজের কাজে মনোযোগ দিল ফের।
একশো তিন নাম্বার কেবিনে অন্বিতা। হার্ট অ্যাটাকের পেশেন্ট এই বৃদ্ধা। বয়স বেশ। তবে অন্বিতা অবাক হলো কেবিনের ভেতরে এত মানুষ দেখে। একজন পেশেন্টের কেবিনে এত মানুষ থাকলে পেশেন্টের তো নিশ্বাস নিতেও অসুবিধা হবে। সে গিয়ে বলল,
‘পেশেন্টের খুব কাছের মানুষজন ছাড়া বাকি সবাই দয়া করে বেরিয়ে যান। এত মানুষ থাকলে পেশেন্টের শ্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা হবে।’
তখন একটা ছেলে বিরক্তের সুরে বলে উঠল,
‘আসছে কোথ থেকে, বড়ো ডাক্তার।’
অন্বিতা তার দিকে চেয়ে বলল,
‘বড়ো বা ছোট যাই হই না কেন, পেশেন্টের ভালোটা অবশ্যই চাই। সেইজন্যই বলছি, কেবিন যত খালি হবে ততই পেশেন্টের জন্য ভালো।’
‘আমাদের পেশেন্ট আমরা বুঝে নিব, তুমি যাও তো। এসব নার্সদের জ্ঞান সম্পর্কে আমাদের জানা আছে।’
অন্বিতা হতভম্ব। কী নিদারুণ অপমান। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘আ’ম অ্যা ডক্টর, আর যদি নার্সও হই, তাতেও বা কী যায় আসে? নার্সরা কি পড়াশোনা না করেই আপনাদের সেবা দিতে চলে আসে?’
‘আরে এত কথা বাড়াচ্ছো কেন? তুমি যাওনা এখান থেকে।’
অন্বিতা এবার রেগে গেল। লোকটা মারাত্মক অসভ্য। সে ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘আপনি কোন সাহসে আমাকে “তুমি” বলে সম্বোধন করছেন? আর কোন সাহসে আমাকে কেবিন থেকে বের হতে বলছেন? কেবিন থেকে বের হবেন আপনারা, আমি না। আমি পেশেন্টকে দেখব, তারপর যাব।’
ছেলেটা তার দিকে তেড়ে এসে বলল,
‘একটা সাদা পোশাক গায়ে লাগিয়ে নিজেকে একেবারে আইনস্টাইন ভেবে ফেলছো, তাই না? শুনো, তোমার এই দুই টাকার ডাক্তারির আমাদের কাছে কোনো মূল্য’ই নেই।’
অন্বিতার ভীষণ রাগ হলো। শুধুমাত্র হাসপাতাল বলে সে সংযত রাখল নিজেকে। তবে ছাড় দিল না। সে সোজা গেল মাহিরের কেবিনে। মাহির জিজ্ঞেস করল,
‘পেশেন্ট দেখা হয়ে গিয়েছে?’
অন্বিতা রেগে বলল,
‘আপনার নার্সিংহোমে কি কোনো রুলস রেগুলেশন নেই?’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘একজন পেশেন্টের কেবিনে আপনারা কতজন মানুষ এলাউ করেন?’
‘দুই থেকে তিন জন, তাও খুব প্রয়োজনে। নয়তো একজন’ই থাকে সবসময়।’
‘তবে একশো তিন নাম্বার কেবিনে দশ থেকে বারো জন মানুষ কেন? একটা ছোট্ট কেবিনে রোগীর পাশে এত জন মানুষ থাকলে রোগীটা শ্বাস ফেলবে কী করে?’
মাহির ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘এত মানুষকে অনুমতি কে দিল?’
‘তার উপর ঐ কেবিনের একটা লোক আমাকে যা নয় তাই বলে অপমান করেছেন, এসব কিছু আমাকে শুধুমাত্র আপনাদের দূর্বল কতৃপক্ষের জন্য শুনতে হয়েছে।’
মাহির চট উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘চলো, সেই দুঃসাহসিক ব্যক্তিটাকে দেখে আসি একবার।’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/