#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৯।
সন্ধ্যা নামল। ফর্সা চকচকে আকাশ ছেয়ে গেল অন্ধকারে। তথাপি পশ্চিম দিকটায় এখনো কিছু লাল আলো স্পষ্ট। তবে চারপাশ ঘোলাটে অন্ধকার। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে আজ আর অন্বিতা বারান্দায় গেল না। বরং চুপচাপ নিজের বিছানার উপর জানলার কাছটায় বসল। দৃষ্টি যদিও ঐ বারান্দার দিকেই। সে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ বাদেই দেখল ছেলেটা বারান্দায়। হাতে গিটার। স্পষ্ট না দেখা গেলেও বোঝা যাচ্ছে সব।
বেশ অনেকক্ষণ ছেলেটা একই ভাবে বারান্দায় দাঁড়ান। না, আজ গান গাইছে না। অন্বিতাও বসে বসে চুপচাপ দেখছে তাকে। যদিও চেহারাটা তার এখনো অস্পষ্ট’ই রয়ে গিয়েছে।
অনেকটা সময় পার হবার পরেও আজ আর সে সুর তুলছে না। অন্বিতা উঠল এবার। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। তাকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠল ছেলেটার গিটার। ভ্রু কুঁচকাল অন্বিতা। মস্তিষ্কে হানা দিল নানান চিন্তা। ছেলেটা কি তবে এতক্ষণ তার’ই অপেক্ষাতে ছিল? কী আশ্চর্য!
রোজকার মতো গান গেয়ে ভেতরে চলে গেল অজ্ঞাত ব্যক্তিটি। অন্বিতা তাও কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। এই ছেলেটা তাকে আজকাল বড্ড দুশ্চিন্তা দিচ্ছে, বিভ্রান্ত করছে। এমনিতেই বক্ষস্থলে শান্তি নেই, তার উপর আবার নতুন অশান্তি শুরু করেছে এই ছেলে। অন্বিতা গভীর ভাবে শ্বাস টানল। ভেতরে চলে এল সে। জীবনের স্রোত যে কোথ থেকে কই নিয়ে যাচ্ছে কে জানে।
পরদিন সকালে চটপট তৈরি হয়ে নিচে নামল অন্বিতা। গিয়েই শঙ্কিত হলো সে। গেইটের সামনে বিশাল গাড়িটা তার’ই অপেক্ষায়। অন্বিতা শীর্ণ বক্ষে এগিয়ে গেল। গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে ড্রাইভার বলল,
‘ম্যাডাম, মাহির স্যার পাঠিয়েছেন।’
অন্বিতা হতাশ হলো। জলদগম্ভীর স্বরে বলল,
‘আপনি চলে যান, আমি একাই যেতে পারব।’
লোকটি নিচু, অসহায় সুরে বলল,
‘আমি খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে গেলে আমার চাকরিটা আর থাকবে না, ম্যাডাম।’
চমকাল অন্বিতা। বলল,
‘কেন থাকবে না?’
‘স্যারের আদেশ, কোনোভাবে অমান্য হলে স্যার আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিবেন।’
নিজের রাগ, ক্ষোভে একটা অসহায় মানুষের বিপদ হোক সেটা অন্বিতা চায় না। অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও সে গাড়িতে উঠে বসল তাই।
_________
অন্বিতাকে তার গাড়ি থেকে নামতে দেখে খুশি হলো মাহির। কেবিন থেকে বেরিয়ে অন্বিতার ডেস্কের দিকে গেল। সেই কক্ষে ঢুকতে নিয়েও মাহিরকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল অন্বিতা। মাহির দেখল তাকে। চমৎকার হেসে এগিয়ে এল। বলল,
‘শুভ সকাল।’
‘শুভ সকাল।’
পাশ কাটিয়ে চলে আসতে চায় অন্বিতা; মাহির বলে উঠে,
‘চলে যাচ্ছো যে, আমার কথা তো এখনো শেষ হয়নি।’
অন্বিতা থামল। ক্ষীণ সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘আর কী বলতে চান?’
‘কাল দাদা ফিরেছেন, আমি দাদাকে নিয়ে আজ’ই তোমাদের বাড়িতে যাব।’
ভ্রু কুঁচকাল অন্বিতা। জিজ্ঞেস করল,
‘কেন?’
‘বিয়ের তারিখ পাকা করতে।’
অন্বিতার বিভ্রান্ত দৃষ্টি। কথার খেই হারায় যেন। নিরেট গলায় বলল,
‘আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাই না।’
‘বয়স পঁচিশ, এটা মেয়েদের বিয়ের জন্য তাড়াতাড়ি নয়, বরং পারফেক্ট বয়স।’
অন্বিতা কপাল গুটাল। রূঢ় সুরে বলল,
‘আমার জন্য কোনটা পারফেক্ট সেটা আপনার চেয়েও আমি বেশি বুঝি। আমি এখন বিয়ে করব না মানে করব না।’
মাহির এগিয়ে এল তার দিকে। অতি সন্নিকটে এসে রাশভারী সুরে বলে,
‘বিয়ে তোমাকে করতেই হবে, অন্বি; আর সেটা খুব শীঘ্রই।’
মাহির চলে গেল। স্তব্ধ, নির্বাক অন্বিতা চেয়ে রইল অযথাই। কেন হচ্ছে এসব? কেন? সে তার জীবনে মাহিরকে আর চায় না, এটা কেন প্রকৃতি মেনে নিতে চাইছে না? কোন দোষের শাস্তি তাকে এভাবে দিচ্ছে?
নিজের মতো করে পেশেন্ট দেখে আজ আগে আগেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়েছে অন্বিতা। মাহিরকে বলে আসার কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি। আসার সময় মাহিরের গাড়িতেও আর চড়েনি। একাই রওনা করে।
যাওয়ার পথে একটা পার্ক পড়ে তার। আজ কী ভেবে যেন রিক্সাটাকে সে সেখানেই থামতে বলে। ভাড়া মিটিয়ে পার্কের ভেতরে আসে। স্কুল ছুটি হয়েছে, বাচ্চারা এখানে এসে খেলছে এখন। অন্বিতা একটা জায়গায় চুপচাপ গিয়ে বসল। বাচ্চাদের ছোটাছুটির, আর হাসির খিলখিল শব্দ কানে বাজছে তার। ভালো লাগছে। এদিক সেদিক দেখছে। ভ্যানে করে আইসক্রিম বিক্রি করছে এক লোক। ইচ্ছে হলো আইসক্রিম খাবে। উঠে দাঁড়াতেই থমকাল সে। পরিচিত একটা সুর কানে এল তার। চমকাল। তাকাল আশেপাশে। কিন্তু যুতসই কিছু পেল না। চিত্ত জুড়ে অস্থিরতা দেখা দিল তাতে। প্রখর কৌতুহলে আশপাশটা দেখে ফেলল ভালো মতো। এই সুরটা চেনে সে, প্রতিদিন সন্ধ্যা তো তার এই সুর শুনেই শুরু হয়। কিন্তু এই সুরের মালিক কে? কোথায় সে। অন্বিতা আশেপাশে সব জায়গা খুঁজে ফেলে। কিন্তু কাউকে পায় না। বিষন্ন মনে আকাশের দিকে চাইল। জীবনের এত হতাশার মাঝে এই নিভু উত্তেজনার দেখা মিলল কেন? কেন হঠাৎ এই সুরের মানুষের আগমন ঘটল? কোন উদ্দেশ্যে?
ফিরে আসতে নেয় অন্বিতা।
‘আরে, আপনি এখানে?’
অন্বিতা দাঁড়াল। পেছন ফিরে চাইল সে। পরিচিত মুখ দেখে প্রসন্ন হাসল। বলল,
‘এমনিতেই, একটু রিফ্রেশমেন্টের জন্য এসেছিলাম।’
‘ওহ, আমিও তাই। অফিসের এত চাপে বিরক্ত হয়ে বন্ধুকে নিয়ে এখানে এসেছি। এখন কি চলে যাচ্ছিলেন?’
‘জি।’
‘কোথায় যাবেন, হাসপাতালে না বাসায়?’
‘এখন বাসায় চলে যাব।’
‘চলুন তবে, আমিও বাসায়’ই যাব।’
‘না না। আমি একা যেতে পারব।’
‘একই তো রাস্তা। তবে অসুবিধা কীসের?’
অন্বিতার তখন মাহিরের কথা মনে পড়ে যায়। মাহিরের ঠান্ডা স্বরের হুমকিকে ভয় পায় সে। তাও নিজের জেদ ধরে রাখতে বলল,
‘ঠিক আছে, চলুন।’
গাড়িতে বসল দুজন। অন্বিতার মনে অন্য ভাবনা। গানটা কি তবে এই লোকটাই গাইছিলেন? ইতস্তত সুরে অন্বিতা জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা, আপনার নাম কী?’
ছেলেটা তার দিকে একবার চেয়ে বলল,
‘অমিত, অমিত দে।’
অন্বিতা খানিকটা চমকাল। তারমানে সে হিন্দু। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল তাই। যাক অবশেষে বেহায়া মনকে বোঝানোর কোনো এক কারণ তো সে পেয়েছে।
বাসার ঠিক সামনে চলে এসেছে। অন্বিতা কী ভেবে যেন আবার জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কি গান করেন?’
অমিত বলল,
‘ঐ টুকটাক, তবে বেশি না।’
‘গিটার বাজাতে পারেন নিশ্চয়?’
অমিত হেসে বলল,
‘না না, গিটার আমি জানি না। তবে ছোটবেলায় তবলা বাজানোটা শিখেছিলাম, যদিও সময়ের স্রোতে এখন সব ভুলে বসেছি।’
অবাক হলো অন্বিতা। তারমানে কি বারান্দায় গান গাওয়া ছেলেটা অমিত নয়, অন্যকেউ?
বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামতেই অন্বিতা ছেলেটাকে বিদায় জানিয়ে চলে আসে। বাসায় ঢুকা মাত্রই মনে হয়, বেশ একটা আয়োজন চলছে বোধহয়। ঘরদোর আজ একটু বেশিই পরিষ্কার। অন্বিতা রান্নাঘরের দিকে যায়। দেখে একসঙ্গে আজ মা অনেক রান্নার আয়োজন করছে। সে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
‘আজ এত আয়োজন কেন, মা?’
আসিয়া বেগম প্রসন্ন হেসে বললেন,
‘মাহির আমাকে কল দিয়েছিল। বলেছে, সে তার দাদাকে নিয়ে আজ’ই আসবে।’
পিলে চমকে উঠে অন্বিতার। সশব্দে বলে উঠে,
‘না, কখনোই না।’
চলবে….
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/