#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব১৭
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
মেডিকেলে ক্লাস শেষ করে শুভ ভাইয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছি আমি আর ইভা। কথা ছিলো তিনজন একসাথে বাড়ি যাবো। আমরা সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি তবে তার দেখা নেই। অগত্যা ইভাকে রেখে শুভ ভাইয়ের কেবিনের দিকে হাঁটা দিলাম। শুভ ভাইয়ের কেবিনের সামনে যেতেই ভিতর থেকে কোনো মেয়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। দরজা হাল্কা ফাঁকা করে দেখলাম শুভ ভাই চেয়ারে বসে আছে আর সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার মুখ ঠিক মতো দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা ঘুরতেই দেখলাম এতো ফাইনাল ইয়ারে তিথি আপু। মেয়েটার মাঝে কেমন গুন্ডি গুন্ডি ভাব আছে। তিথি আপুকে দেখে শুভ ভাই উঠে দাঁড়ালেন। তিথি আপু এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করছে,
“মেয়েটা কে যার সাথে সকাল বেলা হাত ধরে আশা হচ্ছিলো? সাথে মুখে লেগে ছিলো চব্বিশ ক্যারেট গোল্ডের হাসি। ক্লাসে তো সব সময় গোমড়া মুখে দেখা যায়। আর মেয়েটাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো? আবার ঢং করে পাখি ডাকা হচ্ছিলো, ভালোবাসা যেন উতলে উতলে পড়ছে। মেয়েটা কে?”
তিথি আপু এগিয়ে যাচ্ছে আর ভাইয়া পিছিয়ে যাচ্ছে। শুভ ভাইয়ের মুখে ভয়ের রেখা দেখা যাচ্ছে। ভাইয়া সাবধান করে বলল,
“সামনে এগোবে না মেয়ে”
“এগোলে কি করবেন?”
“আমি তোমার টিচার”
“টিচারের গুল্লি মারি। আপনি আগে বলেন মেয়েটা কে?”
শুভ ভাইয়া তড়িঘড়ি করে বলল,
“বোন! বোন হয় আমার”
“বোন? কেমন বোন? কোন জনমের বোন?”
“কাজিন হয় আমার”
“মানুষ কাজিনকে পাখি বলে সম্মোধন করে আমার জানা ছিলো না তো”
“ও আমার কাজিন হলেও আমি ওকে আমার বোনের চোখে দেখি। আর বোনকে আদর করে পাখি ডাকাই যায়”
তিথি আপু এগিয়ে গিয়ে শুভ ভাইয়ের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“তাহলে ঠিক আছে”
তিথি আপু ভাইয়ার থেকে দূরে সরে এলো। এতক্ষনে শুভ ভাই সস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। আমার গম্ভীর, শান্তশিষ্ট, পড়ুয়া ভাই যে তিথি আপুর জালে ফেঁসে গেছে সেটা আমি হারে হারে টের পাচ্ছি। তবে দুজনের জুটিটা অনেক সুন্দর হবে। একজন চুপচাপ শান্ত আরেক দুরন্ত। দুজনের জুটি জমবে বেশ। আমি কাশি দিয়ে উঠলাম। আমার শব্দ পেয়ে দুজনে সরে দাঁড়ালো। শুভ ভাই বলল,
“পাখি তুই এখানে? কোনো দরকার?”
“তুমি না বলেছিলে একসাথে বাড়ি যাবে। সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষা করছি কিন্তু তোমার তো আসার নামই নেই”
“সরি পাখি খেয়াল ছিলো না”
শুভ ভাইয়া পকেট হাতড়ে কিছু একটা খুঁজছেন। তিথি আপু যাওয়ার আগে আমার গাল টেনে আদর করে দিয়ে বললেন,
“মাশাআল্লাহ তুমি অনেক কিউট। ননদ হিসেবে একদম পারফেক্ট। আজ থেকে আমিও তোমাকে পাখি বলে ডাকবো। তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম। আপু যেতে যেতে বলল,
“কিউট গার্ল”
শুভ ভাই পকেট হাতড়ে গাড়ির চাবি বের করে হাতে দিয়ে বললেন,
“তোরা গাড়িতে গিয়ে বস। আমি ২ মিনিটের মাঝেই আসছি”
ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ঢুকছি। ইভা আর শুভ ভাই তাঁদের রুমে চলে গেছে। রুমে ঢুকে ব্যাগটা রেখে পিছনে ফিরতেই অবাক হয়ে গেলাম। আদ্র ভাই আমার বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে আছে। উনি কখন এলেন? তাকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এই মানুষটাই যে এখন আমার মন খারাপের মেডিসিন। সে এসে পাশে থাকলে মন খারাপেরা কোথায় যেন পালিয়ে যায়।
“তুমি? তুমি কখন এলে?”
“রৌদ্রময়ী তো আমায় পাত্তাই দিচ্ছে না তাই ভাবলাম আমিই তার সাথে দেখা করতে চলে আসি। রৌদ্রময়ী কঠোর মনের মানুষ, আমি তো আর তার বেলায় কঠোর হতে পারিনা”
“নাটক কম করো পিও”
আমার কোথায় আদ্র ভাইয়া ফিক করে হেসে দিলেন। উঠে এসে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলল,
“সত্যিই কি আমি তোর প্ৰিয়?”
“অপ্রিয় হওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না”
“তাহলে বলে ফেল”
“কি?”
আদ্র ভাই চোখে চোখ রেখে বললেন,
“ভালোবাসি”
“সঠিক সময় হলে বলবো”
“অপেক্ষায় রইলাম”
আদ্র ভাই চলে গেলেন। আমি তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলাম।
—–
বাড়িতে আয়োজন চলছে। ঈশিতা আপুকে দেখতে আসবে। আমি, ইভা, রোশনি আপুর রুমে বসে আছি। আপু এক মনে সেজে চলেছে। মুখে লেগে আছে মিষ্টি হাসি। হাসি থাকবেনাই বা কেন? তার ভালোবাসার মানুষটি যে আসছে। তৎক্ষণাৎ মাথায় এলো আদ্র ভাই যদি কখনো আমায় এভাবে দেখতে আসে তখন কি হবে? আমি তো লজ্জায় লাল হয়ে যাবো। এতদিন যাকে ভাই হিসেবে দেখে আসছি ভবিষ্যতে তাকে জামাই হিসেবে দেখতে হবে। ভাবতেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগছে। পাশ থেকে ইভা খোঁচা দিয়ে বলল,
“আপুকে দেখতে আসছে কিন্তু তুই এমন লজ্জায় লাল হচ্ছিস কেন?”
ইভার কথায় নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম,
“তোর চোখে ছানি পড়েছে ডাক্তার দেখা। নাহয় ভবিষ্যতে জামাই পাবি না”
ইভা মুখ ভেংচি দিলো। আপু এখনো সেজেই চলেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে আজকে তার বিয়ে।
“আপু একটু কম করে সাজো নাহয় হবু দুলাভাই তোমাকে দেখে ফিট খাবে”
“তুই চুপ থাক তো। আমাকে সাজতে দে”
ভদ্র মেয়ের মতো চুপ করে গেলাম। কিছুক্ষন পর আদ্র ভাই এসে বলল আপুকে নিচে নিয়ে যেতে। আমি আর ইভা মিলে আপুকে নিয়ে যেতে লাগলাম। দরজার সামনে আসতেই আদ্র ভাই ডেকে উঠলো। আপুর সাথে রোশনিকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আদ্র ভাইয়ের কাছে গেলাম।
“বলো”
“তুই ওদের সামনে যাবি না”
“কেন?”
“পড়ে যদি তোকে দেখে পাত্রপক্ষ পছন্দ করে বসে তখন? আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইনা”
“আমি এতটাও সুন্দর নই যে আমাকে দেখে পছন্দ করে ফেলবে”
“তুই যদি আমার চোখ দিয়ে নিজেকে দেখিস তাহলে দেখবি চোখের সমানে পৃথিবী সবচেয়ে সুন্দর রমণী। যার সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয়না। যার সামনে বিশ্ব সুন্দরীও কম পড়ে যাবে”
আদ্র ভাইয়ের কথায় লজ্জা পেলাম। লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেললাম। এই লোকটার প্রেমিক সত্ত্বা বড্ড ভয়ংকর। উনি যেন সব সময় আমায় লজ্জা দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকেন। আদ্র ভাই আমার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে তুলে ধরলেন। তার চোখের দিকে তাকাতেই এক রাশ লজ্জারা আমায় ঘিরে ধরলো। চোখ নামিয়ে নিলাম।
“আমার রৌদ্রময়ী লাজুকলতা হলো কবে থেকে? সেকি জানে তার লজ্জা রাঙা মুখশ্রী আমায় তার প্রেমে পড়তে বাধ্য করে। তার প্রেমে আমি এতটা বাজে ভাবে পড়ছি যে এখন কোনো কুল কিনারাই খুঁজে পাচ্ছি না। রৌদ্রময়ী কি আমায় এই অতল গভীর সমুদ্র থেকে টেনে তুলবে?”
“আমার সময় নেই”
“এতটা নির্দয় হোস না। আমি যে মাঝ সমুদ্রে ভেসে যাবো”
“ভেসে গেলে জাল দিয়ে টেনে তুলবো”
নিচে শুভ ভাই আদ্র ভাইকে ডাকছে। আদ্র ভাই বিরবির করে বলল,
“একটু প্রেমআলাপ করবো কিন্তু এই শা*লা নামক জ্বালাদের জন্য সেটাও পারছি না”
আদ্র ভাই যাওয়ার আগে ফের বলে গেলেন,
“তোকে যেন আশেপাশেও না দেখি”
কি আর করার ওপরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে নিচে কি হচ্ছে তাই দেখার চেষ্টা করছি। ঈশিতা আপুর হবু বরের নাম শিহাব। শিহাব ভাইয়া আপুর দিকে তাকিয়ে আছে। আর এদিকে আপু লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। তবুও একটু পর পর আড়চোখে তাকাচ্ছে। শিহাব ভাই সবার অগোচরে আপুকে চোখ টিপ দিলো। আপু লজ্জায় মরি মরি অবস্থায়। ওদের কাহিনী দেখে আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে।
—–
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। সারা ব্যালকনি জুড়ে রজনীগন্ধার সুবাসে ছড়াছড়ি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে উপভোগ করছি। এমন সময় ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। এই বৃষ্টির সাথে গরম ধোয়া উঠা চা হলে জমে যেত। কিন্ত আলসেমি লাগছে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিচ্ছি। এমন সময় ব্যালকনিতে কারো প্রবেশ ঘটলো। আদ্র ভাই আমার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিলো। কাপ হাতে নিয়ে দেখি চা। আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি বুঝলে কিভাবে এখন আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে?”
“রৌদ্রময়ী যে চা খেতে খেতে বৃষ্টি দেখতে পছন্দ করে সেটা আমার বরাবরই জানা”
“এতটা জানো?”
“সন্দেহ আছে?”
“একটুও না”
দুজনের মাঝে নীরবতা। চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর আর বৃষ্টি দেখছি। আদ্র ভাই চা টা দুর্দান্ত বানায়। আমি নিজেও হয়তো এতো ভালো চা বানাতে পারবো না। আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম,
“কোন ললনার জন্য চা বানানো শিখেছিলে শুনি?”
“যেই ললনা এখন চা খাচ্ছে তার জন্য। ইচ্ছে ছিলো সে বৃষ্টি উপভোগ করবে আর আমি তার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসবো। অতঃপর দুজন মিলে ধোয়া ওঠা চায়ের সাথে বৃষ্টিবিলাস করবো”
কথার পৃষ্ঠে কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় মানুষটার ভালোবাসার সমুদ্রে অতল গহীনে হারিয়ে যাই। ডুবে যাই তার প্রেম সাগরে। তখনই ভেসে উঠে অতীত। অতীতেও তো কাউকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম তাকে। কিন্তু সে চায়নি। মাথায় এটা প্রশ্ন আসলো।
“আদ্র ভাই মানুষ কখনো দ্বিতীয় বার কারো প্রেমে পড়তে পারে?”
“অবশ্যই পারে। মানুষ তখন দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ে যখন প্রথম মানুষটা ভুল হয়”
চুপ করে রইলাম। আদ্র ভাই ফের বললেন,
“এইযে আমায় দেখ আমি প্রতিনিয়ত নতুন করে তোর প্রেমে পড়ছি। নতুন ভাবে ভালোবাসতে শিখছি। তুই আমার সঠিক মানুষ তাই আমি বারেবারে তোর প্রেমেই পড়ি”
এই মানুষটা বরাবরই আমায় অবাক করে। তাকে ভালোবাসতে বাধ্য করে। একটা মানুষ কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে এটা আদ্র ভাইকে না দেখলে জানতেই পারতাম না। আদ্র ভাইয়ের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। তার চোখের দিকে তাকাতেই মনে হলো আমি হারিয়ে যাচ্ছি। একটু একটু করে তার ভালোবাসার অতল গভীরে হারিয়ে যাচ্ছি। যেখানে কোনো কুল কিনারা নেই। আছে আঁকড়ে ধরার মতো আদ্র নামের একজন মানুষ। যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই পুরোটা জীবন।
#চলবে?
(আদ্র আর রোদের জুটি আপনাদের কেমন লাগে? যারা যারা শুভ কে নায়ক ভেবেছেন তাঁদের জন্য এক বালতি সমবেদনা। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন।ধন্যবাদ)