যাতনা_আমার #সানজিদা_ইসলাম_সূচনা #পর্ব: ৪ ও ৫

0
50

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৪ ও ৫

( কপি করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ।)

শহরতলী থেকে অনেকটা দূরেই মির্জা বাড়ির স্থান। নির্জন শান্ত পরিবেশ চারিদিকে। নেই কোনো গাড়ির হর্ণ, কোলাহল পরিবেশ। সচারাচর শুনা যায় সেটা। আয়েশা মির্জার স্বামী খুব সখ করেই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বাড়ির ব্যবসা বাণিজ্য শহরমুখী, যাতায়াতে সমস্যা হলেও তারা মির্জা বাড়ি ছাড়া আলাদা থাকার কথা বলেনা। কাজ শেষে সবাই ফিরে আসে শান্তি নীড়ে। এই শান্তি নীড় যেন একটা অশান্তিতে পরিনত হয়েছে। এমনটাই মনে করেন আয়েশা। গত নয়টা মাস বাড়িটা যেন পাতালপুরীতে ডুবে গেছে। কেউ কারও সাথে কথা বলে না। হয় না এক সাথে খাওয়া দাওয়া। সবাই যেন সেই নয় মাস আগেই পরে আছে। সবকিছুরই মূল যেন ইনায়া। এটাই মনে হয় আয়েশা মির্জার। সোহানার আদিখ্যেতার জন্য চুপ করে যান। মাঝেমধ্যে ইনায়ার জন্য মায়াও হয় তার। আঠারো বছর বয়সেই বাবা-মা হারানো তারপর বিয়ে? সবকিছু ভাবলে ভিষন মন খারাপ হয় ইনায়ার জন্য তারপরও একটা কথা আছে না, মানুষ স্বার্থের কাঙাল। ঘুরেফিরে সেই স্বার্থের পিছনেই ছুটে সব।

চার একর জায়গায় বিশাল বড়ো মির্জা বাড়িটিকে, চারদিকে ঘিরে রয়েছে বড়ো প্রাচীর। বাড়ির বড় মূল দরজা হতে রাস্তা কিছুটা এঁকেবেঁকে গিয়েছে সদর দরজা অবধি। তন্মধ্যে বাড়ির সামনে থামে কালো একটা গাড়ি। বেড়িয়ে আসে ইনায়া আর নিধি দুজন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় আয়েশা মির্জা বসে বসে পান চিবুচ্ছে। নিধি সিড়ি বেয়ে তার রুমে চলে গেল এক্ষুনি গোসল করতে হবে। বিশ্রী কান্ড করছে সে রাস্তায়। ইনায়া সামনে এগুতেই খেঁকিয়ে উঠলেন আয়েশা,

-” এই, এদিকে আয় তুই। ”

ইনায়া মাথার ঘোমটা ভালো করে টেনে আয়েশার সামনে আসে। কেনো জানি দাদিকে তার ভিষন ভয় করে। দাদি যে তাকে বাঁকা চোখে দেখে তা ভালো বুঝতে পারে ইনায়া। তবুও সে চুপচাপ থাকে।

-” কেমন গেলো তোর আজকের দিন? ”
-” জ্বি দাদি ভালো।”
-” আয়, আমার পাশে বোস। ”

পান খাওয়া দাতে হেসে বলে উঠেলেন আয়েশা মির্জা। ইনায়া আশ্চর্য হয় ক্ষানিকটা দাদির ব্যবহারে। এমন করে আয়েশা তার সাথে কোনোদিন কথা বলেছে বলে মনে হয় না। ইনায়া মাথা নিচু করে বসে পরে তার পাশে। আয়েশা মির্জা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে ওঠে,

-” এমন করে কি তোর জীবন যাইবে? দেখ, আমি বাবা সাধাসিধে কথার মানুষ। এই বাড়িতে কিসের আশায় আছিস তুই? বলতো? স্বামী দিয়েইতো স্বামীর সংসার। যেখানে সেটাই নেই, তাহলে এই বাড়িতে কেনো পরে থাকবি বলতো? কিসের আশায়? যেখানে নাভান তোকে না দেখেই বাড়ি ছেড়েছে। মধ্যযুগের নারীরা একটা কথা বলতো জানিস সেটা কি?”

ইনায়া দুপাশে মাথা নাড়ায়। অতএব জানে না সে। আয়েশা মির্জা ভালো করে তাকায় ইনায়ার পানে।

বলত,
-” জামাইরা হলো সাত ভাই, জামাই বিনে কেহ নাই।
স্বামী যদি ভালো হয় তার মুখের দিকে তাকিয়ে সারা জনম মানুষের কটু কথা শুনেও পার করা যাবে। স্বামী হলো স্ত্রীয়ের রক্ষক। স্বামীর বাড়িতে যতই বিলাসিতা, মানুষজন ভালো থাকুক না কেন। স্বামী যদি ভালো না হয় বউয়ের কোনো মর্ম থাকে না। জীবন টা তো সামনে পুরোটাই পরে আছে ইনায়া। নাভানের আশায় না থেকে জীবন টা নতুন কর শুরু কর। এই বাড়িতে ঘুরেফিরে তোর একটাই পরিচয় নাভানের বউ। সোহানা যতই তোর নিজের পরিচয় দেক সেটা তো মুছে যাবে না। আজ না কাল তোদের সম্পর্ক ভেঙেই যাবে। সোহানা ঠিক তোকে পড়াশোনা করিয়ে অন্যথায় বিয়ে দিবে। তখন লোক জানাজানি বেশি হবে। এরচেয়ে ভালো এখনই একটা ব্যবস্থা কর, আমরা তোর পাশে থাকব। শক্ত কর নিজেকে।

কথাগুলো বলে থামলেন আয়েশা। ইনায়া অনুভূতি শুন্য হয়ে বসে আছে তার সামনে। মুখে কোনো কথা নেই। কথাগুলো তার অজানা নয়। আজ না কাল ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবেই। তখন কোথায় ঠাই হবে তার। এর চেয়ে ভালো না আত্মসম্মান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু কই যাবে সে? পৃথিবীতে সে বড্ড একা। আয়েশা মির্জা ইনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। রান্নাঘরের দিকে চোখ রাখেন। নিপা রান্না করায় ব্যস্ত। সতর্ক হয়ে ব’লে ওঠে,

-” আমি যে এসব বলেছি, সোহানা যেন না জানে। পাছে বলবে আমি তোর কানে বিষ ঢেলেছি। এমনিতেই সি আই ডি নিপা সারাদিন কুটনামি করতে থাকে আমার নামে।

-” কে কার নামে কুটনামি করে গিন্নি? ”

কথাটা শুনে চকিতে সামনে তাকায় আয়েশা মির্জা। ইশান দুষ্টু হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিরক্তিতে মুখ কুঁচকালেন তিনি। ইশান তাকে বড্ড জালায়।
-” তোকে বলব কেন? তুই আমাদের কথার মাঝে বা’ হাত ঢুকাচ্ছিস কেনো?”

-” বারে! আমি তোমার কর্তা না।

কথাটা বলে বসতে বসতে রান্না ঘরে থাকা নিপাকে হাঁক ছেড়ে ডাকে ইশান। এক গ্লাস পানি আনার জন্য। সামনে তাকায় ইনায়ার দিকে, মেয়েটির মায়াবী মুখটা বড্ড করুন হয়ে আছে। একসাথে ইনায়ার জীবনে এতকিছু ঘটে গেছে। তার ধাক্কাটা সহজেই কাটিয়ে তোলার মতো নয় আঠারো বয়সি মেয়ের। ইশান তাকানো অবস্থায় ইনায়া চোখ তুলে, মিলিত হয় দুই জোড়া চোখের দৃষ্টি। তড়িৎ গতিতে চোখের দৃষ্টি নামায় ইনায়া।

ছেলের ডাক শুনে তারাতাড়ি করে পানি নিয়ে এলেন নিপা। ইশান একটানে পুরো গ্লাস শেষ করে নিপার হাতে গ্লাস দিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বলে,

-” বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে মা। তোমার স্বামী, ভাসুর আর জা মিলে আমাকে প্রচুর খাটিয়েছে। সকাল থেকে অফিসে এক কাপ কফিও খেতে পারিনি।

-” আহারে,, তুই ফ্রেশ হয়ে আয় আমি এক্ষুনি ভাত বেড়ে দিচ্ছি। আর ইনায়া, তুমি বসে আছো কেন? নিধি কে নিয়ে খেতে আসো। ”

বলেই রান্নাঘরে দৌড় লাগায় নিপা। বাকি সবাই আসার আগে দুপুরের রান্না শেষ করতে হবে। ইয়ানা বরাবরই অবাক হয় ইশানের প্রতি। সবার সাথের গম্ভীর রগচটা মানুষটা মা আর দাদির কাছে এলেই বাচ্চা হয়ে যায়। নিপাও ছেলেকে পাঁচ বছরের বাচ্চা ভাবে যেন।

-” এহ্, আসছে নবাব। তাকে সবাই খাটায়। শোন, আমার দুইছেলে সোনার টুকরো তাদের নিয়ে যা তা বলবি না। আজকে আসতে দে তোর বাবা জেঠা কে। ”

-” তুমি কেমন গিন্নি হে? কর্তার দুঃখ বুঝনা। বয়স তো কম হলো না গিন্নি, কুটনামি কমাও। বাকি জীবন তো আমার, তোমার কুটনীতিতেই পার হয়ে যাবে। ”

ইশানের কথায় তেতে উঠেন আয়েশা মির্জা। ইনায়া আস্তে করে ব্যাগ নিয়ে তার রুমে চলে যায়। সে সোহানা মির্জার সাথে কথা বলবে। দাদির কথাগুলো আসলেই সত্যি। এইভাবে জীবন চলবে না। শোক কাটিয়ে উঠতে হবে তাকে।

ইনায়া যেতেই ইশানের উপর তেড়ে আসেন আয়েশা।
কানমলা দিয়ে রুষ্ট কন্ঠে বলেন,

-” তা আমি যখন এতই খারাপ। নিয়ে আয় নতুন গিন্নি। দেখি তার স্বামী ভক্তি আমার থেকে বেশী কি না। ”

ইশান মুচকি হেসে বলে ওঠে,

-” আনবো তো,, তাকে নিজ হাতে বানাবো আমি। লোহার চেয়েও শক্ত ইস্পাত ধৃর। যার প্রতিঘাতে তুমি দশ টুকরো হবে আশু। তাই বলছি কুটনৈতিক বুদ্ধি এখন কমাও। ”

নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে ইনায়া। বিকাল হতে চললো। দুপুরে খেতে যায়নি নিচে। নিধি এসে অনেকবার বলে গেছে। ইচ্ছা হয়নি তার। জীবনটাই হাঁপিয়ে উঠছে প্রায়। সবইতো ঠিকঠাক ছিল ইনায়ার জীবনে। বাবা-মা কে নিয়ে তার সুন্দর হাসি খুশি একটা পরিবার ছিল। শুধু সুখ আর শান্তিতে ভরপুর তাদের ছোট্ট মধ্যবিত্ত সংসার। তাদের সুখে গ্রহণ হয়ে এলো একটা অ্যাকসিডেন্ট। তারপর নিমিষেই সবকিছুই উলোটপালোট হয়ে গেল। বাবা-মা হাড়িয়ে সদ্য আঠারোয় পা দেওয়া বাচ্চা মেয়েটির কাছে তখন সব কিছুই দুঃস্বপ্ন মনে হয়েছিল। যেন ঘুম ভাঙ্গতেই ঠিক হয়ে যাবে সব। কিছুতেই সম্মুখের ঘটনা গুলো তার মানতে ইচ্ছে হয়না। বরাবরই মতই ইনায়া নিশ্চুপ থাকে। মাঝে মধ্যে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু, তারপরও গলার মধ্যে কান্না গিলে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা হয়ে গেছে এতদিনে। শোয়া থেকে উঠে বসে আলমারির কাছে যায় ইনায়া। সেখান থেকে বের করে তিন জনের হাস্যজ্বল একটা ছবি। হাত বুলায় ছবিটির উপর। মনে পরে একবছর আগের কথা।
নাভানের সাথে ইনায়ার বিয়ের ঠিক হয়েছে তখন দু’ মাস। সোহানা মির্জা বলেছিলেন নাভান ফিরতেই ইনায়াকে বউ করে ঘরে তুলবেন। তখন থেকেই তার ছোট্ট কিশোরী মনে নাভানের জন্য সুপ্ত ভালবাসা পুষেছিল। বিয়ে, সংসার নিয়ে কতশত স্বপ্ন সে ভাজ করে রেখেছিল মনের গহীনে। হঠাৎ বাবা মায়ের মৃত্যু তারপর সোহানার সাথে এই বাড়িতে আসে পরিশেষে নাভানের সাথে বিয়ে। সবকিছু ভাবলে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে ইনায়ার।

-” মা এসেছে ভাবি! তোমাকে যেতে বলেছে তার ঘরে। ”

আচমকা নিধির কথায় ঘোর ভাঙে তার। চটজলদি উঠে দাঁড়ায় ইনায়া। মাথায় কাপড় টেনে, নিধির সামনে এসে জিজ্ঞেস করে,

-” লাঞ্চ করেছে তারা? ”
-” হুম, তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। বলেছি খেয়ে শুয়ে আছে। খাওনি বললে সবাইকে বকবে। ”

ঠোঁট উলটে বলল নিধি। ইনায়া নিধির সাথে কথা বলতে বলতে সোহানার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়।
নিধি তার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় মা ভাবির কথার মধ্যে থাকতে চায়না সে।

চলবে……………………..

#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব:৫

শহরের বেশ সুনামধন্য একটা রেস্তোরাঁয় আমেরিকান ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং আছে নাভানের। ক্লায়েন্ট ইতিমধ্যে এখানে উপস্থিত কিন্তু দেখা নাই নাভানের। নাভানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট সাফরান আহমেদ। কখন থেকেই নাভানকে লাগাতার কল দিয়েই চলেছে। কিন্তু, নাভান ফোন রিসিভ করছে না। সময়ের আগে চলা নাভান শাহরিয়ারের মিটিংয়ে লেট? ভাবতেই অবাক লাগছে সাফরানের। প্রায় পাঁচ মিনিট পর হন্তদন্ত হয়ে রেস্তোরায় আসে নাভান। পার্সোনাল বড় কেবিন বুক করা আছে সেখানে। ১২ নাম্বার কেবিনের দরজার পাশেই সাফরান দাঁড়িয়ে ওয়েট করছিল। আজকে ফর্মাল ড্রেসে নেই নাভান। পড়নে ব্লাক টিশার্ট ব্লাক প্যান্ট এন্ড ব্লাক হুডি। সাফরান অনেক বিস্ময় হলো। অফিসিয়াল কাজে সবসময় নাভান ফর্মাল ড্রেসেই আসে। তার স্যারের মাথা ঠিক আছে তো?

-” গুনে গুনে বিশ মিনিট লেট স্যার! ঠিক আছেন আপনি? ”

-” ইয়াহ্! সবাই এসে গেছে? ”

-” জি স্যার ”

-” ওকে, লেটস্ গেট স্টার্টেড। ”

সন্ধ্যার মিটিং শেষে ক্লায়েন্টের সাথে ডিনার করে বাড়ি ফিরবে নাভান।

কেবিন নাম্বার ২৫, নাভানদের অপজিট পাশের কেবিন সেটা। ছোট গ্লাসে রেড ওয়াইন ঢালছে লিও। মুখ তার কুঁচকে আছে অনেকটা। মাথা কিছুটা ঝাড়া দিয়ে এক টুকরো বরফ মুখে ঢোকায় সে। হাতের ওয়াইনের বোতলটা শব্দ করে টেবিলে রাখে লিও। গ্লাসের ওয়াইন এক চুমুকে শেষ করে বোতলে মুখ লাগিয়ে ডগ ডগ করে খেয়ে শেষ করে সেটা। এতক্ষণ তাকে চুপচাপ পরক্ষ করছিল জিসা।ছেলেটা দিনকে দিন প্রচুর পাগলাটে হয়ে যাচ্ছে। লিও ততক্ষণে আরেকটা বোতলে হাত দিতেই সেটা সড়িয়ে দেয় জিসা। চোখমুখ শক্ত করে সে,

-” আর কতো গিলবি? পরে তো বাড়ি যাওয়ার শক্তি পাবিনা। ”

ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল লিও,

-” এইরকম আরও দুটো খেলেও আমি ফিট থাকব। দেখাই খেয়ে? ”

-” দরকার নেই স্যার। আমাকে খেয়ে দেখাতে হবেনা আপনার। ”

তন্মধ্যে কেবিনে ঢুকলো অদিতি। মলিন
চেহারা উসকোখুসকো চুল। সবসময়ের মতো আবেদনময়ী হাসিটা ঠোটে নাই। পড়নে হাঁটু অবধি স্কাট স্টপ। ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে বসে পড়ে জিসার পাশে। লিও আর জিসা অদিতির দিকে তাকিয়ে আছে। এইরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় অদিতিকে দেখে জিসা হকচকিয়ে গেল,

-” অদিতি কি হাল করেছিস তোর? কোনো প্রবলেম হয়েছে? ”

-” নাভান! নাভান আমার সমস্যা। ও আমাকে নিজের লাইফে চায় না। আমাকে এভোয়েড করছে সে। ”

বিচলিত গলায় বলে ওঠে অদিতি। জিসা মাছি তাড়ানোর মত বলে উঠল,

-” এটাতো হবারই ছিল! কারণ সে কয়েকমাস ধরেই তোর প্রতি উদাসীন ছিল। বাদ দে ব্যাপার না। ”

-” বাদ দিবো? কিভাবে? আমি সিরিয়াস রিলেশনে ছিলাম। তুই বুঝতে পারছিস না অবস্থা? ”

-” কি বুঝবো বল তো? নাভানের গার্লফ্রেন্ড তো বছর ঘুরতেই বদলাতে থাকে, এই আর নতুন কি? কিন্তু তোর সাথের সম্পর্কটা নিয়ে আমরা ভেবেছিলাম নাভানও তোর মতো সিরিয়াস। এমনটাই মনে হতো সবার। কারন তোর সাথেই তার লং টাইম রিলেশন ছিল। বুঝলামনা কি হলো হঠাৎ।”

-” আমিও বুঝতে পারছি না। ”

-” রিভেঞ্জ অভ ন্যাচার। মেনে নে সব এটা কোনো বিষয় হলো? ”

এতক্ষণ চুপ করেছিল লিও। কথাটা বলেই অদিতির দিকে বাঁকা চোখে তাকায় সে। অদিতি লিওর দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,

-“কি বলতে চাইছিস? মেনে নেবো? এত সহজ না সব কিছু মেনে নেওয়া। আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো ”

-” সহজ অদি! প্রেগন্যান্ট হওয়ার পরও যদি। এবোর্শন করিয়ে বয়ফ্রেন্ড কে জাস্ট ফ্রেন্ড বানানো হয়, তাহলে এটা আবার এমন কি। ”

কথাটা শুনে রক্তিম চোখে লিওর দিকে তাকালো অদিতি। লিও শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অদিতি বিরক্ত স্বরে জিসা কে বলে,

-” আমি আসছি জিসা। কাল ক্যাম্পাসে দেখা হবে।”

বলেই বেড়িয়ে যায় অদিতি। লিও বাঁকা হেঁসে আবার ওয়াইনের বোতলে হাত দেয়। জিসা অবাক হয়ে লিও কে জিজ্ঞেস করে,

-” কি হয়েছে বলতো? ”

লিও তার ফোন বের করে জিসার হাতে দেয়। জিসা দেখতে পায়। লিও নাভানকে কিছু ভিডিও ক্লিপ আর ডাক্তারের দেওয়া প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্টের ছবি নাভান কে সেন্ড করেছে আরও চার মাস আগেই। ছবি আর রিপোর্ট দেখে বিচলিত হয়নি জিসা। কারণ, এইসব তার তিনবছর আগেই দেখা। যখন অদিতি লিওর সাথে ব্রেকআপ করেছিল। সব দেখে মন খারাপ করে জিসা বলে উঠে,

-” এইসব করে কি হবে বল? যা হারিয়েছে তা আর পাওয়া যাবে না। ”

-” মামনি আসব?”

সোহানা আর নাহিদ মির্জা বসে, কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলেন। ইনায়ার ডাক শুনতেই তাকে রুমে আসতে বলে সোহানা। ইনায়া রুমে ঢুকতেই সোহানা তাকে নিয়ে বসিয়ে দিলেন। সামনে রাখলেন অনেকগুলো শপিং ব্যাগ। তিনি ইনায়ার পাশে বসে পরলেন। একে একে বের করলেন অনেকগুলো চুড়িদার।

-” এগুলো গায়ে জড়িয়ে দেখিস তো মা। সবগুলোই তোর জন্য এনেছি। খুব মানাবে তোকে। আরও একটা জিনিস আছে। ”

বলেই পাশ থেকে অ্যাপল ব্র্যান্ডের একটা ল্যাপটপ এনে ইনায়ার হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। ইনায়া তাকাতেই হাসলেন তিনি।

-” কবে থেকেই কিনব ভাবছিলাম। আজকে তোর বাবাই আর আমি গিয়ে নিয়ে এলাম।

-” এটা দিয়ে কি করবো আমি?”

-” দরকার পরবে। আজকাল এটা ছাড়া চলে?

-” আমার চাই না। কিছু কথা বলব তোমাকে। ”

ইনায়ার কথা শুনে তার দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করেন সোহানা। এতক্ষণ ফোনে নজর রাখা নাহিদ মির্জাও ইনায়ার দিকে তাকালেন। ইনায়ার মুখটা অনেক শান্ত হয়ে আছে। সে সোহানার হাত ধরে মাথা নত করে বলল,

-” মামুনি আমি জানি তুমি আমাকে অনেক ভালবাসো। নিজের মেয়ের মতনই দেখো। আমাকে স্বাভাবিক করতে, সবকিছু ভুলে যেতে তুমি অনেক ভাবেই চেষ্টা করছো। কিন্তু আমার জীবনের এই দুঁঃখ, কষ্ট, বেদনা আমি কতো টুকু মুছতে পারব, তা নিজেই জানি না। তুমি যদি এখন জিজ্ঞেস করো, কোনো পারব না? তাহলে বলব, আমি মরুভূমির প্রখর রোদের তপ্ত,আগুনে পোড়া বালি মাটি নই যে ইচ্ছে মতো পানি ঢাললেও ভিজবে না তার শোষণ ক্ষমতা অনেক। আমি এক রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ আমারও কষ্ট হয়। নিজেকে সামলাতে অনেক রকম ভাবেই আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু কোথাও গিয়েও আমি যেন এক ব্যর্থ মানবী। কখনও কখনও আমি এই জায়গায় হেরে যাই, আমি কেনো অন্য সব মেয়েদের মতো স্বামী সংসার করব না? আমার স্বামী কেনো আমাকে ভালোবাসবে না? নিজের ভাগ্য নামের দূর্ভাগ্য কে মানতে পারিনা কিছুতেই। আমি কি সত্যিই এসব ডিজার্ভ করি? হয়তোবা করি। ”

এযাবৎ থামল ইনায়া। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে সে। সোহানা আর নাহিদ মির্জা নিশ্চুপ, চোখ তাদের ইনায়ার দিকে। ইনায়া ধাতস্থ করলো নিজেকে।

-” বাবা-মা দুজনের মৃত্যুর পর মানসিক ভাবে অনেক ক্ষতি গ্রস্থ ছিলাম আমি। একটা ট্রমার ভেতর ছিলাম। বাবা-মা নেই মানতেই পারিনি তখন। এর একমাসের ভিতর আবার নাভানের দেওয়া বেদনা, সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে উঠেছিলাম প্রায়। তখন এমনো সময় গেছে তোমাদের অজান্তেই নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিলাম।

বলেই থামল ইনায়া। সোহানা আৎকে উঠলেন প্রায় নাহিদ মির্জারও একই অবস্থা। যদি কিছু করে ফেলত ইনায়া? মৃত্যুর পর কি জবাব দিতেন তিনি ইনায়ার বাবা-মার কাছে। ধ্যান ভাঙলো ইনায়ার কথাশুনে,

-” কেনো করিনি জানো? মৃত্যুর পরের জীবনের কথা ভেবে। নিজের জীবন দিয়েতো আমি মৃত্যুর পরে সুখে থাকতে পারব না। হবো জাহান্নামি! এর চেয়ে ভালো দুঃখ-কষ্ট গুলো আমার ভেতরে নিয়েই বাঁচব। আমি নিজেকে গুছিয়ে নেবো ভেবেছি। কিন্তু এই বাড়িতে থাকলে আমি সেটা পারব না। ক্ষনে ক্ষনে মনে হবে আমি এই বাড়ির কে? কিসের পরিচয়ে আছি এখানে? নাভানের কথা মনে করে আমার কষ্ট বেশি হবে। তিন কবুল বলে তাকে আমি স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছি। উনার প্রতি আমার আক্রোশ রাগ প্রচুর পরিমাণের থাকলেও ভালবাসাটা আমি মনের গহীনে লুকায়িত রাখব। সেটা শুধু আমার নিজেরই মনে অজান্তে থাকুক। কেউ না জানুক সেটা। নাভান নিশ্চয়ই বাড়িতে ফিরে আসবে। তোমরা এখন তার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করলও একদিন ঠিকই মেনে নেবে। কারণ সে তোমাদের একমাত্র ছেলে। তখন আমি আর উনি কি করে নিজেদের ফেস করবো? আমাকে বাড়ি যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আমি পুরান ঢাকায় ফিরে যাবো। নিজেকে ঠিক মানিয়ে নেব, আমি এখানে থাকলে সেটা পারবো না। প্লিজ মামনি মেনে নাও আমার কথা। ”

সোহানা নিশ্চুপ হয়ে রইল। আজকে নিজেকে বেশিই দোষী মনে হচ্ছে তার। এমন না করলেও তো পারতেন। এমনিতেই তপ্ত রোদের শুঁকানো শুকনো কাঠ, তিনি সেটা জলন্ত আগুনে দিয়েছেন। সেটা তো জ্বলবেই। এতকিছুর পরও সোহানা ইনায়া কে পুরান ঢাকায় যেতে দেবে না। ইনায়া ওখানে গিয়ে কি করে একা একা থাকতে পারবে। বাবা-মায়ের স্মৃতি তার চোখে ভাসতে থাকবে সর্বক্ষণ। যতই বলুক একা চলতে পারবে, মেনে নিতে পারবে কিন্তু বলা আর করে দেখানো অনেক তফাৎ। বাস্তবতা কনেক কঠিন। সদ্য ডিম ফুটা মুরগীর ছানাকে যেমন করে মা মুরগী আগলিয়ে রাখে তেমনই ভাবে ইনায়া কে আঠারো বছর পর্যন্ত মানুষ করেছে তার বাবা-মা। সে কি করে বুঝবে বাইরের দুনিয়াটা কি?
সেখানে নিজের স্বার্থ বুজে সবাই। এমন পৃথিবীতে ইনায়া কে একা ছাড়বেন না তিনি।

সোহানা বিচলিত অনেকটা তারপরও নিরুত্তর। ইনায়া তাকিয়ে আছে তার দিকে উত্তরের আশায়। নাহিদ মির্জা ভাবলেন কিছুক্ষন। আসলেই ইনায়ার কথাগুলো সঠিক। কিন্তু ইনায়া কে একা ছাড়াটা কতটা নিরাপদ হবে? তিনি অত্যন্ত শান্ত হয়ে বলল,

-” ইনায়া তোমার কথার যুক্তি আছে। এমন হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে, তোমাকে চলে যেতে দেওয়াটা কতটা ভালো হবে? তারউপর তোমার ফুপু আনিলা আর তার হাসব্যান্ড কয়েকমাস আগে বাংলাদেশে এসেছিল। তুমি জেনে থাকবে ইনায়া, তোমার বাবা ব্যবসার খাতিরে আনিলার থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিলেন। আনিলা ধার দেওয়া টাকাসহ পৈতৃকসম্পত্তির অধিকারে তোমাদের পুরো বাড়িটা নিজের নামে করার দাবি জানিয়েছে। আমি বিষয়টা তোমাকে তখন জানাইনি। কিছু দিন পর তারা বাড়িটা দখলে নিতে আসবেন। এমতাবস্থায় কি করে তোমাকে যেতে দেই? ”

ইনায়া নিরাশ হলো প্রচুর। শেষমেশ ভিটেমাটি ও ছাড়তে হবে। এখন কই যাব সে? মাথা গোঁজার ঠাঁই কই? সবদিক অন্ধকার যেন৷ চকিতে মাথা তুলে বলল,” মামার ওখানে দিয়ে এসো। ওখানেই থাকব ”

নাহিদ মির্জা চাপা হাসলো, মেয়েটির বাড়িটা ছাড়তে কত তাড়া?

-” জানি, বাবা-মায়ের প্রনয়নের সম্পর্ক ছিল। নানা তাদের মেনে নেননি। আমি কয়েকবার গিয়েছি সে বাড়ি। শেষ বার মামাকে বাবা-মায়ের মৃত্যুর দিন দেখেছিলাম। আমি গেলে নিশ্চয়ই আমাকে ফেলে দিবেন না। ”

নাহিদ মির্জা গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,
-” তারা তোমার কোনো খবর নেয়নি ইনায়া। তুমি চিন্তা করো না আমি তোমার বিষয়টা মাথায় রেখে হোস্টেল বা অন্য ব্যবস্থা করবো।”

-” কি ব্যবস্থা করবে তুমি? আমি ইনায়া কে কিছুতেই একলা ছাড়ব না। ”

সোহানার কথায় বিরক্ত হয়ে গেলেন নাহিদ মির্জা। ইনায়া অবাক হলো। সোহানা মির্জা কঠিন স্বরে বলল,

-” তুমি ঘরে যাও ইনায়া,আমি তোমার বিষয় ভেবে দেখব। ”

ইনায়া গুটিগুটি পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে ছাদে গেল। যেভাবেই হোক তাঁকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে হবে।

-” কি চাও তুমি সোহানা ? সবকিছু কেনো ঠিক হতে দিচ্ছ না? এই ভাবে চললে নাভান আর ইনায়ার জীবনের কিছুই ঠিক হবে না। ”

ইনায়া যেতেই নাহিদ মির্জা সোহান কে জিজ্ঞেস করলেন। রাগ হচ্ছে সে সোহানার প্রতি। এইভাবে জীবন চলতে পারে?

-” ইনায়ার কিছুই হবে না। তার জীবন আমি সুন্দর ভাবে সাজিয়ে দিব। কিন্তু তোমার ছেলের টা আমার জানা নেই। সে নিজেই তার জীবন নরক বানিয়ে রেখেছে। আমি তাও নাভানের জীবন ঠিক করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে হতে দিল কই? বারো পাত্রে মুখ দেওয়া যার অভ্যাস। ”

সোহানা রাগান্বিত হয়ে বলে উঠলো প্রায়। নাহিদ মির্জা ক্রোধিত নয়নে তাকাল স্ত্রীয়ের প্রতি। কন্ঠে আক্রোশ ডেলে বলে ওঠে,

-“তার জন্য তুমি দায়ী সোহানা। আর সাথে আমিও যে ছেলেকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারিনি। ”

চলবে…………………

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনেকে অনুমতি না নিয়েই গল্পটি কপি পোস্ট করেছেন। তাদের লাইক কমেন্ট আমার থেকে বেশী। কপি করা নিষিদ্ধ। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here