#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৬
( কপি করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ)
-” নাভানের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী? তুমি কি করে বলতে পারলে? ”
-” কেনো বলতে পারবো না? ছোট থেকেই তুমি নাভানের প্রতি নিজের জেদ চাপিয়ে দিয়েছো। সব কিছুতেই নিজের জেদ, রাগকে প্রাধান্য দেওয়া ভালো নয় সোহানা। ”
রাগান্বিত হয়ে উচ্চ স্বরে বলে ওঠে নাহিদ মির্জা। তার মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে প্রায়। সোহানা গম্ভীর মুখে অবাক হয়ে চিৎকার দিয়ে বলে,
-” আমি নিজের জেদ, রাগ কখন তোমাদের উপর প্রয়োগ করছি? তোমার ছেলের বিগড়ে যাবার দোষ আমার উপর দিওনা। ”
সোহানার চিৎকার পাশের রুমে থাকা নিপা আর নওয়াজ মির্জার কান অবধি চলে যায়। তারা দুজনেই বিস্ময় নিয়ে তাদের রুমের সামনে আসে। আয়েশা, ইনায়া, নিধিও ইশান ও ততক্ষণে চলে আসে। কারণ আজ পর্যন্ত সোহানা আর নাহিদ মির্জা দুজনেই নিজেদের সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেনি। তাদের রুমের দরজা খোলা ছিল। নাহিদ মির্জা সোহানার কথার প্রেক্ষিতে ভয়ংকর আক্রোশ নিয়ে বলে,
-” না সেটা আর দিবো না। কারণ আমিও সমান দোষী। যে তোমার কথা শুনে নাভানকে কানাডায় পাঠিয়েছি। আর ভুল করেছি ইনায়ার সাথে তার বিয়ে দিয়ে। এই বার আমি সব ঠিক করবো। আর ইনায়ার প্রতি কোনো দরদ দেখাবে না তুমি। ওদের জন্য যা করার আমি করবো। ”
-” কি করবে তুমি হা? ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে? তাহলে, শুনে রাখো নাহিদ! আমি ইনায়া কে অন্য কোথাও যেতে দিবো না। তাদের দুজনের বিষয় আমি দেখব। ”
ক্রোধিত ভাবে বলে উঠেন সোহানা। নাহিদ মির্জা রাগের ভস্মীভূত হয়ে সোহানার দিকে আঙুল তুলে ব’লে,
-” কি দেখবে তুমি? তুমি ওদের কারোই ভালো করতে পারবে না। ইনায়ারও না, আর রইল নাভান? তারও না, কারণ তুমি তার আসল মা নও।
বিস্ফোরণ মন্তব্য করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলন নাহিদ মির্জা। এতক্ষণ বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য নীরব শ্রোতা হিসেবে ছিলেন যেন। কেউই কিছু বলতে পারল না। নাহিদ মির্জার কথায় সবাই অবাক হলেও অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছে ইনায়া। নাভান সোহানার ছেলে নয়? সোহানা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। সে নাভানের মা নয়, কথাটা বলতে পারলেন নাহিদ মির্জা? এত বছরের আদর, ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা সব কিছুই কি ফিকে? সে কি সত্যিই নাভানের মা হতে পারেনি? অতীতের সেই প্রায় ভুলে যাওয়া সত্য, আবার তাকে মনে করিয়ে দিলেন নাহিদ মির্জা। মনে করিয়ে দিলেন, তার এতদিন সে শুধু মায়ের অধিকার দেখিয়েছেন নাভানের উপর। ধপ করে চেয়ারে বসে পরলেন সোহানা। পাথর বনে গেছেন তিনি। নওয়াজ তার ভাইয়ের পিছন ছুটলেন। আয়েশা আর নিপা সোহানার পাশে এসে দাঁড়াল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুজে পেলেন না তারা।
-” আমি আসলেই সত মা! তাই না? ”
আয়েশার দিকে তাকিয়ে করুন গলায় বলে উঠলেন সোহানা। কাঁদলেন আয়েশা, সে জানে নাভান সোহানার কতটা আপন। তিনি ভীত গলায় বলে,
-” তুমিই নাভানের মা সোহানা। নাহিদের কথা মন থেকে ফেলে দাও। জানোই তো ও সহজে রাগে না। রাগলে মাথা ঠিক থাকেনা।
বলে সোহানার মন ঠিক করার একটু চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সফল হলেন কই? মুহূর্তেই কেঁদে উঠেন সোহানা। ভেতরটা যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে তার।
ইনায়ার নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছে। তার জন্যেই এতো ঝামেলা। কি করে ঠিক করবে সব? নিধি মায়ের কান্না দেখে গুমরে কেঁদে উঠল। তার মায়ের কান্না সহ্য হচ্ছে না। বাবা কি করে মাকে এই কথা বলতে পারল। নিধির পাশে দাঁড়ানো ইশান। সে নিধিকে ধমক দিয়ে বলল,
-” এমন সিরিয়াস মোমেন্ট কে তুই কমেডি সিন বানিয়ে দিলি গাঁধি? চুপ কর! তোর কান্না দেখে আমার হাসতে মন চায়ছে। ”
কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিল নিধি। ইশানকে জড়িয়ে ধরে হাতের পাশে নাক মুছে, কাতর কন্ঠে বলে,
-” মা কে থামতে বলো ভাইয়া। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ”
-” ইয়াক! সর্দি মুছলি আমার শার্টে। ছোটমা কে থামাব, তার আগে তুই থাম গাঁধি। না হলে পুরো মির্জা বাড়ি আজকে কমেডি হল হয়ে যাবে। ”
ইনায়া পিছু ফিরে দৌড়ে নিজের ঘরে আসে। আর ভাল লাগছেনা তার। যে করেই হোক তার এই বাড়ি ছাড়তে হবে। না হলে ঝামেলা মিটবে কম বাড়বে বেশি। টেবিলের উপর নাভানের হাস্যজ্বল একটি ছবি রাখা। সেখানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়া। হাঠাৎ মনে আসে নাভান সোহানার ছেলে না হলে কার ছেলে? ইনায়ার মনে হয় সে না জানলেও হয়তো বাড়ির সবাই সত্য টা জানে। আচমকা একটা জিনিস মনে আসতে ইনায়া ঝটপট করে আলমারির কাছে যায়। সেখানে থেকে বের করে একটা ডায়েরি। ইনায়ার মামা মিজানুল করিম তার বাবা মা এর লাস দাফন করে শেষ বারের মতো ইনায়ার সাথে দেখা করতে এসেছিল। তখন কান্নারত ইনায়া
মামার সাথে ভালো করে কথা বলতে পারেনি। মিজানুল করিম তাকে একটা নাম্বার লিখে দিয়ে বলেছিলেন, কখনো দরকার পরলে এই নাম্বারে যোগাযোগ করতে। এটা তার ছেলের নাম্বার। সে প্রায় সময় ঢাকার বাইরে থাকেন। ইনায়া ভালো মত নাম্বারটায় চোখ বুলায়। তারপর বিরবির করে পরে সেটা। ফাহাদ করিম, ইনায়া ভালো করে নামটা আওরায়। তাকে এই ফাহাদ করিমের সাথে দেখা করতে হবে। সে তার মামার ছেলে। ফোনটা বের করে নাম্বারটা ঠুকে ফোন লাগলো ইনায়া। নিজেরই ব্যবস্থা করতে হবে।
মিটিং করে রাতের ডিনার শেষে রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে দাঁড়ায় নাভান। সাফরান গেছে পার্কিং প্লেস থেকে গাড়ি ঘুরাতে। কন কনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। রাতের দিকে তুষারপ্রাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মোবাইলে সময় দেখলো নাভান। স্থানীয় সময় নয়টার উপরে। লকস্ক্রিনে একটা হাস্যজ্বল পরিবারের ছবি ভেসে উঠে। নাভান খানিকটা অন্যমনস্ক হলো। এই নয় মাসে বাবা মায়ের সাথে বা বাড়ির কারো সাথে কথা হয়নি তার। শুধু আশু বাদে। হেঁসে ওঠে নাভান। দাদি তাকে একটু বেশিই ভালবাসে। ইদানীং মায়ের কথা মনে হয় নাভানের। তবুও নিজের ইগোকে মানাতে পারে না সে। মা যখন তাকে বুঝেনি, সে কেনো বুঝতে যাবে? যারতার সাথে ধরে তাকে বিয়ে করিয়ে দিল? উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া কোনো মিডেল ক্লাস ঘরের মেয়ে। মানতে পারেনি সে। আয়েশা মির্জার থেকে বাড়ির সব খবরই রাখে নাভান। সামনের মাসে বিডি যাবে সে। আচমকা পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরাতে ধ্যান ভাঙে তার। হতবাক হয়ে পিছনে তাকাতেই অদিতি কে দেখতে পায় নাভান। রেগে কঠিন একটা গালি মুখে আনতে গিয়েও গিলে নেয় সেটা। ততক্ষণে সাফরান গাড়ি নিয়ে হাজির। কিন্তু সে গাড়ির ভেতরেই বসে রইল। স্যার আর তার ঢঙ্গি পাটনারের কথা শুনতে নারাজ সাফরান। নাভান নিজেকে সামলে নিল। নাক টেনে আসে- পাশে তাকিয়ে অদিতির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে , -” কি চাই। ”
-” নাভান প্লীজ একটা কথা শুনো আমার। আর একটা সুযোগ দাও আমাকে। ”
-” কিসের সুযোগ? ”
নাভান ভ্রু কুঁচকে অদিতির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেসা করে। অদিতি অনেকটা বিচলিত মুখে মলিন হয়ে বলে,
-” আমাদের সম্পর্কের! এইভাবে হঠাৎ করে কি সব হয় বল? দু’ বছরের রিলেশন আমাদের। ”
নাভান বিরক্তি নিয়ে মাথার হুডি ফেলে। চুল গুলো হাত দিয়ে পিছনে ফেলে তপ্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-” লিসেন অদিতি! আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে, তোমার সাথে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাই না। এক্ষুনি যাও এখান থেকে। আমার মাথা নষ্ট করো না। ”
অদিতি মূর্তিমান ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই নাভানকে তার চেনা নয়। এতটা কি করে বদলে যেতে পারে নাভান? অদিতির প্রতি নাভান অনেক পজেসিভ ছিল সে। হঠাৎ কি হলো? ভাবতে পারছে না অদিতি।
-” লিসেন নাভান? আমরা একটু বসে ভেবে ডিসিশন নিতে পারি। রাগের মাথায় সেদিন কি বলে ফেলেছি।
নাভান আর কোনো কথা না বলে গটগট পায়ে, গাড়িতে গিয়ে উঠল। গম্ভীর মুখে সাফরান কে বলল গাড়ি স্টার্ট করতে। অদিতি নাখোশ নাভানের ব্যবহারে। সে দৌড়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। সাফরান গাড়ির স্টার্ট দিতে গিয়ে হকচকিয়ে যায়। নাভান এবার প্রচন্ড রেগে গিয়ে সাফরান কে আদেশ দেয়,
-” গাড়ি চালা ওর উপর দিয়ে। একেবারে পিষে ফেল ওকে। পারলে তোর সেলারি বাড়িয়ে দেবো।”
সাফরান হতভম্ব হয়ে যায়। বোকা বোকা চেহারা নিয়ে নাভানের দিকে তাকায় সে। শেষমেষ স্যার তাকে খুন করতে বলেছে। তাও আবার তার গার্লফ্রেন্ড কে? বেশি রেগে থাকলে নাভান তুইতোকারি করে।
-” পাগল হয়ে গেছেন স্যার? আপনি তো আমাকে খুনি বানিয়ে দিবেন দেখছি। ”
-” গাড়ি স্টার্ট দে, এক্ষুনি। ”
ব’লে সাফরানের দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকায় নাভান। সাফরান একবার গাড়ির সামনে থাকা অদিতির দিকে তাকালো। মেয়েটা পাগলের মতো নাভান কে ডেকে চলছে। স্যার কি এই মেয়ের সাথে ব্রেকআপ করেছে? সে ভীত কম্পিত কণ্ঠে নাভান কে বলে,
-” স্যার সামনের মাসে আমার বিয়ে। ”
-” তো, এই সময় আমি তোর বিয়ের কথা বলতে বলছি? ”
আকাশচুম্বী রাগ নিয়ে হুংকার দিয়ে উঠলো নাভান। সাফরান সামান্য ডুক গিলে মিনমিনে স্বরে বলে,
-” ইয়ে মানে স্যার, খুন করলে তো জেলে ঢুকতে হবে। তখন আমার বিয়ের কি হবে? ”
নাভান গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো। আজ অদিতির একটা হেস্তনেস্ত করবে সে। নাভান এগুতেই সেখানে জিসা আর লিও উপস্থিত হলো। তারা নাভান কে অদিতির দিকে এভাবে তেড়ে যেতে দেখে আশ্চর্য হলো অনেক। জিসা এবার এগিয়ে গেল অদিতির কাছে। তারপর হকচকিয়ে না়ভান কে বলে ওঠে,
-” ভাইয়া প্লিজ! আমি অদিতি কে নিয়ে যাচ্ছি। মাঝরাস্তায় সিনক্রিয়েট করবেন না। ”
নাভান এবার রুষ্ট কন্ঠে বলে,
-” তাই করো, ওর মতো মশা মাছিকে মেরে হাত নষ্ট করতে চাই না আমি। ”
কথাটা বলে আপাদমস্তক লিও কে একবার দেখল নাভান। তারপর গাড়িতে উঠে বসতেই সাফরান গাড়ি চালালো। সাই-সাই করে চলে গেল সেটি।কুয়াশাছন্ন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে অদিতি এবার চিৎকার করে ওঠে,
-” ছাড়বো না নাভান। কিছুতেই এতো সহজে হাত ছাড়া করবো না আমি তোমাকে। কিছুতেই না।”
জিসা অদিতিকে শান্ত হতে বলে। অদিতি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে যেন। অদিতির মতো মেয়ের এমন অবস্থা হবে? ভাবতেই যেন অবাক হচ্ছে জিসা। লিও এবার খানিকটা টলতে টলতে অদিতির সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখ বাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি দিল সে। মুখটা করুণ করে,কন্ঠে রাগ নিয়ে বলে ওঠে,
-” কষ্ট হচ্ছে তাইনা অদি? আমারও হয়েছিল, যখন আমার বাচ্চাটাকে তুই খুন করেছিলি। তাও আবার এই নাভানের জন্য। শাস্তি পাচ্ছিস তুই। আর-ও শাস্তি বাকি আছে তোর। ”
বলেই লিও উলটো হেটে তার গাড়ির দিকে এগুলো। অদিতি বিরবির করে কিছুক্ষণ গালি দিল লিও কে।
নেহাৎ ছোট বেলার বেস্টফ্রেন্ড না হলে জানে মেরে দিতো। জিসা বরাবরই লিওর প্রতি আপসেট হয়। আজকাল কতো অহরহ হচ্ছে এবোর্শন। কিন্তু এই ছেলে ভুলতে পারছে না বাচ্চাটার কথা।” স্ট্রেঞ্জ ”
জিসা অদিতিকে নিয়ে পা বাড়ায় সামনে।
চলবে……………
( ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।দেরিতে দেওয়াতে ক্ষমাপার্থী। গল্পটা আমার মতো এগিয়ে নিয়ে যেতে দিন। আশা করি কেউ নিরাশ হবেন না। আর নতুন হিরোর এন্ট্রি সামনের পর্বেই পাবেন। সবাই গঠন মুলক কমেন্ট করবেন প্লিজ।)