#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৫
“শেহরীনা তোকে একটা বুদ্ধি দেয়। সারোয়ার ভাইয়াকে যত জলদি পারিস বিয়ে করে ফেল। তারপর স্টাডি কন্টিনিউ করিস। দেখ আমার এই কথা বলার একটাই কারণ কায়েসাম। তোর আসা-না আসা, তোর বাসার কাহিনী থেকে শুরু করে বিয়ের কাহিনী পর্যন্ত পাই টু পাই খবর রাখতেছে সে। আমার মনে হচ্ছে সে তোকে ভীষণ ভালোবাসে।”
শেহরীনা বিরক্ত মুখ করে ইপশিতার কথায় তার হাত ছড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ইপশিতা বান্ধবীর রেগে যাওয়া মুখশ্রী দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,
“শুন আমরা মেয়েরা কস্মিনকালেও নিরাপদ নয়। কোথাও না কোথাও আমাদের আগে পিছে মানুষ নজর দিয়ে বসে থাকে। তুই না চেয়েও একজন ভালো মানুষ পাবি। হ্যাঁ আমি মানছি মানুষটার আগেও বিয়ে হয়েছে। তবে সেই স্ত্রী তো মৃত্যু তাই না? যদি এমন হতো স্ত্রী থাকার সত্ত্বেও দ্বিতীয় স্ত্রী দেখছে। তাহলে তুই তাকে চরিত্র নিয়ে ব্লেইম করতে পারতি। এখন কী সেটা পারবি?”
শেহরীনা জ্বলন্ত চোখে ইপশিতার দিকে তাকিয়ে তার প্রতি কথার তরফে জবাব দিল।
“দেখ মেয়ে বলে আমি অসহায় না! ‘আমি পদ্মজা’ গল্প পড়েছিস? সেখানে পদ্মজা নিজ স্বামী আমিরের অন্যায় কে প্রশ্রয় না দিয়ে শেষ মুহূর্তে তার জান নিয়ে ফেলেছিল। সেখানে আমিও একজন নারী হয়ে কী কায়েসাম এর মত কাপুরুষ এর সাথে লড়াই করতে পারব না? হ্যাঁ হতে পারে সে সুঠাম দেহধারী পুরুষ। কিন্তু আমিও একজন নারী। নারীকে পুরুষের চেয়েও সবোর্চ্চ আসনে বসানো হয়। দেশের মধ্যেই নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে। কী কারণে হয়? শুধু তাদের পূর্বপুরুষের নির্যাতনের মনোভাবের কারণে। পূর্বপুরুষদের পরিবারের লাঞ্ছনার কারণে। আমার উপর যত মানসিক জুলুমই হোক না কেন! আমি সেসবে পাত্তা দেয় না। আমি শারীরিক বা মানসিক ভাবে দূর্বল নয় ইপশিতা। যতদিন এই শরীরে বল আছে, ততদিন নিজের পায়ে নিজে চলে সংগ্রাম করার ক্ষমতাও আমি রাখি। তুই শুধু শুধু উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার মাইন্ড ভাইব্রেট করার চেষ্টা করিস না।”
ইপশিতা শান্ত চোখে তার বান্ধবীর কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনল। কে বলবে শেহরীনার জীবনে দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু নেই! ইপশিতা সে নিজেও তো একজন নারী। তবুও তার জীবন মরণের মাঝে ভয়ভীতি অটল। তার বাবা-মায়ের চিন্তিত মুখশ্রী দেখলে সে নিজেও ভয়ে থাকে আত্ম নিরাপত্তা নিয়ে। বার কয়েক ছেলে দেখেছে ইপশিতা নাকচ করায় তার পরিবার সামনে অগ্রসর হতে পারেনি। তবে তার মনজুড়ে তো অন্য একজনের বসবাস। সে কেমনে পারবে অন্য একজন কে সেই মনে স্বামীর অধিকার হিসেবে ঠাঁই দিতে।
শেহরীনা কথার ছলে হাঁফিয়ে গেল। ব্যাগ থেকে স্যালাইন এর পানি বের করে একঢোক খেয়ে বোতল বন্ধ করে রেখে দিল। উত্তপ্ত মন আর মস্তিষ্কে শান্তি বিরাজ করে চোখ পিটপিট করে ইপশিতার দিকে তাকায়। সে শেহরীনার দৃষ্টিকোণ দেখে মৃদু হেসে বলে,
“চল ক্লাসের দিকে যায়। আজ ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম আছে। ক্লাস হতেও পারে নাও হতে পারে।”
শেহরীনাও মাথা নেড়ে ইপশিতার হাত আঁকড়ে ধরে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল।
__
“আম্মী আপনি কী সত্যি আমাকে আপনার ছেলে বউ করবেন না? আমি কী দেখতে খারাপ ? বলো না আম্মী। কেনো সারোয়ার ভাইয়ার আমাকে পছন্দ না? কত বার বলেছি দেওয়ান ভাইয়াকে উনি যেনো সারোয়ার ভাইয়াকে বোঝায়। তবে উনিও একরোখা মানুষ। কিছুই বলছে না সারোয়ার ভাইয়াকে। আম্মী কেউ না জানলেও আপনি ভালো করে জানেন আমি শুধু আপনার আর সাজিয়া ভাবীর কথায় পড়াশুনা ছেড়েছি। আমার পড়াশোনা কর…।”
মাইমুনার মুখে ‘পড়াশুনা’ করার কথা শুনে চটে গেলেন জাহানারা পুষ্প। মুখ বিকৃত করে মাইমুনাকে নিজের পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেন। মাইমুনা ভেতরে রেগে গেলেও প্রকাশ করল না। হিতে পরিস্থিতি বিপরীত হতে পারে ভেবে চুপসে যাওয়া মুখ করে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। জাহানারা পুষ্প কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিলেন,
“দেখো মাইমুনা তোমাকে আমি স্বেচ্ছায় তোমার স্টাডি, ক্যারিয়ার ছাড়তে বলিনি। তুমি নিজেই সেই পথ বেছে নিয়েছো। আমার ছেলে সারোয়ার ও একরোখা মানুষ। তার জেদ আকাশচুম্বী। আমি কী তোমার ভাবীর কথা অব্দি সে কানে তুলে না। আর তুমি এক আশায় পড়ে আছো যে তোমাকে সে গ্রহণ করবে , মেনে নেবে হাহ্! স্বপ্ন না বুনে নিজের মত পড়াশুনা করার ইচ্ছে থাকলে করো গিয়ে। আমায় অযথা বিরক্ত করতে এসো না।”
কথা কাটিয়ে তিনি তার মেয়ে সাজিয়ার রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। সাজিয়ার বরাদ্দকৃত রুমে তার ননদ বসে ছিল। ননদ মাইমুনা আজ হঠাৎ বাসায় আসায় কিছুটা ইতস্তত বোধ করে ছিলেন জাহানারা পুষ্প। কোনো কথা ছাড়াই মেয়ের ননদের হুট করে বাসায় আসার ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু। এতে অবশ্য সাজিয়া পাত্তা দেয়নি। সে সাদরে তার ননদ কে বাসায় নিয়ে আদর আপ্যয়নে ব্যস্ত হয়ে যায়। মেয়ের আদিখ্যেতা দেখে মনে মনে বিরক্ত প্রকাশ করে নিজ রুমে চলে গিয়ে ছিলেন জাহানারা পুষ্প। বাসায় আজ সাজিয়ার বাবা আর ভাই দুজনেই নেই। এ সুযোগে মেয়েটা তার মায়ের মাথা খেতে উঠে পড়ে লেগেছে এই যেনো ঢের বুঝতে পারলেন তিনি। তবে তিনিও সহজে ফাঁদে পা ফেলার মত মানুষ নন। জাহানারা পুষ্প আপনমনে ভেবে শুয়ে আছেন। বাড়িতে পুরুষ মানুষ আস্তে আরো ঘণ্টাখানেক বাকি। বিধেয় তিনি সুপ্ত মনে সারোয়ার আর সাজিয়ার দিকটা পরিকল্পনা করছেন।
অন্যদিকে, সাজিয়ার রুমে সবকিছু উল্টোপাল্টা করে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলছে মাইমুনা। তার কাছে সারোয়ার এর প্রত্যাখ্যান তার হৃদয়ে কাঁটার মত বিঁধছে। সে মনেপ্রাণে সারোয়ার কে চাই। সাজিয়া রুমের এককোণে চুপটি করে বসে আছে। মাইমুনার থেকে কয়েক কদম দূরে সে। যেনো কোনো ভাঙ্গা কাঁচ তার শরীরে না বিঁধে। ঢোক গিলে ননদের কাণ্ড দেখছে। মাইমুনা দাঁতে দাঁত চেপে তার ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই আপনাকে আমার ভাইয়ের বউ কেনো করেছিলাম হুম? কেনো করেছিলাম বলেন? যেনো আমি সারোয়ার ভাইয়াকে নিজের করে পায়। নাহলে আপনাদের মত দুটাকার বংশের জাত থেকে ভাইয়ের জন্য বউ আনা জাস্ট মাই ফুট। আপনি আজকে আবারো দেওয়ান ভাইয়াকে বুঝাবেন। ভাইয়া রাজি হলেই সাথে সাথে আমাকে জানাবেন। সারোয়ার ভাইয়াকে আমার চাই। আমার জীবন উনি। এখন বসে বসে আমার মুখ কী দেখছেন রুম অগোছালো হয়ে গেছে চোখে দেখছেন না? সেগুলো সাফসুতরো করে ফেলেন এখনি।”
সাজিয়া মুখ বাঁকিয়ে কাজে লেগে পড়ল। মাইমুনা টু শব্দ না করে বিরক্ত মনে সারোয়ার এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। জাহানারা পুষ্প জানালা দিয়ে মেয়েটার রাগান্বিত রূপে বেরিয়ে যাওয়া দেখে মনে মনে একপাক্ষিক ভাবে নিজের ছেলের মতামত কে সমর্থন করেন। তবুও তিনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নন নিজের ভাবাবেগে। এ নিয়ে তার অবশ্য সময় দরকার। জাহানারা পুষ্প ভাবলেন আজ ছেলে বাড়ি আসলে সেই পাত্রীর কথা তুলবেন। যাতে অপরদিকে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে যেনো কোনো ঝামেলা না হয়। কেনো না মাইমুনা মেয়েটাকে দেখে সুবিধার মনে হচ্ছে না। তিনি হাত কচলে আপনমনে বিড়বিড় করে বলেন,
‘খাল কাটতে গিয়ে কী নিজেই কুমির নিয়ে এলাম না তো?’
____
একটা মাত্র ক্লাসের পর পুরো ভার্সিটির ক্লাস বন্ধ করার আদেশ দেওয়া হলো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)শেহরীনা আর ইপশিতা বেরিয়ে যায়। তাদের ধারণা সঠিক হলো। ইপশিতা কে তার বাবা কল দেওয়ায় সে বিরতি নিয়ে অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগে। শেহরীনা একপলক দেখে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ে। তাকে উদাসীন দেখে ফারদিন ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে। শেহরীনার কাছে গিয়ে তার হাত ছুঁয়ে দাঁড় করায়। চকিত নয়নে ফারদিনের দিকে তাকায়। ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম হবে আজ নতুন ছাত্র ছাত্রীদের জন্য। সেই সুবিধার্থে সিনিয়র ব্যাচগণ নিজেদের অর্ধ ক্লাসের পর ঘুরার জন্য বেরিয়ে যেতে আরম্ভ করে। ইপশিতা দৌড়ে এসে ফারদিন আর শেহরীনার মাঝে ঢুকে পড়ল। এরূপ ব্যবহারে চোয়াল ফাঁকা হয়ে গেল ফারদিনের। ইপশিতা গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ‘কী’। ফারদিন মাথা চুলকে না বোঝায়। ইপশিতা ও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শেহরীনার গলায় ঝুলে পড়ার মত চেপে ধরে তাকে বলে,
“দোস্ত এমন মরা শামুকের মতো মুখ করে আছিস কেন? তোর কী জামাই মরছে যে তুই বিধবার এক্টিং করছিস! দেখ আমরা জানি তুই তোর পার্সোনাল ফ্যামিলি ইস্যু নিয়ে বেশ চিন্তিত। তাই বলে কী নিজের লাইফকে এভাবেই স্পলয় করবি? শুন আমরা যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তোর মুখে কান্না নয় হাসি দেখতে চাই। বাকি সব বাদ। চল আজ আমরা সবাই মিলে টিকেট বুক করে মুক্ত মেলায় ঘুরতে যায় কী বলিস? এমনিতে মেলাটা নতুনও শেষ হয়ে গেলে মজা পাবো না। এখানে রাইডস ও আছে। কী বলিস তোরা?”
শেহরীনা ভেবে দেখল সে আসলেই উদাসীনতায় সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। জীবনের আনন্দক্ষণ কে সে পায়ে পিসে ফেলছে। এই কেনো করছে সে? শুধু নিজের ফ্যামিলির অপছন্দের মেয়ে হওয়ায়? না আজ থেকে সেও নিজের জন্য ভাববে। বন্ধু মহল তাকে খুশি দেখতে চাই তাদের জন্য হলেও সে নিজেকে যাচাই করবে। একান্তে বাঁচার তাগিদ তারও মনে জাগে। সে চট করে সবার মাঝে বলে উঠে। ‘আমি যেতে চাই’। তার এক কথায় যথেষ্ট ছিল তার বন্ধু মহলের জন্য। তারা ‘ইয়েএএ’ করে চেঁচিয়ে শেহরীনাকে চেপে জড়িয়ে ধরে। চুনোপুঁটির মত পিচে যাচ্ছে সে। আমতা আমতা করে ফিসফাস কণ্ঠে বলে,
“আব্বে ছাড় বলদগুলো। আমার শরীর এটুকুন তোদের মতন ডাইনোসরের শরীরে মাঝে আমি পিস্তে পড়ব। ছাড় সবগুলো।”
ইপশিতা আর ফারদিন ছেড়ে দিয়ে মিটমিটে হেসে দেয়। তখনি জাফরান ফোনে ঝগড়া করতে করতে চলে এলো। বন্ধু মহলের সামনে এসে ‘বাই’ বলে কল কাট করে দিল। শেহরীনা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
“কী হলো তোর ডাক্তারনীর সাথে ঝগড়া করছিস কেন?”
“কী করবো বল আমি যখন ফ্রি থাকে। তখন তার সময় থাকে না হাতে আর আমি যখন ব্যস্ত থাকি। তখন তার হাতে কোথার থেকে যে এতো সময় চলে আসে আল্লাহ জানেন! এখনো দেখ আমি ব্যস্ত ছিলাম কল রিসিভ করিনি বলে আমায় বলছে আমি টাইম দি না, তাকে আর ভালোবাসি না, তাকে ভুলে গেছি। এসব বলায় তাকে বুঝাতে চাইলাম। উল্টো রাগ দেখিয়ে ভড়কাচ্ছে আমাকে। পরের বার আমি রাগ দেখায় না! তখন কী করবে জানিস? তখন বলবে হ্যাঁ এখন তো আমি বেশি বিরক্ত করি, আমাকে তো তোমার আর সহ্য হবে না, এতো বিরক্ত করলে রিলেশনশিপ করছি কেন! মানে যতসব ভণ্ডামি।”
তারা চুপ করে জাফরান এর দিকে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণে হু হু করে হেসে দেয়। জাফরান রেগে ‘ধ্যাঁত’ শব্দ করে বুকের উপর হাত গুঁজল। শেহরীনা তার হাসি নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
“দেখ একটা মেয়ের জন্য তার ভালোবাসাটা মেইন। তুই নিজে যেসব কথাগুলো বললি না। সেই কথাগুলোতে তোর মনের রাগ মেটানোর উত্তর দেওয়া আছে। একটু চিন্তা ভাবনা করে দেখ বুঝতে পারবি।”
জাফরান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
“আচ্ছা বাদ দেয় বোন সে সব কথা। চল আজ আমরা সবাই মুক্ত মেলায় আড্ডাবাজি আর মজা করতে যায়।”
“হুম চল আমি খুব খুব এক্সাইটেড।”
ইপশিতা দুয়েক লাফ মেরে শেহরীনার গলায় ঝুলে কথাটা বলে। শেহরীনা বন্ধুমহলের আনন্দে কিঞ্চিৎ মুহুর্তের জন্য হলেও তার বিভীষিকাময় জীবন কে ভুলে গেল।
চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্প পড়তে আমার পেইজে লাইক আর ফলো করে নোটিফিকেশন অন করে রাখুন এতে গল্প পোস্ট করলেই সাথে সাথে পেয়ে যাবেন।
লিঙ্ক
https://www.facebook.com/tasmihaalraiyan)