#তবু_আমারে_দেবোনা_ভুলিতে 💖
#মেহেরিন_আনজারা_নিশা 💖
#পর্বসংখ্যা-(১৮)
________________________
রহিমা খালাকে ছুটি দিয়ে মিঠির ফ্রেন্ডরা কিচেনে রান্না-বান্না করছে। আজ তন্দুরি চিকেন করবে। গোপিকারা তো আবার গরুর মাংস খাবে না। ওরা না খেলে বাকিদের মুখে কিভাবে উঠবে? তাই চিকেন তন্দুরিই করবে। যাতে সবাই খেতে পারে। সবাই মিলেই নানান কথা বলতে বলতে রান্না-বান্না করছে। দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বিকেলের দিকে চলে যাবে ওরা। মোশাররফ সাহেব মলিন মুখে বসে আছেন সোফায়। শেহজাদের সাথে মেপে মেপে টুকটাক কথা বলেছিলো। তবে শেহজাদ বুঝতে পারলো মোশাররফ সাহেবের মন ভালো নেই। কোন একটা বিষয় নিয়ে চিন্তিত। শেহজাদের সাথে মিঠিকে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে দেখে মোশাররফ সাহেব আর কিছু ভাবতে পারলেন না। এতো সহজেই এমন একটা ছেলেকে মিঠির পক্ষে কিভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব!? এটা পরবর্তী কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস নয়তো?সেই টেনশনেও তিনি বুঁদ হয়ে রইলেন। কাছে এসে মিঠি বসলো।
“তোমার মন খারাপ কেনো আব্বু?”
“কিছু না।”
“কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?”
“ওই তোমাকে নিয়ে একটু।”
“চিন্তার কিছু হয়নি আব্বু।”
“শেহজাদ..”
“তার সব জেনেশুনেই তাকে মেনে নিয়েছি আব্বু।”
আর কিছু বলতে পারলেন না। মেয়ে যদি মেনে নেয়,তাহলে উনি আর কী করতে পারবেন? দুপুরে খেয়ে-দেয়ে বিকেলের দিকে চলে গেলো ওরা। সারাদিন মিঠি স্বাভাবিক আচরণ করেছিলো বাবা এবং শেহজাদের সাথে।
____
পরের দিন সকালে মোশাররফ সাহেবের অফিস থাকলেও যায়নি,চিন্তামগ্ন হয়ে সোফায় বসে রইলেন। বার-বার দেয়ালঘড়িতে সময় দেখছেন। এইতো আর কিছুক্ষণের মধ্যে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যেই এসে পড়বেন আহসান সাহেব। শেহজাদ রেডি হয়ে অফিসে যেতে নেয়। আচমকা কলিংবেল বেজে উঠে। মিঠি নিজেই ডোর খুলতেই দেখলো আহসান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘ ২৪ ঘন্টার অধিক জার্নি করে তিনি সবে পৌঁছালেন। কোনকিছু চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়লো মামার বুকে। যদিও এমনটা প্রতিবার হয় তাই তিনি সামলে নিলেন। আবেগেআপ্লুত হয়ে মামার বুকে মুখ থুবড়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো মিঠি। ভেতরে ঢুকেন আহসান সাহেব। মিঠির কান্না থামানো যাচ্ছিলো না। লক্ষ্য করলেন মোশাররফ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন,ভয়ার্ত চোখ-মুখ। উনার থেকে একটু দূরে শেহজাদ দাঁড়িয়ে। শেহজাদকে ঠিক চিনতে পারলেন না। মাথা নুয়ে সালাম দিলেন মোশাররফ সাহেব,শেহজাদও দিলো। শেহজাদের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন।
“ও কে মিঠি?”
আমতা আমতা করে মোশাররফ সাহেব বললেন,”আমি বলছি। মিঠি তুমি যাও।”
“কী বলবে তুমি?”
“ইয়ে..মানে..!”
মোশাররফ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন আহসান সাহেব। শেহজাদ বুঝতে পারলো অবস্থা বেশ সুবিধার নয়। বরং সে এখান থেকে চলে গেলে ভালো হয়। শেহজাদ মিঠিকে বলে চুপচাপ বেরিয়ে যায়। এটাই ভালো মনে করলো। যতটুকু বুঝতে পারলো মিঠির মামা হয়। রাগের বশবর্তী হয়ে যদি কোনো অপমান করে ফেলে তাহলে সেটা শেহজাদ মেনে নিতে পারবে না। খুব কষ্ট হবে। তারচেয়ে বরং তার পেছনে যা ইচ্ছে তাই করুক! তৃপ্তশ্বাস ফেললো শেহজাদ। চলে গেলো অফিসে।
“ওই ছেলেটা কে মোশাররফ?এখানে কেনো?”
“মিঠির স্বামী।
“হোয়াট!?”
মাথা নুয়ে ফেললেন।
“জি ভাইজান।”
স্তব্ধ এবং বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন মোশাররফ সাহেবের মুখের দিকে। মনে হয় না মিথ্যে বলেছে।
“এ কী করে সম্ভব!?”
মোশাররফ সাহেব কিছু বলতে পারলেন না। কাচুমাচু করতে লাগলো।
“আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না,মানে কিভাবে কি হলো? মিঠি,এইসব কী শুনছি?”
মাথা নাড়ালো মিঠি। মিঠিকে ছাড়িয়ে আচমকা মোশাররফ সাহেবের দু-বাহু চেপে ধরলেন।
“আমি ঠিক বুঝলাম না মোশাররফ! কিসের স্বামী? কিসের কী? কী হচ্ছে এইসব?”
কিভাবে বিয়েটা হয়েছে সেটা বলে দিলেন মোশাররফ সাহেব। বাজ পড়লো উনার মাথায়। এটা কিভাবে সম্ভব? ভাবতে লাগলেন আহসান সাহেব। মানে একে তো কালো,আলকাতরা ও বোধহয় ফেল করবে। দ্বিতীয়ত পেটের মধ্যে একটা ভুঁড়ি,তৃতীয়ত কেমন স্বাস্থ্য,আরো বয়স্ক,আবার নাকি ডিভোর্সি। লাস্ট,সন্তান ও নাকি হবে না। মানে একটা মানুষের মধ্যে এতো খুঁত থাকলে এটা কী মানা যায়? কখনো না! গায়ের রঙটা না হয় বাদ,কিন্তু ডিভোর্সি,সন্তান হবে না আরো মিঠির চেয়ে বয়সে অনেক বড়। সবকিছুর একটা লিমিট থাকা প্রয়োজন। পৃথিবীতে ছেলের কি এতোই অভাব যে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দিতে হবে? মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসলেন। গলা শুকিয়ে গেলো উনার। একদম শান্ত গলায় বললেন,”এইসব আমি কী শুনলাম? আর আজ এতোদিন পর আমাকে কেনো জানানো হলো?”
চিন্তায় চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন আহসান সাহেব। আচমকা বলে উঠলেন,”মেয়ের জীবনে তোমার ভূমিকা কী মোশাররফ?”
কিছু বলতে পারলেন না তিনি। মিঠিকে রেখে এবার চেঁচিয়ে উঠলেন,”কী জিজ্ঞেস করেছি বলো? উত্তর দাও।”
মাথা নুয়ে রাখলেন মোশাররফ সাহেব।
“আমার বোনের বাড়ি-গাড়ি সব রেখে এইটুকুন মেয়ে সেই ক্লাস সিক্স থেকে বাড়ির বাইরে একা একা বড় হয়েছে,তাও কি-না তোমার দ্বিতীয় স্ত্রীর মানসিক টর্চারে। সেখানে তুমি এবং তোমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর পরিবারের; ওর জীবনে কী কী অবদান রয়েছে? সব তো ছেড়ে দিয়েছি,দখল করে ভোগ করছে করুক! আজ এতোগুলো বছর যাবৎ অন্যায়ভাবে ভোগ করছে,আমিও স্বইচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছি! কিছুই বলিনি,শুধু মেয়েটার জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে। সবকিছুর বিনিময়ে যদি মেয়েটা একটু ভালো থাকে সেইজন্য,কিন্তু এখন তো দেখছি এতোদিন দুধকলা দিয়ে সাপ পুষেছি মেয়েটার জীবন বরবাদ করার জন্য।”
একনাগাড়ে সবগুলো কথা বলে তপ্তশ্বাস ফেললেন আহসান সাহেব। মৌন রইলেন কিছুক্ষণ। ফের বলতে লাগলেন,”সামনে মেয়েটার পরীক্ষা! কিভাবে ভালো রেজাল্ট করবে সেই টেনশনে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি! আর তাও কি-না এমন একটা সময় এই অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে বসলো জালিমগুলো। তুমি থাকতে এমনটা কিভাবে করলো মোশাররফ? উত্তর দাও!”
এবারে চেঁচিয়ে উঠলেন আহসান সাহেব।
“কেনো মেয়েটার জীবন ছারখার করে দিলে তোমরা সবাই?কেন? মানলাম,বিয়ে দিয়ে তারা দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিলো,কিন্তু তাই বলে এমন! সবকিছুর একটা লিমিট আছে এবং থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি।”
শ্বাস আঁটকে বসে রইলেন মোশাররফ সাহেব।
“আমার ভাগ্নীর জীবনসঙ্গী নির্বাচন করার দায়িত্ব তো কাউকেই দিইনি আমি। এতো বড় সাহস কী করে হয়?”
কিছু বলতে পারলেন না তিনি। কি আর বলার আছে! সব তো ঠিকই বলছে! চোয়াল শক্ত করলেন আহসান সাহেব।
“আমার বোনের বাড়িতে যখন তার মেয়ের জায়গা হয় না; তাহলে সেই বাড়িতে থাকার রাইট কারোরই নেই। মোশাররফ তুমি এখুনি,এই মুহূর্তে আমার এই বাসা এবং আমার বোনের বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে। তোমার যদি কানাকড়ি সমপরিমাণ আত্মসম্মানবোধ বলে কিছু থাকে,তাহলে তুমি আজকের পর আমার বোনের বাড়িতে আর পা রাখবে না। এবার যেখানে খুশি সেখানেই থাকতে পারো। মেয়েটার আঠারো বছর পূর্ণ হোক,তারপর এই বাড়ি ভেঙ্গে একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দেবো। যেই বাড়িতে আমার বোনের মেয়ের থাকার জায়গা হয় না,যেই বাড়িতে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে একটা নিষ্পাপ মেয়েকে একটা ডিভোর্সি ছেলের সাথে জোর করে বিয়ে দেয় সেই বাড়ি আমি আর আস্ত রাখবো না। এতিমখানার জন্য দান করে দেবো। এই তো আর কয়েকটা দিন। এজন্যই চুপ করে আছি এতোগুলো বছর।”
মুখ খুললেন মোশাররফ সাহেব।
“ওরা বাড়িটা নিজের নামে নিতে চায়।”
চেঁচিয়ে উঠলেন আহসান সাহেব।
“বললেই হয়ে গেলো! সাহস কতো! বললেই আমার বোনের সম্পত্তি ওদের দিয়ে দেবো?এতো সোজা! স্বপ্ন দেখতে বলো গিয়ে যাও! আমি আপন ভাই হয়ে আমার বোনের বাড়ির এক পয়সা সমপরিমাণ কখনো ভোগ করিনি,করার চিন্তাও করিনি। কখনো এই বাড়ি-গাড়ি কিংবা ধনসম্পত্তির উপর লোভও করিনি। আল্লাহ আমায় যথেষ্ট দিয়েছেন। উল্টো আমি নিজের বাড়ির অর্থাৎ এই বাড়ির এক কোটি টাকা মূল্যের একটা ফ্ল্যাট আমি তোমার মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি। আঠারো বছর পূর্ণ হলে এই ফ্ল্যাট-টাও ওর নামে দিয়ে দেবো। আজ একটা সত্যি কথা বলি শোনো,আমি চাইলে স্বইচ্ছায় মিঠির থেকে আমার বোনের বাড়ি-গাড়ি,ধন-সম্পত্তি সবকিছু নিতে পারি কোনো প্রেসার ক্রিয়েট ছাড়াই! আমি চাইলে তুমি বাদ,মিঠি কখনো না করতেও পারবে না! এতোটাই বিশ্বাস করে সে আমাকে। কিন্তু আমি লোভী নই! আর ওরা আমার বোনের বাড়ি নিয়ে নিবে এতো সোজা?”
কিছু বলতে পারলেন না মোশাররফ সাহেব। মিঠির সৎ মামাদের যে দাপট! এদের দাপটের সঙ্গে টেক্কা দেওয়া যেন-তেন কাজ নয়।
“মিঠিমণি!”
মামা বুকে মুখ গুঁজে নীরবে মাথা নাড়ালো।
“সামনে তোমার আঠারো বছর পূর্ণ হবে। তুমি তোমার মায়ের সকল সম্পত্তির মালিক হবে। তোমার সৎ মামারা জাল দলীল বানিয়ে তোমার থেকে সব লিখিয়ে নিয়ে যাবে কৌশলে। তুমি টেরও পাবে না। তাই বলে দিচ্ছি,খবর্দার! ভুলেও কোথাও সাইন করবে না। তোমার বাবাকেও আজ থেকে বিশ্বাস করবে না। কারণ তোমার বাবাকে ইউজ করবে ওরা। তাই কোথাও সাইন করার আগে ভালো করে পড়ে নিবে। এবার সেটা যাইহোক,পরীক্ষার এসাইনমেন্ট হলে সেটাও। এরপর এই বাড়ির কী হাল করি দেখো। সরকারী তহবিলে দান করে সোজা এতিমখানা বানিয়ে ফেলবো। দেখি সরকারের সাথে পারে কিনা! কুকুর-বিড়াল ভোগ করার চাইতে নিরীহ মানুষের কল্যাণের জন্য দান করাটাই উত্তম বলে মনে করি।”
মাথা নাড়ালো মিঠি। তার মামা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে,মনিরা খাতুনের ভাইদের জন্য তারা টিকতে পারবে না। তার চেয়ে এতিমখানা কিংবা বৃদ্ধাশ্রম হয়ে গেলে অনেক মানুষের একটা আশ্রয়স্থল হবে। মাথা গোঁজবার ঠাঁই হবে।
“মোশাররফ।”
“জি।”
“এই ছেলের সাথে মিঠিমণি সংসার করবে না। ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো আজই,এখুনি! ওই ছেলেটাকে আসতে বলো কুইক। এই মুহূর্তেই আমার সামনে ডিভোর্স হবে। ফোন করো।”
ভয়ে ভয়ে শেহজাদকে ফোন করলেন মোশাররফ সাহেব। শেহজাদ অফিসেই যাচ্ছিলো। মাঝপথে ফোন পেতেই ফিরে আসে। তবে ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। তার মনে কু ডাকছে! ধারণা করলো ভালো কিছু হবে না। আধাঘন্টা পর ধীর পায়ে বাসায় ফিরলো। মোশাররফ সাহেব মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছেন। বাসায় ঢুকতেই শেহজাদের দিকে তাকালেন আহসান সাহেব। এতো সুন্দর ফুটন্ত পরীর মতো একটা মেয়েকে কোন রুচিতে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে সর্বনাশ করলো ভেবে ফেলেন না তিনি। মানে এইসব কি! আফসোসে উনার মাথায় যন্ত্রনার উদ্রেক হলো। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষ তো আল্লাহ’র সৃষ্টি। কিন্তু তাই বলে ছোট্ট অল্পবয়সী একটা মেয়ের সাথে এমন ছেলের! মানতে পারলেন না তিনি। এটা মানার বিষয়ও না। মেয়েটার এখনো সারাজীবন পড়ে আছে! কতো কি করার বাকি আছে!
“বসো।”
মুখোমুখি বসলো শেহজাদ। মিঠি তার মামার বুকের সাথে লেপ্টে রইলো। কাঁদছে নাকি স্বাভাবিক বোঝা যাচ্ছে না। মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে শেহজাদের খারাপ লাগছে! অস্বস্তি হচ্ছে।
“তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা ছিলো।”
“জি বলুন।”
“তোমাদের বিয়ের ব্যপারে সব শুনেছি!”
মাথা নুয়ে রাখলো শেহজাদ। লজ্জাও লাগলো। যে পরিস্থিতিতে বিয়েটা হয়েছে সেটা কাউকে বলার মতো নয়। খুবই বিভ্রান্তকর এবং লজ্জাজনক একটি ঘটনা। ধুপ ধুপ করে তার বুকটা সমানে কাঁপছে!
“তোমাদের বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন এখনও হয়নি। যেহেতু মিঠিমণির এখনো আঠারো বছর হয়নি। এছাড়াও কেবল ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী বিয়ে হয়েছে তোমাদের। সেহেতু আমি চাই এই মুহূর্তে তিন তালাকের মাধ্যমে মিঠিমণিকে তুমি মুক্তি দাও। আর তা এখুনি।”
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো শেহজাদের বুকটা। ঘামতে লাগলো সে। কেমন অস্থির,অসহ্য লাগছে সব।
“দেখো তুমি মিঠিমণির বয়সে অনেক বড়। সম্ভবত বিশ বছরের। তোমার সাথে মিঠিমণির সংসার করা সম্ভব নয়। তাই আমি চাই মিঠিমণিকে ডিভোর্স দিয়ে তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে সুখী হও! এখন সময় নষ্ট না করে তিনবার তালাক বলে দাও।”
আহসান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো শেহজাদ। এই যে তালাকের কথা বলে দিলো কি অবলীলায় আচ্ছা উনার বুক কাঁপলো না? কিন্তু শেহজাদের বুকটা তো ওই শব্দটি কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই কাঁপছে! যদি সেটা কাউকে দেখানো অসম্ভব। এমনটা জানলে আজ সে এই এলাকায় পা ও মাড়াতো না।
“কী হলো বলো? টাইম ওয়েস্ট করো না।”
হাতঘড়িতে সময় দেখলেন আহসান সাহেব। কোমল গলায় বলল,”মিঠির সাথে একটু কথা বলতে চাই আঙ্কেল।”
“কীসের কথা?”
বিব্রতবোধ করলো শেহজাদ।
“ডিভোর্সের ব্যপারে ওকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।”
“ও ছোট মানুষ। ও ডিভোর্সের ব্যপারে কি বুঝবে?”
“প্লিজ আঙ্কেল।”
“শোনো,ওর এখনো নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বুঝ হয়নি। যা বলার আমি বলে দিয়েছি। আমার কথাই শেষ কথা।”
“ও কী সত্যিই ডিভোর্স চায়?”
“না চাওয়ার কী আছে?কোন গুণে,কোন রুচিতে তোমার সাথে থাকবে?কোন যোগ্যতা আছে তোমার?”
অসহায়ত্ববোধ করলো শেহজাদ। জীবন তাকে এ কোন পরিস্থিতিতে নিয়ে এলো? কী ছিলো! কী হলো! শেহজাদ স্বীকার করে মিঠির স্বামী হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। মিঠি আর সে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কিন্তু তবুও একটা আশা রাখে। অসহায় কণ্ঠে এবার মিঠিকেই জিজ্ঞেস করলো,”মিঠি,তুমি একবার বলো তুমি কি ডিভোর্স চাও?”
বলতেই গলা কেঁপে উঠলো। কিছু বললো না মিঠি। পূর্বের মতোই রইলো। শেহজাদের বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে! মিঠির এই নীরবতা,এমন রূপ মানতে কষ্ট হচ্ছে! নীরবতা নাকি অনেক সময় সম্মতির লক্ষ্মণ হয়। মিঠি কী তাহলে সত্যিই ডিভোর্স চায়? কিন্তু শেহজাদের কষ্ট হচ্ছে! পারবে না মিঠিকে তালাক দিতে। বুকটা ফেটে পাচ্ছে,ভেতরে অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে! তবে কি মিঠিকে ভালোবাসতে শুরু করেছে শেহজাদ? উত্তর এলো,হয়তো! ছলছল নয়নে তাকালো।
“মিঠি কথা বলো প্লিজ।”
একইরকম ভঙ্গিতে রইলো মিঠি।
“ও কী বলবে! আশ্চর্য! আমি তো বলেছি আমার কথার উপর কোনো কথা নেই। আমিই মিঠির একমাত্র গার্ডিয়ান। ওর মা মা’রা যাওয়ার পর আমি এবং আমার স্ত্রী ওকে মানুষ করেছি যতদিন দেশে ছিলাম। মিঠির প্রতি তার বাবার কোনো অবদান নেই বলা যায়। এই পর্যন্ত মিঠির সবকিছুতেই আমি অবদান রেখেছি যেভাবে,যেমনভাবে যতটুকু পেরেছি। ওর ভরণপোষণ সহ পড়াশোনার যাবতীয় সকল খরচ আমিই বহন করছি। জন্ম দিলে পিতা হওয়া যায় না। তাই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমিই নিবো। মিঠি আমার রক্তের সন্তান নয়। কিন্তু আমার সন্তানের থেকেও কোনো অংশে কম নয়। মিঠি মোশাররফের সন্তান নয় আমার বোনের সন্তান আমার সন্তান।”
বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো মোশাররফ সাহেবের। মাথা নুয়ে রইলেন। নীরবে সবার আড়ালে চোখের কোণ বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
“কথায় আছে মেয়েদের পেটে বাবু আসার সাথে সাথেই তার মাতৃত্ববোধ চলে আসলেও ছেলেদের পিতৃত্ববোধ আসে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর। তবে দেরীতে আসলেও তা আমরণ পর্যন্ত থাকে! মা হওয়া কঠিন,তবে বাবা হওয়াটাও কিন্তু খুব কঠিন। যে এক মাইল হেঁটে বিশ টাকা বাঁচিয়ে তোমাকে চিপস কিনে দেয়,সেই তো বাবা! যে নিজের সারাটা জীবন বিলিয়ে দেয় তোমার ক্যারিয়ার গড়তে,সেই তো বাবা! তবে হ্যাঁ! সব বাবারা বাবা হতে পারে না। হুমায়ুন আহমেদের একটা কথা শুনেছিলাম,“পৃথিবীতে অসংখ্য খারাপ মানুষ আছে,কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই।” কিন্তু আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলবো,মোশাররফ একজন খারাপ বাবা। বিশ্বের খারাপ একজন মানুষ।”
অপমানে থমথমে হয়ে গেলো মোশাররফ সাহেবের মুখটা। জিদ থেকেই আহসান সাহেব এইসব বলছেন তা তিনি জানেন। সত্যিই কি তিনি খারাপ বাবা?
“তবুও একবার ওর মুখ দেখে জানতে চাই আঙ্কেল।”
“বলেছি না আমার সিদ্ধান্তের উপর কোনো কথা নেই। দ্রুত তালাক বলো।”
___________
চলবে~
কপি করা নিষেধ।