#যাতনা_আমার
#সানজিদা_ইসলাম_সূচনা
#পর্ব: ৭
( কপি করা সম্পুর্ন নিষিদ্ধ)
আজ সকাল সকাল ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেছে ইনায়া। গতকালকের ঘটনার পর থেকে বাড়িটা একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলেনি তেমন। নিধি আজকে যাবে না বলে জানিয়েছে। ইনায়ার জন্যও বিষয়টা ভালো হয়েছে। কালকে ফাহাদের নাম্বারে কল দেওয়ার পরও কানেক্ট করতে পারেনি ইনায়া। তাই ঠিক করেছে সে নিজেই যাবে তার মামার বাসায়। বাড়ির কাওকে এই বিষয়ে জানায়নি ইনায়া। ভার্সিটির গেইটের সামনে গাড়ি থামতে নেমে পরে ইনায়া। সামনে ঝুঁকে নমনীয় ভাবে ড্রাইভার কে বলে ওঠে,
-” আংকেল, আজকে নিতে আসার দরকার নেই। একটা কাজ আছে আমার। সময় হলে আমিই চলে যাব। ”
ড্রাইভার আতাউর মুখে কোনো রা করলেন না। সে বিরক্ত ভাবে তাকাল ইনায়ার দিকে। যে তার ইনায়াকে নিতে আসার কোনো ইচ্ছাই নেই। তারপর গাড়ি স্টার্ট করে সেখান থেকে চলে গেলেন তিনি। ইনায়া সেটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রথম দিন থেকেই আতাউর তাকে পছন্দ করে না। ইনায়া এবার সামনে এগিয়ে যায়। একটু দুরেই বাস স্টপ। ইনায়া কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে বাসে উঠে। জানালার সাথের সিটে বসে পরে সে। এক ঘন্টার রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। ইনায়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। আকাশটা আজ মেঘলা কিছুটা। কেমন গুমোর হয়ে আছে চারপাশ। মন ভার হলো ইনায়ার। জীবনটা তার চরকির মতো ঘুরছে। সে কি একটু সুখী হতে পারতো না জীবনে? বাবা-মা যাবার সাথে সাথে তার সুখ শান্তি যেন মরুর বুকে এক পলশা বৃষ্টির ন্যায়। গাড়ি চলতেই ভ্রম দূর হয় ইনায়ার। পাশের সিটে একজন বয়স্ক লোক বসে আছে। আনুমানিক বয়স পঞ্চাশ হবে হয়তো। কিছুদূর যেতে ইনায়া লক্ষ্য করলো, লোকটি তার পায়ের দিকটা স্পর্শ করেছে। ইনায়া ভয়ার্ত মুখে লোকটার দিকে তাকায়। গাড়ির হালকা ঝাঁকিতেই লোকটা তার উপর ঢলে পড়ছে। ইনায়া প্রচন্ড অসস্থি নিয়ে জানলার দিকে চেপে বসে। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে তার। এমন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ এতোটাই নিচু মন মানসিকতা। ইনায়া আশে পাশে তাকাতেই দেখতে পায় তার বয়সি একটা মেয়ের পাশের সিট খালি আছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটাকে বলে উঠল,
-” উঠে দাড়ান এখান থেকে। ”
লোকটা পান খাওয়া দাঁতে বিশ্রী ভাবে হাসল। পা হালকা জমিয়ে ইনায়াকে যাওয়ার জন্য ইশারা করে লোকটা। ইনায়ার গা টা ঘিন ঘিন করে উঠে। সে এবার জোরেই বলে ওঠে,
-” উঠুন এখান থেকে আপনি। ”
ইনায়ার কথায় কয়েকজনের নজর তার দিকে পরে।
বাসের হেলপার দৌড়ে আসে।
-” কি হইছে আপা? ”
-” আমি এখানে বসবো না। ওনাকে উঠতে বলুন আমি ওই আপুটার পাশে বসবো। ”
মেয়েটাকে দেখিয়ে বলে উঠলো ইনায়া। হেলপার লোকটাকে সরিয়ে ওই মেয়েটা কে ইনায়ার পাশে বসায়। সাথে কয়েকজন ওই লোকটাকে বিশ্রী ভাবে গালিও দেয়। ইনায়া চোখ বন্ধ করে সিটে বসে পরে। তার সামনে আরও এইসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে সামনে কি হয় তা দেখার জন্যে।
হাতে ধোঁয়া উঠা কফির কাপ নিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে নাভান। চোখ তার সামনে,নিকষ কালো রাতের কুয়াশাজড়ানো আকাশ থেকে বহমান কুঁচি কুঁচি বরফের দিকে। প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস বইছে। কিন্তু এই ঠান্ডার মধ্যেও পাতলা ফুল হাতার একটি টি-শার্ট পরে দিব্যি দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। মাঝে মাঝে দু ঠোঁট ফাক করে কফি খাচ্ছে। হঠাৎ করেই ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দে পকেট থেকে ফোন বের করে নাভান। সামনে ধরতেই চমকে উঠে সে। ফোন স্কিনে ‘মা’ নামটি জল জল করছে। নাভান অনেক অবাক হয় আর নার্ভাসও লাগছে তার। কি মনে করে, মা এতদিন পরে তাকে কল করলো? নয় মাসে যে তার নাম শুনলেই সবাইকে বকাঝকা করতো। কতদিন পরে মায়ের সাথে কথা বলবে। কোথা থেকে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না নাভান। ভেতরটা যেন হাতুড়ি পেটা করছে কেউ। এরমধ্যে কয়েকবার কেটে কেটে ফোন আবার এসেছে। নাভান এবার ফোন রিসিভ করে কানে রাখে। অপাশ থেকে কোনো শব্দ পায়না সে। খানিক্ষন চুপ করে কম্পিত কণ্ঠে শুধায়,
-” মা ” ও মা কেমন আছো তুমি? ”
এই একটা বাক্যে ফোনের অপর পাশের ব্যাক্তির নিরবতা ভঙ্গ হয়। সোহানা মির্জা হাসে একটু। হ্যাঁ সে অনেক ভাল আছে। সামনে যে কাজ করবেন তিনি তাতেই আরও বেশি ভাল থাকবেন।
-” হুম, আছি তো বেশ। যেমন রেখে গিয়েছিলে। ভেবেছিলাম খারাপ থাকব। কিন্তু, আমার ভাল থাকাটা তা হতে দিচ্ছে কই? তাইতো না চাইতেও ভাল আছি। ”
মায়ের এমন কঠিন কথার মানে বুঝতে পারে নাভান। ঠিকই তো? সে তার মায়ের সব কষ্টের মুল। যিনি তার জন্য সারাজীবন এতো সেক্রিফাইস করেছে তাকে সে না বুঝেই অনেক বড় কষ্ট দিয়েছে। মা তো, সন্তানের দেওয়া শত কষ্ট মেনে নিয়েও বলতে পারে ভাল আছি। নাভান বিরবির করে আকুতি ভরা কন্ঠে বলে,
-” স্যরি মা, আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমার কষ্টের কারণ হতে চাইনি। ”
-” তুমি কেন স্যরি বলছো নাভান? ভুল তো আমি করেছি। আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছি। নিশ্চয়ই আমি তোমার মা হবার যোগ্যতা রাখি না। যোগ্যতা আর কি? আমি তো তোমার মাই নই। ”
-” মা কি বলছো? সত্যিই স্যরি, মাফ করে দাও আমাকে। হঠাৎ করে এতকিছু ঘটায় মেনে নিতে পারিনি আমি।”
নাভানের কথায় কিঞ্চিত হাসল সোহানা মির্জা। তার ছেলের এই একটি মাত্র বাক্য কি ঠিক করে দেবে? আগের গত নয়টা মাস। আর এক তরুণীর হ্দয় ভাঙা যন্তনা। না তো, ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অযথা, আর কোনো কথা না বাড়িয়ে তিনি কন্ঠে গম্ভীরতা এনে নাভানের উদ্দেশ্যে বললেন,
-” ভেবেছিলাম সারাজীবন তোমাকে খুশি রাখব। তোমাকে সবকিছুই বেস্ট এনে দিবো। কখনও তোমার মন খারাপের কারণ হবো না। ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো। কিন্তু? আমি স্যরি বেটা। আমার নিজের দেওয়া ওয়াদা আমি নিজে রাখতে পারিনি। ভালো মানুষ বানাতে পারিনি আমি তোমাকে। ভালো করতে গিয়ে সবসময় তোমার খারাপটা করে ফেলেছি। হয়তো তোমার মা হতে পারিনি। কিন্তু এবার থেকে আমি সব ঠিক করে দিবো। তুমি যা চাও তাই হবে। ”
কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন সোহানা মির্জা। নাভানও নিশ্চুপ কোনো কথা নেই তার মুখে। সোহানা হঠাৎ করেই নাভানকে আদেশের স্বরে বলে,
-” নেক্সট উইকে বাংলাদেশে আসো তুমি। ডিভোর্সের এপ্লাই করবো আমি। একটা পবিত্র বিয়েকে অবঙ্গা করেছো তুমি। তিন কবুল বলে যাকে বিয়ে করলে তাকেও অসম্মান করেছো। তোমার আদর্শ নীতি বিদেশের মাটিতে মিশে গেছে। এখন এই সম্পর্ক না রাখাই ভালো। ডিভোর্স হয়ে গেলে তারপর যাকে খুশী বিয়ে করে নিও এবং কি ওই বাজারে মেয়েটাকেও। এখন থেকে তোমার কথাই থাকবে। ”
কথাটা বলে নাভান কে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন কেটে দিলেন সোহানা মির্জা। নাভান গম্ভীর হয়ে চিন্তা করতে লাগলো। সোহানা হঠাৎ করে এমন ডিসিশন নিলেন কেনো? সেটা নাভানের বোধগম্য হচ্ছে না। কই এই নয় মাসে দাদির সাথে কথা বলে তার মনে হয়নি। যে সোহানা ওই মেয়েটাকে এতো সহজে ছাড়বে। আর বাড়িতে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে? মা তার সাথে এমন পরপর ভাবে কথা বলল কেনো? ভাবছে নাভান। অনেক কথা ঘুরছে নাভানের মাথায়। শীঘ্রই তাকে বাড়ি যেতে হবে।
দীর্ঘ একঘন্টা বিশ মিনিট পরে নির্ধারিত জায়গায় থামলো বাসটি। ইনায়া ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে গেলো। এতোক্ষণ সে প্রচুর অসস্তিতে ভুগছিল। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সময়টা দেখে নেয় ইনায়া। ১২ টা বাজে প্রায়। মায়ের মুখে দু একবার নানা বাড়ির নাম শুনেছিল ইনায়া। সেটাতেই ভরসা করে এতদূর আসা তার। ইনায়ার নানা রেজাউল করিম একসময় এই এলাকার মেয়র ছিলেন। মায়ের থেকে শুনা তার নানা জীবনের অর্ধেক সময় রাজনীতিতে দিয়েছেন। এলাকার বাসিন্দাদের প্রিয় নেতা ছিলেন তিনি। ইনায়ার বিশ্বাস রেজাউল করিমের নাম বললে যে কেউ তাকে বাড়ির ঠিকানা বলে দিবে। ইনায়া নিজের মনের জোর বাড়িয়ে সামন হাটে। কয়েক জন কে জিজ্ঞেস করার পরও কেউ বাড়ির সঠিক ঠিকানা বলতে পারেনা। ইনায়ার নিজের প্রতি রাগ প্রচুর রাগ হচ্ছে এখন। তার নানা বেঁচে নেই, এখন তার মামা সেখানে নাও থাকতে পারে। ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের একটা দোকানে যায়। একটা পানির বোতল কিনে সাইডে দাড়িয়ে চোখে মুখে পানি দেয়। দোকানে একটা বয়সী লোক বসে চা খাচ্ছে। ইনায়া লোকটার কাছে রেজাউল করিমেরর কথা জিজ্ঞেস করতেই, লোকটা তার দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব’লে,
-” তার বাড়ি কোথায় আমি জানি। কিন্তু বাড়ির খবর দিয়ে কি করবে তুমি? তিনি তো এখন বেঁচে নেই। ”
ইনায়ার মলিন মুখে হাসি ফুটলো তৎক্ষনাৎ। সে খুশি হয়ে লোকটা কে বলে,
-” তিনি আমার নানা। আমার মামা মিজানুল করিম। আমি পুরান ঢাকা থেকে এসেছি। ”
ইনায়ার কথায় লোকটা বিস্ময় হয় প্রচুর। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। তারপর মুখে হাসি টেনে ব’লে,
-” তোমার মায়ের নাম কি সাজিয়া? ”
মাথা নাড়ায় ইনায়া অবাক হয়ে বলে
-“আপনি কি করে জানলেন?”
-“আমি সুরেশ, আমি ওই বাড়িতে আজ ২৫ বছর ধরে ড্রাইভারের চাকরি করি। তোমার মাকেও আমি দেখেছি। চলো আমার সাথে। তোমারে নিয়ে যাই। ”
ইনায়া রাজি হলেও ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে। এভাবে একটা অচেনা লোককে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে? সুরেশ ইনায়া কে বলল তার সাথে গাড়িতে বসতে। ইনায়া মনে হাজার শংকা নিয়ে গাড়িতে বসে। যেতে যেতে সুরেশ মিজানুল করিমের অবস্থানের কথা বলল। তার দুই ছেলে এক মেয়ে। তিনি তার বাবার মতো রাজনীতি করেনি। সে একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। মিজানুল সবসময় রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছেন। কিন্তু তার দুই ছেলে যেন দাদার আদর্শই ঠিক মতো মাথা পেতে নিয়েছে। শত চেষ্টা করেও ছেলেদের রাজনৈতিক বিষয় থেকে সরাতে পারেননি। বড় ছেলে ফাহাদ করিম বর্তমান মেয়র। আর ছোটজন, বড় ভাইয়ের উপর বিশাল বট বৃক্ষের ছায়া মতোন এক বা পাশ। দুজনেই তুখোড় রাজনীতিবীদ তাদের সাথে বাবার সম্পর্ক দা কুমড়ার মতো। এইসব গল্প শুনতে শুনতে কাংখিত জায়গায় পৌঁছে যায় ইনায়া।
চলবে…….……
(আমার ফোনটা হাত থেকে পরে, ডিসপ্লের যা-তা অবস্থা হয়েছে। গল্প ছোট বোনের ফোন থেকে দিয়েছি। সবাইকে লম্বা একটা স্যরি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।প্লিজ সবাই লাইক কমেন্ট করবেন। এতে আমার লেখার উৎসাহ বাড়ে।)