যাতনা_আমার #সানজিদা_ইসলাম_সূচনা #পর্ব : ১৮

0
314

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব : ১৮

( কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

ইশানের ঘরে উকি দিচ্ছে নিধি। দরজাটা হালকা ভিড়ানো ছিল। শূন্য ঘর দেখে পা টিপে রুমে ঢুকে নিধি। ইশান নিশ্চয়ই ওয়াশরুমে। নিধি ঘরময় কিছুক্ষন ঘুুরে কাবার্ট থেকে ইশানের একটা টিশার্ট নিয়ে নেয়। প্রায় সময় সে ইশানের পছন্দের কাপড় নিজের কাছে রেখে দেয়। নিধি এবার ওয়াশরুমের দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই, দেখে সেটা খুলা। নিধি ভ্রু কুঁচকায়। এতো রাতে কই যাবে ইশান নিচেও তো নেই। নিধি ভাবলো আয়েশা মির্জার রুমে আছে নিশ্চয়ই। সেটা ভেবে নিধি দাদির রুমের দিকে অগ্রসর হয়। দরজার কাছে আসতেই থমকায় সে। ভালো করে খেয়াল করে দেখতে পায়। তার বাব-মা, চাচা-চাচি আয়েশা মির্জার শিয়রে বসে রয়েছেন। আয়েশা মির্জা পান চিবুচ্ছেন। আর তিরিক্ষ দৃষ্টিতে দুই ছেলে আর ছেলের বউদের পরিক্ষা করছেন। আয়েশা মির্জা বাদে বাকি চার জনের মুখ থমথমে। আয়েশা মির্জা এবার সুর টেনে বলে উঠেন,

-” তা আমার এক কথা শুনেই তোমারা এমন ছইলেন্ট হয়ে আছো কেন? ”

নাওয়াজ মির্জা এবার মুখ খুললেন। তিনি শান্ত স্বরে বলে ওঠে,

-” মা সাইলেন্ট হবে। ছইলেন্ট নয়। ”

আয়েশা মির্জা এবার মুখ কুঁচকালেন। তিনি অত্যন্ত বিরক্তি সহিত বললেন,

-” তোকে এখানে আমার ভুল ধরতে বলি নাই। ডিটিশন নিতে বলেছি। ”

-” মা ওটা ডিসিশন হবে। ”

আয়েশা মির্জা এবার রক্ত চোখে নাওয়াজ মির্জার দিকে তাকায়। চুপ হয়ে যান তিনি। অতঃপর সোহানা এবার গম্ভীর মুখে বলেন,

-” মা আপনি যেটা বলছেন সেটা কি আদেও সম্ভব? ”

-” সম্ভব কেনো নয় বড় বউমা। ব্যপারটা তাদের আমরা আগে থেকেই জানিয়ে দিবো ওদের। ”

নিধি ভ্রু কুঁচকায়। কি বিষয়ে তারা এমন করে কথা বলছেন? তা বোধগম্য হচ্ছে না তার। তবু আড়ি পেতে রইল বাকিটা শুনতে।

নিপা এবার কাচুমচু করে মিনমিনে স্বরে বলে ওঠে,

-” ওদের ও তো নিজস্ব মতামত, পছন্দ থাকতেই পারে। ”

-” না নেই। থাকলে দুজনেই আমাকে আরো আগেই বলে ফেলতো। ”

বাজখাঁই গলায় বলে ওঠে আয়েশা মির্জা। নিপা চুপসে যায়। নাহিদ মির্জা এবার মুখ খোলেন,

-” এটা কেমন দেখাবে না মা? পাড়াপ্রতিবেশি কি বলবে? ”

-” পাড়াপ্রতিবেশি কি আমাদের খাওয়াই না পড়ায়? যে তাদের কথা এতো ক্ষনে ক্ষনে চিন্তা করতে হবে। আমরা তো কোনো অবৈধ কাজ করবো না নাকি? এখন তোরা বল? তোদের নিধি আর ইশানের বিয়েতে কোনো আপত্তি আছে নাকি? ”

কথাটা শ্রবণ হতেই নিধি থমকে যায়। ভেতরে যেন ড্রাম বেজে চলছে। তরতর করে ঘেমে একার হয়ে যাচ্ছে নিধি। না সে তো কোনো ভুল শুনছে না। আসলেই দাদি তার আর ইশানের কথা বলেছেন। খুশীতে নাচতে মনে চায়ছে নিধির। এতো সহজে মানুষটাকে পেয়ে যাবে ভাবতে পারেনি সে। ইশান কে তো কবেই মন দিয়ে বসে আছে। শুধু ভয়ে ছিল ফ্যামিলি আর ইশান কি ভাবে নেবে। খন আয়েশা মির্জাকে দৌড়ে একটা শক্ত হাগ দিতে মন চাইছে তার। এখন ভালোই ভালোই বাবা-মা মেনে নিলেই হয়।

নাহিদ মির্জা এবার নাওয়াজ মির্জার দিকে তাকায়। দুজনেই আবার চোখ রাখেন সহধর্মিণীর দিকে। নিপা একবার সোহানার দিকে তাকিয়ে খুশি মনে বলে,

-” আমাদের নিধির আর ইশানের বিয়ে নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। ইশান আর নিধি রাজি হলেই হবে। ”

সবাই যেন একটু প্রসন্ন বোধ করে। আয়েশা মির্জা এবার হেঁসে বলে ওঠেন,

-” তোমরা চিন্তা করো না। ওদের আমি রাজি করাবো। ”

-” আমার একটা শর্ত আছে। ”

সহসাই বললেন সোহানা মির্জা। নিধি এবার ভয় পায়। মা জানি কি বলে? সবাই প্রশ্নবিদ্ধ মুখে তাকায় সোহানার দিকে।

-” যতদিন না নাভান আর ইনায়ার ডিভোর্স হচ্ছে। ততদিন এই বিষয়টা আমাদের মধ্যেই থাক। ”

সবাই সহমত প্রকাশ করে। নিধি এবার দৌড়ে নিজের রুমে যায়। চোখ বেয়ে সুখের অশ্রু বয়। ইশানের টিশার্ট টা গায়ে জড়িয়ে। নিচের দিকটা গিট দিয়ে ছাদে যায় নিধি। ইশান ছাদের রেলিঙে বসে এতোক্ষণ তিথির সাথে কথা বলছিল। বৃষ্টিটা কিছু কমে শীতল বাতাস বইছে। হটাৎ ছাদে কারো আগমনে পিছন ফিরে ইশান। চটজলদি ফোন কেটে দেয় তার। হাসিমুখে নিধি এবার ইশানের সামনে দাড়ায়। ইশান নিধিকে আপাদমস্তক দেখে তেতে উঠে।

-” এটা কি করলি গাধি? আমার ফেবারিট টিশার্ট ছিল এটা। খোল এটা। নষ্ট করে দিলিতো একেবারে। ”

নিধি এবার মুখ বাঁকায়। কয়দিন পরে তো নিধি পুরো মানুষটাকেই নিজের করে ফেলবে। তখন কি রিয়াকশন দেবে ইশান? আচমকা হেঁসে উঠল নিধি। ইশান অবাক হলো। এই মেয়ে আজকে বকা খেয়ে হাসছে? আর সময় তো বকা খেয়ে মুখ আধার করে ফেলে।

-” ঠিক আছিস তো গাধি? নাকি তোর উপর কোনো ভুতে ভর করেছে? ”

নিধি শান্ত চোখে তাকায় ইশানের পানে। অবাক চোখে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে আছে ইশান। হঠাৎ গাড়ির হন বেজে উঠায় দুজনেরই ধ্যান ভাঙে। একযোগে নিচে তাকাতে উভয়ই চিৎকার দিয়ে উঠে,

-” ভাইয়া এসেছে? ”

মুখটা মলিন করে ইনায়া বসে আছে। তিথি তখন থেকে এটাসেটা জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাচ্ছে না। খাবার সামনে তিথি অনেক্ক্ষণ পায়চারি করে রেখে দেয়। অনেকগুলো ব্যাগ সামনে এনে রাখে তিথি। ইনায়া জিজ্ঞেস সুত্রে তাকালেই তিথি বলে,

-” নিধি এসেছিল আজ। এইগুলো নাকি তোমার জন্য কিনেছে। বলেছে সব গুলো ট্রাই করতে। ”

ইনায়া বিশেষ কিছু গুরুত্ব দেয় না। আবারও উদাসীন হয়ে রয়।

-” কি হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা? বলতে পারো। ”

ইনায়া ম্লান হাসে। তিথি হতাশ হয়ে ফোন নিয়ে বসে পরে। ইনায়া কাপড়ের ব্যাগ গুলো সড়িয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টি এখন নেই। বাইরে পুরো নিশি রাতের আধারে ঢেকে রয়েছে। মাঝেমধ্যে শুনা যাচ্ছে ব্যাঙসহ কোনো এক নাম না জানা প্রাণীর ডাক। হঠাৎ তিথি ডাকতেই ইনায়া পিছন ফিরে। তিথি ফোন হাতে আতংক নিয়ে ইনায়াকে দেখিয়ে বলে,

-” দেখো না ইনায়া। এফবি তে এই ছবিটা ভাইরাল হয়েছে। কে জানি এই দুটো লোক কে পিটিয়ে, উলঙ্গ করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে। স্থানীয়দের চোখে পড়তেই, কয়েকজন মিলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। কি একটা অবস্থা দেশের। মধ্যবয়সী বাপদেরও ছাড়ে না। ”

ছবি দেখে ইনায়ার চোখ উলটে যাবার উপক্রম। কারণ ছবিতে সন্ধ্যার সে দুই লোককে দেখা যাচ্ছে। ইনায়া ভীতি হয় প্রচুর। কে করতে পারে এদের এমন অবস্থা? ইনায়া মনে মনে একটু শান্তি পায়। হঠাৎ ইনায়ানর ফোনের নোটিফিকেশন আসে। অচেনা নাম্বার সেটা। ‘ এইবার খুশি তো বোকা হরিণী? ‘ মেসেজ টা দেখে ইনায়া অবাক হয়। এটা কার নাম্বার? এই নামে তো জায়ান তাকে ডাকে। ইনায়া কিছুক্ষণ নিরবে ভাবে। তৎক্ষনাৎ তার টনক নড়ে এই কাজ ওই গুন্ডাটাই করেছে। কিন্তু জায়ান কি করে জানলো? রাগতেই নাকের পাতি গুলো ফুলেফেঁপে উঠে ইনায়ার। তিথি ফোন থেকে চোখ সড়িয়ে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বলে,

-” তুমি এইভাবে ফুঁসছো কেন? আবার কি হলো? ”

-” কিছুনা ”

তিথি ঠোঁট উলটে ফোন রেখে ওয়াশরুমে যায়। ইনায়া জায়ানের নাম্বার ঠুকে ফোন করে। কিছুক্ষণ যেতেই ফোন রিসিভ করে জায়ান। ইনায়া রেগে বলে,

-” ওই লোকগুলোকে আপনি মেরেছেন? ”

-” ওয়েট হরিণী! জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাও তো। ”

ইনায়া তাকায়। জায়ান মুচকি হেসে উঠে বলে,

-” দেখতো তোমার আকাশে ক’টা চাঁদ উঠেছে? ”

এমন প্রশ্নে রেগে যায় ইনায়া। চাঁদ আবার ক’টা উঠবে। চাঁদ তো একটাই। একটাই উঠবে? ইনায়া রাগে দাঁতেদাঁত চেপে বলে,

-” বৃষ্টি রাতের আকাশে আমি চাঁদ খুঁজে পাইনি। আপনি বলুন আপনার আকাশের খবর? ”

-” আমার আকাশে এতোক্ষণ একটাই ছিল। আপনি স্বরণ করে দুটোই করে দিলেন। ”

জায়ান বলতেই ইনায়া তেতে উঠে।

-” ফালতু কথা রাখুন। ওই লোক গুলো কে আপনি মেরেছেন? ”

-” এটা কোনো কথা? আমি ওই লম্পটদের মেরে হাত নোংরা কেন করবো? আমি মারিনি। তবে? আমার লোকজনদের দিয়ে মার খাইয়েছি এন্ড ঝুলিয়ে দিয়েছি। ”

কি দারুণ স্বীকারোক্তি? ইনায়া অবাক হয়ে বলে,

-” আপনি আমার পেছনে স্পাই লাগিয়ে ছিলেন? ”

জায়ান উচ্চ স্বরে হেঁসে ওঠে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে বলে,

-” আপনার দিকে কোনো পিঁপড়ার চোখ পরলেও আমার কষ্ট হয়। সেখানে আস্ত দু’জন মানুষকে আমি কি করে সহ্য করবো? বলেন তো হরিণী। কি নিদারুন যাতনায় আমি প্রতিদিন ডুবছি। কেন যানি হাড়িয়ে যাচ্ছি মায়ার অতল গহ্বরে। এর উত্তর কি আপনার কাছে আছে হরিণী? ”

ইনায়া চমকায়, হতবিহ্বল হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো আচমকা কেঁপে উঠে। জায়ানের কথার মানে কি?
ইনায়া যেন ঘামছে এবার। ঠোঁট নাড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” কি বলতে চাইছেন আপনি? কি চাই আপনার? ”

জায়ান এবার জোরে হেসে উঠে। তারপর অন্য প্রাসঙ্গিক টেনে বলে,

-” তোমার জন্য বাবা একটা গিফট পাঠিয়ে ছিল। পেয়েছো তো? ”

হঠাৎ করেই কথা বদলানো তে ইনায়া আর জায়ান কে আর ঘাটে না। সে নিরুত্তর রইল জায়ানের কথায়। জায়ান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,

-” তোমার টেবিলে একটা খাম আছে। খামটা খুলে হলের বেলকনিতে চলে আসো। ”

বলেই ফোনটা রেখে দেয় জায়ান। ইনায়া টেবিলে তাকাতে দেখতে পায়। সত্যিই একটা খাম রাখা সেখানে। ইনায়া সেটা নিয়ে খুলতেই স্তব্ধ হয়ে রইলো। চোখগুলো পানিতে টইটম্বুর হলো। যা গড়িয়ে পরে গলদেশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য এমন পরিস্থিতি খুবই জঘন্যের। কোনো মেয়ে এমন পরিস্থিতিতে না পরুক। তিথি বের হয়ে ইনায়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। ইনায়ার হাতে ডিভোর্স লেটার দেখে মুখ মলিন করে। সন্ধেবেলায় জায়ান এটা নিয়ে এসেছিল। তিথি চুপটি করে বিছানায় শুয়ে পরে। ইনায়া শান্তনা দেবার মতো কোনো ভাষা নেই তার কাছে। ইনায়া ভাবে, সে কেনো সুখি হতে পারল না। তার কি কোনো অধিকার নেই স্বামির সাথে সুখে থাকার। তার এই ছোট্ট জীবনে কোনো অন্যায় করেনি। তাহলে কেন তার এতো কষ্ট? বাবা মায়ের কথা আজ বেশি করে মনে পরছে ইনায়ার। ফোনে মেসেজ আসায় ইনায়া উঠে দাঁড়ায়। ডিভোর্স পেপার টা হাতে নিয়ে দরজা খুলে বের হয়। গন্তব্য হলের বেলকনিতে। হলের প্রত্যেক তলায় দুপাশে রুম মাঝ দিয়ে সুরু রাস্তা বয়ে বিশাল বেলকনিতে গিয়ে ঠেকেছে। ইনায়া বেলকনিতে দাঁড়াতেই দেখে, ল্যাম্পপোস্টের হলদে নিয়ন বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে জায়ান কে। হাতে কালো একটা ছাতা ধরানো। পিছনে কালো মার্সিডিজ। ইনায়া কে দেখে মুচকি হেঁসে ওঠে জায়ান। ইনায়া জায়ান কে কল দেয়। জায়ান ফোন রিসিভ করে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলে ওঠে,

-” কি ব্যাপার? গিফট পেয়ে তো মানুষ খুশি হয়। তুমি কাঁদছ কেন? ”

ইনায়া ম্লান হাসে। কম্পিত ধরা কণ্ঠে বলে,

-” এই উপহার নিদারুণ নিষ্ঠুর এক কষ্টের সমাহার। এর চেয়ে মৃত্যুই বুঝি খুব সুখকর। ”

জায়ান ইনায়ার পানে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। ঠোঁট নাড়িয়ে আস্তে করে বলে,

-” এতো যাতনা পেয়েও তার প্রতি এতো টান? ইশ্ কি নিষ্ঠুর ভাগ্য তার। পেয়েও হারাতে হয়েছে। এখনো ফিরে পেতে চাও তাকে? ”

ইনায়া জায়ানের দিকে তাকিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে। অতঃপর বিরবির করে বলে ওঠে,

‘ ও নিকষ কালো রাতের আধার, বলে দিও ওরে!
ছেড়েছি তারে, চিরতরে!
নেই কোনো অধিকার, তার প্রতি আর।
যেটুকু আছে, সেটুকু হয়ে থাক যাতনা আমার! ‘

ইনায়ার বেদনাসিক্ত কথার সাক্ষী শুধু এই আধার নয়। হয় জায়ানও। যে মনেপ্রাণে সপে যায় এই মেয়ে যেন আর দুঃখ না পায়।

চলবে…………

( সবাই গঠন মূলক কমেন্ট করবেন প্লিজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here