#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৮।
একশো তিন নাম্বার কেবিনে প্রবেশ করল দুজন। মাহিরকে দেখে কেবিনের বাকি মানুষগুলো একটু অপ্রস্তুত হলো বোধ হয়। বিশেষ করে সেই অভদ্র আচরণ করা ছেলেটি। মাহির শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,
‘একটু আগে উনার (অন্বিতাকে দেখিয়ে) সাথে খারাপ ব্যবহার কে করেছিলেন?’
ছেলেটা আমতা আমতা করে বলল,
‘খারাপ ব্যবহার কেউ করে নাই, ডাক্তার। আমি তো শুধু…’
বাকি কথা শেষ করার আগেই সশব্দে একটা চড় পড়ল ছেলেটার ভরপুর গালে। থ হয়ে গেল সবাই। মাহির তার দিকে খানিক এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘এটা হাসপাতাল বলে এখনো তোকে জ্যান্ত রেখেছি। নয়তো আমার ফিয়ন্সির সাথে খারাপ ব্যবহার করার অপরাধে তোকে মাটিতে পুঁতে দিতাম। ক্ষমা চা এক্ষুনি।’
ছেলেটি ঢোক গিলে বলল,
‘আমাকে ক্ষমা করে দেন ম্যাডাম, আমার ভুল হইছে।’
অন্বিতা ইতস্তত সুরে বলল,
‘ঠিক আছে, আর কাউকে কোনোদিন এমন অপমান করে কথা বলবেন না।’
ছেলেটি মাথা নাড়াল। মাহির বলল,
‘পেশেন্টের বাড়ির যেকোনো একজন লোক ব্যতিত বাকি সবাই বেরিয়ে যান।’
মাহিরের কথা মতো বেরিয়ে গেল সবাই। তারপর সে একবার গিয়ে পেশেন্টের শারীরিক অবস্থাটা দেখে নিল। সেই কেবিনের নার্সকে ডেকে এনে বলল, নিয়ম ব্যতিত যদি একের অধিক বাড়ির লোক কেবিনে থাকে তবে পরবর্তিতে সে অন্য ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। মাহিরের ঠান্ডা ধমকে ভীত হলো নার্স। তাকে আশ্বাস করে বলল, আর কখনো এমন হবে না।
মাহির কেবিনে ফিরে আসে আবার। অন্বিতা চলে যায় তার ডেস্কে। চেয়ারে বসে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাহির এখনো আগের মতোই রয়ে গিয়েছে, একজন ডেডিকেটেড প্রেমিক। আগেও অন্বিতার দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালেই সে সিংহের মতো গর্জন করে উঠত, এখনো তাই। কেবল মাঝখান দিয়ে অনেকটা সময় তাদের মাঝে বেশ দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে। নয়তো এতদিনে তাদেরও একটা সুখের জীবন থাকত। এসব ভেবে অন্বিতার আজকাল বড্ড আফসোস হয়।
পেশেন্ট দেখার মাঝেই মাহিরের ফোনে একটা মেসেজ এল। সে এক মিনিট সময় বের করে দেখে নিল মেসেজটা। সেই গাড়ির মালিকের ডিটেইলস সে পেয়ে গিয়েছে। এবার তিল থেকে তাল হওয়ার আগেই ব্যাপারটার ইতি টানতে পারলেই বাঁচে।
মধ্যাহ্নভোজের সময় এসেছে। মাহিরের সহকারী অন্বিতার ডেস্কে এল। জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কি সাথে খাবার এনেছেন, ম্যাডাম?’
‘জি, কেন?’
‘নয়তো স্যার বলেছিলেন, উনার সাথে গিয়ে খাওয়ার জন্য।’
‘আপনার স্যারকে গিয়ে বলুন, আমি খাবার এনেছি। উনি যেন উনার খাবার খেয়ে নেন।’
‘ঠিক আছে, ম্যাডাম।’
অন্বিতা মাথায় হাত দিয়ে বসে। এই লোকটা যা শুরু করেছে, আর বেশিদিন লাগবে না পুরো হাসপাতালের অবগত হতে যে, তাদের সবার প্রিয় কার্ডিওলজিস্ট মাহির আশহাবের সাথে অন্বিতার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তখন বাকি মেয়ে ডাক্তারদের আবার কোন নতুন নাটক শুরু হয়, কে জানে।
খাবার দাবারের পর একটা মিটিং ডেকেছে মাহির। অন্বিতা তাই আগে আগে গিয়েই সেই মিটিং রুমে বসে আছে। তারপর একে একে আসে বাকি সবাই। মাহির আসে কিছুক্ষণের মধ্যেই। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘কাল আমার একটা অপারেশন আছে, সেই অপারেশনে আমাকে সাহায্য করার জন্য কেউ কি আগ্রহী?’
সবাই হাত তুলল এবার। অন্বিতা জানে, সে হাত তুলুক বা না তুলুক মাহির তার নাম’ই নিবে। তাই সেও হাত তুলল। অথচ তার এত নিশ্চিয়তাকে বিফলে নিয়ে মাহির অন্য একজন ডাক্তারকে পছন্দ করল। ছেলে সে। বাকি মেয়েদের এবারও মন খারাপ। অন্বিতা মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মাহির বলল,
‘এত নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছু নেই। প্রতি অপারেশনে আমি একজন করে নিব, এবং অপারেশন থিয়েটারের ভেতর আপনার পারফরম্যান্স’টা কিন্তু লাইসেন্স পাওয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, মনে রাখবেন।’
যদিও মাহির কথাটা সবার উদ্দেশ্যেই বলেছে। তবে অন্বিতার মনে হলো, এটা যেন কেবল তাকেই বলা হয়েছে।
মিটিং শেষ হতেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল সবাই। হাসপাতালের মেইন গেইট পার হতেই অন্বিতা দেখে মাহির বাইরে দাঁড়ান। তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। এই লোকটা না তার কেবিনের দিকে গিয়েছিল, তাহলে আবার এখানে কী করছে। মাহির নিজ থেকেই এগিয়ে এসে বলল,
‘চলে আসার আগে আমাকে বলে এসেছ?’
‘আপনি তো মিটিং এ থাকা অবস্থাতেই সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন, নতুন করে আর বলার কী আছে?’
‘অবশ্যই আছে। সবাইকে ছুটি দিয়েছি, তোমাকে না।’
অন্বিতা বিরক্তির সুরে বলল,
‘কলেজ পড়ুয়া ছেলেরা যখন নতুন নতুন প্রেমে পড়ে তখন এমন আচরণ করে; আপনার মতো একজন ম্যাচিউরড ডাক্তারকে এসব মানায় না।’
মাহির হাসল। অন্বিতার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
‘আমাকে তবে কী মানায়?’
‘জানি না আমি।’
‘তাহলে আমার এমন আচরণ’ই তোমাকে সহ্য করতে হবে।’
‘দেখুন স্যার, আমি চাই না হাসপাতালে আপনার আমার সম্পর্ক নিয়ে কোনো আলোচনা সমালোচনা হোক। তাই অন্তত হাসপাতালে থাকা অবস্থাতে আপনি আমার সাথে এই ধরণের আচরণগুলো করবেন না।’
‘কে কী বলল তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’
অন্বিতা কঠিন স্বরে জবাব দিল,
‘তবে আমার আসে। আমি চাই না কারোর সমালোচনার পাত্রী হতে।’
‘কারোর এমন সাহস’ই হবে না, আমি হতে দিব না।’
‘কী করবেন, আজকের মতো মেরে ধরে মানুষের মুখ বন্ধ করবেন? এটা কি একজন ডাক্তারের স্বভাবের সাথে যায়?’
‘আমার ভালোবাসার অপমান আমি কোনো অবস্থাতেই বরদাস্ত করব না।’
অন্বিতা ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘তবে সেদিন কেন বরদাস্ত করেছিলেন?’
থামল মাহির। মুহুর্তেই কথা হারাল সে। অপরাধ বোধটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল যেন। অসহায় সুরে বলল,
‘চিন্তা শক্তি লোপ পেয়েছিল হয়তো। সেদিনের জন্য নিজেকে আমি আজও ক্ষমা করতে পারিনি।’
‘না পারুন। আমি দোয়া করি, আপনার অনুশোচনা আপনাকে কুরে খাক।’
‘এমন বদদোয়া দিও না।’
অন্বিতা কথা বাড়াল না আর। চলে এল সেখান থেকে। মাহির চেয়ে রইল সিক্ত চোখে। অন্বিতার ভালোবাসা পাওয়ার আকাঙ্খায় বক্ষস্থল আজ হাহাকার করছে। অথচ মেয়েটা বুঝতেই চাইছে না।
অন্বিতা তার বাসার গেইটের সামনে নামতেই দেখল সেই ছেলেটির গাড়িও এসে নিজ বিল্ডিং এর সামনে থেমেছে। অন্বিতা ভাবে, ছেলেটা এখন নেমে এসে তার সাথে কথা বলতে চাইলে, সে জিজ্ঞেস করে ফেলবে, প্রতিদিন সন্ধ্যায় গানটা সে’ই গায় কি-না। কিন্তু অন্বিতাকে আশায় ফেলে, ছেলেটা তাকে খেয়াল না করেই উপরে চলে গেল। অন্বিতাও আশাহত হয়ে তখন চলে এল নিজের বাসায়।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল অন্বিতা। কাঙ্খিত বারান্দার দিকে নজর তার। ছেলেটা কি একবার বেলা থাকতেই বারান্দায় আসতে পারে না? কেন সন্ধ্যা হলেই আসতে হয় তাকে? আজ যদি একটু ব্যতিক্রম হতো? আজ যদি এই বিকেলেই বারান্দায় গিটার সমেত হাজির হতো সে। তবে হলো না তেমন কিছুই। ভগ্ন হৃদয়ে নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়ল অন্বিতা। শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতেই মনে হলো, সে ঐ ছেলেটাকে নিয়ে একটু বেশিই ভেবে ফেলছে না তো? যদি এমন হয়, তবে তো সেটা মোটেও উচিত নয়। সে তো নিজেকে ওয়াদা করেছিল, আর কাউকে নিয়েই ভাববে না। না না, সে এই ওয়াদার খেলাপ আর হতে দিবে না।
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/