#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব১৩
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
গোধূলি বিকেলে মন মাতানো স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ। হাওয়ার তালে দুলছে অবাধ্য কেশগুচ্ছ। ঠান্ডায় শীতল হয়ে আসছে শরীর। এতক্ষন স্বল্প রোদের দেখা পাওয়া গেলেও এখন নেই। ধীরে ধীরে শীতলতায় ছেয়ে যাচ্ছে ধরণী। দোলনায় বসে দোল খাচ্ছি আর পরিবেশ উপভোগ করছি। কিন্তু সেটা যেন একজনের সহ্য হচ্ছে না। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এতদিন ঘুরেফিরে হয়নি? এখন পড়া বাদ দিয়ে এখানে কি করছিস?”
আমাদের বাড়ির পড়ুয়া ছেলে শুভ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। মেজাজ কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। চলতি ফিরতি বইয়ের দোকান কি এখান আমাকে একটু পরিবেশ উপভোগ করতেও দিবে না?
“আমাকে কি তোমার কোনো দিক দিয়ে রোবট মনে হয়? আমার অন্য কোনো কাজে নেই সারাদিন শুধু বই নিয়ে বসে থাকবো?”
“সারাদিন বই না পড়লে যখন পরীক্ষায় ডাব্বা পাবি তখন বুঝবি। ডাক্তার হওয়া এতো সহজ না। তার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়”
শুভ ভাইয়ের সামনে হাত জোর করে বললাম,
“মাফ করো ভাই আমায়। কোন দুঃখে যে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম আল্লাহ জানে। কোথায় সবাই শীতের ছুটিতে এদিক ওদিক ঘুরতে যাচ্ছে আর আমার ভাই আমাকে বইয়ের মাঝে ডুবিয়ে মারছে”
“বেশি কথা না বলে পড়তে যা”
শুভ ভাইয়ের ওপর রাগ করে গট গট পায়ে চলে এলাম। এই লোকের যন্ত্রনায় বাঁচি না। সারাদিন বই, বই আর বই। পারে না আমায় বইয়ের মাঝে ডুবিয়ে মা*রে। পড়ার কথা মনে করতেই এডমিশনের কথা মনে পড়ে গেল। এডমিশন টেস্ট এর কথা মনে হলে গাঁ শিউরে উঠে। সেকি টর্চার। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আমার কিন্তু সব দায়িত্ব যেন ওনার। কোচিংয়ে ভর্তি করা থেকে শুরু করে সব কিছু। আজকে এই সিট্ তো কাল ওই সিট্ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো তাড়াতাড়ি পড় আমি এসে পড়া জিজ্ঞেস করবো। তখন শুভ ভাইকে ভাই কম কসাই বেশি মনে হতো। একদিন শুভ ভাই পড়ানোর সময় তো জিজ্ঞেস করেই বসেছিলাম,
“শুভ ভাই তুমি ভাই নাকি কসাই?”
শুভ ভাই পড়ানো তে মনোযোগী থাকায় ঠিক ভাবে শুনতে পায়নি। শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বললি? শুনতে পাইনি, আবার বল”
“কিছু না। তুমি পড়াও”
ওনার জ্বালায় আমি আর ইভা শান্তি মতো তিনমাস ঘুমাতেও পারিনি। দিনের তিনভাগের দুইভাগ সময়ই বই নিয়ে বসিয়ে রাখতো। ইভা আর আমি তাকে মনে মনে কতো যে বকেছি তার শেষ নেই। তার এই কঠোর পরিশ্রমের ফল হিসেবে এখন আমি আর ইভা ঢাকা মেডিকেলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সেবার মেধা তালিকায় তেত্রিশ তম হয়েছিলাম। রেজাল্ট দেখে আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না এটা আমার রেজাল্ট। সেদিন আমার থেকেও কয়েক গুন বেশি খুশি ছিলেন শুভ ভাই আর আদ্র ভাই। আদ্র ভাই তো সকাল সকাল বাড়ি এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়েছিলেন। একটু পর পর চেক করছিলেন রেজাল্ট দিয়েছি নাকি। তার কপালে ছিলো চিন্তার ভাজ। মনে হচ্ছে আমার না তার রেজাল্ট দিবে। রেজাল্ট শুনে বাড়ির সবাই খুব খুশি হয়েছিলো। কেউ ভাবেই নি আমার মতো পড়ায় ফাঁকিবাজি করা মেয়ে কখনো মেডিকেলে চান্স পাবে। সেদিন আমার খুশির শেষ ছিলো না। আমি আমার স্বপ্নের একধাপ কাছে এগিয়ে গিয়েছিলাম। পুরোনো স্মৃতি মনে করতে করতে রুমে চলে এলাম। কি আর করার ফ্রেশ হয়ে এসে বই নিয়ে বসে পড়লাম। ফুপ্পির বাসায় দিব্বি ভালোই তো কাটছিলো দিনগুলো। আরু আর ফুপ্পির সাথে গল্প করে মাঝে মাঝে আদ্র ভাইয়ের সাথে খুনসুটি, আবদার করে কিভাবে যে দিনগুলো চলে গিয়েছে তার খেয়াল নেই। গতকাল বিকেলে আরু আর আমি ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করছি এমন সময় শুভ ভাইয়ের ফোন। ফোন রিসিভ করতেই গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে এলো,
“পড়াশোনা কি লাটে তুলে দিয়েছিস? বেড়ানো শেষ হয়নি? এভাবে ঘোরাঘুরি করলে ডাক্তার তো দূর কম্পাউন্ডারও হতে পারবি না”
“এভাবে বলছো কেন? একটু ঘুরতেই তো এসেছি। সব সময় তো পড়ি”
“এভাবে বলবো না তো কিভাবে বলবো? দুইদিনের কথা বলে পাঁচ দিন হয়ে যাচ্ছে। একটা মেডিকেল স্টুডেন্ট এর জন্য সময় কতো গুরুত্ব পূর্ণ জানিস? তুই নিজে আসবি নাকি আমি আসবো নিতে”
মেকি হেসে বললাম,
“তোমার কষ্ট করার দরকার নেই আমিই আসছি”
তার হুমকি শুনে সকাল সকাল বাড়ি এসে হাজির হয়েছি। ইভা গিয়েছে ওর নানু বাড়ি। বাড়িটা এখন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কারো সাথে যে গল্প করবো তারও কোনো উপায় নেই। অগত্যা সব ভাবনা বাদ দিয়ে পড়ায় মনোযোগী হলাম।
——–
সূর্যের আলোয় আলোকিত ধরণী। সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ফ্রেশ হয়ে ব্যালকনিতে যেতেই চোখ পড়লো আমার ব্যালকনি বরাবর কৃষ্ণচূড়া ফুলের গাছের দিকে। কৃষ্ণচূড়ার লাল রং আমায় খুব করে টানে তার কাছে। এখান থেকে দেখে শান্তি লাগছে না। ইচ্ছে হচ্ছে কাছে গিয়ে ছুঁয়ে দিতে। দৌড়ে লাগলাম বাগানের উদ্দেশ্যে। দরজার সামনে যেতেই ধাক্কা লাগলো কারো প্রসস্থ বুকের সাথে। নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।
“এরকম উদভ্রান্তের মতো কোথায় ছুটছিস? ট্রেন মিস হয়ে যাচ্ছে নাকি?”
“তুমি বুঝবে না। সামনে থেকে সর তো”
আমার কথায় আদ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কোমরে হাত গুঁজে বলল,
“কোন রাজকার্যে যাচ্ছিস শুনি”
“বাগানে যাচ্ছি”
বলেই ছুট লাগলাম। পিছন থেকে আদ্র ভাই চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“সাবধানে যা”
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। গত বছর এই গাছগুলো আমায় আদ্র ভাই গিফট করেছে। গাছ গুলো এখন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে। একদিন কলেজ যাওয়ার সময় আদ্র ভাইকে কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখিয়ে বলেছিলাম,
“আদ্র ভাই দেখো কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো অনেক সুন্দর না? ইসস আমাদের বাগানে যদি একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ থাকতো”
আদ্র ভাই গাড়ি চালাতে চালাতে সায় জানিয়েছিল। বাকিটা সময় দুজনে চুপচাপ ছিলাম। সেদিন বাসায় এসে মনটা একটু খারাপ ছিলো। বিকেলে পড়ছি এমন সময় ইভা ডেকে বলল,
“বনু দেখে যা”
“মন ভালো নেই। তুই যা তো এখান থেকে”
“আরে তুই এসে একবার দেখবি তো। জিনিসটা দেখতেই তোর মন নিমিষেই ভালো হয়ে যাবে”
টেবিল থেকে উঠে ইভার সাথে নিচে নেমে এলাম। নিচে নামতেই ইভা আমার চোখ ধরে নিল।
“কি হলো চোখ ধরলি কেন?”
“কানামাছি খেলবো তাই?”
“কানামাছি খেলবি ভালো কথা আমার চোখ কেন ধরেছিস?”
“এতো কথা না বলে একটু চুপ থাক না”
একটু পর চোখ ছাড়তেই নজরে এলো কৃষ্ণচূড়া গাছ। মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। এক সারিতে অনেক গুলো কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছে কয়েক গুচ্ছ ফুল ফুটে আছে। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলাম ফুলগুলো। ইভার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কে এনেছে এগুলো?”
ইভা ইশারা করলো। ওর হাতের ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখি আদ্র ভাই একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে মুচকি হাসি। চোখে তার মুগ্ধতা। আদ্র ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম,
“তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আদ্র ভাই”
আদ্র ভাই গাল টেনে দিয়ে বলল,
“এই মিষ্টি মুখে মিষ্টি হাসি যেন সর্বদা লেগে থাকে। তার হাসি মুখ দেখার জন্য পুরো শহর আমি কৃষ্ণচূড়ায় রাঙাতেও রাজি আছি”
হেঁটে হেঁটে সবগুলো গাছ ছুঁয়ে দিচ্ছি । আমার খুশির যেন শেষ নেই। সারা বাগান ঘুরে বেড়াচ্ছি। হটাৎ খেয়াল হলো একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে চিরকুটের মতো কিছু। হাত বাড়ালাম নেওয়ার জন্য কিন্তু নাগাল পাচ্ছি না। লাফ দিয়ে চিরকুটটা হাতে নিলাম। চিরকুটে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা,
“কৃষ্ণচূড়ার লাল রং ছড়িয়ে যাক তার শহর জুড়ে।রঙের সমাহারে ভরে উঠুক তার আঙিনা। কৃষ্ণ চূড়ার ন্যায় রঙিন হয়ে উঠুক তার জীবন”
ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। এটা যে আদ্র ভাইয়ের কাজে সেটা বুঝতে একটুও সময় লাগলো না। চিরকুটটা সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিলাম। কৃষ্ণচূড়া গাছ গুলো একে একে ছুঁয়ে দিচ্ছি। কানে এলো করো কণ্ঠস্বর,
“লাল রঙা কৃষ্ণচূড়ায় নতুন রূপে সেজে উঠুক রৌদ্রময়ীর শহর”
#চলবে?
(গল্পটা আপনাদের কাছে কেমন লাগছে? ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন। আপনার মূল্যবান সময় ব্যায় করে গল্পটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ)