#উষ্ণ_প্রেমের_আলিঙ্গন
#পর্ব১৪
#আফিয়া_আফরোজ_আহি
বিকেলের রোদের লালচে আভা মিলিয়ে যাচ্ছে অস্তাচলে। নদীর তীরে পরিবেশটা মনমুগ্ধ কর। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির ওপার সৌন্দর্যে। বন্ধুরা মিলে অনেক দিন কোথাও ঘোরাঘুরি হয় না। পড়তে পড়তে নিজেদের কেমন রোবট রোবট ফিল হচ্ছিলো। তাই সবাই মিলে প্ল্যান করে এই গোধূলি লগ্নে প্রকৃতি বিলাস করতে চলে এলাম। সবাই যার যার মতো করে হাটছে। আমি আর ইভা একসাথে হাটছি আর গল্প করছি। এমন সময় কেউ খপ করে হাতটা ধরে নিল। তাকিয়ে দেখলাম মেডিকেলের সিনিয়র ভাই। ছেলেটা কয়েক দিন ধরে বড্ড জ্বালাচ্ছে। যেখানে যাই হেংলার মতো তাকিয়ে থাকে।
“কি বেপার ললনা কোথায় যাওয়া হচ্ছে? মেডিকেলে তো তোমার পাত্তাই পাওয়া যায় না”
“হাত ছাড়ুন”
“একটু আলাপচারিতা হোক তারপর নাহয় হাত ছেড়ে দিবো”
মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে থা*প্পরে বেটার গাল লাল করে দেই। আশেপাশে মানুষের সমাহার তাই নিজেকে সামলে নিলাম। তার ওপর সিনিয়র বলে কথা পড়ে যদি মেডিকেলে ঝামেলা করে । পুনরায় ভদ্র ভাবে বললাম,
“হাতটা ছাড়ুন। নাহয় ভালো হবে না বলে দিলাম”
“কি খারাপ করবে দেখি?”
পাশ থেকে ইভা বলল,
“মানুষ জড়ো করে কেলানি খাওয়াবো বেশি করলে। ওর হাত ছাড়ুন”
তবে তার হাত ছাড়ার লক্ষণ নেই। হাত মুচড়ামুচড়ি করছি কিন্তু ছাড়াতে পারছি না। মাথায় একটা বুদ্ধি এলো পা দিয়ে তার পায়ে পারা দিতে যাবো তার আগে কেউ একজন ছেলেটার বুক বরাবর লাত্থি দিলো। ছেলেটা ছিটকে যেয়ে কিছুটা দূরে পড়লো। আমি আর ইভা ভয় পেয়ে গেলাম। লাত্থি দেওয়া মানুষটাকে দেখতে পিছনে ফিরতেই ঝটকা লাগলো। এতক্ষন রেগে থাকলেও এই মুহূর্তে ভয় লাগছে। আদ্র ভাই দাঁড়িয়ে আছে। রাগে তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। আদ্র ভাই ছেলেটাকে উঠিয়ে ইচ্ছে মতো মারছে আর বলছে,
“তোর সাহস কিভাবে হলো ওর হাত ধরার? তোর এই হাত আমি হাতের জায়গায় রাখবো না ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবো”
আদ্র ভাই ছেলেটার হাত মুচড়ে ধরলেন। হাস্যজ্জল আদ্র ভাইকে এই মুহূর্তে ভয়ানক লাগছে। ছেলেটা চিৎকার দিয়ে উঠলো। আশেপাশে এতক্ষনে মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছে। আমার সকল ফ্রেন্ডরা এসে জিজ্ঞেস করছে,
“কি হয়েছে রে? আর এই ছেলেটাই বা কে?”
একজন বলে উঠলো,
“যেই হোক দেখতে কিন্তু একদম হিরোর মতো”
আমি আছি টেনশনে আর এই মুহূর্তেও এদের ছেলে নিয়ে না ভাবলেই নয়। ছেলেটার অবস্থায় শোচনীয়। আর কিছুক্ষন মারলেই ছেলেটার খারাপ কিছু হয় যেতে পারে। আদ্র ভাইকে আটকাতে হবে। কিন্তু তার কাছে যেতেই যে ভয় করছে। তাও কোনো রকম সাহস সঞ্চয় করে আদ্র ভাইয়ের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
“আদ্র ভাই ছেড়ে দাও নাহয় ছেলেটার হাত ভেঙ্গে যাবে”
“যেই হাত তোকে ছোয়ার সাহস দেখাবে সেই হাত আমি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেব”
অনেক কষ্টে আদ্র ভাইকে টেনে সেখানে থেকে নিয়ে এলাম। একটু দূরেই আদ্র ভাইয়ের গাড়ি পার্ক করা। তাকে গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে পানি এনে দিলাম। আদ্র ভাই ঢকঢক করে সব পানি খেয়ে নিল। বিরবির করে বলে উঠলো,
“ওই হা*রামির সাহস হয় কিভাবে আমার রৌদ্রময়ীর হাত ধরার?”
আদ্র ভাই বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“গাড়িতে উঠ”
ইভা সুরসুর করে গাড়িতে উঠে বসলো। আমি দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। ধমকে বলে উঠলো,
“গাড়িতে উঠতে বলছি কথা কানে যায় না?”
আদ্র ভাইয়ের ধমকে কেঁপে উঠলাম। রাগ যেন তার নাকের ডগায় উঠে এসেছে। এখন আর রাগানো ঠিক হবে না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িতে পিন পতন নীরবতা। বাড়ির সামনে গাড়ি থামালে ইভা আগে ভাগে নেমে গেল। বাঘের গুহায় রেখে গেল আমাকে। নেমে বাড়িতে ঢুকবো এমন সময় আদ্র ভাইয়ের কণ্ঠ,
“এরপর ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হলে আমাকে বা শুভ ভাইকে যেন বলা হয়। একা একা বাড়ি থেকে বের হলে পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রাখবো”
আমার কি হলো জানি না বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলাম,
“পা ভাঙলে পা ভাঙা মেয়েতো কেউ বিয়ে করবে না। তখন আমার কি হবে?”
বলে ঠোঁট উল্টে ফেললাম। আদ্র ভাই রাগের মাঝেও ফিক করে হেসে দিলেন।
“তোর এতো কিছু নিয়ে না ভাবলেও চলবে। কেউ একজন আছে যে তোকে যেকোনো পরিস্থিতি বিয়ে করতে এক পায়ে রাজি”
“কে সে?”
“তোর এতো কিছু জানতে হবে না।তুই বাড়িতে যা”
বাড়িতে ঢুকতেই আম্মুর প্রশ্ন,
“তোরা এলি আদ্র কোথায়? ছেলেটা এসে তোদের না পেয়ে আমার থেকে জেনে তোদের আনতে গেল এখন তোরাই ওকে রেখে চলে এলি?”
“তোমাদের ছেলে কি খোকা বাবু যে তাকে কোলে করে নিয়ে আসতে হবে? আসছে পিছনে”
ধুপধাপ পা ফেলে ওপরে চলে এলাম। আদ্র ভাই পাড়লো আমাকে এভাবে ধমক দিতে? তার একটুও খারাপ লাগলো না? সব সময় বলে রোদ তোর মুখে হাসি মানায়, দুঃখ নয়। আজ সে নিজেই ধমক দিলো। কথাই বলবো না তার সাথে। এক সেট কাপড় নিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
———-
রাতে প্রায় বারোটার কাছাকাছি। টেবিলে বসে পড়ছি। পড়তে পড়তে মাথা ধরে গেছে। তাও পড়া শেষ হচ্ছে না। আগে যদি জানতাম মেডিকেলে এতো পড়া তাহলে ভুলেও মেডিকেলের নাম নিতাম না। কিন্তু কি করার স্বপ্ন যখন দেখেছি পূরণ তো করতেই হবে। আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো পড়া শেষ হতে। একাধারে বসে থাকতে থাকতে কোমর ধরে গিয়েছে। একটু হাটাহাটি করা দরকার। সাথে খোলা হাওয়া হলে আরো ভালো হয়। বিছানায় রাখা ওড়না গাঁয়ে সুন্দর মতো জড়িয়ে ছাদের উদ্যেশে হাঁটা দিলাম। দোলনায় বসে দোল খাচ্ছি আর দূর আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। চাঁদটাও আমার মতো একা। রাতে সবাই ভুতের ভয়ে ছাদে না এলেও আমার রাতের বেলা ছাদে দাঁড়িয়ে পুরো শহর দেখতে খুবই ভালো লাগে। চারপাশ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ থাকে সাথে ঠান্ডা হাওয়া। মন নিমিষেই ভালো হয়ে যায়। এক মনে আকাশ পানে তাকিয়ে আছি এমন সময় কারো পায়ের আওয়াজ আসছে। পিছনে ফিরে দেখলাম কারো অবয় দেখা যাচ্ছে। কেউ এগিয়ে আসছে সামনে। সামনাসামনি আসতেই দেখলাম মানুষটা আর কেউ নয় আদ্র ভাই। তাকে দেখে বিকেলের কথা মনে পড়ে গেল। সে যেন আদ্র ভাইয়ের এক ভয়ংকর রূপ। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো তার ওই রক্তিম চোখ দ্বারা আমায় ভস্ম করে দিবে। তার ধ*মকের কথা মনে পড়তেই গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। আদ্র ভাই আমার বরাবর একটু দূরে রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে পাত্তা না দিয়ে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“এতো রাতে না ঘুমিয়ে কি করছিস?”
আদ্র ভাইয়ের কথার উত্তর দিলাম না। শুনেও না শোনার ভান ধরে একই ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আদ্র ভাই আবার বললেন,
“কি হলো কথার উত্তর দিচ্ছিস না কেন?”
“তোমার সাথে আমার কথা নেই?”
“কেন? আমি আবার কি করলাম?”
“তুমি আমায় ধমক দিয়েছো”
“শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে”
কিছু বললাম না। এটা তো সত্যিই যে আদ্র ভাই মানুষটা আমাকে সত্যিই অনেক আদর করে। যখন যা আবদার করি মুখে বলতে দেরি তার হাজির করতে দেরি নেই।
“আচ্ছা যা সরি। আর কখনো ধমক দিবো না। এখন খুশি?”
মাথায় দুস্টু বুদ্ধি চেপে বসলো। আদ্র ভাইকে একটু জ্বালানো যাক,
“কানে ধরে বলো তাহলে সরি একসেপ্ট করবো”
আদ্র ভাই করুণ চোখে তাকিয়ে বলল,
“কানে ধরতেই হবে?”
“হ্যাঁ”
“ঠিক আছে। আমি কানে ধরল তুই যদি খুশি হোস তাহলে তাই করি”
আদ্র ভাই কানে ধরতে যাবে তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলাম।
“হয়েছে কানে ধরতে হবে না। সরি একসেপ্ট করে নিয়েছি”
দুজনের মাঝে নীরবতা। দুজনেই তাকিয়ে আছি দূর আকাশের পানে। হটাৎ আদ্র ভাই বলে উঠলো,
“লং ড্রাইভ এ যাবি?”
“এখন?”
“হ্যাঁ। রাতের শহর ঘুরে আসবো দুজন মিলে”
“দেরি কিসের চলো”
দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। আদ্র ভাই গাড়ি ড্রাইভ করছে আর আমি পাশের সিটে বসে আছি। রাতের নিস্তব্ধ শহর। নেই কোনো যানজট, কোলাহল। অনেকক্ষন পর দুই একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছে। রাতের শহর যেন সত্যিই অন্য রকম। আদ্র ভাই গাড়ি এনে থামালো একটা নদীর পাশে। নদীর পাশে মস্ত বড় মাঠ। এই জায়গাটা শহর থেকে অনেকটা দূরে। গাড়ি থেকে নামতেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। শহরের কোলাহল ছেড়ে এই নিস্তব্ধতা যেন বড্ড সুন্দর লাগছে। নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ধপ করে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম।আমি বরাবরই প্রকৃতি বিলাস করতে পছন্দ করি। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ায় যেন এক অনন্য সুখ আছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে যান্ত্রিক এই জীবন ছেড়ে ছুড়ে দূর পাহাড়ে চলে যাই। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। আদ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম,
“আদ্র ভাই দেখো চাঁদ টা কতো মোহনীয় লাগছে না? দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে”
“রৌদ্রময়ী মোহের কাছে চাঁদ কিছুই নয়”
আদ্র ভাইয়ের কথা শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কিছু বললে?”
“নাতো”
আদ্র ভাইয়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দৃষ্টি স্থাপন করলাম চাঁদের দিকে। চাঁদের মোহনীয় আলোয় আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখ পড়লো আদ্র ভাইয়ের ওপর। তিনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে ধ্যানে বসেছেন। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“এভাবেই তাকিয়ে আছো কেন?”
“দেখছি?”
“কি দেখছো?”
“উস্কেখুস্ক এলোমেলো চুলে একদম পে*ত্নীর মতো লাছে তোকে। যে কেউ দেখলে হার্ট অ্যাটাক করতে পারে। আমার হার্ট স্ট্রং বলে এখনো বেঁচে আছি”
“আদ্র ভাই”
চি*ল্লিয়ে উঠলাম। আমায় পে*ত্নী বললো উনি? রাগে নাকের পাটা ফুলে উঠলো। আদ্র ভাই নাক টিপ দিয়ে বলে উঠলো,
“রাগলে তোকে একদম পাকা টমেটোর মতো লাগে। ইচ্ছে করে গাল গুলো টেনে দেই”
আদ্র ভাই গাল টেনে দিয়ে দৌড়। আমিও ছুটলাম তার পিছু পিছু। আদ্র ভাই এতো জোরে দৌড়াচ্ছে তার নাগাল পাচ্ছি না। অনেকক্ষন দৌড়াদৌড়ি করে হাপিয়ে গেছি। আর দৌঁড়াতে পারছি না। ধপ করে ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। আমাকে বসতে দেখে আদ্র ভাইও এসে পাশে বসে পড়লো। উনি বসতেই তার গাল টেনে দিয়ে বলে উঠলাম,
“হিসাব বরাবর”
আদ্র ভাই হেসে দিল। চাঁদের আলোয় তার হাসিটা যেন বড্ড সুন্দর লাগছে। এতো দিন খেয়ালই করিনি মানুষটা হাসলে তাকে এতটা সুন্দর লাগে। চোখ ফিরিয়ে নিলাম তার থেকে। আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে দুজনে বাড়ি ফিরে এলাম।
#চলবে?
(বিকেলে ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরেফিরে বাসায় এসে মনে পড়লো গল্প লিখার কথা। তৎক্ষণাৎ বসে পড়লাম গল্প লিখতে। তাই গল্প দেওয়ায় দেরি হয়েছে। তার জন্য দুঃখিত। ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন। ধন্যবাদ)